Friday, May 3, 2024


 



" এক যে আছে মা...."

রীনা সাহা 


   
           বারেবারে হাত ধোয়া,স্যানিটাইজ করা, সকাল থেকে রাত eye drop দেওয়া। বিরক্তির রঙ লাল? হবে হয়তো। তবে কালো চশমা পড়া মায়ের চোখের দিকে তাকালে সব বিরক্তি সাদা হয়ে যায়। 
    
       বাইরে থেকে দেখে মাকে এখন অন্ধ লাগে। তবু বেশ বুঝতে পারি কালো চশমার ভেতর থেকে  এক হৃদয়ের সঙ্গী খোঁজে মা, অকালমৃত ছেলেকে খোঁজে। দু'জনের কেউ বেঁচে নেই, তবুও খোঁজে।

       যে ছেলে বেঁচে নেই, তার সঙ্গে কিডনি ডোনার মায়ের একটা কিডনি পুড়ে ছাই। আর একটা ফ্যামিলি পেনশনে চলে। মোটা মাইনের রিটায়ার্ড বড় ছেলে, বৌমা আর মা। তবুও মায়ের ভাগের অর্ধেক পেনশন না হলে সংসার সুখের হয় না। পঁচাত্তরের মা যতটা খাবার খায় তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দেয় , পাড়াপড়শির এ যুক্তি ধোপে টেকে না।

      হাতে পায়ে এখনও সচল মা, রান্নাঘরের সাইড হেল্পার। বড় ছেলের মার্বেল মোড়া বিল্ডিং হবে।ভালবাসায় অন্ধ মা, নিজের অংশ লিখে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ভুলেও ভাবেনি নিজের টিনশেডের ঘর আর বাথরুম পুরোনো হবার অজুহাতে ক'দিন বাদেই বেমানান হবে। 

       ইদানিং মায়ের দুচোখে পুরু ছানি, অপারেশন হবে। বৌমার আবদার, ছেলের আদেশ---- মেয়ের ফ্ল্যাট ছোট হলেও সেখানেই যেতে হবে। একেবারে দুচোখের ছানি কাটিয়ে, পুরোপুরি অন্ধত্ব সারিয়ে তবেই যেন বাড়ি ফেরে মা। নিজের বাড়িতে "survival of the fittest " হয়ে কতদিন থাকতে পারবে, বৌমার চার তলার ঠাকুরও হয়তো জানে না।

        এখনো কি মায়ের চোখে তেমনি রাগ থাকবে , যে রাগ ছেলেমেয়েদের ছোটবেলায় ছিল। পড়তে বসতে দেরি হলে বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা হাতে ঘরময় দাপিয়ে বেড়ানো কিংবা স্কুল থেকে বাবা ফিরে এলে বদমাইশির ফিরিস্তি দিয়ে মার খাইয়ে স্বস্তি পাওয়া---- মায়ের চোখের কালো চশমা খোলার অপেক্ষায় মেয়ে।

       নাতি- নাতনির ছোটবেলাও বড় হয়েছে, ঠাকুমার আদর- সোহাগে। কোটিপতি নাতি, আমেরিকায়। নাতনি ফ্রান্সে। বড় বালাই টাইম- ডিসট্যান্স। ঠাকুমার সাথে কথা হয় না। আমেরিকায় যখন দিন, ভারতে মাঝরাত। মেয়ে বোঝায়, মা বোঝে না।

       সাতদিন পার, মা এখন মুখ ধোয়। চোখে জল যায়। একটুআধটু জল লাগলেও ক্ষতি নেই, মা জানে। লুকিয়ে রাখা মোবাইল ঘাঁটে, ফাঁকা কল লগ। চোখে জল আসে। তড়িঘড়ি কালো চশমা,  ওয়াইপার খোঁজে।

           দশ বাই দশ ফুটের satin finish Dulux দেয়াল, গুমোট লাগে। তাই দুচোখে ড্রপ দেওয়া হলে এক মিনিট শুয়ে থেকে ছাদে উঠে যায়। হাজার স্কোয়ার ফিটের তেপান্তরের মাঠ। একান্নবর্তী পরিবারের পূর্ববাংলার মেয়ে, বড় বাড়ির মা, Parapet দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ের বাড়ির আকাশ থেকে নিজের বাড়ির আকাশ খোঁজে। সে আকাশ ছেলের ব্যূহে, বধ্যভূমি কুরুক্ষেত্রে।

           কালো চশমায় গান্ধারী মা, যদুবংশের কথা ভাবে। এ যুগের পরশুরামের বাক্যবাণে আধমরা মা। তবু নিজের বংশ ধ্বংস চায় না, অভিশাপ দেয় না। উপেক্ষায় বিদ্ধ মা উলুপীর মতো, পরশমণির ছোঁয়ায় বাঁচিয়ে তোলে অর্জুন। বেঁচে যায় বব্রুবাহন।

        বিদুরের খুদে তৃপ্ত মা, পরের জন্মে মা হলেও, সন্তান চায় না। তাঁর চোখের সবটা জুড়ে ছাদ আকাশের সূর্য এখন। হাতে ধরা কবচ কুণ্ডল। কর্ণের মতো ছেলে হোক ---- লড়াই করে ছিনিয়ে আনুক মায়ের বাড়ি, টিনশেডের সাম্রাজ্য।

           নিরীহ মা, " নিলোভনা " হতে পারেনি। চোখে চোখ রেখে বলতে পারেনি "A man can be destroyed but not defeated". দুর্বল মা, পুরু ছানির বাধা সরিয়ে অস্তিত্বের লড়াই লড়তে পারেনি। তাই Marmee March মায়ের চোখে সাদা চশমা ওঠার অপেক্ষায় মেয়ে।

No comments:

Post a Comment