স্মৃতির পাতায়
বাবার বাবাগিরি
অমলকৃষ্ণ রায়
অবসর যাপন চলছে। হাতে অঢেল সময়। সংসারের টুকিটাকি কাজের বাইরের সময়টার সিংহভাগই অতীতের স্মৃতিবহুলতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। ষাটোর্দ্ধ জীবনের স্মৃতিকোষের একের পর এক পাতা উলটে যাই। একেবারে প্রথম পাতায় ফিরে যেতে চাই। যেখানে জীবনের শুরুর শুরু, যেখানে আমার শৈশব-কৈশোর থরে থরে সাজানো রয়েছে। সব যে অক্ষত রয়েছে তা নয়, অনেককিছুই কচি পাতা শুকিয়ে যাবার মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে। বিস্মৃতির আবছায়ায় ঢাকা পড়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের খেত থেকে একজন কৃষক যেমন যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব সযত্নে তুলে ঘরে নিয়ে যায়, আমিও আমার স্মৃতির অক্ষত অংশটুকু নিংড়ে ধুয়েমুছে তুলে নিতে বসি রোজ।
সেই রিলে নায়োকোচিত ভূমিকায় যাকে দেখি, তিনি হচ্ছেন আমার বাবা, হেমেন্দ্রচন্দ্র রায়। সেই মানুষটা একরকম খালি হাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশান্তরিত হয়ে কোচবিহারের মাটিতে পা রেখেছিলেন। সময়কালটা পঞ্চাশের দশকের শুরু, যখন সবে কোচবিহার রাজ্য থেকে জেলার তকমা পেয়ে জেলাশাসকের অধীনে চলে গেল। সেই থেকেই আমার বাবার সংসারজীবনের বীজ পুঁতে তাতে জল-বাতাস-সার দিয়ে বাড়িয়ে তোলার ব্রত শুরু হলো। তবে একটা কথা হয়তো ভুল বললাম, একেবারে ঠিক খালি হাতে নয়, শুরুর দিনে বাবার হাতে একখানা ম্যাট্রিক পাশ সার্টিফিকেট ছিল। তা দিয়েই একখানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি, সেই সামান্য আয় থেকে তিলেতিলে তিনি একটা আস্ত সংসারকে সাজিয়ে তুলতে শুরু করেছিলেন।
আজও একান্তে বসে যখন বাবার কথা ভাবি, তখন গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মত করে বাবার উদ্দেশ্যে বলতে থাকি—
তুমি সবে ম্যাট্রিক পাশ করে মার্কসশীট সার্টিফিকেট নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি এলে। সে খবর পেয়ে তোমাদের টাঙাইলের গফরগাঁও গ্রামের পদ্মার পাড়ের বাড়িটায় তোমাকে ঘিরে একটা খুশির আবহ বইছিল। পাড়াপ্রতিবেশিরা ছুটে এসে কেউ কেউ বলল, জানি হেমেন্দ্রর লেখাপড়ার মাথা ভাল। পাশ তো করবেই।
এরকম একটা আনন্দঘন পরিবেশে জেঠামশায় গম্ভীরমুখে হুট করে বলে উঠলো, পাশ করছস। ভালা কথা। এইবার ভারতে যা। যাইয়া চাকরি জোগাড় কইরা, জমিজমা কিইনা থাকোনের ব্যবস্থা কর। এ দেশে থাকোনের উপায় নাই। জেঠার কথাটা যেন বাড়ির পরিবেশটাকে নিমেষেই পালটে থমথমে করে ফেলল। ঠাকুরদা বেঁচে নেই। জেঠামশায় তোমাদের অভিভাবক। তিনি কোনও বিপদের আঁচ না পেলে কেন এ কথা বলবেন?
সন্ধেবেলায় এ নিয়ে দ্বিতীয় দফার বৈঠক হলো। তাতে জেঠামশায়, জেঠিমা, ঠাকুমা সবাই মিলে সিদ্ধন্ত নিল তোমাকে কোচবিহারে পাঠানো হবে। তারপর সে দেশের অবস্থা কেমন, সেটা চিঠি মারফত জেনে সেইমতো কবে কখন বাকিরা ঠাঁইনাড়া হবে ঠিক করা হবে। সেইমতো তুমি পরদিনই রওনা হয়ে গেলে। সঙ্গে তোমার প্রফুল্লমামা। মামার হাতে ঠাকুমা তোমাকে শপে দিয়ে বলল, প্রফুল্ল, অরে দেইখ্যা শুইন্যা রাখবি। মামাও ম্যাট্রিক পাশ। এলোপ্যাথিক ওষুধ সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ। তাই ঠিক করলো, চাকরি যতদিন না পায়, ততদিন গাঁয়েগঞ্জে ডাক্তারি করে মামাভাগ্নে মিলে দিন গুজরাবে।
বৈশাখ মাস। তোমরা কোচবিহারের মাটিতে পা রেখে মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজছো। রাস্তার দুধারে প্রচুর আমকাঁঠালের গাছ। তোমরা লক্ষ করলে, আজস্র পাকা আম গাছের তলায় পড়ে রয়েছে। পাশেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। অথচ কেউ আম কুঁড়িয়ে খাচ্ছে না। তুমি ভাবলে আমগুলো বোধহয় টক, তাই কেউ খাচ্ছে না। একটা আম কুঁড়িয়ে খেয়ে দেখলে ভীষণ মিষ্টি। তারপর ব্যাগ থেকে গামছা বের করে কুঁড়াতে শুরু করে দিলে। তা দেখে ছেয়েমেয়েগুলো হাসতে লাগলো, হর দ্যাখ। মানসিলা পচা আম কুঁড়ির ধইরছে। তোমরা বুঝলে পারলে, আমগুলোকে তারা পচা মনে করে খাচ্ছে না। অথচ কয়েকজন গোল হয়ে বসে কাঁচা আম নুন দিয়ে খাচ্ছে।
তোমরা পাকা আম ভরতি ব্যাগ নিয়ে চলতে চলতে একটা বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করলে। কোনও ভাড়া বা টাকাপয়সার বিনিময়ে নয়। কোচবিহারের একজন উদার প্রকৃতির মানুষ তোমাদেরকে থাকার মতো একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। তোমরা শুরু করলে মামাভাগ্নের সংসার।
একদিনের কথা তুমি আমায় বলেছিলে। তোমার মামা রান্না করে খেতে ডাকলো। ডাল আর আলু ভাজা রান্না করেছে। তুমি খেতে বসে মুখে শুধু বালি পাচ্ছো। ডালের গন্ধমাত্র নেই। তোমার মুখের হাবভাব দেখে মামা জিজ্ঞেস করলো,
‘ভাইগ্না ডাইল কেমুন হইছে?’ তুমি মুখের গ্রাস কোনওরকমে গিলে বললে,
‘মামা, ডাইলে তো বালি কিচকিচ করে।’ মামা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,
‘কী কও ভাইগ্না! ভালা কইরা ধুইয়া রান্না করলাম। বালি থাকব কেমনে?’ ততক্ষণে একদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়লো, ডালের গামলা অক্ষত অবস্থায় উনুনের ধারেই রয়েছে। তার বদলে তিনি হাত ধোওয়া নোংরা জলের গামলাটাই ফোড়ন দিয়ে ডাল রান্না করেছেন। ভুল ভাঙতেই মামা চমকে উঠে বললো,
‘এইডা কী কামটা করলাম! ডাইল তো পইড়া রইছে। একটু বও, এইবার ডাল ফোড়ন দিই।’ উনি তখন আরেকবার ডাল সম্বার দিতে উনুনে কড়াই বসালেন।
তোমাদের মামাভাগ্নের যৌথ সংসার একদিন ভেঙে গেল। না, কোনও ঝগড়াঝাটি নয়, তুমি একটা চাকরি পেয়ে স্থানীয় একটা বাড়িতে লজিং থাকার সুযোগ পেয়ে গেলে। তার বিনিময়ে সে বাড়ির বাচ্চাগুলোকে দুবেলা পড়াতে শুরু করলে। এদিকে তোমার মামা পাশের গ্রামেই একটা এলোপ্যাথিক ঔষধের দোকান খুলে বসে পড়লো।
এভাবে কিছুদিন চলার পর সম্মন্ধ করে তোমার বিয়ে হলো। মাকে নিয়ে প্রাথমিক স্কুলের চাকরির বেতনে নতুন সংসার শুরু করলে। ছোট্ট দুটি কুঁড়ে ঘর বানালে। সামান্য কিছু জমি কিনলে। তারপরই তুমি জেঠামশায়কে সবাইকে নিয়ে আসার কথা চিঠিতে জানিয়ে দিলে। জেঠামশায় তোমাদের পিতৃপুরুষের সমস্ত সম্পত্তি ফেলে বাকি সবাইকে তোমার কাছে চলে এল।
একটা সরকারি চাকরি-খেতি জমি-ঘরবাড়ি-স্ত্রী-সন্তান সবই হলো তোমার। একজন মধ্যবিত্ত ঠিক যেমন করে বাঁচে, তুমিও ঠিক সেরকমই আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করলে। তোমার স্ত্রী-সন্তানকে কোনওদিনও সংসারের অভাবের আঁচ কোনওদিন অনুভব করতে দাওনি, অভাব বুঝতে দাওনি। জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছু হাতের নাগালে না পেলেও, নিদানপক্ষে একজন সন্তানের বাবার কাছে যতটুকু প্রাপ্য, তা সবই তুমি দিয়েছ।
আজও ভাবলে বিস্মিত হই, ঐ নিম্ন আয়ের সংসারের অংকটার আয় ব্যায়ের হিসেবটা কী করে মিলিয়েছিলে? কী করে আমার মাকে একটা প্রশস্ত উঠোনের চারদিকের চারটি লেপা-পোছা পরিচ্ছন্ন কুঁড়েঘরে ঘেরা, পুকুর-ফলের বাগানে পরিপূর্ণ করে একটা বসতবাড়ি সাজিয়ে উপহার দিতে পেরেছিলে? আমি বলব, পারার পিছনে তোমার গণিতের দক্ষতাটাই কাজ করেছে। তোমাদের সংসাররজ্জুটা তোমার হিসেবের খাতায় বাঁধা ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।
তোমায় রোজ সন্ধেবেলায় সারাদিনের খরচের হিসেব লেখার সরু একখানা লম্বা আকারের খাতাটা নিয়ে বসে পড়তে দেখেছি। এমনকি যেদিন কোনও খরচ হতো না, সেদিনও তুমি খাতাটা বের করে তারিখ দিয়ে লিখতে— খরচ নাই। এই খাতাটাই ছিল তোমাদের সংসার নিয়ন্ত্রণের হাল-পাল সবই। সংসার সমুদ্রে কী করে নিরাপদে ভাসতে হয়, কোথায় থামতে হবে, কখন চলতে হবে, কখন রাশ টানতে হবে, কোথায় নতুন পরিকল্পনা যোগ করতে হবে, কখন দিক পরিবর্তন করতে হবে, সবই তোমার ঐ সংসারখাতার যোগবিয়োগের অংকের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। সেই অংকটা তুমি আমায় হাতে ধরে না শেখালেও, তুমি আমায় গণিত বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছিলে। তাই হয়তো একদিন গণিতই আমার পেশাগত জীবনের মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল।
আরও অনেককিছুই তোমার কাছে শেখা বাকি ছিল বাবা, হয়ে উঠেনি— ভালো বাবা হয়ে ওঠার শিক্ষা, ভাল সংসারী হয়ে ওঠার শিক্ষা, পরিশ্রমী মানুষ হবার শিক্ষা। তাই পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে সে জনমে তোমার সন্তান হয়ে বাকি শিক্ষাটুকু শেষ করে নিতে চাই। আপাতত এই প্রত্যাশাটুকু মননে সযত্নে তুলে রাখছি। ভাল থেকো বাবা।
বাবার সঙ্গে আমার আলাপচারিতা আসলে মনোলোগ হলেও আমার কাছে এটা দ্বিরালাপই মনে হয়। ঠিক বুঝতে পারি, বাবা আড়ালে থেকে আমার কথাগুলো শুনছে, ক্ষণে ক্ষণে কোথাও ভুল বললে ধরিয়ে দিচ্ছে। তা নাহলে এত কথা মনে রাখলাম কী করে?
No comments:
Post a Comment