মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
তুমি কিছু দিয়ে যাও...
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
চুড়ির রিন ঠিন, শাঁখা পলার মিলে মিশে যাওয়া শব্দ কোনদিন মোছেনি।কুসংস্কারের গুচ্ছ তালে আমরা ঘুচিয়ে দিয়েছি অনেকেই। না, তোমাদের অস্ব্ত্তি ছিলনা সে সব শব্দের। বয়সের ক্লান্তি কোনদিন পড়েনি। শুধুই দেখেছি দিয়ে যাওয়া। দিতে গেলে যে শুধু মন নয়, অর্থের জোর বাস্তবিক, সেও কি পরিপূর্ণ ছিল! কিন্তু শিখেছি, না, হা-হুতাশ না কখনোই, বিশেষত আত্মজ আত্মজার সামনে টুঁ শব্দটি না। সুতরাং দু:খ সমুদ্র জমে যেত দু'টি উদার ভেজা হাতের অন্তরে। আমার শৈশব থেকে যৌবন কাল আশ পাশ পরিবেশ কেবল জানিয়েছে অন্ত:রঙ্গে বহি রঙ্গে কেবল নারীসত্তাটুকু ছাড়া সবটাই'বাবা' কেন্দ্রিক। আমিও জেনেছি, খুশি হয়েছি সেই শিশুকাল থেকে যৌথ বাড়ির আদরে বড় হতে হতে পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্য, আর নিজস্ব চেতনায় বাবাই আমার ধ্যান জ্ঞান ভালবাসা অভিমত উৎসার অভিজ্ঞতা। ধীরে নিজস্বী তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসাও তাঁরই মত।
ক্লান্ত চোখ নিয়ে পিছনে তাকাই। ঠিক তোমার চলে যাওয়ার আগে পরে কিছুদিন থেকেই নিজেকে বলেছি, "বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কি... " একটু একটু করে ক্ষরণ শুরু হল। উপলব্ধি অনুভবে সে আমার 'মা' হয়ে ওঠায় নয়, আমার অন্তর্গত সত্তা বহুদিন থেকে জানিয়েছে কষ্টে দীর্ণ হচ্ছে একজন। যে সারাদিন তোমার কথা ভাবছে। ক্ষণজন্মা রুগ্ন এক সন্তানের জন্য অহরহ সুস্থ রাখার কথা ভাবছে।
পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকেই বাইরের জগতের একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলে তুমি। তৎকালীন সতের বছর বয়সে সরকারী চাকরী, অসাধারণ অভিনয়। ঐ অভিনয়েই প্রেমকে চেনা। আর গড়িয়ে যাওয়া সময় আনন্দে বিষাদে। বুঝতে পেরেছি অনেক পরে সেই কবেই অশ্রুজল শুকিয়ে ফেলেছিলেন এক বালিকা বধূ, প্রথম পুত্র সন্তানের অবহেলার মৃত্যুতে, সঙ্গে বিয়ের পর পর বাড়ি থেকে জ্যেষ্ঠা কন্যা বেরিয়ে গেছে জেনে তাঁর ব্রাহ্মণ পিতার ব্রাহ্মনত্বের অভিশাপ! সব জয় করে নিয়েছিল শিখর চূড়ার বুকভরা ভালবাসা, অদ্ভুত নিরাসক্তিতে দেখেছিল সে বালিকা বধূ মাত্র সতেরতেই, তার কুশপুত্তলিকা লকলক আগুনে দগ্ধ হচ্ছে, মেয়েকে অস্বীকৃতি কোন ব্রাহ্মণ পিতার। যার ঐ আস্ফালনটুকুই সার। আর অধিকার বজায় রাখার তীব্র বাসনা জ্যেষ্ঠা কন্যার প্রতি। শুধু অসবর্ণ বিবাহ নয়, বাকি নাবালক ছেলে মেয়েদের মানুষ করিয়ে নেওয়ার বাসনায় কর্মরতা জ্যেষ্ঠা কে বেঁধে রাখার অভিলাষী পিতার ক্রোধ আগুন হয়ে ঝরে পড়েছিল।
মেয়েও মুখ বুজে সহ্য করে লুকিয়ে, মার সঙ্গে দেখা করা, দারিদ্রতায় সঙ্গে থাকা আর শেষ বয়সে সেই অকারণ দোর্দণ্ড প্রতাপ মানুষটি জ্যেষ্ঠার হাত ধরে তারই নাম করতে করতেই বিদায় নিয়েছিল। কোথায় ধূলিস্যাৎ ততদিনে অভিমান কলুষতার প্রাচীর।
সবটাই আমার মার সহ্যশক্তি। যেটা বড় হয়ে উঠতে উঠতে অনুভব করেছি বাস্তবিকই।
যৌথ বাড়ির নানা কূট কৌশলের শিকার হতে বড় করুণ চোখে দেখেছি তখন, প্রতিবাদের প্রশ্ন ই আসেনা। 'ডেঁপো' 'পাকা' এসব তকমা তখন বাতাসে ঘোরে। মা কে কখনো ছোট হতে দেখতে ইচ্ছে করেনি। তাই এ নীরবতা। বড় পরিবারের এ উঠোন পেরিয়ে অন্য উঠোন... রান্নাঘর, কয়লা উনুন, গুল ঘুঁটের থমথমে অবস্থায় মাকে দেখেছি রূপবতী সাবলীল। একটা ছুটির দিন কি অনায়াসে তুলে রাখা কাজ পর পর সাজানো। বিকেলে মাথা ঘষা চুল ফুলে উঠতে। একঢাল চুলে বারান্দা বা উঠোনে ছড়িয়ে বসতেন মোড়ায়,উলের গুটির রঙবেরঙ দুরূহ সব ডিজাইনের সোয়েটার বুনতেন, অবশ্য ই সেটা শীতের দুপুর। কমলা রঙের রোদ্দুরের দুপুর। বিকেলে অথবা সন্ধেয় প্রায়দিনই নাটকের রিহার্সাল। আমার একেবারে ছোট্ট বেলায় বাবার অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবে সন্ধে বেলার রিহার্সাল, আমিতো থাকব ই। সমস্ত পার্ট মুখস্থ করে নেওয়া আমারও স্বভাব ছিল যে! বয়স পাঁচ বছর না হতেই মা বাবার সঙ্গে নাটক করেছি। পড়াশুনো, শাসন সব শিখিয়ে তোলার জন্য কখনো চাপ ছিলনা, দেখে শেখা ছিল সেই সময়ের শিক্ষা। বাবা যেমন বাইরের সবটা দেখছেন আর মায়ের দায়িত্ব, ইচ্ছের দৌড় মার মতই। সত্যি বলতে কি গান ভালবাসতেন খুব। প্রথম সংগীত শিক্ষার মাষ্টার মশাই এলেন আমাকে শেখাতে মার তত্ত্বাবধানে। উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীতে ভালবাসা থাকলেই তো শুধু হবেনা, তাকে সুস্থ সুন্দর সুচারুভাবে আয়ত্ব করতে হয় মা জানতেন। আমার বাড়ির ছেলেদের, বড়দের, কোন কোন দিদির গানের গলা , ভাব অপূর্ব ছিল, কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা। মা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিলেন বলতে গেলে। পড়াশুনোর ফাঁকে গানের চর্চার এক বড় জায়গা তৈরি হল। রবীন্দ্র চর্চা আর গান তো শেখা সেই কোন ছোটবেলা থেকে। এখনো যে মনে মনে মার উপস্থিতি টের পাই ঐ রবীন্দ্রসংগীত চর্চায়, রবীন্দ্রভারতী তে জোড়াসাঁকোয় পৌঁছতে পেরে। ডিগ্রী নিতে পেরেছি ঐ মার আশীর্বাদ ছিল বলেই।
অদ্ভুত মিঠেল আর মোহময় স্বর তাঁর। একের পর এক মুখস্থ বলতেন, 'কচ দেবযানী'... বিদায় অভিশাপ, 'কর্ণ কুন্তী সংবাদ'। মুগ্ধ হতাম। লোডশেডিং তখন বাঁধাধরা। কোন অসুবিধে হতোনা। সবাই মিলে চাঁদের আলোয়, কখনো বা মোমবাতির আলোর মধ্যে গান কবিতার খেলা খেলেছি।
আত্মীয়, বিশেষত, মামাবাড়ির দিকের দিদিমারা যখন উচ্চারণ করত, 'রুনু, তোর মেয়েটা তোর রঙ পায়নি'। মাকে লক্ষ্য করতাম মুখ ভার হয়ে যেত। মনে মনে রাগ হত তাঁর। ছোট্ট ক্ষুদে আমারও মার জন্য কষ্ট হত।
আসলে বেশিরভাগ মায়েদেরই বোধহয় সন্তানের জন্য নিজেকে নি:শেষ করে দিয়েই সুখ। মা কে শেষপর্যন্ত আমি সেভাবেই পেয়েছি। অসুস্থ অবস্থাতেও আমার কন্যা জন্মের পর ভার টুকু নিতে চেয়েছেন অক্ষম শরীরেই।
কত কথা যে মা কে বলা হয়নি! কত কথা তাঁরও বলার ছিল আমাকে। ফোনে (তখন ল্যান্ডফোন) ফিসফিস করে বলতেন,... 'পরে বলব তোকে... '
সেই পরে আর এলোনা। কত মানুষ ভাল মানুষের মুখোশে সত্যিকার যত্নে তুলে রাখার সম্পদকে অবহেলা করেছে। চরম অন্যায় করেছে। দায় আমিও এড়িয়ে যাইনা।
সেই ষাটের দশকে'এক পশলা বৃষ্টি' নাটকের জন্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কার তুলে নেওয়া শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, আবৃত্তির কত না পুরস্কার, শংসাপত্র , নাটক অভিনয়ে প্রথমদিকের মহিলা অভিনেত্রী যিনি উত্তর থেকে কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে নাটক করে পুরস্কৃত হয়েছেন। অসুস্থতায় বিছানায় যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত নাট্যচর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চায় নিজেকে যুক্ত রাখার ইচ্ছে বজায় রেখে গেছেন। উৎসাহ দিয়ে গেছেন সন্তানকে। শেষ মহূর্ত পর্যন্ত কষ্টমুক্ত রাখতে নিজের জমানো বুকের ব্যথা টুকু নিজের কাছেই রেখে দেওয়া মা আমার, ক্ষমা হয়ে নেমে আসুক তোমার আশীর্বাদ।
এখনো যে সহ্য করি, এখনো যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চোখ তুলে তাকাতে বা শব্দ করতে পারি, এখনো যে নিজেকে মানুষ হিসেবে আলাদা চোখে দেখি আর শত নেতিবাচক ভাবধারার বিরুদ্ধে অস্তিবাদী হতে পারি এবং সে শিক্ষাও দিতে পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর ভালবাসি মানুষ, সে তোমার জন্যই। একথা অকপটে সব অর্থেই আকাশের মত, এই বিরাট প্রকৃতির গাঢ় সবুজ রঙের মতই সত্যি। এখনো কষ্ট ব্যথায় জ্বরে বিনিদ্র রাতে তোমাকেই ভাবি বার বার। তোমার নরম আঁচল রেখ আমারই জন্য। বাতাসের নিবিড় স্পর্শে শাশ্বত হোক তোমাকে খোঁজা।
No comments:
Post a Comment