মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
বিনোদিনী দাসীর সাহিত্যকীর্তি/আজকের ভাবনা/অন্য এক অনুভূতি
সঞ্জয় সাহা (এস.সাহা)
বাংলা কবিতার জগতে উনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহিলা বহু কবি যেমন জনমানসে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন, তেমনি আরও অনেক কবি সুযোগ ইত্যাদির অভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছেন, তাঁদের নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। এইসব ব্রাত্য কবিদের কবিতা যদি আমরা অনুসন্ধান শুরু করি তাহলে দেখতে পাবো তার ভেতর অনেক অনুভূতি উঠে আসবে, যা হয়তো তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত মহিলা কবিদের থেকে কোন অংশে কম নয়। যেসব মহিলারা প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন তাদের ভাগ্যের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে তারা পতিতালয় কিংবা নাট্যমঞ্চ থেকে এসেছেন, তারা যে কতখানি ঘৃণার পাত্র সমাজে তা সে সময়ের সামাজিক অবস্থান দেখলে বোঝা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে যাদের প্রথমেই দু-মুঠ অন্ন'র জন্য ঘৃণিত পথ অবলম্বন করতে হয়, তাদের ভেতরেও যে সুকুমার বৃত্তি আছে সে সন্ধান কে রাখবে। ঠিক এইরকম এক ব্রাত্য কবি বিনোদিনী দাসী। তাঁকে যতখানি আমরা বাজারি গণিকা ও রঙ্গমঞ্চের 'নটী' হিসেবে জানি, কিন্তু তিনি যে অনবদ্য কবিতাও লিখে গেছেন তা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায় ও পুস্তক-আকারে, সে খবর আমরা কজন জানি? তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে নাটক, ছায়াছবি ও সফল যাত্রাপালা তৈরি হয়েছে। দুঃখের বিষয় যে, সেগুলিতে তাঁর সুকুমার বৃত্তির থেকে কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলো সামনে আনা হয়েছে। বিনোদিনীর একমাত্র প্রামাণ্য প্রামাণ্য জীবন কথা দারি লিখিত "আমার কথা" কাব্যগ্রন্থ থেকে আমরা তাঁরই জীবনের অনেকটাই জানতে পারি। তাঁর জীবনের সার্ধ-শতবর্ষ পার হলেও তাঁকে নিয়ে দু একটি উদ্যোগ ছাড়া বিশেষ কোনো কার্যক্রমের সন্ধান পায়নি। যার ফলে তাঁর উপর মানুষের আগ্রহ তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি।
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের প্রথম যুগের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসির নামে আগে এখনও 'নটী' শব্দটি চালু থাকা ও নটী'র আগে একজন গণিকা বা পতিতা হিসেবে আরও বেশি করে জনসাধারণের সামনে তাঁর ইমেজ থেকে যাওয়া ইত্যাদি তাঁর সার্ধ জন্মবর্ষ পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পরিবর্তন হল না। এমন কি তাঁর স্বপ্নের স্টার থিয়েটার তাঁরই নাম অনুসারে 'বি' থিয়েটার করার ইচ্ছাও কারোর না থাকা বুঝিয়ে দেয় জনমানসে তাঁর 'মর্যাদা' কতখানি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁকে নিয়ে বর্তমানে যাত্রাপালা,সিনেমা কিংবা ঘোরার গাড়িতে বিনোদিনী সাজিয়ে পথ-পরিক্রমা ইত্যাদি ইত্যাদিতে কোন আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কলকাতা পৌরসভার পক্ষ থেকে স্টার থিয়েটারের পাশের রাস্তার নামকরণও "নটী বিনোদিনী"। ২০১৩ সালের ১৮ই এপ্রিল কালিন্দী নাট্য জনের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবের সূচনা হয়েছিল স্টার থিয়েটারে, সেখানে কলকাতা পৌরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে স্টার থিয়েটারের নামকরণ হবে "বিনোদিনী" মঞ্চ। কিন্তু এতদিনেও তা সম্ভব হলো না। অদ্ভুত এই সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর প্রতি বিভিন্ন বঞ্চনার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। এমনকি জেদি এই প্রতিভাময়ী তাঁর অভিনয় জীবনে গুরুদেব গিরিশচন্দ্র ঘোষকে "আমার কথা" আত্মজীবনীর ভূমিকা লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র সে অনুরোধ রক্ষা করলেও বিনোদিনীর সেই ভূমিকা পছন্দ না হওয়ায় তা তিনি প্রথম সংস্করণে প্রকাশ করেননি। পরে গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় সংস্করণে এই ভূমিকা প্রকাশ করেন। গিরিশচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার কারণে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী নটী বিনোদিনী । বাংলা রঙ্গমঞ্চে তার অবস্থান মাত্র ১২ বছর কিন্তু সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর বিচরণ প্রায় ৪০ বছর ।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে "ভারতবাসী" পত্রিকায় রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কীয় পত্রাবলীতে শুরু এবং ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে "রূপ ও রঙ্গ" সাপ্তাহিক পত্রিকায় স্মৃতিকথা দিয়ে শেষ হয়। যদিও দীর্ঘ ৪০ বছরে তিনি মাত্র দুটি কাব্য ও দুটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন । তা সংখ্যা নিরিখে স্বল্প হলেও সাহিত্যের দিক থেকে এক উচ্চমানের সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন । গিরিশ ঘোষ এর অনুপ্রেরণায় যে তার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায় । নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে গিরিশ ঘোষের সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বই নিয়ে এসে পড়াশুনা করতেন । এছাড়া তিনি ক্রিশ কোষের সাথে নিয়মিত বিভিন্ন পন্ডিত মানুষের আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়ে ইংরেজি ক্লিক ফরাসি জার্মান প্রভৃতি সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন । ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত বাসি সাপ্তাহিক পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ বিষয়ক পত্রাবুলের মাধ্যমে তার সাহিত্য জগতে পদার্পণ । প্রথম লেখাতেই পাঠক সমাজকে চমকে দিয়েছিলেন । এই পত্রাবলীর মাধ্যমে সেই সময় রঙ্গমঞ্চের বিভিন্ন বিষয় খুব সহজ সরলভাবে তুলে ধরেছিলেন । লেখাটা প্রকাশিত হবার পর বিদগ্ধ পাঠকেরা সেটা গিরিশ কোষের নিজের লেখা বিনোদিনীর নামে প্রকাশ করেছিলেন বলে সে সাবাস্ত করেছিলেন । এরপর টানা ১০ বছর নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছিলেন তিনি । ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে গিরিশ ঘোষ সম্পাদিত অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সৌরভ পতিকায় দুটি সংখ্যার হৃদয়রত্ন ও অবসাদ নামে দুটি কবিতা এবং কুড়ি পৃষ্ঠা দীর্ঘক কাব্য কাহিনী প্রকাশিত হয় । বিনোদিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বাসনা ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের মাকে উৎসর্গ করে প্রকাশিত করেছিলেন । এই কাব্যগ্রন্থে চল্লিশটি কবিতা এবং একটি আখ্যায়িকা কাব্য সংকলিত হয়েছে । তার অভিনয় প্রতিভার আড়ালে যে এক কবি প্রতিভা লুকায়িত ছিল তা তার কবিতাগুলোতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে । যেমন তিনি তার থিয়েটার জীবনের তীর্থ অভিজ্ঞতা ও স্বার্থ তাকে সঠিক মূল্য না পাওয়ার যন্ত্রনার স্মৃতি তার মনে যেমন দুঃখের অবতারণা করতো আবার অন্যদিকে সংসারে সবকিছুই অনেক তো সেটা উপলব্ধি করতো সেটি তার কাব্যগ্রন্থের স্থিতি কবিতা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন ।
"স্মৃতিলো বিষয়ে জ্বালা নিয়ো নাকো আর,
এ সংসারে চিরদিন কিছুই না বয়।
তবে কেন দুঃখ তুমি দাও অনিবার,
তুমি মনেপ্রানে জ্বালা অতিশয়।।
অস্থায়ী সংসারে কিছু চিরস্থায়ী নয়,
সুখ-দুঃখ চিরদিন ঘরে সমভাবে,
কালের কবলে সবে হয়ে যাবে লয়,
অনন্ত নিদ্রার কালে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে"।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সেকালের মহিলা কবিদের তুলনায় তাঁর কবিতাগুলি অপাঙতেয় নয় । এ প্রসঙ্গে ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল্যায়নটি খুবই প্রণিধানযোগ্য । এই বাস্তব বিস্মিত কল্পনাচারী বিষন্ন রোমান্টিকতা গীতি কবিতার বহু পরিচিত মোটিফ, অবশ্য এতে কখনো পরিপূর্ণ শিল্প বিকশিত হতে না পারলেও উনিশ শতকের অনেক মহিলা কবির রচনার চেয়ে বিনোদিনীর কয়েকটি কবিতা স্পৃহণীয় তাতে সন্দেহ নেই ।
বিনোদিনীর দ্বিতীয় শেষ কাব্যগ্রন্থ "কনক ও নলিনী" প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে । ১৯০৪ সালে কন্যা শকুন্তলার মৃত্যু হয়, তাই তিনি এই কাব্যগ্রন্থটি কন্যার স্মৃতিতে তার নামে উৎসর্গ করেছিলেন । "কনক ও নলিনী" একটি কিশোর কিশোরীর বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী । স্বাভাবিক বেদনা বোধ,ভাবুকতা ও রোমান্টিকতা এই কাব্যগ্রন্থটির কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে । বিনোদিনী রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করার প্রায় ২৩ বছর পর তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন। বিনোদিনীর স্মৃতিকথা ১৯১০ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় "নাট্য মন্দির" মাসিক পত্রিকা প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । সে সময় এর নাম ছিল "অভিনেত্রী আত্মকথা"। দুটি সংখ্যা প্রকাশের পর কোন এক অজানা কারণে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই প্রকাশিত হওয়া বন্ধ হয়ে যায় । পরে ১৯১২ সালে "আমার কথা" নামে গ্রন্থাকারে প্রথমখণ্ড প্রকাশিত হয় । দ্বিতীয় খন্ড লেখার ইচ্ছা থাকলেও তা অপূর্ণ থেকে গেছে । বিনোদিনীর "আমার কথা" একটি আগাগোড়া পত্রাকারে লেখা আত্মজীবনী যা তিনি তাঁর নাট্যগুরু গিরিশ ঘোষকে কে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন । তারপর প্রায় এক যুগ পর পুনরায় স্মৃতিকথা রচনা আরম্ভ করেন। "রুপ ও রঙ্গ" পত্রিকায় ১৯২৪ সালের মাঘ মাস থেকে ১১ টি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁর দ্বিতীয় স্মৃতিকথা "আমার অভিনেত্রী জীবন"। তবে এটি অজ্ঞাত ও কারণে অসম্পূর্ণ থেকেই যায় । এবং এই স্মৃতিকথাই তাঁর শেষ রচনা ।
"আমার কথা" ও "আমার অভিনেত্রী জীবন" কেবলমাত্র স্মৃতিকথা মনে করলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না । বই দুটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । আমার কথায় তিনি বিবৃত করেছেন তৎকালীন বাঙালি সমাজের কথা, বাংলা থিয়েটারের কথা। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে রঙ্গমঞ্চের অনেক বিষয় তিনি তাঁর লেখাতে তুলে ধরেছেন । তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক লেখাকে এক কথায় বলা যায় থিয়েটারে ঐতিহাসিক দলিল । তিনি কতটুকুইবা পড়াশোনা করেছিলেন কিন্তু তাঢর লেখা ছিল সহজ-সরল এবং ভাষা শৈলী ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ । এছাড়া তিনি তার আত্মজীবনী 'আমার কথা'র ভূমিকাতে স্পষ্ট করেছেন কেন তিনি আত্মকথা লিখতে শুরু করলেন। তিনি লিখেছেন, "মনের ব্যথা জানাইবার লোকজগত নাই... কেননা আমি সমাজ পতিতা, ঘৃণিতা বারনারী ! লোকে কেন আমায় দয়া করবে ? কাহার নিকটেই বা প্রাণের কথা জানাইব ? তাই কালিকলমে আঁকতে চেষ্টা করিতেছি"।
আমার অভিনেত্রী জীবন লেখাতে আত্ম স্মৃতির কথাগুলি অন্যভাবে তুলে ধরলেন । তখন লেখা থেকে দুঃখের সুর চরে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছিল হাস্যরস । আমার কথা লিখেছিলেন সাধু ভাষাতে । এখানে তার পরিবর্তে চলতি গদ্য রীতিতে লিখেছিলেন । আগের লেখা থেকে এই লেখা হয়ে উঠল আরও আধুনিক এবং তা বোঝা যাবে লাইনটি থেকে । ......"কোন কিছু বলতে গেলে তাই আগে মনে পড়ে সেই কথা, যা আমার কাছে এখনো সুখ-স্বপ্নের মতো মধুর, যার মাদকতার আবেশ ও আবেগ এখনো আমি ভুলিতে পারিনি । .... আর যা বোধহয় আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গের সাথী হয়েই থাকবে। তাই বোধ হয় আমর এই অভিনেত্রী জীবনের কথা বলবার সাধ"।
ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লিখেছিলেন-- "এই চলতি ভাষার লেখা দ্বিতীয় স্থিতিকাহিনীটি সেকালের থিয়েটারের গল্প হিসেবে স্মৃতি-কথা, সাহিত্য হিসেবে স্থায়ী স্থান স্থান পেতে পারে । তাই অবশেষে যেটা বলার বিষয় বিনোদিনীর সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়ন করা দরকার । কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে বিনোদিনীর নাম সচরাচর দেখা যায় না । এমনকি তাঁর লেখা কবিতাগুলিও তৎকালীন মহিলা কবিদের সাথে একসাথে উচ্চারিত হয় না । বিনোদিনী বারাঙ্গনা ছিলেন বলেই কি তথাকথিত ভদ্রলোকের সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ?
ঋণস্বীকার _____
১. আমার কথা ও অন্যান্য রচনা--- বিনোদিনী দাসী ।
২. তিনকড়ি, বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ।
৩. রঙ্গালয়ে রঙ্গনটী--- অমিত মৈত্র ।
৪. বিনোদিনী দাসীর কবিতা - সম্পাদনা--নীলাঞ্জন কুমার। তেঘড়িয়া, কলকাতা।
No comments:
Post a Comment