মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
ডোনার
মৌসুমী চৌধুরী
"সরি টু সে মিসেস সেন , বাস্তবটাকে অ্যাকসেপ্ট করুন, প্লিজ। আপনার শরীরে সুস্থ ডিম্বাণু উৎপন্ন হচ্ছে না। অনেক ওষুধ প্রয়োগ করেও সেটা পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগ ডোনারের ব্যবস্থাও তো আপনারা করেছিলেন। আপনার হাসবেন্ডের শুক্রাণু দিয়ে ডোনারের ডিম্বাণুর নিষেক ঘটানো সম্ভব হল না প্রথম দু'বার। শেষ দুটো প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দু'বারই ভ্রূণ আপনার জরায়ুতে ইমপ্ল্যান্ট করবার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই মিসক্যারেজ হয়ে গেল! অর্থদন্ড হল আপনার, চার চারটে এক্সপেরিমেন্ট ফেইলিওর হল আমাদের!"
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থেমেছিলে- ন ডঃ বি.এম মুখার্জি তারপর আবার বলতে শুরু করেছিলেন,
—" মন খারাপ করেবন না। মা হবার জন্য অন্য রাস্তা বেছে নিন এবার। বেটার টু গো ফর অ্যাডপশান। সেটা মানতে না পারলে আবার নতুন কোন ডোনারের খোঁজ করুন।"
ডঃ মুখার্জির কথাটা শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মল্লিকা। তার পৃথিবী যেন নিমেষেই আলোহীন, নিকষ কালো! তার সাতাশ বছরের জীবনে সে শুধু একটাই জিনিস চেয়েছিল। একজনের মতো হতে চেয়েছিল সে। হ্যাঁ, একদম মায়ের মতো হতে চেয়েছিল। মায়ের মতো স্বাদে- গন্ধে অতুলনীয় রান্না করতে, চটপট হেলদি ব্রেকফাস্ট বানাতে, জ্বরে মাথায় মায়ের মতো শীতল জলপট্টি দিতে, পা মচকে গলে হলুদ চুনের টোটকা দিতে, সন্তানের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কঠিন কঠিন সব পাঠ্য বিষয়কে মুশকিল আসান করে তুলতে ... সব সব সবকিছুই মায়ের মতো করতে চেয়েছিল মল্লিকা! আসলে আদ্যন্ত একজন মা হতে চেয়েছিল সে। অথচ তার সন্তান তার শরীরের অংশই হবে না? হবে না তার নাড়ি ছেঁড়া ধন ? বায়োলজিক্যালি সে কারও মা-ই হতে পারবে না? দমকে দমকে বুক ফাটা কান্না বেরিয়ে আসতে থাকে মল্লিকার ভিতর থেকে।
গত তিন বছর ধরে ডঃ বি. এম মুখার্জির ক্লিনিকে আই.ভি.এফ পদ্ধতিতে ইনফার্টিলিটির ট্রিটমেন্ট চলছিল মল্লিকার। তার শরীর থেকে সুস্থ ডিম্বাণু পাওয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু নানা মেডিক্যাল টেস্টের পর ডাক্তারেরা কনফার্ম হয়েছিলেন বেবী ক্যারি করতে কোন রকম অসুবিধেই নেই মল্লিকার। কৃষ্ণেন্দুর শুক্রাণুও সুস্থ ও সক্রিয়। তাই ডিম্বাণু ডোনারের সাহায্য নিয়েছিল তারা। ডোনারের ডিম্বাণু ও কৃষ্ণেন্দুর শুক্রাণু নিয়ে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতিতে মল্লিকাকে সন্তান সুখ দিতে চেষ্টা করছিলেন অভিজ্ঞ ডাক্তার- দের টিম। কিন্তু তাঁদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। ভাঙা টুকরো টুকরো মন নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরে এসেছিল মল্লিকা আর কৃষ্ণেন্দু।
শীতের বেলা বড্ড তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। পশ্চিমের বারান্দায় বসে মল্লিকা দেখছিল কমলা রঙা আলো ছড়িয়ে দিয়ে চোখের সামনে দিগন্তরেখায় ডুবে যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল দিন। ধীরে ধীরে ফিকে শ্লেট রঙে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা আকাশটা। হঠাৎ দূরে ফুটপথে নজর পড়ে তার। ছেঁড়া-ন্যাকড়া পরা ভিখিরি এক মা পরম যত্নে চুল আঁকড়ে দিচ্ছে তার বাচ্চা মেয়েটার। একটা স্বর্গীয় মা মা আলো যেন ঠিকরে পড়ছে ভিখিরি মায়ের মুখ থেকে। সহসা তাকে খুব ধনী আর নিজেকে খুব গরীব মনে হতে লাগল মল্লিকার। সমস্ত বুকটা হু হু করে উঠল। দৌড়ে ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। এখন শোবার ঘরটা অন্ধকার। অনেকক্ষণ শুয়ে আছে মল্লিকা। ঠাকুরঘর থেকে শাঁখ আর ঘন্টা বাজানোর শব্দ পেল। বোধহয় চম্পা মাসী সন্ধে দিচ্ছে। উত্তরের ব্যালকনির দরজাটা আর ঘরের জানালাগুলো খোলা। সেদিক দিয়ে বাইরের স্ট্রীট লাইটের আলো আর তিরতিরে উত্তুরে বাতাস ঘরে ঢুকে লুটেপুটি খাচ্ছে। সন্ধে ঘন হতেই খোলা জানালার দিয়ে দূরের হাইরাইজ আবাসনগুলোর আলোকিত খোপ খোপ জানালা দেখা যাচ্ছে। আনমনে সেই আলোর দিকে তাকিয়ে মল্লিকা ভাবছিল ওই আলো, হাসি, গান ক্রমশঃ কি তার থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে? কতদিন ছাদ আর বারান্দার গাছগুলোর পরিচর্চা করা হয় নি! কত্তদিন রেওয়াজেও বসেনি সে! জীবন কেমন যেন থেমে গেছে। সব ইচ্ছেগুলো হঠাৎ যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে! কৃষ্ণেন্দুও কেমন থম মেরে গেছে আজকাল। তিন বছর বিয়ে হয়েছে তাদের। আগে কখনও এমন দেখেনি হুল্লোড়বাজ, আড্ডাবাজ কৃষ্ণেন্দুকে। নিজেকে বড় অপরাধী মনেহচ্ছে মল্লিকার। কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রাখতে পারছে না। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে আসে। তখনই দরজা খোলার খুট করে একটা শব্দ হতে সেই চেনা মিষ্টি বকুলফুল ফ্লেভারের পারফিউমের গন্ধটা নাক ছুঁয়ে দিল মল্লিকার আর তার কপালে সেই চিরন্তন শীতল স্পর্শ... মা-আ-আ-আ। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল সে। তার ভিতরের সমস্ত নোনা জল যেন গল গল করে বেরিয়ে আসছে।
চিরটাকাল মেয়ের সমস্ত লড়াইয়ের পাশে থেকেছেন অপরাজিতা। আজ মেয়ের এই কান্নায় বড় অসহায় বোধ করতে লাগলেন তিনি। মেয়েকে ঘিরেই তো তাঁর জীবন আবর্তিত হয়ে চলেছে আজও। মনটাকে এক লহমায় শক্ত করে নিয়ে তিনি বললেন,
— " বী ব্রেভ, মলি! কান্নায় তো কোন সলিউশন উঠে আসবে না। ওঠ। শক্ত হ।
চল তো আজ দু'জনে একটু রেওয়াজে বসি। বহুদিন এই সব নানা চক্করে তোতে -আমাতে ডুয়েট গাওয়া হয় না।"।
— " নাহ্। ভালোলাগছে না,মা। কিচ্ছু ভালোলাগে না আজকাল।"
— "না না ওঠ। শরীর ও সর্বোপরি মন দুইই তো সুস্থ রাখতে হবে, মা। চল চল... আর আমি তো আছি সোনা। একটু ভাবতে দে আমাকে।"
বলতে বলতে নিজের বড় ট্রলিটা টেনে ঘরের এক কোণে রাখেন অপরাজিতা।
— এই বুড়ো হাড়েও একটু বাতাস লাগুক দেখিনি। দিন-রাত তোর বাবার ফাই-ফরমাশ খেটে খেটে জীবন আমার একেবারে কয়লা হয়ে গেল রে। গলা থেকে সুর তো বিদায় নিতে বসেছে। চল আজ মায়ে-ঝিয়ে একটু প্রাণ খুলে গাই।"
পরিবেশটাকে হালকা করবার চেষ্টা করেন অপরাজিতা।
মা এলে যেন এক ঝলক তাজা আনন্দ বাতাস বয়ে যায় মল্লিকার মনে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— " কে আমার মাকে বুড়ো বলে শুনি?
কার এত বড় সাহস? তুমি তো এভার
গ্রীন, মা! ছেচল্লিশেও ইউ আর লুকিং লাইক ছত্রিশ।"
— " সেকি! একেবারে দশ বছর কমিয়ে দিলি? এটা একটু বেশি হয়ে গেল না? হাঃ হাঃ হাঃ... "
শব্দ করে হাসতে থাকেন অপরাজিতা।
— " মোটেও না। তোমাকে আমাকে একসঙ্গে দেখলে আজও বন্ধুরা বলে কাকীমাকে দেখতে তোর দিদির মতো লাগে!
দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে মল্লিকা।
— " নে নে কথা রেখে এবার তানপুরাটা নিয়ে আয় তো। নয়তো তুই বোস, চম্পাকে দিয়ে যেতে বলি।"
অপরাজিতা তাড়া লাগান মেয়েকে।
— "তোমার জীবনীশক্তি অফুরান, মা। আচ্ছা, তুমি আজই চলে যাবে না তো ?"
মল্লিকা জিজ্ঞেস করে।
— "না রে। ক'দিন থাকব বলেই এসেছি।
কিছুদিন মেয়ের আদর খেয়ে যাই।"
হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে নিজের জামা-কাপড়গুলো বের করতে থাকেন তিনি ।
—"সত্যিইইইই??? ইয়া হু... তা তোমার পোষ্য, তোমার বাগান, তোমার অফিসের কি হবে? "
আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে মল্লিকা।
— " সব কিছু থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়েছি। আমার এই সোনাটার জন্য।"
বলে মল্লিকার চিবুক ছুঁয়ে আদর করেন অপরাজিতা।
আজ সকালে উঠে বহুদিন পর তার ছাদ বাগানে এসেছে মল্লিকা। ছাদেই নানা সাইজের টবে তার বহু গাছ। বোগেনভিলিয়া গাছে ঝেঁপে ডীপ পিঙ্ক কালারের ফুল এসেছে। বেলি ফুটেছে থোকা থোকা। চোখ বুজে বাতাসে ছড়ানো তার মিষ্টি গন্ধটা নাকে টেনে নিল। এছাড়া রয়েছে নিম, লেবু, লাউ মাচা প্রভৃতি। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে যেন মর্নিং প্রেয়ার করছে। সকালের নরম রোদে সবকিছু ভারী ভালোলাগে মল্লিকার। শখ করে একটা বড় সিমেন্টের টবে সবেদা গাছ লাগিয়ে -ছে কৃষ্ণেন্দু। ভালো ফলও হয় তাতে। সবেদা গাছটার তলায় মৃদু মৃদু বাতাসে আলো-ছায়া এক্কা-দোক্কা খেলছে৷ সববেদার ডালে বাসা বেঁধেছে একটা চড়ুই পরিবার। তারাই কিচিরমিচির করছে। হঠাৎ মল্লিকা দেখে খুব ছোট্ট তিনটি চড়ুই ছানা হাঁ করে মুখ উঁচু করে আছে আর চড়ুই মা ঠোঁটে করে তুলে তাদের খাবার খাইয়ে দিচ্ছে! কী সুন্দর দৃশ্য! বিভোর হয়ে চেয়ে থাকে সে। চড়ুই মাও কত ভাগ্যবতী। সেও মা! চোখ জলে ভরে ওঠে মল্লিকার। ভগবান শুধু তাকেই মাতৃত্বের সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। অভিমান গাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে৷ সহসা মল্লিকা অনুভব করে করে তার পিঠে কোমল হাতের সেই পরিচিত স্পর্শ। এই স্পর্শই তাকে বার বার কঠিন পরিস্থিতির মুখেও আগলে ধরে...
— " আপনার নাম?
— "অপরাজিতা দত্তগুপ্ত।'
"আপনার ঠিকমতো পিরিয়ড হয় তো?"
— হ্যাঁ।
— "ফ্লো কেমন? ক'দিন থাকে?"
সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করেন ডঃ মুখার্জি।
—" ফ্লো ভালোই। ওই মোটামুটি পাঁচদিন
থাকে।"
— " আগে কাউকে কখনও এগ ডোনেট করেছেন ?"
ডঃ মুখার্জি জানতে চান।
— " নাহ্..."
— " বয়স কত আপনার? বাচ্চা আছে?"
পর পর প্রশ্ন করেন ডঃ মুখার্জি।
— " ছেচল্লিশ। হ্যাঁ, একটি মেয়ে আমার।
আপনার পেশেন্ট মল্লিকা সেন আমারই মেয়ে। আমি আমার মেয়েকেই ডিম্বাণু
ডোনেট করতে চাই।"
এবার সোজাসুজি অপরাজিতার চোখে
চোখ রেখে ডঃ মুখার্জি বলে ওঠেন,
— " মিসেস দত্তগুপ্ত , 'ল'জ্ রিলেটেড টু ডোনেশন অফ এগ ইন ইন্ডিয়া'-তে
এগ-ডোনারের বয়স কিন্ত পঁয়ত্রিশ উল্লেখ আছে। আর মা তাঁর মেয়েকে এগ ডোনেট করতে চাইছে এক্ষেত্রে কোন লিগ্যাল ইসু হলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।"
— " সেটা আমরা জানি, ডাক্তারবাবু। লিগ্যাল ব্যাপারগুলো আমরাই দেখে নিচ্ছি। আপনি পরবর্তী ধাপের দিকে এগিয়ে চলুন।"
এবার সোজাসুজি উত্তর দেয় মল্লিকা।
— " ওওকে।"
তাহলে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে নিই,
— "আপনার মাকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে উর্বরতার ওষুধ খেতে হবে। এই ওষুধগুলি সাধারণত মৌখিকভাবে বা সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হবে, যা ডিম্বাশয়ের ফলিকলগুলিকে উদ্দীপিত করবে। এটি একটি নিয়মিত চক্রের চেয়ে বেশি ডিম্বাণু পরিপক্ক করে।"
— "ঠিক আছে কোন অসুবিধে নেই।"
অপরাজিতা উত্তর দেন।
একটু থেমে ডাক্তারবাবু আবার বলতে
শুরু করেন,
— " ডিম্বাশয় উদ্দীপিত হওয়ার পরে, আপনার ডিম্বাণু এবং ফলিকুলার বিকাশের নিরীক্ষণের জন্য আপনাকে আমাদের এখানে ৫-৭ বার আসতে আসতে হবে। আর এটিই সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ অংশ।"
— "ঠিক আছে, তাই আসব।"
অপরাজিতা সম্মতি জানান।
সুরেলা রিংটোনে ফোনটা অনেকক্ষণ থেকে বেজে চলেছে। বাগানের অর্কিডগুলোর পরিচর্চা করছিল মল্লিকা। আজকাল প্রায় সময়ই গাছদের সঙ্গে কাটায় সে। মন ভালো থাকে। মাঝে মাঝে যেতে হয় ডঃ মুখার্জির ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকে। বাকী সময়টা গান শোনে, বই পড়ে। মা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসে রয়েছেন তার কাছে। তিনি আর চম্পা মাসী মিলে সংসারের সব কাজ সামলে নিচ্ছেন।
ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে মল্লিকা। দেখে ডঃ মুখার্জির ক্লিনিক থেকে ফোন,
— "হ্যালো... "
— "মিসেস্ মল্লিকা সেন ম্যাডাম
বলছেন?
— " হ্যাঁ, বলছি।"
—" অভিনন্দন ম্যাডাম! আপনি কনসিভ
করেছেন। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট এসে গেছে। তিন সপ্তাহ হয়েছে..."
মল্লিকা ফোন রেখে ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। অপরাজিতাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে হু হু করে কেঁদে ফেলে সে।