মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
ইন এ নাটশ্যেল
রণিতা দত্ত
চার কুড়ি ছুঁইছুঁই বয়সী আমার মা। আর মধ্য পঞ্চাশ পেরিয়ে এই আমি, ওই মায়ের মেয়ে । মায়ের জীবনের গল্পটা গুছিয়ে বলবে এমন কথকঠাকুর মেলেনি কখনো ।প্রথম পুরুষে গল্প বলার বলার লোক ছিলনা। মায়েরও বলার তেমন গরজ ছিলনা ।আসলে যুগটাই ছিল অদ্যপান্তু প্রচারবিমুখ যুগ । মায়ের স্কেচ আখরে বানাতে গিয়ে খুঁজে পেলাম কিছু সাদাকালো ফ্ল্যাশব্যাক, জীবনপথের মুসাফিদের টুকরো কথা আর ফ্যাকাশে হয়ে আসা খান কতক পেপার কাটিং। হ্যাঁ,মায়ের ওই গলার কাছটায় যখন অভিমানটা দলাপাকায়, তখন স্বাভাবিক আবেগে মুখ ফসকে বলে ফেলা অগোছালো নিজের অতীতের কথা । কুড়িয়ে নিই। জুড়ে দেই,চেষ্টা করি নাগাল পেতে ।
বেলা শুরু থেকে বেলা শেষে এসে পৌঁছে যাচ্ছি। গোটা জীবনটা এই ছোট্ট শহরে কাটিয়ে দিলেম। আর্থ সামাজিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বদলেছে শহরটা।তবু আজও সে শহরে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হই। ভিন্ন-ভিন্ন বৃত্তে দীর্ঘকাল কাজে ব্যাপৃত থাকা একজন মানুষের এই পরিচিতিটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যি বলছি, এই মানুষটিকে সব্বাই কেমন যেন অতিরিক্ত আন্তরিক ভাবে ভালোবেসে। মনে হয় আমার বাবাকে কব্বে হারিয়ে দিয়েছে আমার মা বা বাবা কোনদিন এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেইনি | পরিচিতেরা যখন দেখা হলে মাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে। তখন ভীষণ অহংকার হয়। একটু-আধটু হিংসেও যে হয় না তেমন নয়। কারণ ওর মত গন্ডি ভেঙে মানুষকে কাছে টানতে হয়তো পারিনা। পারিনা নিঃস্বার্থভাবে, অহেতুক ভালোবাসতে । মাকেই অনুকরণ করি। আন্তরিক হয়ে পরিচিত মহলে মেলামেশা করি ।সচষ্ট থাকি সহজে মিশে যাওয়ার জন্য । মনে হয়,কোথাও ফাঁক থেকে যাচ্ছে। তেল জলের মিশ্রণ। চেষ্টা করেও মিশিয়ে নিতে পারি না। মনে হয়, নিজের মা যেন আমাকে হারিয়ে দিচ্ছে। হেরেও যাই। নিজের কাছে হেরে যাই । নিজের ত্রুটি ঢাকতে মায়েরই খুঁত ধরি । বলি -"তুমি নিজেকে ঠিকমতো ক্যরি করতে পারো না মা । টুক করে নাগালের মধ্যে চলে আসো সকলের। সকলের ঘ্যানঘ্যানানি শোনো কেন । খেয়ে কাজকর্ম নেই তোমার।" কি সাংঘাতিক সাইকোলজিক্যাল এনপ্যাথি দেখুন আমি হেরে গিয়েও গলাবাজি করি। ভারি উদাসীন নিরুত্তাপ থেকে যায় আমার মা ।
মজার কথা আমার মা এই ইন্ডিয়ায় ক'টা দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিলো। বয়োস্কোপের ডিরেক্টর পেলে সিনেমা বানিয়ে নিতো এমন গল্প এটা। সে'বার , (১৯৬১ সাল ) পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাট্রিকের গেজেটে বেরোলো। দেখা গেল, এই মা মরা মেয়েটার নাম সব্বার ওপরে। ইস্কুলের হেড মাস্টার মামুদ সুলতান এরকম একটা কিছু ভেবে ছিলেন আগে থাকতে । তখন নম্বরের ক্রম অনুসারে ভর্তি। ঢাকার ডাক্তারি কলেজে মেয়েটার নাম এক নম্বরে। ডাক্তারির পড়া কি অল্পস্বল্প ব্যাপার ! কিছু বছর আগেই পরিবারগুলো কাঁটাতারের বেড়ার এদিক ওদিকে ছিটকে গেছে। ইন্ডিয়ায় মেয়ের পিসি জ্যাঠা। ওদের ওখানে ঘুরে এসে মন বসাবে ডাক্তারি পড়ায়- সেরকম একটা কিছু ভাবনা ছিল মেয়েটার মনে । লালমণিহাট দিয়ে এসে পৌঁছলো ইন্ডিয়ায় । সে আসার পর ওদিকের পরিস্থিতি ঘোরালো হল। শাসকের অন্যায়ে সরব দাদার ছোট বোন আমার মা। টার্গেট হয়ে গেছে ততদিনে । যদিও মা এখনো মনে প্রাণে অবিশ্বাস করে দেখেশুনে বড় করলো যে লুৎফা খালা, নুসরাৎ আপ্পু, প্রাণের বন্ধু রোকেয়া, পড়াশুনোয় প্রতিদ্বন্দ্বি ছোটবেলার বন্ধু শহিদুল আর প্রাতঃ স্মরণীয় মাস্টারমশাই মামুদ সুলতান এরা? এরা কখনো কি ওর কোনরকম ক্ষতি হতে দিত। যাইহোক, বড়রা বলেছিল 'ফেরা হবে না' তাই হল না আর । কিছুদিন চলে গেল কান্নাকাটি করে। সরকারি কলেজে সাইন্স আছে। অন্ততঃ বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে । পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিল, কিন্তু আইন আটকে দিল । মাইগ্রেশন নেই। হবে না সরকারি কলেজে ভর্তি। আবার ধাক্কা। ওই সময় দিনহাটা কলেজে পি ইউ আর পাসকোর্সে ডিগ্রি পড়ানো হত । অনার্স পড়ানোর অনুমোদন ছিলনা। ইউনিভার্সিটি যাতে -"আরে বাহ্ " করে পিঠ চাপড়ে অনার্স খুলতে অনুমতি দেয় সেজন্য উঠে পড়ে লেগেছেন অধ্যাপকরা। দু চারজন সম্ভবনা আছে এমন স্টুডেন্ট পেলে রেজাল্ট ভালো করে দেখানো যায়। সুযোগ এসে গেল। একবার নয়, পরপর তিনবার। দু বছর আগে ওই কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল শ্রীযুক্ত মতিলাল বিশ্বাসের মেয়ে পি ইউ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হল। পরের বছর বিখ্যাত সংবাদ পাঠক অনিল সরকার তৃতীয় । এবারে দুবেণী ঝুলিয়ে কলেজে আসা মেয়েটি যা একটু ভরসা। যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে বেশ দেরিতে, প্রায় সেশনের মাঝে এসে ভর্তি হয়েছে। যে আত্মীয়দের টানে ইন্ডিয়া আসা তারা ভাইঝি থেকে যাচ্ছে শুনে দূরত্ব বাড়িয়েছে। কোন এক বাড়িতে সে তখন আশ্রয় পেয়েছে। ওই সব পেয়িং গেস্ট কনসেপ্ট তখন কোথায়? আর থাকলেও পে করবে কে? বাড়ির বাচ্চাগুলোকে অংক ইংরেজি পড়ালে ই থাকতে দিত ওসময়। দিনহাটা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক 'এ বি স্যার 'তো বলেন গত দু বছরে ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষের সব দরখাস্ত নাকি ওই মেয়েটার হাতের লেখায় জমা পড়েছে। ভালো ইংরেজি লেখে মেয়েটা। কে. ডি স্যারের কথায় বোঝাযায় একাউন্টেন্সির অংক ফসফস করে দেয়। আপসোস,নেহাত পিওর ম্যাথ নেই কলেজে। থাকলে বাজি মাত করতে পারতো এ মেয়ে। কিন্তু সব্বার আশঙ্কা শঙ্কা দূর করে মেয়েটিই পি ইউ তে প্রথম। এবারে অনার্স খুলল দিনহাটা কলেজে। গপ্পো বলে দিলাম। গাঁজাখুরি নেই। কেউ এখনো থেকে থাকবেন যিনি এই রূপকথার গল্পের সাক্ষ্য দিতে পারবেন। যাগ্গে।
এই শহরে কেটেছে মায়ের কলেজবেলা। পরবর্তী দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবন। স্বনামধন্য কোন এক মানুষের সহধর্মিনী মা । চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও আঠারো বছর। সবসময়েই মা ব্যস্ত ওর কাজ নিয়ে । আমাদের নজরে যদিও ওগুলোর বেশিরভাগই 'উটকো কাজ'। 'উটকো কাজ' কি ? -যেমন ধরুন, সর্বশিক্ষার এক 'এস এস কে'। শহর থেকে দূরে। সরাসরি যাতাযাতের যানবাহন নেই বড় একটা ।শহরের নামি ইস্কুলের পর ওখানকার হেড পোস্ট।অস্বাভাবিক, বেমানান। ঘাবড়ে যাবে যে শুনবে সে ! " কেন এই সিদ্ধান্ত? " যদি এটা প্রশ্ন হতো, তাহলে উত্তর ছিল , "কয়েকটা ছেলেমেয়ের চাকরির ব্যাপার "। নিজের পেনশন আছে। তাই এস এস কে থেকে প্রাপ্য রিমোনারেশনটা ওই স্বল্প বেতনভগী ছেলেমেয়েগুলোর । ৬৫ পর্যন্ত মা ওদের বাইকে স্কুটিতে করে গিয়ে ইস্কুল করেছে। মেয়ের বিয়ে, বইকেনা, ফর্ম ফিল আপ, টিউশন ফি, চিকিৎসার খরচ এ'গুলো সেসময় তো প্রায় সকলকে করতে। তবে দারিদ্রতা দূর করতে মা পার্মানেন্ট সলিউশনে বিশ্বাসী। মধ্যবিত্তদের এই মানসিকতা কম দেখেছি। কাজের প্রচার নেই, পেছনে বা সামনে কোন সংস্থা বা সমবায় সংগঠন নেই । হয়তো লেডি ব্রেবন ডিপ্লোমা করিয়ে দিল। সেলাই মেশিন কিনে থান কাপড় কিনে সায়া বানিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিত। কখনো আবার নার্সিং ট্রেনিং এ ভর্তি করিয়ে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা । এছাড়া চলতো অবৈতনিক কোচিং সেন্টার, দাতব্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ এর ব্যবস্থা।-ওর টাইমলাইনে দাঁড়িয়ে ভেবে ফেলা এবং করে দেখানো খুব পরিণত ও পারদর্শী কাজ। নিঃশব্দে ঘটতো এসব ।হয়তো তারা মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে এলে আমি কেন, আমার বাবাও তখন জানতেন। আমি লিখছি জানলে হয়তো বকুনি খাবো । মা এখন বাচ্চাদের মত অভিমানী। আমাদের বকে না আর । কোভিড পরিস্থিতিতে নিজে ঘর ছাড়তে পারেনি খানিকটা আমাদের ভয়ে, খানিকটা ঘরে সংক্রামন প্রবেশের ভয়ে। কিন্তু মা সেসময় ঘর ছাড়াদের সাথে থেকেছে। যতটা পেরেছে সংকট সামলাতে হাত বাড়িয়েছে। বয়স বা শারীরিক অপারগতার তোয়াক্কা না করে এখনো ভর দুপুরে বেরিয়ে পরে ট্রেজারি, ডি আই অফিস ব্যাঙ্ক -নিজের বা বয়স্কা সহকর্মীদের লাইফ সার্টিফিকেট জমা, পাস-বই আপ ডেট, পেনশন স্কেল রিভাইজ এসব সামান্য কাজ নিয়ে। নিজের হাত দুটো এখন মায়ের প্রায় অকেজো। কাজের তাই বলে বিরাম নাই । যেতে "না" বলে লাভ কিছু হয়না। তাই এই করে ভালো থাকবে ভেবে বলা বন্ধ করে দিয়েছি আমরা ।যতদিন পারে করুক।
আমার মায়ের মনে বড় একটা খেদ রয়েছে । খেদ এই যে মায়ের স্মৃতির থলিতে নিজের মায়ের ছিটেফোঁটা স্মৃতি নেই। তখনকার দিনে আরও দশটি বহুপ্রসবা রুগ্না মায়ের মত আমার দিদার কনিষ্ঠা সন্তানটি বেড়ে উঠেছে মাতৃস্নেহহারা ।এই মাতৃস্নেহ বঞ্চনা নিয়ে একটা লেগেসি আছে আমাদের মা মেয়ে ও আমার মেয়ের মধ্যে । সংসারে প্রতিটি সম্পর্ককে নিখুঁত ভাবে ধরে রাখাতে দেখেছি মাকে। এব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্ব আমার মায়ের । হয়তো একএক সময় মনে হয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে ফেলে মা । আমার তথাকথিত দায়িত্বকর্তব্যে সচেতন মা, যদি আমাদের প্রত্যাশিত কোন দায়িত্বে বিচ্যুতি ঘটিয়ে থেকেছে । যেগুলো নেহাত ই সামান্য হয়তো বা নগন্য। কিন্তু আমাদের মত চিরকাল হাতের নাগালে না চাইতেই সব পেয়ে উচ্ছন্যে যাওয়া অপগন্ড সন্তানদের কাছে সেগুলো প্রকান্ড বিচ্যুতি বলে মনে হয় । সন্তানদের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকলে আমরা, সন্তানরা মিলি মাইক্রন ও ছেড়ে কথা বলি না মাকে। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী আমার মা তখন হঠাৎ করে সংকুচিত হয়ে পড়ে। আমার মেয়েরও অনেক অভিযোগ থাকে আমার ওপর । মেয়ে,ওর মায়ের সাথে অন্য মায়েদের আচরণগত বৈসাদৃশ্য নিয়ে অভিযোগ করে । আমি তখন সহজে মুক্তি পেতে আমার মাকে ই সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত করি।" ওই একটা পারফর্মেন্সই আপ টু দ্য মার্ক নয় দিদার । কিভাবে আমি ওই ফিল্ডে পারফেক্ট হব।" অজুহাত যেন তৈরী থাকে।স্ট্রাইকারটা মায়ের দিকে তাক করে অভিযোগগুলো ঠকাঠক মেরে দেই। লাল সাদা কালো গুটি ক্যারামের বোর্ড থেকে (আমার নিজের ঘাড় থেকে )পকেটে (মায়ের ঘাড়ে ) ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি।
আবার ধরুন, মাকে পুজো দেখাতে নিয়ে গেছি। হ্যাঁ, এখন আগের দিন তো নেই। দাবার বোর্ড এখন উল্টে গেছে। আগে ওর হাত ধরে , এখন ও আমাদের হাত ধরে।অসম্ভব ভীড়। তাদের মধ্যে ইতিউতি পরিচিতমুখ পরিচিতির নিরিখে কেউ বেশি কেউ অল্প। কেউ আবার সম্ভাব্য পরিচিত। কেউই দেখি আমার মায়ের নজর এড়ায় না। ডেকে ডেকে কুশলবার্তা নেওয়াটা কি ব্যাক ডেটেড বলুন দেখি। এমনও হয় তো মাঝে মধ্যে একআধজন কেউ , যার সঙ্গে বহু বছর পর দেখা, ঠিক মনে পড়ছে পড়ছে না, চেনাচেনা লাগছে -- এমন। হয় তো! মায়ের ক্ষেত্রে ওরকম সিন্ হওয়ার কোন সম্ভবনা বিন্দুমাত্র থাকে না। সকলের নথি যেন ওঁর স্মৃতির দোরাজে ঝকঝকে তকতকে সাজানো । ক্ষেত্র বিশেষে, কাউকে দেখেও না দেখার মত করে এড়িয়ে যাওয়া -এগুলো করতে মাকে কখনো দেখিনি। বরং পরিচিত কেউ নজরে পড়লে মায়ের মুখে ফুটে ওঠে হলদে মোম গলা জোৎস্নার মত হাসি। সে হাসি দাম মিলিয়ন ডলার।সেই হাসিটুকু অমলিন থাকুক আমার মায়ের মুখে।
No comments:
Post a Comment