মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
আমার মা
শ্রাবণী সেন
আমার মনেহয় পৃথিবীর সব থেকে মধুর শব্দ হল মা। ভালোবাসি এই শব্দটির সঙ্গে যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে মা শব্দটিও। মা উচ্চারণ করলেই মনে যেন শান্তির প্রলেপ পড়ে যায়। একটি একটি করে বছর পার করে এই বর্তমানে এসে, পিছনে ফিরে তাকালে বুঝতে পারি মা আছেন বলে এই জীবনের পথ চলা অনেক সহজ হয়েছে।
আর সবায়ের মতই আমার মা আমার কাছে অনন্যা। খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে শিলিগুড়িতে আমাদের উঠোনে মা নোটস হাতে পায়চারি করতে করতে অনুচ্চ স্বরে পড়া মুখস্থ করছেন আর আমি পাশে পাশে একটা পোস্টকার্ড হাতে নিয়ে " কেমন আছ - ভালো আছি " বলতে বলতে ঘুরছি। মায়ের মাথায় এই এত্ত বড় খোঁপা আর আমার মাথায় মায়ের অনুকরণে মায়ের খোঁপার চেয়েও বড় তোয়ালের খোঁপা, আমার বায়নায় বাবা বেঁধে দিয়েছেন।
সেই কোন ছোট্টবেলায় আমার মা আমাদের দুই বোনকে নাচ শেখাতেন, শিলিগুড়ির সেই সুবিখ্যাত বর্ষায় আমরা "বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা", " মধুগন্ধে ভরা" নাচতাম। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে হে নূতন, হে চির নূতন, এই সব গান ছাড়াও রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করতে মা আমাদের শিখিয়েছিলেন। আমাদের সেই কোন ছোটবেলা থেকে নিয়মিত গান শেখা তাও মায়ের উৎসাহেই।
আমার মামারবাড়ি হুগলি জেলায়, মা স্কুল শেষ করেন চন্দননগরের সুবিখ্যাত কৃষ্ণভাবিনী নারী শিক্ষামন্দির থেকে। আই এ পাশ করেন কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে। বিয়ের পরে স্নাতক হন, অনেক বছর পরে স্নাতকোত্তর পড়েন। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর দুইটিই শেষ করেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে শিলিগুড়ির একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে মা দীর্ঘদিন সহপ্রধানশিক্ষিকার দ্বায়িত্বে ছিলেন।
সব মেয়েরাই মায়ের গুণমুগ্ধ হয় আমিও কোনো ব্যতিক্রম নই। আমার মায়ের সব থেকে বড় গুণ হল মায়ের প্রাণোচ্ছলতা এবং সবাইকে আপন করার গুণ। মা একদমই পরচর্চা পছন্দ করেন না, আমাদের মধ্যেও সযত্নে সেই অভ্যাস গড়ে দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সেলাই, সোয়েটার বোনা শিখিয়েছেন। দিদির আর আমার বই পড়ার অভ্যাসও মায়ের থেকে পাওয়া, অবশ্য আমার বাবাও বই পড়তে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় ভালো সিনেমা এলেই দেখাতে নিয়ে গেছেন আমাদের বাবা এবং মা।
এই আশি পার করা বয়সেও মা সেলাই করেন, সে যে সে সেলাই নয় কা়ঁথা স্টীচ করেন এখনো, সেলাইয়ের জন্য আঁকা ছবিটি নিজেই কপি করেন কাপড়ের ওপরে।
বাংলা, ইংরেজি বই পড়েন,শত খানিক রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং গোটা কুড়ি দীর্ঘ কবিতা এখনও মুখস্থ। আমি গাইতে গাইতে শব্দ ভুল করলে মা শুধরে দেন।
বর্তমানে মা তাঁর ছোট নাতি নাতবৌয়ের( আমার ছেলে বৌমা) কাছে এসেছেন আমাদের সাথে আকাশপথে পনেরোশো কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব পার করে ।
মনে পড়ে গেল আমার ছেলের জন্মের সময় মায়ের যত্নের কথা, আবার কলেজে পড়তে পড়তে ছেলে সংক্রামক অসুখে আক্রান্ত হয়ে মায়ের কাছে থেকেই উপযুক্ত চিকিৎসা ও পথ্যে সুস্থ হয়ে আবার কলেজে ফিরে গেছল। আমি বা প্রফেসার সেন কাজ ছেড়ে আসিনি, আমার ছেলে ফোনে বলেছিল " Maa, don't worry, I am in the best hands. "
এক জীবনে অনেক পথ পার হয়েছেন মা , আমার বাবার মৃত্যু মায়ের অর্ধাংশেরও অনেক বেশি কেড়ে নিয়েছে, তবুও অনিরুদ্ধ প্রাণশক্তি এবং সবার প্রতি প্রীতিপূর্ণ আচরণই মাকে এগিয়ে চলার পাথেয় জুগিয়েছে।
পার্থিব সম্পদের প্রতি অতি আসক্তি এবং অযথা আড়ম্বর আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনও দিনই ছিল না তার কারণ হয়তো মায়ের স্বল্পেসুখী মনোভাব যা তিনি আমাদের দুই বোনের মধ্যে বুনে দিতে পেরেছেন।
মায়ের কথা লিখতে গিয়ে গুছিয়ে লিখব এমন ক্ষমতা আমার নেই। একটি ঘটনা লিখে শেষ করব- বেশ কয়েক বছর আগে বাবা চলে যাবার পর মা তখন শিলিগুড়িতে একলাই থাকতেন, একজন সহায়িকা মাসি ঘরের কাজ করত আর একজন রাতে মায়ের কাছে থাকত। রাতে একলা থাকবেন না এই কথা দেওয়াতে আমরা মা'কে তখন বাড়িতে থাকতে বাধা দিইনি। যাইহোক তখন এক শীতের দিনে মা সামনের দোকান থেকে গোবিন্দভোগ চাল, চালগুঁড়ি, দুধ, খেজুরগুড় সব নিয়ে এসে অনেক রকম পিঠে আর পায়েস করেছেন, না নিজের জন্য নয় মায়ের ওই দুইজন সহায়িকার জন্য। আমার মায়ের রান্নার হাতযশ আছে। মা যখন ওদের সযত্নে সাজিয়েগুছিয়ে পরিবেশন করেছিলেন ওরা যতটা খুশি হয়েছিল অবাক হয়েছিল ততোধিক, এই আমার মা!
ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাই মায়ের আশীর্বাদের হাত যেন আমাদের মাথার ওপরে সুদীর্ঘ দিন থাকে। মা যেন এমনই সানন্দ এবং সুস্থ থাকেন দেহে মনে।
No comments:
Post a Comment