Thursday, May 2, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



দুটি লেখা 

চন্দ্রানী চৌধুরী



অপেক্ষা

মায়ের শুধু অপেক্ষা ছিল। আর কিছু না। কবে ছেলে বড় হবে। স্কুল শেষে কলেজ যাবে। দশের মাঝে তুলবে মাথা গর্ব ভরে। ছেলে কবে চাকরি পাবে।  উন্নতিতে আকাশ ছোঁবে। ছেলের নিজের বাড়ি হবে ; একটুখানি মাটি হবে। ছেলের ভরা সংসার হবে।‌ ভালোবাসায় সিক্ত হবে। 
গোপন মনের সুপ্ত কথা গোপন করে রাখতো মা চিলেকোঠার ঘরে কাঠের সিন্দুকে রাখা লুকোনো সম্পদের মতো।‌ চুপিচুপি বলত শুধু ছেলের কাছে। 
স্কুল শেষে কলেজ গেল। চাকরি হল। বিদেশ। উন্নতিও। ছেলের নিজের বাড়ি হল। ভালোবাসার মানুষ এলো। 
তবু মায়ের অপেক্ষাই ছিল। দিনের পর দিন যায়। বাঁশের খুঁটির অন্তরালে নিজেকে আড়াল করে মায়ের শুধুই অপেক্ষা। দিনের আলো নিভে গেলে একাকী ভাবতো বসে ফিরবে ছেলে সঙ্গে আলো আনবে ঘরে। 
দিন ফুরোলে মুহূর্তও দ্রুত হারিয়ে যায়। মায়ের আয়ুষ্কাল ফুরোলে চেনা ছবি ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে ওঠে।‌ মায়ের শোবার ঘরে, বিছানায়, দেবতাসনে পড়ে থাকে পুরোনো ছবি, অ্যালবাম আর অতীত কথা। শুধু হারিয়ে যায় মমতামাখা আঁচল আর মায়ের অপেক্ষা....




মাতৃত্ব 

সন্তানের জন্মের দিন একটি মেয়ের দ্বিতীয়বার জন্ম হয় । প্রথমবারে সে মেয়ে হয়ে জন্মেছিল আর দ্বিতীয়বারে সে মা হয়ে জন্মগ্রহন করে। এ অনুভূতি অন্য কোনো অনুভূতির সাথে মেলে না। আবেগ, দায়িত্ববোধ,মমতা, স্নেহ আর শর্তহীন ভালোবাসা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। জীবনের লক্ষ্য টাও রাতারাতি পাল্টে যায়। সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন মা সবসময় সন্তানের প্রয়োজনে সন্তানের পাশে থাকেন। 
কিছুদিন আগে ট্রেন থেকে নেমে গাড়ির জন্য  প্রিপেডের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রমহিলা হুইল চেয়ারে করে ট্রেন থেকে ওনার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে লাইনে দাঁড়ালেন।ছেলেটি আনুমানিক ২৫ বছরের। পা দুটো অকেজো ; হাঁটতে পারে না ; বেশ বড়সড় চেহারা। আর ভদ্রমহিলাকে দেখলাম রোগা মতোন ছোটোখাটো চেহারার। গাড়ি বুক হয়ে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা ঐ চেহারা নিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে তুলছেন দেখে চারপাশের সবাই এগিয়ে এলো সাহায্য করার জন্য। কিন্তু উনি কারোর সাহায্য নিলেন না।  বললেন 
“ আপনারা ব্যস্ত হবেন না ; আমার অভ্যেস আছে।” ওনারা গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম ঐ রোগা চেহারা নিয়ে অতো বড়সড় চেহারার ছেলেকে ভদ্রমহিলা কোলে তুলে নিলেন কি করে !! 
এ ঘটনা অনেকদিন পর্যন্ত আমার মনে গেঁথেছিল। শুধুমাত্র মনের জোরে এ কাজ সম্ভব হয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস। তিনি জানেন যে তিনি ঐ অসুস্থ সন্তানের মা ; কাজেই সন্তানের প্রয়োজনে তাকে সব কাজ পারতেই হবে।
তবে ভদ্রমহিলার স্বাস্থ্য যদি আরেকটু ভালো হত তাহলে ওনার হয়ত শারীরিক কষ্ট আরেকটু কম হত। কিন্তু সমস্যা হল বেশিরভাগ মায়েরাই এটা বুঝতে চায় না যে সন্তানের জন্য সংসারের জন্য বিশেষত তার নিজের জন্যও সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী। আর সেজন্য তাকে প্রয়োজন মতো খাওয়াদাওয়াও করতে হবে । এখনও এমন অনেক মা আছেন যারা মাছ মাংস ছেলেমেয়ে ভালোবাসে বলে তাদের বেশিরভাগটা দিয়ে নিজে সামান্যতম খাবার খান । চল্লিশ পেরোলেই মেয়েদের শরীর দুর্বল হতে থাকে।শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তাছাড়া বেশিরভাগ মেয়েরাই এখন ঘরে বাইরে দু দিকেই কাজ করে । তাদের এই পরিশ্রমের ফলে শরীরে অনেকটা ঘাটতি দেখা দেয় । আর এই ঘাটতি পূরণ করতে গেলে অবশ্যই ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে।আমার মাকে ও সবসময় বলি “ অনেক ত বয়স হল , এবার অন্তত নিজের খাওয়া দাওয়াটা ঠিক মতো করো । যতদিন বাঁচবে  যেন সুস্থ ভাবে থাকতে পারো সেকথা মনে করে চলো । তুমি শুধু কারো স্ত্রী বা মা নও .. তুমি একজন আলাদা মানুষও “। মা মানেই আমার নিজস্ব জীবন বলে কিছু থাকবে না এমন কিন্তু না।
পরিবারের সবার সাথে পছন্দের আদান প্রদান জীবনে খুব জরুরী। মা নামক ব্যাক্তিটির পছন্দ অপছন্দ নিয়ে সংসারে যে অবহেলা হয় আমি তার ঘোরতর বিরোধী।
সব মেয়েদের অর্থাৎ  যারা মা হয়েছো অথবা ভবিষ্যতে মা হবে সবাইকে আামি একটি কথাই বলতে চাই “ জীবনে কোন পরিস্থিতিতেই নিজের জন্য বাঁচতে ভুলো না”।

No comments:

Post a Comment