মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
মা
শান্তনা বর্মন
পৃথিবী সুন্দর যার জন্য সেই জন্মদাত্রি "মা" যার সমগ্র বর্ণনা দিলেও মনে হয় অসমাপ্ত থেকেই যায়। "মা" একটি ছোট্ট শব্দ। এই শব্দের মাঝেই লুকিয়ে আছে-মায়া,মমতা,নিঃস্বার্থ ভালবাসার সব সুখের চাবিকাঠি। সেই মা'কেই যখন পাগলিনীর মতো এলোকেশী,ঠুটো হাত ,সাদাবস্ত্র পড়া দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম দিনটা ৩১ শে মে , ২০০৭ সময় সন্ধ্যা ৫.৪৫ মিনিট বাবা পরিবার,পরিজন ও পৃথিবীর সমস্ত মায়া,মমতা কাটিয়ে পরলোক গমন করলেন। সেই দিনের পর থেকে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে ও ভয় হতো মনে হতো ইনি কে? অচেনা কোনো মহিলা আগে এই রূপে কাউকে দেখিনি। মায়ের কাছেও যেতে পারতামনা ভয়ে বার বার শুধু মনে হতো পিতৃস্নেহর পাশাপাশি বুঝি মাতৃস্নেহ থেকেও বঞ্ছিত হলাম ।আসলে তখন আমি সবে ষোড়োষী,ভয় লাগারই কথা আমার জন্ম থেকেই দীর্ঘ ষোলো বৎসরযাবৎকাল মায়ের পরনে রঙীন শাড়ি, মাথায় চওড়া সিঁথি তাতে রাঙা সিঁদুরে ভরাট থাকতো, হাতে সাদা শাখা,লাল পলা ঠিক যেনো কোনও গৃহদেবী ।আর তাকেই আজ দেখছি বিবর্ণ,ফ্যাকাসে,এলোকেশী বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যায়।
কিন্তু "মা" তো শান্তির নীড়,শক্তির আধার ।পিতৃস্নেহ বঞ্চিত আজ আমি ষোলো থেকে তেত্রিশ এ পদার্পন করলাম মা আগলে রেখেছে গোটা পরিবার,তার ছেলে-মেয়েদেরকে।
আগেকার দিনে মেয়েদের খুব কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো আমার "মা"এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছর কাটিয়েছেন যৌথপরিবারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর উপক্রম সেখানে সাজসজ্জা, আর বিলাসিতা মনে আনাও পাপ। ইচ্ছে থাকলেও কিছু সময় উপায় হয়না ,নিজের সমস্ত শখ-আল্লাদ যেন গলা টিপে হত্যা করেছে। সংসারে আবদ্ধ থেকেছে বাইরের জগৎ কি তা অধরাই ছিল। যখুনি মা ছেলে-পুলেদের বড়ো করলো একটু সুখের মুখ দেখবে ভেবেছিল মনে ঠিক সেই সময় বাবাও গত হলেন।নিজেরা ভালো থাকার পাশাপাশি মাকে ভালো রাখার,হাসি-খুশি রাখার দায়িত্বও বর্তায় প্রতিটি সন্তানের।কথায় বলেনা,মেয়েরা তো মায়ের-ই জাত তাই মায়ের কিসে সুখানুভূতি আর চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া জল দুঃখের না আনন্দের তা মেয়েরাই বেশি বুঝতে পারে। আমার বাবা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থাকার দরুন যখন মাঝে-মধ্যই পেনশনের জন্য মাকে নিয়ে বাইরে বেরোই তখন বুঝতে পারতাম দু-চার জন লোকের সঙ্গে বাক্যালাপ হলে মা এক মানসিক শান্তি অনুভব করে। আমার পিতৃ বিয়োগের পর মাকে দেখতাম নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে রাখতে,মুখ লুকিয়ে কাঁদতে ছেলে-মেয়েদের ভালো রাখতে,মানুষ করতে চোখের জল আড়ালে রাখতে। " মা জননী" বুঝি এ জন্যই বলে,জীবতকালে আমার বাবা দীর্ঘ সাত বৎসর পারালাইসিস রোগে ভুগছিলেন নিজে হাতে খাবার উঠিয়ে খেতেও পারতেন না। তখন মাকে দেখতাম -সংসারের সমস্ত কাজ সামলে,যত্নসহকারে বাবাকে খাইয়ে দেওয়া, ধৈর্য্য নিয়ে গোটা পরিবারকে ভালবাসার চাদরে মুড়ে রাখতে।কখনো মুখে-চোখে বিরক্তির কোনও প্রকাশ নেই।
সময় চলে যায় নদীর স্রোতের ন্যায় তোমার আট ছেলে-মেয়ে আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত কেবল আমি ছাড়া।খুব মনে পরে যখন তোমায় নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতাম তোমায় বলতাম তোমার যা যা লাগবে বলো,তুমি সেই তুমিই রয়ে গেলে আমার সবেই তো আছে আর কি নেবো ।আমার মা কখনও পাঁচতারা হোটেল খেতে চায়না,রাস্তার মোড়ে মিষ্টি দোকান থেকে এক বাটি রসমালাই আর সবশেষে রসনাতৃপ্তির জন্য একটা মিষ্টি পান তাতেই খুশি।
মায়েরা বার বার মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পরে। ছেলের ঘরের চার নাতি-নাত্নি নিয়ে মায়ের দিন কাট ছিল ভালোই হঠাত্ এক দমকা হাওয়া পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে যে যার মতো নিজেদের গুছিয়ে নিল সংসার।ছোট ছেলে শহরে চলে গেল তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে এদিকে গ্রামের বাড়িতে দুই ছেলে, বৌ,নাতনিদের নিয়ে থাকলেও যৌথপরিবারে থাকা ছোটছেলের মুখ খানি বার বার অন্তরে ভেসে ওঠে।।মা মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে কেন এমন ছেলেবেলায় ভাই-বোনে কত হাসি মজা করে একসঙ্গে দিন কাটিয়েছে আর বড়ো হলেই ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই।একদিন ছোটছেলের সঙ্গে মা গেলো শহরে ছোট ছেলের বাড়িতে কিছুদিন থেকে তার যেন মনে হচ্ছিলো স্বামীর ভিটে মাটি ছেড়ে চলে এসে শ্বাসরুদ্ধ লাগছে।গ্রামের বাড়িতে থাকা নাতনিদের মুখগুলো মানস পটে ভেসে উটছে।আসলে আমার মা বরাবর-ই গ্রামের মানুষ, গ্রামে থেকে অভ্যস্ত তাই শহরের চার দেওয়ালে বন্দি জীবনে তার দম আটকে আসার উপক্রম।আবার যখন বেশিদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে থাকে তখন শহুরে থাকা নাতির জন্য মন কেমন কেমন করে।
মা বরাবরই কাজ পাগল,বেশিক্ষন বসে থাকতে পারেনা।বয়স অনুযায়ী তার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন কিন্তু এই তিয়াত্তর বছর বয়সে এসেও মা এখনো উনুনে রান্না করা থেকে সমস্ত সাংসারিক কাজ করে ।হয়তো আমরা এখনকার দিনের মেয়েরা এই বয়সে এসে এতটা কাজ করতে পারবো না নিঃসন্দেহে।আমরা বারণ করলে বলে , আমি বসে থাকলে শরীর অসুস্থ বোধ করি কাজে যে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় তাতে শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে।
আজ ভেবে ভেবে অনেক কষ্ট হয় মা ,আজ বুঝতে পারি মা হওয়া সহজ কথা নয়।যখন পড়াশোনা সূত্রে বাইরে থাকতাম বাড়ি গিয়ে অকারণে তোমার উপর রাগ করতাম,চিত্কার করতাম রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে তুমি পাশে জেগে বসে থাকো।পারলে আমায় ক্ষমা করো মা।তোমাকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা করি,ভালোবাসি আর আগলে রাখতে চাই তোমায় আঁকড়ে সারাটা জীবন বাঁচতে চাই "মা"। জীবনে চলার পথ অনেক কঠিন ও সংগ্রামের কিন্তু "মা" পাশে থাকলে সব বাধা অতিক্রম করে সফলতা পাওয়া যায়।
No comments:
Post a Comment