শুধু বাবার জন্য
হয়তো আমার বাবা...
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
হয়তো আমার বাবা এমন ছিলেন। আমার বাবা ঠিক এমনটাই ছিলেন, একথা৷ বলবার মতো স্মৃতি আমার নেই। একটা কুয়াশাবৃত সকালে শব-মিছিলে, দড়ি বাঁধা ইজের প্যান্ট আর হাফ হাতা, না কাচা জামা গায়ে, পথ হাঁটা বাপহারা ছেলেটা কখনো কখনো সারাজীবনের পথ চলাতে কারো কারো কাছে, পিতৃস্নেহ পেয়ে এসেছে। প্রকৃত শোক জীবনে এসেছে অনেকটা পরে।
বনগাঁর খেলাঘর মাঠের কাছে দাদুর বাড়িতে আমার জন্ম হলেও, হাবড়া এবং মছলন্দপুরের মধ্যে অখ্যাত গ্রাম বেড়গুমে, প্রায় দু'শ বছর পুরনো চুন সুরকি ওঠা হতশ্রী বাড়িতে আমার শৈশব কেটেছে। তখন আত্মীয় স্বজনরা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। খুব ধুমধামে তাঁরা সমাদৃত হতেন। আমাদের জমি জায়গা ভালোই ছিল। বাবা সেই জমি জায়গাই নিজে দেখাশোনা করতেন।গ্রামের উত্তরদিকে চাষের মাঠ ছিল সেখানে আমাদের ধান চাষ হতো।আমাদের বাড়ির উঠোনে ধানের গোলা ছিল।
একবার দুপুরে সবাই ভাত খাচ্ছেন। দুপুরের সংবাদ হচ্ছে, আকাশবাণী কোলকাতা, খবর পড়ছি... রেডিওর নব নাড়াচাড়া করতেই সেটা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল।আমি ভাবলাম হয়তো বা আমি রেডিও খারাপ করে ফেলেছি। ভয় পেয়ে আমি ধানের গোলার মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিলাম। বাবার কাছে বকা খাওয়ার ভয়েতে। পরে অবশ্য রেডিওতে খবর শুরু হওয়ায় ধানের গোলার বাইরে রের হয়ে এসেছিলাম।
গ্রামের মধ্যে ছিল বেড়গুমে হাটখোলা। সেখানে সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো। সেই দুদিন, রবিবার আর বৃহস্পতিবার। সেখানে বাবার সাথে হাটে বেড়াতে যাওয়ার জিলিপি, রসগোল্লা খাওয়ার স্মৃতি আজও স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে। যতদূর মনে পড়ে সদাহাস্যজ্বল আমার বাবা খুবই নিরিবিলি প্রকৃতির ছিলেন।
মা গান ভালোবাসতেন, মায়ের একটা মোটা গানের খাতা ছিল। বনগাঁর দাদুর বাড়িতে সাহিত্য সভা বসতো। সেই সাহিত্য সভায় মা গান গাইতেন। একবার সেই খবর বনগাঁ বার্তায় ছেপেছিল। আমরা ভাই বোনেরা মায়ের খবরের কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া, মলাট ছেঁড়া, গানের খাতাটা আগলে আগলে রাখতাম। সেই খাতার গান শুনে আমরা ছয় ভাই বোন বড় হই। সেই খাতাটিতে আমাদের সবার জন্মদিন, জন্মের সময় রাশি তিথি, যারা প্রয়াত হয়েছেন তাঁদের তিথি, নক্ষত্র সব লেখা থাকতো।
মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সেই বাবার চোখের ছানি অপারেশন করতে হয়। চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়াতে জমি জায়গার কাজকর্ম বড় একটা দেখাশোনা করতে পারতেন না। পরে হাবড়াতে একটি দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে কাঠের ফার্নিচারের দোকান দিয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই, তিন বোন খুব সচ্ছল ভাবে না হলেও নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছিলাম। বোনে দের বিয়ে দিতে জমি জায়গা প্রায় সবই জলের দরে বিক্রি হয়ে যায়। ভালো ধানের জমি একশো টাকা শতকে বিক্রি হয়ে যায়। তখন সোনার ভরি ছিল আট হাজার টাকা। সেটা উনিশ শো পঁচাত্তর সালের ঘটনা। এর মাঝেই বাবার গলায় মারণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বাঁধে। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় বাবা চলে যান না ফেরার দেশে। সেবছর সবে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার টেষ্ট পরীক্ষা দিয়েছি।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং গ্রাজুয়েশন এর দিনগুলোতে সব বন্ধুরা তাদের বাবাদের গল্প করত। আমার জীবন জুড়ে বাবা বলতে ছিল শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস আর তার প্রাণভরা আশীর্বাদ।
তাঁর আশীর্বাদকে পাথেয় করে আমার দীর্ঘ পথচলাতে কখনো কখনো পিতৃস্নেহ পেয়েছি। কখনো কালো অক্ষরে দুই মলাটে বন্দী করবার সুযোগ আসলে, তা থেকে বিরত হব না। তবে আজ জীবনের প্রান্তদেশে এসে আমার অনুভব এই যে, বাবার মতো বলে কিছু হয় না। বাবা কেবল বাবা ই হয়। বাবাহীন জীবন যে কতটা ফাঁকা তা পিতৃমাতৃহীন অনাথ মাত্রেই অনুভব করতে পারেন।
শুরু হল বর্গা অপারেশন। লাঙ্গল যার জমি তার। বাংলাদেশ থেকে এসে যারা আমাদের জমি কিনে ঘর বাড়ি বানিয়েছিল। তারা বাবার অবর্তমানে জমির সীমানা বাড়িয়ে দখল করা শুরু করল।
একাধারে জমি জায়গা, কোর্ট -কাছারি। পঞ্চায়েত, উকিল মাতব্বর আমাদের ভরণপোষণের সব ভার পড়ল আমাদের বিধবা মায়ের ওপর। সেই অর্থে আমাদের জীবনে কখনো সুদিন আসেনি। কাউকে অভাব অভিযোগ জানানো বাবা পছন্দ করতেন না। আমার মেজদা অমিত, একাধারে চেষ্টা করতেন আমাদের ভালো রাখবার। এত দু:খ কষ্টের জীবনে কখনো ওর মুখের হাসি মলিন হতে দেখিনি।
গান গাওয়া, ফুলফোটানো মা কান মুলে দেওয়ার ভয় দেখালেও, কখনো বকাবকি করলেও সেই অর্থে কোনো ভাই বোনের গায়ে হাত দেন নি। আমরা ভাই বোনেরা কেউ কখনো মার খাইনি। মায়ের গান গাওয়া কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। সব দু:খ কষ্ট মা হাসি মুখে সয়ে গেছেন। আমরা তাঁর কাছেই পিতৃস্নেহ পেয়েছি। মা তার জীবদ্দশায় কখনোই আমাদের সুদিন দেখে যেতে পারেন নি।
পুত্র সাবলম্বী হলে সে পিতার ভূমিকা পালন করে। একথা শাস্ত্রে বর্ণিত । সেই অর্থে পুত্রেরাই এখন আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। একথা না লিখলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
উইলিয়াম শেকসপিয়ার বলেছিলেন, " আমি নিজে কি তা আমি জানি, কিন্তু আমি কি হতে পারতাম তা আমার জানা নেই। " তাই পিতা এবং পিতৃস্নেহ বঞ্চিত আমি, কি হতে পারতাম তা এই জীবনে অজানাই থেকে গেল।
No comments:
Post a Comment