Friday, May 3, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



মা কে মনে পড়ে
অনিতা নাগ 


বৈশাখের তপ্ত দুপুরগুলোয়  বড্ড মন কেমন করা পেয়ে বসে। ঘরের বাইরেটাও কেমন নিশ্চুপ। রাস্তার কুকুর গুলোও কোথাও ছায়া খুঁজে আড়াল নিয়েছে। আমার ঘরের জানলা দিয়ে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যায়, সে তারা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল রঙের লুকোচুরি। চারদিকের শূন্যতার মাঝে সবুজ ডালপালা মেলে সে দিব্যি আছে। নিজের মধ্যে বিভোর। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার উপায় নেই। বড্ড তাপ। জানলায় মোটা পর্দা টেনে দিয়ে নিজেকে আগলে রাখি তাপ থেকে। ঠান্ডা মেশিনের হাওয়া ছুঁয়ে যায় শরীর। কিন্তু মন তার ডানা মেলে উড়ে চলে ছোটবেলার দিনগুলোয়। খুঁজে বেড়ায় ছড়িয়ে থাকা মণি মাণিক্যগুলো। আজকাল তোমার কথা বড্ড মনে পড়ে গো মা। 

বহুদিন তোমার সাথে কথা হয়নি। আজকাল তোমার চিঠিও আসে না। সুদূরে যেখানে ঘর বেঁধেছো, সেখানে কি একটাও পোস্ট-অফিস নেই?   এই জুলাইতে আট বছর হবে তোমাকে দেখিনি। ওমা! হাসছো কেনো! ঠিক বলেছো। দেখা তো রোজই হয়। রোজ সকালে যখন চোখ মেলে নতুন দিনের পরশ পাই, তখন সবার আগে তুমিই তো আমাকে ছুঁয়ে যাও। তোমার আত্মজা তোমার পরশ নিয়েই দিন শুরু করে। তবু, তবুও মাগো, তোমাকে ছুঁতে চায় মন। সারাদিনের ব্যস্ততায় ছুটে চলা সময়ের সাথে ছুটতে ছুটতে থমকে যাই আমি। 

আজকাল প্রায়ই সেই ছোটবেলাতে ফিরতে ইচ্ছে করে।  সদর দরজা পেরিয়ে উঠোন। উঠোনের একদিকে রান্নাঘর আর কয়লার ঘর, অন্নদিকে ভাঁড়ার ঘর। রান্নাঘরে জোড়া উনুন পাতা। সেই উনুনের সামনে  আটপৌরে করে পড়া সাধারণ শাড়ী, মাথায়  এলো খোপা, আগুনের তাতে লাল হওয়া ফর্সা মুখ তোমার! রাজ্যের ব্যস্ততা। একান্নবর্তী পরিবারের সকলের সব ঝক্কি সামলাতে ব্যাস্ত। জানো মা, তোমার এই চেহারাটাই আজকাল বেশী মনে পড়ে। 

 সকাল থেকে সারাদিনের বেশীটাই সংসার সামলাতে কেটে যেতো তোমার।  সংসারের শতেক ঝক্কি  সামলেও কতো কিছু করতে তুমি। তোমার নিজের ভালোলাগা ছিলো সেলাই। সোয়েটার বুনতে খুব ভালো বাসতে।  তোমার করা এমব্রয়ডারি কাজ কি নিঁখুত! তোমার মতো অতো নিঁখুত করে সূঁচ দিয়ে নক্সা তুলতে আমি পারি না। কি সুন্দর কাঁথা করতে তুমি। আমার মেয়েকে, ছেলেকে কতো নক্সা করে কাঁথা করে দিয়েছো। সব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তোমার মেয়ে কিন্তু পারলো না। নাতির জন্য কাঁথা করবো ভেবেও করা হলো না।  জানো মা, এখন অনলাইনে সব পাওয়া যায়। কষ্ট করে না বানালেও হয়। হাতের সামনে সহজ উপায় থাকায় সেলাই ফোঁড়াই সব শিকেয় উঠেছে।  তবে কি জানো তো, আত্মজা যে! কতোকিছু আবার তোমার মতো পেরেও যাই। 

আজও আপনজনদের  সোয়েটার বানিয়ে দিতে ভালো লাগে। নারকোল নাড়ু, চন্দ্রপুলি বানিয়ে খাওয়াতে ভালো লাগে।বাড়ীতে কাউকে ডাকলে নিজে রান্না করে খাওয়াতে ভালো লাগে। সবাই গজগজ করে। কেনো যে ঝামেলা করো! অর্ডার করলেই তো হয়। তখন তোমার কথা মনে পড়ে। কতোদিন তোমার হাতের থোড়ের ঘন্ট খাওয়া হয় নি। একবারটি যদি আসতে ফিরে, সব সাধ মিটিয়ে নিতাম। আমার  বিয়ের পর যখন প্রবাসে সংসার পাতলাম  তুমি চিঠিতে  সব রান্নার রেসিপি লিখে পাঠাতে! আমি সে'সব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এখনো ছোলার ডালের বরফি,  ডালপুরি, আমতেলের মশলা,  সব সেই লেখা দেখে করি। মাথায় থাক আমার ইউ টিউবের রেসিপি। 

 পুরোনো বাড়ী ছেড়ে যখন আমাদের নতুন বাড়ীতে এলাম , তখন পাতা উনুনের জায়গায় তোলা উনুন এলো। একটা ঘরে চাপাচাপি করে থাকতে হতো না। তোমার হাতের সুন্দর রঙীন নক্সার মতো বাড়ীটাকে সাজিয়েছিলে তুমি। কতো বড়ো বাড়ী। পুরোনো বাড়ীর মতো সিঁড়ি ভেঙে উপর নীচ করা নেই। আজো চোখ বুজলে সবটা ছবির মতো দেখতে পাই। তুমি চলে যাওয়ার পর আর যাওয়া হয়নি সেখানে। আজ সবটাই স্মৃতি। তবুও সেই  বাড়ীর আনাচ কানাচ আজও আমাকে জড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ। তোমার জন্যই নামকরা স্কুলে পড়া। নাচটাও তোমার ইচ্ছেতেই শেখা। মনে পড়ে যেদিন নাচের ক্লাস থাকতো তাড়াতাড়ি কাজ সেরে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে। নাচের কম্পিটিশনে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে জলযোগের মিষ্টির দোকানের জলভরা তালশাঁস সন্দেশ দেখিয়ে বলতে সব বিভাগে সেরা হলেই একটা জলভরা আমার! সন্দেশের লোভে কিনা জানিনা, তবে তোমার সে কথা রাখতে পেরেছি সবসময়। আজ সেটা ভেবে খুব ভালো লাগে গো মা। 

তোমার সেই আলো আলো মুখটা দেখতে পাই। আজ তো সব কিছুই বড় সহজলভ্য।  বড্ড অনায়াসে পাওয়া যায় বলেই তার কদর গিয়েছে কমে। সে'দিন আলমারি গোছাতে গিয়ে একটা ব্যাগের মধ্যে পেলাম আমার পুরোনো মেডেলগুলো। বিবর্ণ, অবহেলিত।  আজ আর ওগুলোর কোনো দাম নেই। এই মেডেলগুলোর সাথে কতো স্বপ্ন, কতো অধ্যাবসায় জড়িয়ে আছে। মাগো, বোধহয় এমনি হয়। আজ যা অমূল্য কাল তা ধুলোয় মলিন। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কান্না তোমাকে মনে করায় বারবার।  আমার রান্নাঘরে এখন কতো রকমের গ্যাজেট। উনুন ধরাতে হয় না।  শীলে মশলা বাটতে হয় না। তরকারী বারবার গরম করা নেই। গরম থেকে বাঁচানোর জন্য বেঁচে যাওয়া তরকারি  কলাই এর কাঁসিতে জলে বসিয়ে কাপড়  চাপা দিয়ে রাখতে তুমি।  আমাদের ঘরে একটা কালো কুঁজো থাকতো। খুব ঠান্ডা হতো জল।এখন কুঁজো পাওয়া যায় কিনা জানি না। তবে আমি একটা কলসী আনিয়েছি। কলসীর ঠান্ডা  জলের শীতলতায় কেমন এক মন কেমন করা মিশে থাকে। 

গরমে কতো রকমের আচার বানাতে তুমি। গুড় আম, আমের মোরব্বা, আমের জেলি। সে'সব আচার আমি তো চুরি করেই ফাঁকা করে দিতাম। কি বকতে তুমি! তারপর মিটসেফে তুলে তালা দিয়ে দিতে। সে'যে কি দুঃখ আমার! যা হারিয়ে যায় তা আগলে রাখার চেষ্টা করি আমি। ঠাকুর ঘরে শিবের মাথায় জল দিতে গিয়ে মনে পড়ে তোমার কথা। তোমার পূজিত মহাদেব এসেছেন আমার কাছে। পুরোনো বাসন গুছোতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া কলাইয়ের কাঁসিতে তোমার স্পর্শ খুঁজি। আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি তোমার ছোঁয়া লাগা সেই কলাইয়ের কাঁসি।  চটের উপর উলের নক্সা করা আসনগুলোও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখি। মনে হয় তোমার পরশ পেলাম।

বিকেল হলেই গা ধুয়ে, চুল বেঁধে হিমানী স্নো লাগাতে তুমি। কপালে সিঁদুরের টিপ। পরিপাটি করে বাঁধা চুল।  তাতেই কতো সুন্দর লাগতো তোমায়। তখন তো তেমন করে  দেখা হয় নি তোমায়। এখন দেখি। বারবার দেখি। আশ মেটে না।

বাবা চলে যাবার পর বড্ড একা হয়ে গিয়েছিলে তুমি। নিজ গৃহে পরবাসীর মতো অবস্থা তোমার। আমি তোমার কষ্ট কমাতে পারিনি। কলকাতায় ফিরলাম যখন প্রবাস থেকে তখন তুমি একেবারে অন্যরকম। খুব কষ্ট হতো আমার। একদিন যে মানুষটা সারাদিন ছুটে বেড়াতো সকলের জন্য, শেষটায় তার চলৎশক্তি ছিলো না। এই শেষের দিনগুলোতে তুমি একেবারে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলে।  তবু বাড়ী ছেড়ে কোথাও যেতে চাওনি। একেবারেই চলে গেলে। এতো দূরে চলে গেছো যে তোমার নাগাল আর পাই না । তবু তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছো সবসময়। আমার শিক্ষায়, আমার সংস্কারে, আমার গানের সুরে, আমার নাচের ছন্দে তুমি জড়িয়ে আছো আমায়। 

তোমার বিদায় কালে তোমার অস্তি ভাসিয়ে দিয়ে সুরে সুরে তোমাকে অর্ঘ্য দিয়েছিলাম “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে,  এ'জীবন পুণ্য কর দহন দানে”।  

তোমার শেষ পরশটুকু আগলে রেখেছি আপন মনের গভীর গহনে, পরম সংগোপনে। 

একটা সুর আজকাল জড়িয়ে থাকে আমায়
“ শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, 
তোমারি সুরটি আমার
মুখের 'পরে, বুকের 'পরে”।।

No comments:

Post a Comment