সম্পাদকের কথা
আবার আর একটি বসন্ত। ঋতুচক্রের নিয়মে বিষয়টি নতুন কিছু নয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক একটি ঋতু আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবু আমরা মনুষ্যকূল অপেক্ষা করি, নতুনের, বিশেষ করে বসন্তের। কেননা শীত মানেই রুক্ষতা আর মলিনতা। অবশ্য আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতের সেরকম প্রকোপ নেই। কিন্তু তবু পৃথিবীর সব দেশেই বসন্ত মানে সজীবতা, স্পন্দন আর আনন্দ। নতুনের আবাহন। গাছে কচি সবুজ নতুন পাতা থেকে প্রকৃতিতে রঙের মেলা। না ঠান্ডা, না গরম। দিন ও রাত প্রায় সমান সমান। এসবের মাঝেই নতুন ভাবনা। বাঁচবার নতুন উদ্দীপনা।
রাজ্য সহ দেশের অবস্থা অবশ্য ঠিক বাসন্তিক নয়। বেকার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আর্থিক উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাড়ছে অস্থিরতা।
কবে এসবের হাত থেকে রেহাই মিলবে তার কোনও উত্তর জানা নেই। সত্যি কবে বসন্ত রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আমাদের জীবন, জানা না কেউই। অজ্ঞানতার শীত কবে সুর হয়ে আলোর বসন্ত আসবে জানে না কেউ!
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৯
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রচ্ছদ - শঙ্কর জানা
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৯
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
বেলা দে, চিত্রা পাল, সপ্তাশ্ব ভৌমিক, দেবাশিস ভট্টাচার্য,
শ্রাবণী সেনগুপ্ত, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, রীতা ভদ্র দত্ত,
রীনা মজুমদার, রথীন পার্থ মণ্ডল, প্রতিভা পাল,
সারণ ভাদুড়ী, অপর্ণা দেবনাথ, বটু কৃষ্ণ হালদার,
দেবর্ষি সরকার, অভিষিক্তা বসু, মজনু মিয়া,
সুনন্দ মন্ডল, রেজাউল করিম রোমেল, মুহাম্মদ আলম জাহাঙ্গীর,
আকাশলীনা ঢোল, রিসা দাস
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৯
মুক্তগদ্য
তুমি কোথায়
চিত্রা পাল
বসন্ত তুমি কোথায়? এই
প্রশ্নটা কয়েক বছর হলো প্রায়শঃই আমার কাছে চলে আসে। ক্যানো আসে জানিনা। সেটা কি
প্রকৃতিকে দেখে না সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন দেখে কে জানে,ওই কিছু একটা হবে
হয়তো। কিংবা দুটোই হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ ভাবায়। আজকাল মানে এই বিগত কয়েক
বছর ধরে দেখছি যে শীতের পরে বসন্ত এসেই যেন যাই যাই করে,দরকারি কাজ ফেলে আসা জনের
মতো,কদিন পরেই সে দরকারের তাগিদে না কি কে জানে, টুক করে কেটে পড়ে, গ্রীষ্মকে রেখে। তখন বসন্তকে খুঁজে
পাওয়াই যায় না। কয়েক দিন আগেই গেছে ফাল্গুনী পূর্নিমা।এখনো তার জ্যোত্সনায়
মাখামাখি চারদিক। নারকেল গাছ সুপুরি গাছের
পাতা মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে মর্মর শব্দে।
মনের মধ্যে ভেসে উঠছে আগেকার কত কথা কত স্মৃতি। মনে পড়ছে সেই ফুটন্ত পলাশ গাছটাকে।
আগাপাশতলা ফুটন্ত পলাশ গাছটাকে দেখে মনে হয়েছিলো যেন একটা আগুনের জ্বলন্ত
লেলিহান শিখা, যে পারলে ওই নারকেল গাছের মাথাটাকে ছাড়িয়ে যাবে। আমের মুকুলের গন্ধে
ম ম করছে আম গাছের আশপাশ। এখন আমি বসন্তকে খুঁজে বেড়াচ্ছি কয়েকদিন ধরে,ও গেলো
কোথায়। ও আসলে গ্রীষ্মকে বসিয়ে রেখে চলে গেছে কোথায় যেন। কদিন খোঁজাখুঁজির পরে
জানতে পারলুম এখনি ও আসবে না, আসবে যখন ওর সময় হবে মানে সামনের শীতের পরে। কি আর
করি। তাই মেনে নিয়ে পূর্বস্মৃতির ছায়ায় অবগাহন করাকেই যর্থাথ মনে করে এখনকারমতো
চুপ করি।
কবিতা
ডাক
সপ্তাশ্ব ভৌমিক
আমার কোনো তৃষ্ণা নেই
ভেতরে সেই
অন্ধকার
বন্ধ দ্বার
আমার কোনো স্বপ্ন নেই
শুধু শোকেই
ক্লান্ত রাত
রিক্ত হাত
আমার কোনো দৃষ্টি নেই
অনুভবেই
ছুড়েছি বাণ
ছুঁয়েছি প্রাণ
এ ভাবে হয় ? এ ভাবে নয়
ভেতরে ক্ষয়
দিয়েছে ডাক
ঘুমিয়ে থাক।
ছবির আকাশ
দেবাশিস ভট্টাচার্য
পূর্ণিমাতে আঁকবো আকাশ তোকে
জারুলবনের আলো ছায়ার রঙে
ক্যানভাসে নয় শুকনো পাতার গায়ে
একলা বসে নিঝুম রাতের বনে
দেখিস এসে উড়ছে কত তিতির
তোর ভুবনে সুখের ডানায় ভেসে
চরৈবেতি চরৈবেতি শান্ত বেলার
পাতায় আঁকা ছবির আকাশ দেশে
আবহতে থাকবে কোরাস ঝিঁঝির
আঁকবো তোকে একলা বসে যখন
ভেসে আসবে ছলাৎ ঢেউয়ের সুর
মুজনাইতে বাইবে না কেউ তখন
আসিস কিন্তু দেখতে তোকে আকাশ
পাতায় পাতায় দেখবি তোকে ঘুরে
আলো রঙের ঝিলিক তারা গুলো
দেখবি কেমন হাসছে আকাশ জুড়ে।
স্বপ্ন তোরণ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কান্নাভেজা স্বপ্নেরা আজও কেমন অধরা
একখণ্ড আকাশ গায়ে জড়িয়ে বেঁচে থাকা
কালের আবর্তে বদলায় জীবনের ক্যানভাস
ঘটনার ঘনঘটা আহত করে নিশিদিন
সব অনুভূতি অঙ্কুরেই অবলুপ্ত হয় বার বার স্বজনের পরিহাস আহত করলেও, যেন
বিদ্রোহী হব না এজীবনে, এ আমার অঙ্গিকার।
পরজন্মের লোভ বুকে পুষে রেখেছি, কেন
জানি না, কিছু বলবার সুযোগের প্রত্যাশা
হাতছানি দেয়, ঈশারায় মুখ তুলে ডাকে
বার বার প্রতিবার, একদিন একবার, নিশ্চিত
প্রতিবাদ ভাষা পাবে, আর কিছু লেখা রবে
কালো অক্ষরে,
তখন সময় সুযোগ বুঝে বিদ্রোহ লিখব
বিদ্রোহী হব বলতে পারিনা, নিশ্চিত ভাবে।
স্বপ্ন ডানারা আজীবন ছুঁয়ে যেতে চায়
আজীবন বুকে পোষা কাঙ্খিত স্বপ্ন তোরণকে।
তেপান্তরের মাঠ বরাবর ওদের যাতায়াত,
আলিঙ্গনের প্রত্যাশায় প্রহর গোনে ভেজা মন
জানি চোখের বাস্প একদিন সাগরে মিশবেই।
অনুভবের অনুরণন
রীতা ভদ্র দত্ত
দুয়ার আঁটা শীত সন্ধ্যা;
মাঝে মধ্যে দু একজন পথচারী-
কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা ঝাপসা পথবাতি।।
এমন সন্ধ্যায় একটা গান,গাওয়া যেতেই পারে
দুজনে মিলে!
কী গান?
আশ্চর্য! হয় না কোনো মতান্তর!
ডুবে যাই কবির গানে; গভীর গোপন
অন্তহীন ভালোবাসা গড়িয়ে পড়ে দুচোখ বেয়ে
প্রিয় তুমি,গুরু ও তুমি,
তুমিই পরম আপনজন;
তোমার জন্যই কান্না-হাসি,
সুখ-দুঃখ পাশাপাশি;
বাঁচি-মরি,ভালোবাসি।।
অভিসার রীনা মজুমদার
আকাশে ফাল্গুনী চাঁদ, পূর্ণিমা রাত
অরণ্য মায়াময়, জোনাকির সহস্র দীপ
চাঁদেরও কি প্রেম জাগে অন্তরে?
তবে কেন সে পলাশের অবগুণ্ঠন খোলে !
বনানীর সারি , আলোকিত বন্য নদী
নৈঃশব্দের গান গায়, পাতা ঝরার সুরে
ভালোবাসা যেন, ছেলেবেলার
ছুটির দিনে দুপুরের এক্কা দোক্কা !
মায়াবী নির্জন রাত সাক্ষী রয়
চাঁদ আর পলাশ মুখোমুখি হয়
ভালোবাসা যেন, মাঘ পঞ্চমীর
প্রতীক্ষার মাঠভরা হিমেল রোদ !
ফাগুনের আগুনে, পলাশের বক্ষে
কলঙ্ক মুছে, চাঁদের অন্তহীন অভিসার...
মনে পড়ে
রথীন পার্থ মণ্ডল
পথ চলতে চলতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি
মাঝে মাঝে ভালো লাগে না পথ চলতেও
তবুও চলতে খুব ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে সামনের দিকে এগোতে
ইচ্ছে করে পিছোতেও
তোমার সাথে হাতে হাত রেখে পথ চলতে
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে
কিছু কিছু সময় হারিয়ে ফেলি পথও
আসলে ফেলে আসা কালের পথে
আজও খুঁজে পাই নিজেকে
খুঁজে পাই তোমাকে
এই পথের কাছে রোজই কত কিছুই না শিখি
তবুও কেন জানি না মাঝে মাঝে বড্ড
অচেনা লাগে এই পথকে
একলা চলার পথে
পথের সাথে কথা বলতে বলতে
কানে কানে বলে যায়–
কাঁকড় বিছানো পথে হাঁটার অভ্যাস রাখো।।
বসন্ত যাপন
প্রতিভা পাল
সেবার বসন্ত এসেছিল প্রতীক্ষার শেষ প্রহরে,
বিস্মৃত ধুলো-ধূসর অবসর প্রাণ পেয়েছিল
পিচ্ছিল সময়ের শ্যাওলা সরিয়ে !
সেবার ফাল্গুনী পূর্ণিমার চাঁদে
একঝাঁক ইচ্ছেরঙ পাখনা মেলেছিল মায়ায়,
ছায়াপথের সমস্ত আবছায়া নিয়ে !
নিঃসীমতারও নদীর মতো প্রবাহ,
নিস্তব্ধ কান্নাও মেঘের চোখে রামধনু আঁকে
আকাশের ভেজা গায়ে,
গন্তব্যহীন অন্তহীন অধ্যায়
আবহমানের সংগীত গায় স্মৃতির বালুচরে !
ফিরে ফিরে আসা সেবার
এবারের সঙ্গে একাকার হয় বসন্ত আবিরে,
তারপর উদযাপিত হয় ভাললাগার সহস্র কারণ,
সময় থামিয়ে….
তোমার মন খারাপে
সারণ ভাদুড়ী
তোমার মন খারাপের অজুহাতে
আমি তোমায় দেবো গোলাপ,
তোমার মন কেমনের অজুহাতে
আমি তোমায় দেবো
এক আকাশ কালো মেঘ ও দু একটা বৃষ্টি...
তোমার মন ভাঙনের অজুহাতে
আমি তোমায় দেবো সপ্তসিন্ধু।
তোমার মন কি খুশি করার জন্য,
আমি তোমায় দেবো অমর -অক্ষত - প্রেম
তোমায় দিতে পারি আমি সর্ষে ক্ষেত
তোমায় এনে দিতে পারি সেই রূপকথার গল্পের ঘোড়া..
তোমার মন খারাপের সঙ্গী হব,
তুমি আমায় নেবে কি ?
মন খারাপকে ছুড়ে ফেলে,
তোমায় গল্প শোনাবো....
আমায় নেবে কি ?
গল্প
ওয়ার্থলেস
বেলা দে
আজ খুব সক্কালে বেড়িয়ে পড়েছে মান্তু কিছু উটকো ছেলেকে টাইট দিয়ে আসতে হবে যে,পড়শিরা ওকে নামকরণ করেছে মেয়ে মস্তান আরও বলে নারীর কোমনীয়তা তো ওর একেবারেই নেই, বিশেষ লোকেদের কথায় "ওয়ার্থলেস,"যে যাই বলুক সে মেয়ে কারও ভালো ছাড়া খারাপ করে না, সেটা মনে মনে সবাই জানে। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই মেজাজটা বিগড়ে যায় একেবারে একটা শুকরছানা ড্রেনের জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে কৌতুহলী জনতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে আর ইস ইস করছে, তাদেরকে কিছু খিস্তি মেরে যান যান সরে দাঁড়ান বলে বাচ্চাটাকে দু'হাতে আকড়ে তোলে পাবলিক সব হা হয়ে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে মান্তু বলেই এটা সম্ভব, ঘেন্নাপিত্তি কিচ্ছুটি নেই পাশে দাঁড়িয়ে মা শুকর গো গো করছিল অনেকক্ষন ছানাটিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চললো দেশ উদ্ধার করতে। বাবার মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরেছে মান্তু একটা ছোট্ট দোকান ছিল বাবার সেটাও শরিকরা ঠকিয়ে খেয়েছে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা টোটো কিনে দিয়েছে মা ও নিজেই চালায় ওই দিয়ে চলছে তাদের। পরিস্থিতিই ওকে ছেলের মতো বানিয়ে ফেলেছে বয়কাট চুল জিনসের প্যান্ট সার্ট, ছেলেরাই ওর বন্ধু বাবলা,রতন, ট্যারা মাকু, শাড়ি পরলে তবু মেয়ে বলে চিহ্নিতকরণ করা যেত চেহারাও খানিকটা ছেলেদের মতো। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে মেয়েরা সব দলবেঁধে স্কুলে যায় কয়েকটা বেপাড়ার উটকো ছেলে তাদের বিরক্ত করে সিটি বাজায়, মান্তুর কাছে খবর পৌঁছাতেই একহাত নেবে বলে তৈরি হয়ে এসেছে হেস্তনেস্ত একটা করবেই, এদিনেও অন্যথা হয় না, একজন গান ধরেছে রোগামত একটা ছেলে সিটি বাজাচ্ছে এরপর আর কথা নেই একলাই সে প্যাংলামত ছেলেটাকে কলার পাকড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলে বাকিদুটো ভয়ে চম্পট কেউ এগিয়ে আসা দূরের কথা চটজলদি হনহনিয়ে হাঁটা দিয়ে গা বাচায়, পাড়ার এক অশীতিপর বৃদ্ধ বলে মান্তু তুই আছিস তাই আমরা সবাই নিশ্চিন্ত রে, মান্তু বৃদ্ধের হাতটা মাথায় রেখে বলে "ওয়ার্থলেসকে আশির্বাদ করুন।"
মেলাবেন তিনি মেলাবেন
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
"বৌমা আমার কাছেই থাকবে"-সদ্য পুত্রহারা মায়া চক্রবর্তীর কথা শুনে গুঞ্জনরত মহিলারা চুপ।পাশের বাড়ির গুহগিন্নি বললেন-"সেকি মায়া,তোমার কি পুত্রশোকে মাথা খারাপ হয়ে গেল?এতোবড়ো ক্ষতির পরেও এই অপয়াকে তুমি ঘরে রাখতে চাও!"মায়াদেবী বললেন-"রিন্টু ওকে হাত ধরে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল,আমি নিজে বরণ করে ঘরে তুলেছি,আমার ঘরের লক্ষী আমার কাছেই থাকবে।তোমরা এখন এসো।"গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন প্রতিবেশিনীরা-"এতো আঘাতেও দেমাক যায়না।"দ্বিতীয়বার স্বামীহারা টগর কথায় কথায় খুঁত ধরা শাশুড়ির দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল।শ্রদ্ধায়, নিরাশ্রয় না হবার ভরসায় তার অবিরাম বর্ষিত চোখ আরেকটু বারিধারায় সিঞ্চিত হল।
দেখতে দেখতে কাজের দিন এগিয়ে এলো।কাজ করবে মায়াদেবীর ছেলের প্রথমপক্ষের পুত্রসন্তান রোহিত,যাকে টগর মেনে নিতে পারেনি।সে থাকেও তার নিজের মায়ের সঙ্গে।কাজের দিন আশ্রমের পুরোহিত রোহিতের কাছে তার মাতামহ এবং ঊর্ধ্বতন কয়েক পুরুষের নাম জানতে চাইলেন।তাকে চুপ করে থাকতে দেখে টগরকে দেখিয়ে বললেন-"মা,আপনি ছেলেকে বলে দিন।"নিঃসন্তান টগরের বাবা জল পেলেন রোহিতের হাতে।এইভাবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি মিলিয়ে দিলেন সবকিছু।
বসন্ত বাতাস
অপর্ণা দেবনাথ
উথাল পাথাল হাওয়া। ফাল্গুনের এই দিনগুলো বড় এলোমেলো। অনাবৃত করে দেয় সব ! বাতাসের দামালপনায় ভিতর-ঘর ও উলট-পালট। এমন দিনে তাঁকে মনে পড়ে। মনে পড়ে গাছ-গাছালির ফাঁকে আলো পাঠিয়ে দেয়া সূর্যের লুকোচুরি।সেই আলোয় উদ্ভাসিত মুখ। চোখ। আশ্চর্য চোখের জ্যোতি ! সেই জ্যোতিতে পুড়ে গিয়েছিল বাইশের তমা। শুধু একজনের পাশাপাশি হাঁটায় ও যে এতো সুখ লুকিয়ে থাকে, জানতো না সে ! কি দুর্বার আবেগ ! নিজেকে পরিপূর্ণ, সম্পূর্ণ মনে হতে লাগল তমার। এই পৃথিবী, জল, মাটি, আকাশ, বাতাস যেন ভালবাসায় মাখামাখি ! কারও হাতের স্পর্শে, স্বর্গীয় সুখ ! সেই দেড় দশক আগের অনুভূতির প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে তমা। ভেসে যেতে না চাইলেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। এই বসন্ত- বাতাস। হুটোপুটি। এই পলাশ। বাড়ির সামনের যে ছোট্ট চৌকো মত জমি, তাতে তমার সাধের গাছ-গাছালি। একটা পলাশ, একটা আমলকী, একটা শিউলি গাছ ও রয়েছে তাতে। অন্যান্যদের থেকে তারা খানিকটা দীর্ঘ ও বটে। তমা অপেক্ষা করে। সারাবছর। আমলকীর ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো যখন তার এই ছোট্ট একতলা বাড়িতে উপস্থিতি জানান দেয়, তমার মুখও আলোয় ভেসে যায়। আলোর গন্ধ মেখে নেয় সে ! এখন পলাশের আগুনে রঙে ছায়া পড়ে যেন ! ফেলে আসা সময়ের ছায়া! দোদুল্যমান পলাশ। উপছে পড়া ফুলের দল। যৌবনমদে মত্তা ! মনে পড়ে সেই পলাশগাছ । আর, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তমা। আগুন রঙা পলাশের নিচে নীলাম্বরী সে। পাশে, বাবু হয়ে বসে থাকা, সেই মানুষটি। চেয়ে আছে দূর দিগন্তে। তাঁর উদাসীন ঝুলে থাকা মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিয়েছিল তমা। চোখের কোণায় উপচে পড়া জলটুকু স্থির রেখেছিল, তমা। নাহ্। এই জলটুকু তাঁর একান্ত থাক। যে চলে যেতে চায়, তাঁকে আটকে রাখার মতো বিড়ম্বনা আর কিছুতেই নেই! সে চলে যায়। দূরে। বহুদূরে। তমা দাঁড়িয়েছিল। একা। দেড় দশকে তমা এখনো দাঁড়ায়। প্রতিটি বসন্তে। প্রতিটি পলাশের বেলায়। এলোমেলো হয়। ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলে ভেসে যায় যাবতীয় বোধের মিশেল। পুবের সূর্য আমলকী গাছের ফাঁকে পাঠিয়ে দেয় আলোর সমুদ্দুর। একসময় চুপিসারে ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। আগুনে রঙ ছড়িয়ে দেয় দিনান্তের গোধূলি। তমা সমে ফেরে। এবার ফিরতে হবে। ফিরতে হয় ! রঙবেরঙের ফুলগাছের গোড়ার মাটিগুলো আলগা করে অভ্যস্ত হাতে। ওয়াটারিং ক্যানের ধারায় ভিজে তারা আশরীর।তাদের দিকে চেয়ে থাকে, গোধূলির পলাশ। স্থিত বসন্ত-বাতাস। পাখিদের ঘরে ফেরার কলকাকলিতে এক ভাললাগার সুর ছড়িয়ে পড়ে। আর একটু বাদেই ভরে উঠবে তার ঘর-সংসার। অফিস থেকে ফেরা স্বামী। কোচিং সেরে ফেরা ছেলে। সন্ধ্যের কাজে আসা বিন্দু মাসি। আর একটু একটু করে সেই বসন্ত-বাতাস ছেড়ে যাবে তাকে। শূন্যতাটুকু রেখে যাবে আলগোছে...
প্রবন্ধ
নেতাজি সুভাষের জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাববটু কৃষ্ণ হালদার
স্বামী বিবেকানন্দর প্রতিটি বাণী আমাদের বাঁচার প্রেরণা,অক্সিজেনের মত।কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোলাঁকে চিঠি লিখেছিলেন_"ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দের লেখা পড়ো। তার মধ্যে সবকিছু ইতিবাচক,নেতিবাচক কিছুই নেই"। জবাবে রোম্যাঁ রোলাঁ লিখেছেন তার লেখাগুলি _"মহান সঙ্গীত এর মতো। পংক্তিগুলি বেটোফেন শৈলির মত। চিত্তাকর্ষক শব্দগুলি হ্যান্ডেল কোরাসের কুচকাওয়াজের মত।আজও ত্রিশ বছর পরেও তার বাণীগুলোকে স্পর্শ করলে আমার শরীরে বৈদ্যুতিক আঘাতের মতো শিহরণ জাগে। এই মহা নায়কের মুখ থেকে যখন এই জ্বলন্ত শব্দগুলি উচ্চারিত হয়েছিল তখন নিশ্চয়ই অনেকে এই শিহরন অনুভব করেছিলেন"।
উনবিংশ শতকে বাংলায় বাঙালি মনীষীদের নবজাগরণ ঘটেছিল। যাঁরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বন্ধা সমাজকে দিয়েছিল উর্বরতার ঠিকানা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দ। ভারতের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন তিনি। ১৮৬৩সালে ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলা অঞ্চলে বিখ্যাত দত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নি ছিলেন।মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। এই মহান কর্মজীবীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১২ ই জানুয়ারি ভারতবর্ষে "যুব দিবস" হিসেবে পালিত হয়।তিনি খুব ছোটবেলা থেকে শরীর চর্চা করতেন এবং প্রথম সকালে নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করতেন। নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন।প্রচণ্ড সাহসী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং পরিশ্রমী ছিলেন।"উঠে দাঁড়াও,শক্ত হও,যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নাও,আর এটা সবসময় মাথায় রেখো তুমি নিয়তির স্রষ্টা,তোমার যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন সবটা তোমার মধ্যে রয়েছে সুতরাং নিজের ভবিস্যত নিজে তৈরী করে নাও"। তাঁর উদ্দীপ্ত বাণীর মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। প্রতিটি মানুষ অন্তর্নিহিত গুণের অধিকারী। সচিন তেন্ডুলকর তিনি নিজেও জানতেন না সারাবিশ্ব তাকে এভাবে চিনতে বা জানতে পারবে। সৎ ও নিরলস পরিশ্রম তাকে পৌঁছে দিয়েছে জীবনের উর্ধ্বসীমায়। তিনি বুঝিয়েছেন মানুষের জীবনের উন্নতির একমাত্র উপায় হল সৎ ও নিরলস পরিশ্রম। তিনি বরাবর ভারতের যুবসমাজকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ যুবসমাজ হল ভারতের মেরুদন্ড, ও ভবিষ্যৎ। মানুষের মেরুদণ্ড যদি শক্ত না হয় তাহলে,সে মানুষ কখনোই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো তিনি শিখিয়ে গেছেন।তিনি কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলেন।নগরে নগরে ঘুরে তিনি ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং বিশ্বের দরবারে নিজের দেশের কথা তুলে ধরা যায় তা নিয়ে সর্বক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
উনবিংশ শতকের শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্ম মতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। হিন্দু পূর্ণ জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা।সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি শুধু কর্মযোগী মহান সন্ন্যাসী ছিলেন না, ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়ক। তাঁর রচিত দুটি গান হল"খণ্ডন-ভব-বন্ধন"(শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক ভজন), ও "নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি","নাচুক তাহাতে শ্যামা"।
কর্মজীবী মহান বীর শিখিয়েছিলেন মানুষকে ভালবাসতে। ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় তা তিনি প্রমাণ করেন।"বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি যেথা খুঁজেছি ঈশ্বর /জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। জীব সেবা মানেই শিব সেবা। তিনি কাম ক্রোধ লোভ হিংসা কে ঘৃণা করতেন। কারণ একটি মানুষের জীবন পর্যায়ে উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পৃথি বীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা হল মানব সভ্যতা। সেই সভ্যতার মানুষ জন কখনও কখনও লোভ হিংসার বশবর্তি হয়ে ভুল পথে চালিত হন। সেটা তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। বিশ্বের মহা সম্মেলনে তার বাণী আজও অক্ষত হয়ে আছে বিশ্বের দরবারে। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি আমেরিকার উদ্দেশ্যে বলেন_"my dear sisters and brothers in America",এই সম্বোধনে ধর্মসভার সমস্ত ব্যক্তি আপ্লুত ও উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়েন। চারিদিকে করতালিতে ভরে যায়। মাত্র ৫ মিনিট বক্তৃতা দিয়ে সমগ্র আমেরিকা তথা বিশ্ববাসীর মন জয় করেন। ভারতীয় দর্শন,ধর্ম সংস্কৃতি ও বাঙালি সমাজ কে নিয়েছিলেন বিশ্বকে। তিনি ভারতীয় ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশে ঘুরে বহু অর্থ ও সম্মান উপার্জন করেছিলেন।
অহেগানন্দ ভারতী বলেছেন"আধুনিক যুগের হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জ্ঞান বিবেকানন্দের রচনা থেকে আহরণ করেন"।ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদী ধারণার অভ্যুত্থানে প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদী আদর্শের টিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের মূল সমস্যার উপর আলোকপাত করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন _"দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ভারতের জাতীয় নবজাগরণের প্রয়োজন আছে"। তাঁর জাতীয়তাবাদী ধারণা ভারতীয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে জামসেদজী টাটা_"Indian institute of science"নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন যা ভারতের প্রথম সারির গবেষণা মূলক বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বিদেশে প্রাচ্য বৃদ্ধ ম্যাক্স মুলার ও বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলারের এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সমাজ সংস্কারক চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ এর ভাষায়_"স্বামী বিবেকানন্দের নির্ভীক দেশাত্মবোধ সারা ভারতের জাতীয় বাদী আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় যোগদান করেছিল"। ভারতের নবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের যতটা অবদান ছিল নিঃস্বার্থভাবে ততটা অন্যকেও তেমনভাবে স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেনি।
জন্মিলে মরিতে হবে /অমর কে কোথা কবে, এটাই তো বিধির বিধান। সৃষ্টি কর্তার শ্রেষ্ঠ বরদান হল জীবন সৃষ্টি। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। মানব জীবন আটকে আছে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মে। অনন্ত কাল নয়। জীবনের শুরু হয় জন্ম দিয়ে আর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যু দিয়ে। ঠিক এই নিয়ম অনুসারে কর্মযোগী মহান বীর স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ২ রা জুলাই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে ফিরে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি আজ নেই আমাদের মধ্যে,তবুও এ সমাজের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। যতদিন তাঁর বাণী স্মরণ করবে নতুন প্রজন্ম, নতুন করে সংগ্রাম করার শক্তি ফিরে পাবে।
তবে তিনি আজও বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে।তিনি প্রেরণা,আশা,ভরসা ছিলেন বহু মানব,বিপ্লবীদের।তেমনি ভাবে মহান দেশ নায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু র জীবনে তাঁর আদর্শ,মতাদর্শ দেশ প্রেমের ও আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন। যার কারণে নেতাজি বিবেকানন্দের আদর্শ তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।মূলত তিনি বিবেকানন্দের বিবেক কে আঁকড়ে ধরে দেশ সেবার কাজে ব্রতী হন।তবে নেতাজির জীবনে স্বামীজির প্রভাব কিন্তু খুব ছোট বেলা থেকে লক্ষনীয়।
কিভাবে, তা একটু জানা দরকার।
সুভাষ চন্দ্র বসু প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন হঠাৎ পড়ে গেলেন। মাতা প্রভাবতী দেবী খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাড়ির চাকর সারদা কেঁদে উঠলেন, বললেন -"সুবি পড়ে গিয়েছে"। স্কুলে যাওয়ার গাড়ি দেখেই পাঁচ বছরের ছেলে ছুটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে।
সুভাষ কে ঘরে আনা হয়েছে, ডাক্তার এসেছেন দেখতে। ওদিকে বৈঠকখানায় পিতা জানকীনাথ ব্যস্ত নিজের কাজ নিয়ে, এমন সময়ে চাকর সরকার এসে বললেন - "সুবিবাবু পড়ে গিয়েছেন।"
জানকীনাথ বলেন - "পড়ে গিয়েছেন।ওর না আজ স্কুলে ভর্তি হবার দিন? "সরকার বললেন যে স্কুল যাওয়ার সময় গাড়ি দেখে ছুটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। জানকীনাথ ভাবলেন- "পাঁচ বছর বয়েস কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছে। স্কুলে যেতে অন্যরা কাঁদে আর এই ছেলের দারুন ফুর্তি।" তিনি আরও ভাবলেন- "স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনই ছেলেটার বাধা পড়ল। লেখাপড়া কিছু হবে না আর কী"।হঠাৎ সরকারকে জিজ্ঞাসা করলেন যে কোথায় চোট লেগেছে সুভাষের? সরকার বলে উঠলেন- "মাথায়।"মাথায়? তা হলে তো কর্মসিদ্ধি। মাথায় বাধা কর্মসিদ্ধির লক্ষণ। স্বামী বিবেকানন্দও ছেলেবেলায় পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন। ফেটে রক্তারক্তি।"
চাকর সরকার বলে উঠলেন- "সুবিবাবুরও তাই।"
"তাই ঠিক বলা যায় না কী হয়।" প্রদীপ্ত মুখে উঠে পড়লেন জানকীনাথ।
শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন বিবেকানন্দ সম্পর্কে: ঐ আঘাতে ওর শক্তি বাধা পেয়েছে, নইলে ও জগৎ সংসারকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারত।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস যখন সমাজ সেবায় নিজেকে ব্রতী করে তুললেন,ঠিক সেই সময়ে পনের বছর বয়সে হঠাৎ বিবেকানন্দ রচনাবলী এল সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে।স্বামী বিবেকানন্দ ইতিমধ্যে শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিয়ে ঐদিক হিন্দু সভ্যতার নব মূল্যায়ন ঘটিয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবী মহানবীর স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণ ঘটে যাওয়া তে দেশ কার্যত পিতৃহীন হয়ে পড়ে। কারণ তার বাণী হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণীকে সেই মুহূর্তে উদ্দীপিত ও পরিশীলিত করে চলেছে। শুধু যুবক-যুবতী নয়, তার বাণী হয়ে উঠেছিল অন্ধকার সমাজ থেকে আলোয় ফেরর মূলমন্ত্র। দেশের মানুষ দিশাহীন থেকে কিনারা ফিরে পেতে শুরু করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাদের মধ্যে একজন যিনি পরম শ্রদ্ধার সাথে স্থান দিয়েছিল নিজের হৃদয়ে। বিবেকানন্দের রচনাবলী হাতে পাওয়ার পর সমস্ত রাত ধরে সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্রদ্ধা সহকারে অধ্যায়ন করতে শুরু করলেন। একটু একটু করে অনুধাবন করলেন যে জীবনকে কিভাবে গড়ে তোলা উচিত? আর বুঝতে পারলেন সেবা ধর্মই মানুষের আসল মুক্তি। আর্তপীড়িত নির্যাতিত দুস্থদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে, সেবা করতে হবে ভারত মাতার। তিনি স্থানীয় গ্রন্থাকারে গিয়ে বিবেকানন্দ রচনাবলী অন্যান্য খন্ড গুলির সংগ্রহ করলেন। এরই সঙ্গে বিবেকানন্দ সম্পর্কে অনুসন্ধিতসা ও উৎসুক আরো বেড়ে গেল। কার বাণী পড়তে পড়তে নেতাজির প্রখর দৃষ্টি কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরে জেগেছে এক ধরনের আত্মপ্রত্যয় বোধ।গভীর অধ্যাবসায়ের সঙ্গে চোখ রেখেছেন জ্ঞানযোগ,রাজযোগ, ভক্তিযোগের পাতায়। তার চোখে বিবেকানন্দ এক রহস্যময় পুরুষ' বলেই মনে হয়েছে। বিবেকানন্দ ই একমাত্র বিপ্লবী সন্ন্যাসী যিনি চিরাচরিত শাশ্বত প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় ভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।ধর্মের যে একটা বাস্তব দিক আছে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ কুশলতার না থাকলে ধর্ম সংকীর্ণতা রুপে বন্দী হয় বিবেক বাণী পড়েই সুভাষচন্দ্র বসু এ বিষয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেন। এরই পাশাপাশি তার মরনে আরেকটি বিষয় প্রবেশ ঘটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন রাজনীতিকেও আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক দর্শন কখনো পরিশুদ্ধ এবং বৌধিক জ্ঞান সম্পন্ন হতে পারবে না।তাই বর্তমান সময়েও আমাদের সমাজে এমন এক মহান কর্মযোগী র মহান বাণী গুলিকে প্রতিনিয়ত সঙ্গী করে চলা উচিত। আর তাতেই মিলতে পারে ভারতবর্ষের মুক্তির পথ।
বিবেকানন্দের কথা বলতে গেলে হারিয়ে ফেলি নিজেকে,কে বুঝবে তাকে? অসম্ভব, সুগভীর তিনি জটিল ঋব্ধময়,ত্যাগে বেহিসাবি,কর্মে বিরামহীন,প্রেমে সীমাহীন,জগনে সমুদ্র গভীর, সমালোচনায় অগ্নি বর্ষা। আর সারল্যে শিশু,একেবারে শিশু,এ জগতে তার তুল্য নেই,কেউ নয়,আমি কে,যে বলব তার কথা:_ কর্ম যোগী মহান বীর সম্বন্ধে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উক্তি। তাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতই স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিটি ভারতবাসীর আদর্শ হওয়া উচিত।তাঁকে আরও গভীরভাবে আমাদের জানতে হবে। অবশ্যই তাঁর বই পড়তে হবে। ভারতবর্ষকে চরম অস্থিরতা থেকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে তাঁর মহান আদর্শ।
রম্য রচনা
ধারণাদেবর্ষি সরকার
বড় বাজারের মধ্যে একটি ভাঙ্গা বেঞ্চিতে বসে আছি। এ অভাগার দেশে সবকিছু যা সার অথবা অসার বস্তু আছে তাকে পিটিয়ে গাধা থেকে ঘোরা করতে গেলে গাধা টাই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়। তা জানা সত্ত্বেও তাদের গাধার চেয়ে ঘোরার দাম, কদর ও প্রতিপত্তি বেশি বলে চক্ষুলজ্জার চোটে সকলে গাধাটাকেই পিটিয়ে ঘোরা করতে চায়। তাই বেঞ্চিটাকে যতটা বোঝা চাপানো উচিত তার চেয়ে বেশি বোঝা চাপানোর ফলে এই অবস্থা হয়েছে। তা আমি বোঝা সত্ত্বেও জায়গাটিতে তিল ধারনের স্থানটুকুর অবর্তমানের ফলে বসে আছি ওই ভাঙ্গা বেঞ্চিটিতে। হাতে ধোয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ ও আর এক হাতে বাজারের থোলে। না সেটা ফাঁকাই আছে। টাকার বদলে জিনিসপত্র ভরবার এখনো সময় হয়তো আসেনি। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়েছি একগুচ্ছ টাকা নিয়ে বিনা কারণে ব্যয় করবার উদ্দেশ্যে।
সরকারি চাকরিজীবী একটা সংসার। আপামর বাঙালির যা আশা থাকে। ছেলে মানুষ, কথায় আছে "মরদের বাত হাতির দাঁত।"যাই হোক, ছেলেটা একটা সরকারি চাকরি জোটানোর দুই মাস না যেতেই সাত পাকে বাঁধা সেটার আশা আমার বাবা-মাও দেখেছিলেন দুচোখ ভরে হয়তো। তাই চাকরি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে একটি কন্যাসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করছি। মা ও বাবা পরলোকগমন করেছেন অনেক আগেই।
তাদের কথাগুলো আজ মাঝে মাঝে মনে আসে।সে যাই হোক,কি আবোল তাবোল ভেবেচলেছি।
মানুষ, বিশেষ করে বাঙালি বিশেষ করে চাখোর। চা তাদের সুখে, চা তাদের দুঃখে, চা তাদের আনন্দে, চা তাদের উল্লাসে, চা তাদের বেদনায়, চা তাদের ভালোবাসায়, কেউ জন্মালে তাকে দেখতে গেলেও অতিথি আপ্যায়নে চা, জমি সংক্রান্ত বিরোধী নিষ্পত্তির বৈঠকেও চা, বিয়ের পাকা দেখাতেও চা, চা অন্ত প্রাণ তারা।
আর আমার মতন লেখক মানুষের যদি চা খাবার নেশা থাকে আর মাথায় যদি থাকে সম্পাদকের নির্দেশমত লেখবার আদেশ তাহলে তো কথাই নেই। মেঘ না চাইতেই জলের যোগান। কাল রাতে ফেসবুক অন করতেই দেখি সম্পাদক মহাশয় ফাল্গুন সংখ্যার লেখবার জন্য লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। সকাল থেকেই ভেবে চলেছি কি বিষয় নিয়ে লেখা যায়। সত্যি আমাদের চারপাশে ,আমাদের মস্ত চোখের সামনে কতইনা উপকরণ আছে কিন্তু আমরা তাদের ভালোভাবে দেখতেই পারি না। তাদের আমরা স্পর্শই করতে পারিনা। আসলে যাদের চোখ আছে তারা দেখেও দেখেনা, যাদের কান আছে তারা শুনেও শুনেনা, তেমনি আমাদের চোখ আছে কিন্তু দেখার শক্তির অভাবে আমরা তা ভালোভাবে দেখতে পারিনা।
দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে এইসব কথাই ভাবছিলাম, যে কি বিষয়ে কলম ধরা যায়। কিন্তু এখন যখন চায়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারছি তখন ভাবছি অন্য কথা। ছুটির দিন বলেই হয়তো মেয়েটা আজ বায়না করলো এমন ধরনের। তার নাকি হলুদ শাড়ি লাগবে, কাল নাকি তার আবার বসন্ত উৎসব। কি উদঘট ধরনের! সে যাই হোক বাচ্চা মানুষের মন রাখবার চেষ্টা তো করেই চলতে হয় বাবাদের আজীবন ,আমাদের বাবারাও ঠিক এমনটাই করতো মাঝে মাঝে মনে হয়। আমরা প্রত্যেক মানুষই একটা চক্রের মধ্যে পড়ে আছি। বাবা তার সন্তান সে আবার আরেক সন্তানের বাবা সে আবার হবে সন্তানের বাবা এমনি করেই কি আমাদের প্রত্যেকের জীবন চলে যাবে তাই ভাবি। সে হোক এখন ওসব দার্শনিকতা আমার আবার ঠিকঠাক তেমনটা আসে না। প্রতি পদে পদে যা অনুভব করে চলি তাই ভাবি। মেয়ের আবদার তার নাকি পাঁচ রকমের রং লাগবে। তার নাচের স্কুলের দিদিমণি তাই নিয়ে আসতে বলেছে সবাইকে। আজকের দিনে সেই সই। চলো ছুটির দিন তাই ব্যাগ হাতে বাজারে এসে চায়ে আরেকটি চুমুক দিয়েই দিলাম। ভেবেছিলাম লিখতে বসবো কিন্তু আর হলো না। আমার জীবনে বর্তমানে সংসারটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে, লেখালেখি তা এখন গৌণ আছে।
আমার মেয়ে বলে নয়, হাতে এন্ড্রয়েড ফোন এখন বর্তমান প্রযুক্তির যুগের সকল ৮ থেকে ৮০ বয়সের মানুষের। কোথায় এখন এরা পুতুল নিয়ে খেলবে, গল্পের বই পড়ে নিজেদের একটা কল্পনার লোক বানাবে, তা নয় তারা এখন মোবাইলপ্রেমে আসক্ত।তা লকডাউনটার ফলে আর যাই হোক জীবনটাকে সহজ করতে গিয়ে আমরা বড়োরা জীবনটাকে এমন সহজ করে ফেলেছি যে আমাদের দেখাদেখি ছোটোরাও এখন তাদের জীবনটাকে সহজভাবে উপভোগ করছে। সেদিন আবার অর্ধাঙ্গিনী বলছিলো, আমাদের পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটি নাকি মোবাইল না দেখলে একদানাও দাতে কাটেনা। তাও ভগবান আমাদের রিম্পিকে এসব দোষের থেকে দূরে রেখেছে তাই ভগবানের অশেষ দয়া। হোলির বর্তমান নাম আজ হয়েছে বসন্ত উৎসব।
শান্তিনিকেতনে কি হয় তা হয়তো জানি না। তবে ওখানকার নামকরে চটুল গানের আসর না করলেই ভালো হয় বলে আমার মনে হয়। আমাদের সময় দোলের আগের দিন বুড়ির ঘর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে দোলের সূচনা হত। তারপরে দিন রঙের অভাবে তার চেয়ে কালি,কাদা, আলকাতরা এগুলিই মুখ্য হয়ে উঠতো আমাদের রং খেলার উপকরণ হিসেবে। আর এখন এদের দেখলে মনে হয় এরা সেজেগুচ্ছে হয়তো বিয়ে বাড়ি চলেছে রং খেলতে তাও আবার স্নান করবার আগেই। ইস্, ভাবলেই শরীরটা একেবারে ঘিনঘিন করে ওঠে।
বাবু আপনার হয়েছে মোট পাঁচ টাকা। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম কালো ধরনের দেহের রং, খুব মোটা নয় আবার খুব রোগাও নয়, মাথায় আধ পাকা ও আধ কাচা চুল ,মুখের সামান্য পাকা কাঁচা দাড়ি পরনে নোংরা একটি শার্ট ও লুঙ্গি। বয়স আমার বাবার চেয়ে কম হবে না আবার বেশিও নয় ।ঐরকমই প্রায় বাবা যখন প্রাণ ত্যাগ করলেন তখন তার বয়স ছিল ৬০ বছর। বাবার বয়সের একজন ভদ্রলোক আমাকে বাবু বাবু বলে সম্বোধন করছে চোখের সামনে সেটা আবার আমি শুনতে পাচ্ছি ইস্, ছি ছি ছি কি দিনকাল পড়লো ঈশ্বর সত্যি কলিযুগ এসে পড়ল তবে রিম্পির মা ঠিকই বলতো কলির কারণেই সবাই কেমন জানি একটু বদলে বদলে গেছে। কেউ আজকাল সরল সাদাসিধে ধরনের নেই ।মানুষ সত্যি সত্যি কেমন জানি ঘোরালো প্যাঁচানো ধরনের পরিণত হয়েছে। মা কালীর মতো একহাত জিভ কেটে ,নানা সেটা ভেতরেই কাটলাম বাইরে নয় বললাম আপনি আমার স্বর্গত বাবার বয়সের মশাই। আপনি আমাকে বাবু বলে ডেকে আমার আর পাপের বোঝা বাড়ানোর গুরুভার নেবেন না দয়া করে।
লোকটা হয়তো এতক্ষণ ধরে দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েছে সামনের লোকটা হয়তো পাগল টাগল। কেমন জানি নিজে নিজেই কথা বলে কি সব ভাবে। সেই বিকেলে এসেছে চা খেতে এখন রাত নটা বাজে অর্ধেক বাজার বন্ধ হয়ে গেল এতক্ষন সেও ব্যস্ত ছিল অন্যান্য খরিদ্দারকে নিয়ে তাই অনেকক্ষণ লক্ষ্য করেনি। তবে এবার কাছে এসে হঠাৎ এমন চোখে পড়ল লোকটাকে কি সব ছাই পাস নিজের মনে মনে বলতে লাগলো, আকাশের দিকে চেয়ে কি সবকিছু নিজের মনে ভাবতে লাগলো। টাকা চাইতে আসলাম নিজের মনেই কি বিড়বিড় করতে লাগলো। লোকটা হয়তো সত্যি পাগল হয়ে গেছে।
লোকটা প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল এবার সে বলল ,ও মশাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সবাইকে বলতে বলতে এক ধরনের অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই বলে ফেলেছি আপনাকে ভুল করে। কিন্তু মান করবেন না আপনি। আপনার মোট পাঁচ টাকা হয়েছে চায়ের।
আমি একটু হেসে মানিব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকার একটি কয়েন তার হাতে দিয়ে ব্যাগটা আবার পকেটেই রেখে দিলাম।
কিছুক্ষণে আমরা দুজনেই চুপ করে রইলাম। কেবল পাশের পলাশ গাছের কোকিল টা ডেকে চলেছে অনবরত ।ইস, কি মধুর তার স্বর। লোকটাকে দেখলাম দোকানের ঝাপটা বন্ধ করে দোকানের সামনেটা জল দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। আমার সামনে আসতেই আমি ব্যাকুল ভাবে বলে উঠলাম, আপনার নাম কি মশাই ?কতদিন ধরে এ ব্যবসা করে চলেছেন?
লোকটা প্রথমে আমার কথাটা শুনে সহজ ভাবে উত্তর দিল ,একটু দাঁড়ান আসছি। তারপর দেখলাম প্রথমে জলের বালতিটা দোকানের ভেতরে ঢোকালো ও দোকানের ঝাপটা বন্ধ করে দিল। এরপর হরিহরি কিসব মন্ত্র যেন আবৃত্তি করল তারপর হাতের টাকার নোটগুলি গুনতে গুনতে পকেটে রাখল তারপর গামছাটিতে হাতখানা মুছতে মুছতে এসে বসলো আমার পাশে বেঞ্চটিতে। তারপর সে বলল, বাড়ি ছিল আমার রতনপল্লী। ওদিকে বাবা কাজ করে এসেছে চিরটাকাল ক্ষেতে ও খামারে। আমি ছিলাম তার একমাত্র সন্তান। স্কুলে গেছিলাম কদিন। কিন্তু গরিবের কি আর পড়ালেখা হয় মশাই !পেটের দায়ে বাবার সাথে কাজ করে চললাম ,কৃষিকাজ। মাঝে মা মারা গেল। তারপর একদিন বাবাও চলে গেল। গ্রামে আর আমাদের আপন বলে কেউ রইল না ।তাই গ্রামবাসীর কথায় গ্রামের ওই একটি মেয়েকে বিয়ে করে এই শহরে এসে উঠলাম। এখানে আমার মেয়ে করবী হয়। তারপর ক'বছর ভিন রাজ্যে গিয়েছিলাম কাজ করতে, স্ত্রী ও মেয়ে এখানেই ছিল। কিন্তু এই শালার করোনা সবকিছু কেড়ে নিল আমার থেকে। কাজ হারিয়ে চলে আসলাম এখানে। তাই দু বছর হলো এখানেই চা ও বিস্কুটের দোকান চালাই। নিজেরা খাই কম কিন্তু মেয়েটাকে কোনদিন আধপেটা খাইয়ে রাখি না। বহু কষ্টে সংসার চালাই মশাই। এক বছর হল মেয়েটাকে একটি স্কুলে ভর্তি করেছি।
এই কথাটা বলেই লোকটা চুপ করে গেল আমি বুঝতে পারলাম সে কাঁদছে আমার আর সাহস হলো না তার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে দুটো সান্তনার কথা বলবার আমি এইসব বিষয়ে প্রথম থেকেই বেশ একটু ভীরু ধরনের ।তারপর অনেকক্ষণ মৌন থেকে লোকটাই বলে উঠলো, আমার নামটা জিজ্ঞেস করছিলেন ,তা এই অধমের নাম হল হীরেন ,সম্পূর্ণ নাম হীরেনচন্দ্র রায়।
লোকটা আবার বলে উঠলো, প্রথমে ভেবেছিলাম পাগল হবেন ।কিন্তু এখন কথা বলে পোশাক আশাক দেখে তো মনে হচ্ছে একটি ভদ্র ঘরের মানুষ ।তা আপনি সেই কখন থেকে বসে কি যে নিজে নিজে ভেবেই চলেছেন আর একা একাই কথা বলে চলেছেন এর অর্থ কি মশাই?
এবার আমি নিজেই একটু লজ্জায় পরে গেলাম। আমি যেই বলতে গেলাম কারনটা অমনি লোকটি আমার কথাটাকে এমন ভাবে আটকে দিয়ে নিজে কথা বলতে শুরু করল যেন মনে হল কোন ট্রেন চোখের নিমেষে কোন মানুষকে পিষে দিয়ে চলে গেল, কিন্তু মানুষটি টের পেল না।
লোকটি বললো, তামশাই আপনি এমনটা কেন বলুন তো। প্রথম থেকেই আপনাকে আমার মনে ধরেছে। আপনাকে আমি আজ রাত্রে আমার বাড়ি নিয়ে যাব। এই যে দোকানটি দেখতে পাচ্ছেন ঠিক তার পেছনেই আমার ছোট একটি ঘর ।আমরা তিনটে মানুষ থাকি সেখানে। এই রাতে এই গরীবের ঘরে উৎসব ,আপনাকে খেতেই হবে মশাই না হলে পাপ করেছি বলে মনে করব।
ওমনি সে জোরে একটু ডাক দিল, করবী এদিকে একটু আয় তো মা।
দেখতে পেলাম আমার রিম্পির বয়সের একটি মেয়ে শরীরে ফ্রক পরা ,চুলগুলো ঘাড় অব্দি এসে ঠেকে আছে ।সামনে এসে তার বাবার সামনে দাঁড়ালো অমনি লোকটা মেয়েটিকে বলল ,এই কাকুটি আজ আমাদের সাথে খাবে তুমি চট করে গিয়ে তোমার মাকে বলে দিয়ে আসো তো ।মেয়েটা তার বাবার আদেশ পেয়ে ছুটে চলে গেল। আমি যেন কোন কথাই বলতে পারলাম না ।কোনো একটা প্রতিবাদ যেন করা হলো না এমন।
কিছুই যেন করতে পারলাম না। হঠাৎ করে মেয়েটি কোথা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, মা বলল ভাত বেড়েছে ডাকছে। বলেই সে আবার দৌড়ে চলে গেল। অমনি লোকটি আমার হাত ধরে প্রায় জোরজবস্তি তার ঘরে নিয়ে চলল। ঘরে ঢুকেই লোকটির সংসারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে আরো বিশদে জানতে পারলাম। দেখতে পেলাম টিনের চাল দেওয়া দুটি ঘর। তার একটি মধ্যে রান্নাঘর রান্নার গ্যাস ওভেন ও সামান্য কয়েকটি স্টিলের বাসনপত্র। ঘরের মধ্যে এক কোণে ঠাকুর দেবতার স্থান ,আর এককোনে একটি কাঠের আলমারি ও একটি ছোট্ট খাট। সেই খাটের নিচেই দুটো আসন পাতা তার সামনে দুটো স্টিলের থালায় সামান্য পরিমাণ ভাত ও বাটিতে কিসের যেন ঝোল।
অভাব দেখে নয়, খেতে বসতে যেন কেন মন থেকে সায়ে দিচ্ছে না। তাও জোরজবস্তি লোকটা আমার হাত ধরে এক আসনে বসিয়ে দিল এবং নিজে আরেক আসনে উপবেশন করল। লোকটি বলল, খেতে বসুন মশাই। আমি জানি আপনারা এইসব খেতে অসুবিধা হবে। আপনারা সব উঁচু দরের মানুষ কত ভালো ভালো খাবার খান প্রত্যহ ।আপনাদের মুখে কি এগুলো রোচে? আসলে আমি আপনাকে খাওয়ার কথা বলতাম না। এখন জানি সেটা বললে অনধিকার চর্চা হতে পারে ।কিন্তু দেখলাম আপনি বড় অসহায়। পাগলেটে ধরনের ,তাই বললাম বসুন দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
দেখতে পেলাম একটি স্ত্রী লোক মাথায় ঘোমটা দেওয়া পরনে আধমায়লা পাতলা এক শাড়ি পরিহিতা হয় সেই লোকটির স্ত্রী হবে। আমাকে বলল, খান বাবু লজ্জা করবেন না জানি এই মোটা চালের ভাত কিছুই না আপনার কাছে। আমরা যা গরিব তাতে খেতে বলাটাই পাপ। কিন্তু যখন মেয়েটা এসে বলল মা একটি পাগল ধরনের লোক বাবার সাথে দোকানে বসে গল্প করছে এবং বাবা বলল লোকটি আমাদের সাথে আজ রাতে খাবে। আমি তখন বারণ করতে পারলাম না। স্বামীর আমার দয়ার শরীর। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি বেশ ভদ্র ও বড়লোকের মানুষ। তা এরকম ঘুরে বেড়ান কেন পথে ঘাটে? বাড়ির লোকের তো চিন্তা হয়। জানেন কি কতদিন হয়ত খাওয়া হয়নি ঠিক মতো? শরীরের কি হাল! খান লজ্জা করবেন না।
মনে মানে ভাবলাম দুপুরেই মুরগির টেংরি চিবিয়ে বেরোলাম আর আমি কিনা পাগল! আমি কিনা পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াই! কতদিন খেতে পারি না! ইস ,ভগবান আমার সাথেই যে কেন এমনটা করেন সব সময় তাই বুঝে উঠতে পারি না! কি যে করি! প্রতিবাদ যে করব সেটা কখন থেকে চেষ্টা করে চলেছি, কিন্তু সত্যি আমার জিভটা কে যেন আটকে রেখেছে আমি কিছু বলতেই পারছি না। না আজ সত্যি প্রমাণিত হলো সাহিত্য প্রেম মানুষকে সমাজে পাগল বানাতে পারে। তাই হয়তো গিন্নি বলে, কত সাহিত্য টাহিত্য কোরোনা, সংসার মুখ্য সাহিত্য গৌণ।
থালার কিছুটা ভাত সামনে টেনে নিয়ে তাতে বাটি থেকে সামান্য পরিমাণ জলের মতো তেলবিহীন, স্বাদবিহীন কেবল হলুদ, লবণ গোলা তরল বস্তু আমার পাতের উপর এসে পড়ল সাথে আসলো গোল গোল দুটো বস্তু ,ভালো করে টিপে দেখলাম সেটা আর কিছুই নয় আমাদের সকলের পরিচিত হাড় ছাড়া মাংস ছোয়াবিন। তাই দিয়ে এই লোকটা উদ্দাম খেয়ে চলেছে অনবরত। পেটে তার কতদিনের খিদে জমা হয়ে আছে হয়তো। ইস্, হয়তো কয়দিন ঠিকঠাক খেতেও পারে না।
খানিকক্ষণ আবার আমরা মৌন। আগুন জ্বালা হলে তাতে কাঠ না দিলে এক সময় তা ঠিক নিভে যায় ,তেমনি কথার বিষয় না হলে মানুষ বোবা হয়ে যায়। অমন আমি জিজ্ঞেস করলাম,
তা মশাই আপনি যে বলছিলেন আপনার বাড়িতে আজ কি উৎসব না কি অনুষ্ঠান আছে। তা কি আজ সত্যিই আছে, আপনার মেয়ের কি আজ জন্মদিন নাকি?
লোকটা মুখের ভাতটুকু শেষ করেই হো হো শব্দে হেসে কুটিপাটি লেগে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে নিয়ে বলল, আরে না না মশাই তেমন কিছুই না। কালতো হলি। তা আজ সকালে তিনটে গামলা করে আবির রেখেছিলাম দোকানে ।ওরে বাবা দুপুর বারোটা না বাজতেই সব কটা গামলা খালি হয়ে গেল। কি ভালই না ছিল আজকের দিনটা। কি জানি কার মুখ দেখে আজ ঘুম থেকে উঠেছিলাম কে জানে ?আসলে আমাদের পরিবার এইরকম খাওয়া একরকম উৎসবের সমান। তা আপনারা বুঝবেন না।কাল সকালেই দেখতে পারবেন কত প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে হলুদ রঙে মুড়ে দলে দলে বড় মাঠের দিকে চলেছে সূর্যের কিরণ মাথায় নিয়ে সারাদিন নাচ গান করে বসন্ত উৎসব পালন করবার জন্য। আমার ভাই তেমন সামর্থ্য নেই তাই নিজের স্ত্রী ও মেয়েকে ভালো পোশাক আশাক কিনে বসন্ত উৎসবে পাঠাতে পারি না আমার নিজের সময়ও নেই একদিন দোকান বন্ধ রাখলে ব্যবসার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। তাই নিজে বসন্ত উৎসবে যেতে পারি না। আমাদের ওসব হয় না।
তাই আমরা তাদের দেখে সন্তুষ্ট থাকি মশাই।
বলেই লোকটি আবার খেতে শুরু করল।
লোকটির বলা শেষের কথাগুলো আমার মনে একেবারে ছুয়ে গেল। সত্যি আমরা বিশেষ করে চাকরিজীবীরা এই ছুটির দিনগুলোতে কতই না আরামে দিনগুলো কাটাই ।বিশেষ করে হোলির দিন টিতে সকালে উঠে বাজারে গিয়ে বড় খাসিটা কাটিয়ে বা বয়লাটা কাটিয়ে বাড়িতে গিন্নির হাতে দিয়েই আমরা খালাস ।তারপর দিন একটু গড়ালেই নিজেদের দেহকে হলুদে মুরে বাইক নিয়ে বা হেঁটে সপরিবারে অথবা সবান্ধবে যোগ দিতে যাই বসন্ত উৎসবে। কিন্তু রাস্তার এইরকম বঞ্চিত এলাকায় আমরা যদি একটু চোখ ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাই নিজেদের জীবন টিকিয়ে রাখতে কত মানুষ এভাবে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা লড়াই করে নিজেদের সাথে। সত্যিই এই সব মানুষগুলোর জীবনে উৎসব বলে কিছু নেই। বসন্তের দখিনা বাতাস হয়তো এইসব এলাকাগুলিতে ঢোকে না। পলাশ শিমুলের গন্ধ হয়তো এইসব মানুষগুলো পায় না। এইসব মানুষগুলো হয়তো বসন্তের রং বেঁচেই চলে কেবল, সেই রঙের ছোঁয়া হৃদয় ভরে অনুভব করতে পারে না। আজ এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না এক আলাদা বসন্তোও আমাদের সমাজে আছে। মানুষ কেবল উপরেই দেখে চলে। কেউ মনের গভীরে গিয়ে গভীরের চোখ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করে না। তাই আগেই বলেছি চোখ থাকলেই মানুষ দেখতে পাবে এমনটা নয়। ডাগর ডাগর চোখ বিশিষ্ট ব্যক্তিও অনেক সময় চোখে ভুল দেখেন।
ইস্, আবার কি সব উলটপালট ভেবে যাচ্ছি। নিজের ভাবনাটা ভেঙে গেল আমার পকেটের ফোনের রিংটোন এ। ফোনটা রিসিভ করেই কানে দিতে হ্যালো বলবার ফুসরত পেলাম না। ওপার থেকে শুনতে পেলাম ঝাঁঝালো কন্ঠে কন্যা রিম্পি বলে উঠছে,হলি চলে গেলে তুমি বাড়িতে রং নিয়ে এসো।ফোন রাখছি।
মশাই সংসার মুখ্য ,সাহিত্যভাবনা গৌন।
নবাবী শহরে আমরা
অভিষিক্তা বসু
ভ্রমণ পিপাসু মন প্রতিটি মানুষের মনের অন্দরমহলেই বাস করে থাকে। কখনও কখনও গুটি গুটি পায়ে তারা মনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। এমনই একদিন হঠাৎ করে সুযোগ আসে । দুই বছর বি এড করার সুবাদে আমার যাতায়াত শুরু হয় নবাবী শহর মুর্শিদাবাদে। তবু ব্যাস্ততার মধ্যে কখনই শহরটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের সুন্দর মহিমাময়ী ইমারতগুলি দর্শন করার মতন পর্যাপ্ত সময় হয়ে ওঠেনি।
সাহিত্যের ছাত্রী হলেও ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ আমার বরাবরের। হয়তো সাহিত্য জানতে গেলে তার ইতিহাস না জানলে তাকে আত্মস্থ করা যায় না বলেই, নতুবা প্রাচীন ইতিহাসের মধ্যে কোথায়ও যেন আমি শুনতে পাই বর্তমান ভারতের নিঃশব্দ পদচারণা। সে যাই হোক, ২০১৯ এর ঠিক জুন মাসের ২১ তারিখ আমার বি এড পরীক্ষার ফাইনাল শেষ হয়। বি এড পড়তে যাওয়ার সুবাদে আমার সঙ্গী হয় দুটি ভাই। এরা কেউ আমার পূর্ব পরিচিত নয়। প্রথম যেবার (২০১৭) উচ্ছ্বসিত বন্যার দাপট সামলে বহরমপুর থেকে প্রায় ৮০ কিমি দূরে ডোমকলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম,সেবার ওদের সাথে আলাপ। তারপর ২ বছরের দীর্ঘ যাত্রা পথ পাড়ি দিলাম একত্রে। ওরা অনির্বাণ, শ্যামল।
আমাদের ফেরার টিকিট ছিল ২২ শে জুন বিকেলের ট্রেনে। কিন্তু আমরা যে সরকারি আবাসনে থাকতাম, সেখানে কিছু প্রয়োজনে আমাদের ঘর ছাড়তে হল ২২ শে জুন সকালে। প্রায় ১০-১২ দিন বাড়ির বাইরে থেকে আমারই বাড়ি আসার তাড়া থাকত বেশি, কারণ দূরে আমার জল শহরে আমার অপেক্ষায় একটি ছোট প্রাণ প্রহর গুনতো প্রতিনিয়ত।
বাইশে শে জুন তাই সকাল সকালই আমাদের গোছগাছ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই অনির্বাণ ও শ্যামল আমাকে জিজ্ঞ্যেস করল,ঘুরতে যাওয়ার কথা। বলতে গেলে নিয়মমাফিক আসা এই আমাদের শেষবার। তাই নবাবী শহরের এমন হাতছানি আর অস্বীকার করতে পারলাম না। সাত পাঁচ ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম, তিন জনে।
জানতাম স্বল্প পরিসরে এই শহরে সবটা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়, তাই কয়েকটা জায়গার ছক কষে নিলাম আমরা। স্থির হল ৪ টে জায়গায় যাব। কাটরা মসজিদ, হাজারদুয়ারি, কাঠ গোলা বাগান বাড়ি, মতিঝিল।
আমাদের গাড়ি ছুটল সেই মতো ,প্রথমেই আমরা গেলাম কাটরা মসজিদ। অদ্ভুদ নবাবী আতিশয্যের নিদর্শন এই স্থান টি। ভাবতে সত্যি গর্ব হয় যে এত সুন্দর ইমারত রয়েছে এই বাংলায়। সুলতানি আমল ও নবাবী আমলের এক অদ্ভুত সংমিশ্রন । একজন গাইড আমরা সঙ্গে নিলাম,এই পাথরের কারুকার্যের সূক্ষ্ম ইতিহাস জানার জন্যে। যা কিনা ইতিহাসের পাতায় মেলা ভার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় যে, ইসলামী ইতিহাসের সাক্ষী বহন করা এই ইমারতের চার সীমানার মধ্যেই স্থান পেয়েছে একটি শিবের মন্দির। গাইডের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে জানতে পারি সুলতান ঔরঙ্গজেবের প্রেরিত তৎকালীন বাংলার সুবাদার মুর্শিদকুলি খাঁ নাকি আদতে ছিলেন হিন্দু বংশদ্ভুত। ডাকাত দলের হাতে অপহৃত হয়ে এসে পরেন সুলতানের হাতে , নিজের গ্রাম ও মা বাবার সন্ধান পেয়ে সেখানে ফিরে গেলেও মা বাবা তাকে গ্রহন করতে পারেনি, মসুলমানী দরবারে স্থান পেয়েছিল বলে। তাই অগত্যা ফিরে আসেন সুলতানের কাছেই, আর তার পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত হতে থাকেন। ধর্ম পরিবর্তিত হয়ে নাম হয় মুর্শিদকুলি খাঁ। তো সেই মুর্শিদকুলি খাঁ কে যখন বাংলার সুবেদার হিসেবে প্রেরন করেন সুলতান তখন নাকি তিনি এই মসজিদ নির্মাণ করেন,যার চারদিকে চারটি গগনচুম্বী মিনারের থেকে আজানের শব্দে জেগে উঠত বাংলা। এই মসজিদের ছাদেই ব্যাবস্থা রয়েছে ২০০০ জনের এক সাথে নামাজ পড়ার। অদ্ভুত সব কারুকার্যে পূর্ণ সেই শৈল্পিক নিদর্শন। পাথরেরাও যেন কথা বলছে। মুর্শিদকুলি খাঁর কবরও এই মসজিদের একেবারে পেছনের দিকে রয়েছে। মসজিদের চারটি গম্বুজের মধ্যে এখন মাত্র ২ টি অক্ষত আছে। নামাজ পড়ার স্থান থেকে পেছনের দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই তার নীচে সযত্নে সমাধিস্থ মুর্শিদকুলি খাঁ। এই সিঁড়ি তে নাকি আগে তারের জাল বসানো ছিল। তিনি নাকি সকল ধর্মের প্রতি অনুরাগি ছিলেন, তাই তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবরে সকলের পদধূলি যেন পরে, তাহলে তার ইহ জন্মে করা পাপ কর্ম কিছুটা হলেও লাঘব হবে। বর্তমানে সেই জাল আর নেই। ঘুরে দেখলাম ইসলামী ছাত্রদের উর্দু শিখতে আসা আবাসিক স্থল। আসলে এটি মাদ্রাসা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সূচনা পর্বে। প্রতিটি গাঁথনি যেন ইতিহাসের দামামা বাজিয়ে চলেছে প্রতি নিয়ত। শোনা যায় এই মসজিদ টি ঢাকার একটি মসজিদের অনুকরণে নির্মিত। ইতিহাসে আছে যে ,মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন ঢাকা থেকে রাজধানী বাংলায় স্থানান্তরিত করেন তখন এই স্থান টির নাম হয় তার নামানুসারে মুর্শিদাবাদ। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে Archeological survey of India ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা এলাম কাঠগোলা বাগান বাড়ি । পরবর্তীতে মুর্শিদ কুলি খাঁ হয়ে ওঠেন বাংলার নবাব। স্বাধীন বাংলার সিংহাসনে এর পর একে একে বসেন্ সরফরাজ খাঁ, সুজাউদ্দিন, আলিবর্দি খাঁ, সিরাজউদদৌলা । মুর্শিদাবাদের বিশেষ আকর্ষণ হাজারদুয়ারি থেকে মাত্র ৪ কিমি দুরত্বে উত্তরের দিকে অবস্থান এই বাগান বাড়িটির। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনের সময় মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা ফিকে হলেও এর আভিজাত্যের আকর্ষণ কখনও কমেনি। এর এই মায়াবি আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এসেছে কত পর্যটক। এই শহরের অলিগলি নবাবী ইতিহাস যেন আজও বহন করে চলেছে।
প্রাসাদের প্রবেশ মুখ থেকে যতই এগিয়ে যেতে লাগলাম ততই আমার মনে হতে লাগল,আমি যেন কোথাও এই প্রাসাদ দেখেছি। ক্রমশ ধোঁয়াশা কেটে স্পষ্ট হল,কিছুদিন আগেই দেখা ‘ এক যে ছিল রাজা’ সিনেমার শুটিংটা এই প্রাসাদেই হয়েছে। সিনেমার চালচিত্রের সাথে মিলতে লাগল সব কিছু। প্রাসাদের মুখেই রয়েছে এই বাগান বাড়ির নির্মাতা জিয়াগঞ্জের রাজা ও তার ৪ ভাইয়ের ঘোড় সওয়ারি মূর্তি। আসলে এটি একটি বাগান বাড়ি । বাগানে ঘেরা বিশাল স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে মুগ্ধ হতে লাগলাম আমরা। বাগানে প্রবেশের মুখেই দেখা যায় বড় নহবত গেট। লোকে বলে প্রবেশ পথের দুপাশে নাকি এক সময় ছিল কাঠের গোলা ,তাই এই প্রাসাদের নাম সেখান থেকেই উঠে এসেছে। এই বাগান বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর বহু ফুল ও ফল গাছ সমৃদ্ধ সুবিশাল বাগান। চারিদিকে সাবেকি আসবাব পত্র, নাচ ঘর, নহবতখানা, হাতিশালা, পাকশালা, সবই যেন ইতিহাসের পাতা উল্টে নবাবী ইতিহাসের রম্য রচনায় আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এই প্রাসাদের ভেতরেই আছে আদিনাথ ও জৈন মন্দির। আছে এক বিশাল দিঘি, যার স্বচ্ছ জলীয় প্রতিবিম্বে এখনও স্পষ্ট হয় রাজ হংসের কোলাকুলি। এই বাগান বাড়ি কে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের মুখে বহু রহস্য আজো ঘোরাফেরা করে। শোনা যায় এই বাগান বাড়ির পুরনো মসজিদে ও কবরস্থানের কাছে একটি কুয়োতে নাকি প্রচুর গুপ্তধন পাওয়া গিয়েছিল। তার অর্থেই নাকি বাগান বাড়িটি গড়ে তোলা হয়। জমিদারি ও নবাবী আমলে নিয়মিত এই বাগান বাড়িতে জলসা আয়োজিত হত। প্রাসাদের দুই দিকে আছে দুটি প্রাতকালীন ও সন্ধ্যা কালীন জলখাবার গ্রহনের জন্য সাবেকি ডাইনিং চেয়ার ও টেবিল। অদ্ভুত মনোহারী সেই শৈল্পিক নমুনা। আমরা যেন প্রতি ক্ষণে পৌঁছে যাচ্ছিলাম সেই প্রাচীন বাংলায় যার আঁটঘাঁট বাঁধা ছিল এমন সব অত্যাশ্চর্য বহু মূল্যবান স্মৃতি বিজরিত স্থানে। ইংরেজদের মুর্শিদাবাদে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ষড়যন্ত্রে নাকি এই বাগান বাড়ির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কথিত আছে বাগান বাড়ির ভেতরে সুড়ঙ্গ পথ যুক্ত হয়েছে ভাগীরথীতে। আমরা তিন জন যেন ইতিহাসের পাতায় নিজেদের হারিয়ে ফেলছিলাম। মুগ্ধ দৃষ্টিতে আস্বাদ নিচ্ছিলাম বাংলার এই ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের রূপ রস গন্ধের। কিন্তু সময় যে হাতে বড্ড কম। ঘড়ির কাঁটা জানান দেয় সময় হয়েছে এবার ফেরার।
আমরা এবার এগিয়ে চলি মুর্শিদাবাদের অমোঘ আকর্ষণের দিকে … গন্ত্যব হাজারদুয়ারি। বাংলার নবাবী আমলের স্থাপত্যকলার এক উজ্জ্বল নিদর্শন এটি, ব্রিটিশ এর যুগেও যার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই স্থাপত্যের ইতিহাস জানার জন্য এখানেও একজন স্থানীয় গাইড নিই। আমার সামান্য জ্ঞানের ভাণ্ডারে আমি জানতাম যে এই স্থাপত্য টি সিরাজের তৈরি। এখানে গিয়ে জানলাম এটি নবাব হুমায়ুন জা ইউরোপীয় স্থপতি দিয়ে এই প্রাসাদ বানান। সিরাজের প্রাসাদ ,যার নাম ছিল হিরাঝিল, তা এখন ভাগীরথী গর্ভে শায়িত। এই প্রাসাদটি তাই ইংরেজি আদলে তৈরি। তিনতলায় বেগম ও নবাবদের থাকার ঘর, দোতালায় দরবার, পাঠাগার ও অতিথিশালা। প্রবেশ পথেই আছে গাড়ি রাখার স্থান। এই সুবিশাল অট্টালিকার উত্তর দিকে রয়েছে বাংলার সব থেকে বড় ইমামবারা। হাজার দুয়ারি প্রাসাদে প্রবেশের মুখে বসানো রয়েছে এক বিশাল তোপ, যার নাম ‘বাচ্চাবলি তোপ’ । এই তোপ টি সম্পর্কে বহু কথা প্রচলিত আছে, কেউ বলেন এটি হুমায়ুন জা ভাগীরথী গর্ভ থেকে উদ্ধার করে ছিলেন, আবার কারো মতে এটি বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের। তবে এর নামকরন নিয়ে যে গল্পটি প্রচলিত তা হল, এই কামান টি যখন দাগা হয়েছিল( মাত্র এক বার) তখন নাকি এর বিকট গর্জনে আশেপাশের বহু গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটেছিল। এরপর থেকে এই কামান শুধু প্রাসাদের শোভা বর্ধন করে আসছে। হাজার দুয়ারি ও ইমাম বারার মধ্যে খানে আছে মদিনা ও ঘড়ি ঘর। আমাদের পথ প্রদর্শক ভদ্রলোকের মুখে তার শহরের এই সমস্ত ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা ৩ জন জুন মাসের ওই প্রচণ্ড দাবদাহে যেন নিজেদের ক্ষিদা তৃষ্ণা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের চোখে ও মননে তখন নবাবী আমলের পদধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে। এবার আসি এই প্রাসাদের নামকরনে, যদিও, যারা ইতিহাস প্রিয় পাঠক তারা হয়তো এর চেয়েও অনেক বেশি জানবেন। তবু আমার নিজের মতন করে আমার বাংলা কে জানার এই প্রথম ধাপে আমার অভিব্যাক্তি টুকুই ভাগ করে নিচ্ছি মাত্র। এই প্রাসাদের বাইরে থেকে ও ভেতর থেকে অনেক দরজা দেখা গেলেও, এর পুরটাই এক চমক। এর অনেক দরজাই আদপে নকল, অথচ তা এত তাই নিখুঁত তা বোঝার উপায় নেই। এখানে নয়শোটি আসল ও একশোটি নকল দরজা রয়েছে। বর্তমানে এটি ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে একটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে রয়েছে ইতিহাস খ্যাত রাজা বাদশাহ দের ব্যবহৃত প্রচুর অস্ত্র। বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগে করে সংরক্ষিত করা হয়েছে রাজাদের বিভিন্ন শিকার। আরও বহু মহা মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন। রয়েছে অকৃতজ্ঞ মোহাম্মদী বেগ দ্বারা সিরাজ কে হত্যা করায় ব্যবহৃত ছোরা টিও । এর পাশাপাশি রয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের ব্যবহৃত সামগ্রীও। আর দূরের ওই বিরাট প্রাসাদ টি হল ইমামবারা , এখানে পালিত হয় মহরমের রাতে যাকে বলে ‘ কাতল কি রাত’ ,সেই রাতেই এখানে পালিত হয় ‘ আগুনে মাতম’। কয়েকশো বছরের রীতি মেনে এটি পালিত হয়।
হাজার দুয়ারি ঘুরে পেট জানান দিল,এবার কিছু খাবার আমাদের একান্ত প্রয়োজন। সকাল গড়িয়ে দুপুর তখন তিনটে। আমাদের তালিকা অনুসারে এখনও মতিঝিল দেখা বাকি। সামনেই একটি হিন্দু হোটেলে আমরা মধ্যাহ্ন ভোজন করলাম। আমাদের ড্রাইভার দাদা কিছুতেই কিছু খেলেন না।
দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আমরা ছুটলাম মতিঝিলের পথে। পেছনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল আমাদের নিজেদের প্রাচীন কাহিনি গুলো। বিকেল তখন। ঈশান কোনে তখন মেঘ ঘনিয়ে আসছে, আমাদের তাই পৌঁছতে হবে এখান থেকে কিছুটা দূরের স্টেশনে।
বিকেল প্রায় চারটা, আমাদের গাড়ি এসে থামে মতিঝিলের সিংহ দুয়ারের সামনে। বর্তমান রাজ্য শাসকের আনুকূল্যে এই ঝিলটি কে পর্যটক দের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে বিশেষ সৌন্দর্য আনয়ন করা হয়। দুকূল ছাপান সুবিশাল ঝিলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে মুর্শিদাবাদের তাবড় তাবড় ব্যাক্তিদের মূর্তি। মূর্তি গুলো যেন সিরাজ ও বাংলার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের সাক্ষ্য বহন করছে। প্রকৃতি ও ইতিহাস যেন এখানে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। এই ঝিলের একদিকে মসজিদ ও অন্যদিকে রাধা মাধব মন্দির। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো, বের হয়ে আসতে আসতে শুনলাম আজান ও আরতির ধ্বনির এক অনন্য সহাবস্থান। দুই সম্প্রদায় যেন কোথায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি যেন আচ্ছন্ন করলো আমাদের ৩ টি হৃদয় কে।
বেরিয়ে এলাম ইতিহাসের ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, ও সিরাজের হৃদয়ের অসীম বেদনা কে সঙ্গে করে। অন্যদিকে ব্রিটিশের লোলুপ দৃষ্টি যেন আজো স্থির হয়ে আছে এই ইমারত গুলির গাঁথুনিতে।
ফিরে আসতে আসতেই মনে হতে লাগল, কবির সেই বানী ……
‘ বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।‘
হ্যাঁ, অন্য দেশ হয়তো ঘুরি নি, কিন্তু নিজের দেশে যত সামান্য ঘুরেছি, তাতে এই ঘোরাটুকু যেন আমার জীবনে একটা নিজস্বতার স্বাদ রেখে গেল। মুর্শিদাবাদ এটুকুতেই শেষ হয়ে যায় না। যার পালকে রয়েছে জমিদারি, সুবেদারি, নবাবী, সুলতানি , সর্বোপরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের , ষড়যন্ত্রের ,বিশ্বাসঘাতকতার রক্ত বিন্দু তার ইতিহাসের পট ভূমিকা অবশ্যয়ই অনস্বীকার্য। তবু আমাদের ফিরতে হবেই, ঘড়ির বাঁধা নিয়মে, আসে গেলাম স্টেশনে। পেছনে পরে রইল বাংলার সেই অকথিত বেদনার কাহিনি, যা নীরবে আজো প্রতিবাদ করে ওঠে যেন। কত আন্দোলন ,কত বিরোধ , না জানি কত শত গোপন রোদন পাথরে শায়িত প্রেমিকার বুকে, সংঘর্ষের আড়ালে নিপীড়নের শ্বাস রোধ করা রোমাঞ্চ। ফিরে এলাম এক ঐতিহাসিক আমেজ নিয়ে।।
কবিতা/ ছড়া
ফুলগুলো রেখে দিলাম
মজনু মিয়া
আজকে তোমার যৌবন সময় ভালো লাগে সব
আমার গুনগুনানো প্যানপ্যানানি রাগ কলরব
তোমার দেয়া রঙিন ফুলের গুছা হাতে নিয়ে তাই
ভাবি আবার ফাগুন এলে তোমাকে যদি না পাই!
চাই, তোমাকেই যেন ফিরে পাই বার বার আবার
কারণ, তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি ভাববার
হারানোর বেদনা বেশি, যাতে হারাতে না হয় তায়
মনের মাঝে আকুপাকু করে চিন্তা অজানায়।
ফুলগুলো যতনে রেখে দিলাম বইয়ের ভাঁজে
ঘ্রাণ শুকিয়ে গেলেও জমা রবে মনের খাঁজে।
আগামী জীবন
সুনন্দ মন্ডল
ভাত ফোটে
ধোঁয়া ওঠে
উনুনে দাও দাও আগুন।
ভাত নামে
পাতে বসে
বাড়ির যত স্বজন।
পাত ফাঁকা
আসন গোটা
ভরা পেটে সুখ।
তৃপ্ত স্বাদ
স্বাদে রসনা
জাগে হাসি মুখ।
যদি অভাবী ঘরে জোটে নুন
যতই হাটে লাগুক আগুন!
রেঁধে-বেড়ে দিন যাপন
একান্ত আলাপে শুরু গান।
গানে গানে বাঁধা আগামী জীবন...
বাংলাদেশ
রেজাউল করিম রোমেল
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা
আমার বাংলাদেশ,
আমাদের এই বাংলাদেশে
রূপের নেইকো শেষ।
ধনী গরিব জেলে চাষি
সবার বাংলাদেশ,
গর্বে আমার বুক ভরে যায়
এটাই আমার দেশ।
রক্ত দিয়ে জয় করেছি
সোনার বাংলাদেশ,
এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি আমার
দেখতে লাগে বেশ।
বইমেলা
মুহাম্মদ আলম জাহাঙ্গীর
দেশের নানা প্রান্তে বসে
বই পুস্তকের মেলা,
শিশু-কিশোর সবার বই যে
শুধু বইয়ের খেলা।
স্টলে স্টলে সাজান থাকে
শত বইয়ের কলি,
লেখক পাঠক শুভাকাঙ্ক্ষী
সবাই বইয়ের অলি।
বই বিপণি ঘুরে দ্যাখে
লেখক পাঠক দলে,
নানা রকম বই কিনে সব
বাড়ি ছুটে চলে।
বই মেলাতে সবাই আসুন
থাকতে হাতে বেলা,
বইমেলা ভাই লেখক পাঠক
সবার মিলনমেলা।।
ছবি
আকাশলীনা ঢোল
রিসা দাস
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৯
No comments:
Post a Comment