ব্যক্তিগত গদ্য
বাবা
সম্মিলিতা দত্ত
টাকা দিয়ে নাকি সব কেনা যায়! সত্যিই কি তাই? আমার তো মনে হয় না। এমন কিছু কিছু জিনিস, জিনিসই বা বলি কেন, সম্পদ আছে যা শুধু আমরা কেন স্বয়ং আম্বানিও কিনতে পারবেন না। সেরকমই এক সম্পদ হলো বাবা। আমাদের জীবনে মায়ের পরে যার অবদান সবচেয়ে বেশি। বাবাকে নিয়ে হয়তো খুব কম বলি আমরা...তবুও প্রত্যেকেই জানে তাদের নিজের নিজের জীবনে তাদের পিতার মূল্য কতটা। বাবারা হলেন সেই নোঙর যার ওপর ভর দিয়ে আমরা সন্তানেরা দাঁড়িয়ে থাকি। আমার বাবাও এর ব্যতিক্রমী নন। ছোটোবেলা থেকেই তাকে দেখেছি একা হাতে সব সামলাতে। এবার প্রশ্ন হলো একা হাতে কেন?
আমার বয়স যখন চারবছর, তখন কর্কট নামক মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন আমার মা। তিনি পেশায় একজন স্কুলশিক্ষিকা ছিলেন আর বাবা তখন সাংবাদিকতা ও তার পাশাপাশি গৃহশিক্ষকতা করতেন। আমাদের পরিবার অনেক বড়ো।আমার বাবারা পাঁচভাই। কিন্তু সকলেই নিজেদের পরিবার নিয়ে যে যার মতো থাকতেন। আমাদের পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন কাকু ও জেঠুর পরিবার। বাড়িতে তখন লোক বলতে আমি, বাবা আর দিদি। দিদি আমার থেকে তিনবছরের বড়ো। সেইসময় বাবা খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লেন। তার পক্ষে খুব শক্ত হয়ে পড়লো মাকে দেখাশোনা করে আমাদের দেখভাল করা। সত্যি বলতে কেউই সেইসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। বাবা একা হাতে সব সামলেছেন। সাংবাদিকতা, গৃহশিক্ষকতা, পাশাপাশি মায়ের খেয়াল রাখা, সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো_সব। তবু কখনও ক্লান্তি বা অনীহা প্রকাশ করতেন না।কিন্তু এত কিছু করেও যখন আর কিছুই হলো না, ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিলেন সেদিন সত্যিই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনোদিন আমি তাকে ভাঙতে দেখিনি। বরফ যেমন জল হওয়ার পরও আবার বরফ হতে পারে, বাবাও সেরকম জানেন ভেঙে পড়ার পর শক্ত হতে।
আমাদের দুইবোনকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ ছিলো না। একা একা দুইজনে বসে থাকতাম কখন বাবা আসবে তার অপেক্ষায়। আমার বাবার পরে একমাত্র মানুষ ছিলেন আমার দাদু যিনি আমাদের খেয়াল রাখতেন। বাবা যেহেতু সারাদিনই পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাই তার পক্ষে আমাদের পড়ানো সম্ভব হয়ে উঠতো না। তবুও তার মধ্যে সময় করে উনি আমাদের পড়ানোর চেষ্টা করতেন। বাড়িতে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটার কারণে আমার স্কুলে ভর্তি হতে একবছর দেরি হয়েছিল। তাই আমাকে এক ক্লাস উপরে ভর্তি করানো হয়। স্কুলে যখন যেতাম, দেখতাম আমারই সহপাঠীরা আমার আগে যোগ-বিয়োগ, রিডিং পড়া সব করে ফেলছে। কিন্তু আমি এসব তখনও শিখতে পারিনি। স্কুলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। কিন্তু স্কুলে গিয়ে গিয়ে এবং বাবার অধ্যবসায়ে ওদের আগেই আমি ওদের থেকে ভালো রিডিং পড়তে শিখে গিয়েছিলাম। আমাকে বাবা টিউশনি যাওয়ার সময় সাইকেলে করে স্কুলে দিয়ে আসতেন ও ফেরার সময় নিয়ে আসতেন। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই বাবা ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়তেন, তাই তার পক্ষে আমাকে দিয়ে আসা সম্ভব ছিলো না। তাই খুব ভয় করলেও আমি একা একাই যেতাম। মনে হতো বাবা যদি সব একা করতে পারে, তাহলে আমি কেন পারবো না? তাকে তো দেখেছি পাঁজরভাঙ্গা কষ্ট করার পরেও হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে।
আমাদের এখানে আগে খুব ভালো মেলা বসতো প্রতিবছর। বাবার সাথে রোজ আমার এর দিদির সেখানে যাওয়া চাই-ই। বাবা কখনও না বলতেন না। যা চাইতাম নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাই কিনে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। হয়তো পকেটে বেশি পয়সা থাকতো না, তবুও কখনও সেটা আমাদের বুঝতে দিতেন না।
বাবা বই পড়তে প্রচুর ভালোবাসেন। তার আলমারি সাজানো থরে থরে বই। তার মধ্যে নিজের লেখা বই যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অন্যদের লেখা বইও। আমি ছোটো থেকেই বাবাকে দেখে আসছি কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকতে। বাবা ছোটো থেকেই আমাদের প্রচুর বই পড়ে আসার কথা বলেছেন। তা সে পড়ার বই হোক কিংবা গল্পের। আর আমি সত্যিই ধন্য সেইসব কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে পারায়। বাবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এইজন্য। উনি না থাকলে আমি হয়তো জানতামই না কীভাবে ঘণ্টার পর ঘন্টা বইয়ের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বাবার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি যে আমাদের চারদেওয়ালের বাইরেও একটা জগৎ আছে, চেনা পৃথিবীর বাইরে আরেকটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবী রয়েছে রূপকথা, উপকথার দেশ। সেখানে কুটির বেঁধে দুয়োরানীরা থাকেন। সেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে কোনো হিংসা নেই, নেই কোনো বিরোধ। বাবা সবসময় বলেন, জগৎটা যেমন বড়ো, স্বপ্নও তেমন বড়ো হওয়া চাই। আর নিজের স্বপ্নে পৌঁছোতে হলে শুধু পরিশ্রম করে আর লড়ে যেতে হবে। দেখবে সাফল্য তোমার আসবেই। বাবার কথাটা ঠিক বুঝতে পারি না। পরিশ্রম করে সাফল্য পাওয়াটা সফলতা, নাকি সাফল্য পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করাটা সফলতা?
সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে উনি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষ, যিনি আমাদের জন্য নিঃস্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।আর তার সাথে একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতাও, যিনি বাবার পাশাপাশি মায়ের ভূমিকাও পালন করে চলেছেন। আমাদের প্রতি তার দায়িত্ব, কর্তব্য পালন আর অবদান নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো সেই লেখা আমার পরজন্মেও শেষ হবে না। এককথায় বাবা আমার সকল সমস্যার সমাধান, সব রোগের ওষুধ আর দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকা সুখ।
No comments:
Post a Comment