অতিমারি ও তিনি
স্মৃতির শব্দে বাবার খোঁজ
প্রতিভা পাল
একটা সময় পর দৈনন্দিন যাপন অভ্যস্ত হয়ে ওঠে অভ্যাস কাটিয়ে। অথচ মন তখনও কী সাবলীলভাবে এঁকে যায় স্মৃতির যাবতীয়। ‘বাবা’ ডাকটি তেমনই সযত্নে লালিত এক চিরাচরিত অভ্যাস। চার বছর ধরে কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেও যে ডাক আজও মন-জুড়ে বেঁচে আছে। আজও যে অবয়ব অস্তিত্বর কণায় কণায় জাগ্রত।
জীবনের অজস্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাবার কাছ থেকে আয়ত্ত করেছি। দুঃখ-সুখ সরিয়ে দায়িত্ববোধের পথেই আজন্ম হেঁটে চলা তাঁর। আমৃত্যু তাঁর আত্মত্যাগ। বাবারা হয়তো এমনই সহজ, শান্ত, সুন্দর মনের একজন মানুষ হন। আমার বাবা যেমন। তবে অনুশাসনের সময় তিনিই আবার অন্যরকম -কঠোর, গম্ভীর।
মানুষটি যৌথ পরিবারের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। চোদ্দ জনের একটি পরিবারে তিনিই ছিলেন প্রধান। তাঁর নিঃস্বার্থ ভাবনা, কর্তব্যনিষ্ঠা ছোট থেকেই আমার গর্বের বিষয়। ধৈর্যশীল মননে যেকোনও পরিস্থিতির সমাধান সূত্র নির্ণয় ছিল বাবার স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস। হাতের লেখা ছিল অপূর্ব। আর, পড়াশোনায় মেধাবী। মানুষটি আমার বাবা প্রশান্ত কুমার পাল। আমার সমস্ত অনুপ্রেরণার উৎস।
পরিবর্তনশীল সমাজে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। জীবনের পাঠ পড়াতেন নিজস্ব অভিজ্ঞতার দৃষ্টিতে। বাবা তাই আমার শিক্ষাগুরুও।
বাবার ছেলেবেলার গল্প শুনে বাস্তব আর অসহায়তা ঘুরে ফিরে ভিড় জমাতো আমার মনে। দেশভাগ, পাবনা ছেড়ে অজানায় পাড়ি, বড় ছেলের দায়িত্ব পালন, সাত ভাইবোনের বড়দা হয়ে ওঠার কাহিনী, এসবই আমাকে ভাবাত। বার্ণিশ ঘাটের নতুন পরিবেশ, নৌকো করে কলেজ-এ পড়তে যাওয়া, ব্যবসা দাঁড় করানোর ইতিহাস শুনে কত কত কল্পনার ছবি উঁকি দিত মনে। তিস্তার গ্রাসে ঘর হারানো, বন্যায় সব হারানোর গল্পগুলো শুধুই কি গল্প? সেগুলো আদতে কঠিন সময়েও বেঁচে থাকার আর বাঁচিয়ে রাখার শিক্ষা। আজও যেন সেসব বাবার মুখেই শুনি।
একদিন করোনার প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ল গোটা বিশ্বজুড়ে। এবং, আমাদের পরিবারেও। ফিরতি পথে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাবাকে।
তবে বাবাদের কখনও মৃত্যু হয় না। সন্তানের হাঁটা সেই আবহমানকালের গাছের ছায়ায়। খর রোদে শীতল ছোঁয়ায় আজও তাই বাবাকে ছুঁয়ে থাকি দিনরাত, রাতদিন।
No comments:
Post a Comment