ঘিরে রেখেছেন তিনিই
বাবা তোমাকে----
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
দেয়ালের তিন বাঁধানো ছবি দেখিয়ে বলেছিলে, এইতো ঈশ্বর। নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ। আর কোন পুজোর দরকার নেই। সেইসব শুনে শুনে আরও এক বড় আকাশ ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম বুকে। দুপুরের কাজ ছিল লেখার বাইরে আবৃত্তির জন্য কবিতা মুখস্থ করা আর কখনো বা নাটকের সংলাপ মুখস্থ করা, আর তোমার এঁকে দেওয়া স্কেচ মকশো করা চাইনিজ ইঙ্ক অথবা রঙ তুলিতে। তখনো প্যাস্টেল আসেনি হাতে। আর বলতে মন থেকে ছবি আঁক, এই দিলাম খাতা। বাঁধানো সুদৃশ্য খাতায় জলরঙে কত যে এঁকেছি! আমার আঁকা কাঁচা হাতের সরস্বতী অনেকগুলো বছর স্বপ্নের মত টাঙিয়ে রেখেছিলে তোমার সামনের দেয়ালে। খুশি হতাম অসম্ভব। ক্যালেন্ডারের চার হাতের সরস্বতী আর আমার আঁকা দেবীকে প্রণাম করে স্কুলে যেতাম। সেও তো শিখিয়েছিলে।
কি শেখাওনি তাই ভাবি বসে, এতগুলো বছর পেরিয়ে, একা এক্কেবারে নির্জন মনে। কবে আলাদা সত্তা হয়ে দাঁড়ালাম হিসেব পাইনে।
হ্যাঁ বাবা, তোমাকেই বলছি, যৌথ বাড়ির সব জেঠতুতো দাদা দিদি জেনে গিয়েছিল এ মেয়েটা ছোটকাকার স্বপ্নের। অসম্ভব ভালবাসা আদর ছুঁয়ে ছিল বাড়ি ভরা। এ উঠোন ও উঠোন চার উঠোনের আনাচ কানাচ।
লাল মেঝের সকলের ঠাকুর ঘরে সময়ে সময়ে কত উৎসব। সব ব্যবস্থা করে দিতে দূরে দাঁড়িয়ে। সবার আনন্দে তোমার ও চোখ ভাসতো। কখনো ঠাকুরের অঞ্জলি দিতে দেখিনি। কীর্তন মহোৎসব হত আমাদের বৈষ্ণব ঘেঁষা বাড়িতে। জেঠুর তত্ত্বাবধানে। কি আনন্দে কীর্তনের পদ পদকর্তা গান, সুর একাকার হয়ে যেত। গাঁদা ফুল দিয়ে চন্দন পরিয়ে দিতাম সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে। শিখিয়েছিলে চালের গুঁড়ো য় আলপনা দেওয়ার সময় পেঁচা এঁকে কিভাবে প্রাণবন্ত করতে হয়। যা আজ ও করি। লক্ষ্মী পুজোয়, এখনো। প্রতি জন্মদিনে বই সম্ভার, তোমার উপহার সবার আগে।
যাবতীয় বাঁচা গুলো টুকরো টুকরো করে দেখলে মিলিয়ে নিতে নিতে দেখি সব 'তুমি ময়' হয়ে আছে। ভাবনারা ছোটে তোমার পথেই। তোমার মত, তোমার মনের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেও ঐ নি:স্বার্থ প্রাণ হতে পারলাম কই! সে উদার মনের কারিগর ঐ একজনকেই দেখেছি। ভেবেছি, এত গুণী বাবা আমার! তুমি হেসে বলতে, "jack of all trades master of none"
সে হাসির মধ্যে কষ্ট খুঁজে পেতাম। যা হতে পারতে, হয়নি। আর্ট কলেজ কলকাতায় ভর্তি হতে চেয়েছিলে, তখন পড়তে কৃষ্ণনগর কলেজে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এক ব্যাচ সিনিয়র। একসঙ্গে লিখছ। রূপাঞ্জলির মত পত্রিকায় দুজনের লেখা। স্বপ্ন ছিল, হলো না। সংসারের যৌথতার দাবীতে ফিরতে হল। যে শহরকে ভালবেসে শুধু নাটক কেন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সবটা দিয়েছ, দক্ষিণ উত্তর মেলবন্ধন ঘটিয়েছ ঐ রাজনগরে বসেই।সে শহরের নতুন প্রজন্ম তোমার সবটা জানলোই না! আসলে নিজের সম্পর্কে উদাসীনতা সবসময় ভালো নয়। তোমার বহু ইচ্ছেকে দিয়ে তৈরি করেছিলে আমাকে। আমিও কিছুই দিতে পারিনি। 'বাবা' নামটাই... আমাকে স্কুলের বাক্স গুছোনো, খাতাপত্র মলাট দিয়ে গুছিয়ে দেওয়া, প্রতিদিন উল্টে পাল্টে দেখা, সব নতুন ব ই বছরের প্রথমেই বাঁধিয়ে ঝকঝকে করে দেওয়া, অফিস ফেরত সব খুঁটিয়ে দেখা।... তোমাকে নিয়ে বলতে গেলে এক ইতিহাস যাপন।
সন্ধের ঐ নাটক রিহার্সাল রুমের মধ্যিখানে বেড়ে উঠতে উঠতে দেখেছি তোমার কর্ম পরিচালনা, অভিনয় একের পর এক। আবার খেলার মাঠের ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনে পদাধিকার বলেই একাত্মতা। বাড়ির চৌহদ্দিতে নামী সাহিত্যিক, অভিনেতা যেমন কলকাতা থেকে এসেছেন, থেকেছেন, খেলোয়াররা ও বাদ ছিলনা। এখনো চোখ বুজলে তোমার অফিস ঘরের সেই এক হাতে কাজ করা বিশেষ ভাবে সক্ষম পিওনকে দেখি। কিংবা তোমার আর এক কর্মচারী কলিমুল্লাহ মিঞা, যাঁকে কাকু ডাকি এখনো.. তোমার কথা বলতে গেলেই অঝোরে কাঁদেন যিনি, এত ভালবাসা দিয়েছ।
জনসংযোগ আধিকারিকের কাজের ফাঁকে ঐ গণসংযোগ আর অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখার বিজ্ঞাপন গুলো হয়ে উঠেছে সাহিত্য আকর। সেসব নিয়ে লিখেছেন সাহিত্যিক অমিয় ভূষণ মজুমদারের ছেলে অধ্যাপক অম্লান জ্যোতি মজুমদার। অত্যন্ত ভালবাসতেন অমিয় ভূষণ মজুমদার। তাঁর রচনাবলীতেও তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎকার বিষয় বিধৃত।
আমার বাবা হয়েও তুমি সকলের। এত সৃষ্টি সব ছড়ানো। একখানা ছড়ার ব ই বেঁচে থাকতে করেছিলে। "স্বপ্নের নামে", ছোট্ট পাতলা একখানি মূল্যবান ছড়া সংকলন। পরে তোমার রেখে যাওয়া বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের বহু নিবন্ধ নিয়ে'কোচবিহার প্রসঙ্গ', এগারোটি নাটকের সংকলন'নীরজ নাটক' প্রকাশ করেছি, সে তুমি দেখনি। এই মর্মবেদনা থেকে যাবে আজীবন।
যেখানেই যাই, পুরোনো মানুষ দেখলেই বলেন "এক্কেবারে নীরজদা"। এই তো বাহির ভিতর তোমাকে নিয়ে চলেছি, চলব এভাবেই ছায়ার মত মায়ার মত যতদিন পারি।
মুজনাই কে অনেক শুভেচ্ছা, ভালবাসা শৌভিককে, ইতিহাসের কথাটুকু দিয়ে এ শ্রদ্ধার্ঘ সামান্য হলেও সাজিয়ে দিতে পারলাম...
No comments:
Post a Comment