Thursday, May 2, 2024



মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 




আমার মা
রীতা মোদক


ছোটো বেলায় দেখতাম মা সারাদিন শুধু কাজে ব্যস্ত  থাকতো । আমরা চার বোন , বাবা - মা , ঠাকুমা ঠাকুরদাদা মিলে আটজন ছিলাম । মা একা হাতেই সব সামলাত। মা রান্না ঘরে রান্না করতো , আমি একটা বড় পিঁড়িতে বই রেখে , আর একটা পিঁড়িতে বসে জোরে জোরে পড়তাম। ভুল হলে মা খুন্তি নাড়তে নাড়তেই পড়া বলে দিতো,কখনও দৌঁড়ে এসে লেখা ঠিক করে দিয়েছে। গরমের রাতে উঠোনে চট পেতে মাঝখানে একটা হেরিকেন রেখে চার বোন একসাথে পড়তাম । মা পাশে বসে জামা  কাপড় সেলাই করতো , কখনো বা কাগজের ঠোঙ্গা বানাতে বানাতে আমাদের পড়া দেখিয়ে দিতো ।আমার যখন ক্লাস টেন, তখন মা আমার পড়াশুনো এবং থাকার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করে দেয়। ভালোকরে পড়াশুনার জন্য মায়ের ছিল করা শাসন। সেটাও ছিলো নিয়মের মধ্যে।মায়ের নিয়ম ছিলো সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পড়তে হবে।আবার ভোর চারটা থেকে উঠে পড়তে হবে।আমার ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হতো।কিন্তু মা চারটার আগে থেকে ডাকতেই থাকতো। যদি না উঠি তাহলে চুল ধরে উঠিয়ে দিতেন।আমি মাঝে মাঝে রাগ করে চুল কেটে ফেলতাম।অত ভোরবেলায় জাগিয়ে দেওয়ার জন্য মায়ের দিকে মনে মনে খুব রাগ করতাম। মা বলতো, ভোরের পড়া মনে থাকে।আমার গল্পের বই পড়ার খুব নেশা ছিল। যে গল্প উপন্যাস পড়তাম শেষ না হলে ভালো লাগতো না। কাহিনীর শেষটুকো জানার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম।কিন্তু মা বেশী রাত পর্যন্ত কিছুতেই পড়তে দিতো না, লাইট অফ করে ঘুমানোর জন্য বলতে থাকতো। মায়ের এরকম নিয়মাবলী-আদর -শাসন  ছিলো বলেই আমরা মানুষ হতে পেরেছি।আমার কাছে আমার  মা প্রথম শিক্ষাগুরু ।
অভাবের সংসার। আমরা বেড়ে উঠছি দ্রুত। আমাদের নিয়ে পাড়ার লোকেদের যেন চিন্তার শেষ ছিল না। তারা প্রায়শই মাকে বলত -- "দেখতে দেখতে তোমার মেয়েরা তো উপযুক্ত হইয়া গেল। বিয়া দিবা কিভাবে?কেউ কেউ বলতো --- মেয়েছেলেদের এতো পড়াশোনা করাইয়া কি লাভ? এদের গতি করার ব্যাবস্থা কোরো।"
মা বলতো -- "আমার মেয়েরাই ঘরের লক্ষী । আমি আপনি চিন্তা করার কেউ না।এদের ভাগ্যে যা আছে  তাই হবে।"
হতে পারে আমার মা অতটা স্মার্ট নয় l শহুরে কায়দায় ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে পারে না l মাঝে মাঝে রাগ উঠলে মাথা গরম হয়ে যায় l তবু ও আমার মা আমার কাছে আদর্শ নারী lআমার মা  আমার কাছে  দুর্গা মায়ের থেকে কম কিছু নয়।বাড়ির  সবকিছু  মা একা হাতেই সামলে রাখে।  পড়াশোনার পাশাপাশি আচার -ব্যাবহার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো,  শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল --- এসব কিছুই আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা। সুখ দুঃখে, অসুখ বিসুখে মা সব সময় আমাদের আগলে রাখে। আমরা যদি কখনো কোন ব্যাথা পাই অথবা যদি কোথাও আঘাত লেগে যায় তখন সবার আগে মা-গো.. বলে চিৎকার করে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে মা ছুটে এসে নিজের শাড়ির আচল ছিড়ে ক্ষতস্থানে বেঁধে দেয়। মায়ের মমতা মাখানো হাতের স্পর্শ সব বেদনা ভুলিয়ে দেয়।তখন যেন  মায়ের- আদর -ভালোবাসা -স্নেহের টান মা দুর্গাকে ছাপিয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে।

 

No comments:

Post a Comment