Sunday, June 2, 2024


 

পিতৃতর্পন


সাদা ট্রাউজার আর পাজামা-পাঞ্জাবির দিনগুলো
উদয় সাহা  


একান্নবর্তী সংসারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো প্রায়৷ কিন্তু তখনও অবধি ছিল৷ মায়েরা তিন বোন৷ তিন ভাই৷ আর সকলের মধ্যমণি বাবা৷ দিদার আদরের একমাত্র জামাই৷ সবার ভালবাসার মানুষ। তখনও লম্বা বারান্দায় একসাথে বসে পাত পেড়ে খাওয়া৷ খাবার সময় ছুঁ-কিতকিত খেলা৷ দূরত্বের কারণে নবদ্বীপে নিজের বাড়িতে সবসময় যাওয়া হ'ত না বলে বাবাকে কেন্দ্র করে আমাদের বেশীরভাগ আনন্দ-উৎসবের ঘটনাস্থল ছিল মামাবাড়ি। 

আজকের সরকারি অনুদানে তৈরি ছাদ দেওয়া ঘরের জায়গায় সেখানে ছিল দোচালা কাঁচাঘরের সারি৷ কাঁচা ড্রেণ৷ দু'টো মাত্র স্ট্রিট লাইট। গলির ভাঁজে একটা চাপা কল৷ সেই কলের পাড়েই বাসন মাজার ভিড়। আমরা এখন যেখানে থাকি সেই জায়গা থেকে হাঁটা পথে মিনিট পনেরো। সেই গলিপথ ধরেই যখন বাবা তাঁর শ্বশুর বাড়ি যেতেন, গলির মুখে গল্পে মত্ত বিভিন্ন বয়সের কাকিমা, জ্যেঠিমা একসঙ্গে বলে উঠত, ' ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ ক্যারা আইসে লো!  উ মা গো জামাই যে ...! '

জামাইষষ্ঠীর দিন৷ মন্থর নিম্নবিত্ত জীবনে তেমন কোনো উত্তাল ঘটনা না ঘটলেও এই দিনটি বাবার কাছে ছিল ভীষণ আনন্দের৷ বছরের অন্যান্য দিন যেমনই হোক, ষষ্ঠীর দিন ব্যাগভর্তি বাজার, বড়ো প্যাকেটে দই-মিষ্টি, দিদার জন্য নতুন তাঁতের শাড়ি। এসব ছিল আবশ্যিক ৷ আমি যখন লিখছি, বাবার গৌরবর্ণ চেহারা, মোটা কালো গোঁফ, গালভরা হাসি চোখে ভাসছে। 

বিশেষ কিছু দিনে বাবা সাদা ট্রাউজার পরতে পছন্দ করতেন। আর তা না হলে গিলা করা পাঞ্জাবি-পাজামা। ষষ্ঠীর দিনগুলোতে এই পোশাকে অপরূপ লাগতো বাবাকে। আরো একটা পোশাক বাবার খুব পছন্দের ছিল। সাফারি৷ প্যান্ট এবং একই কাপড় দিয়ে জামা। তবে এই ক্ষেত্রে জামা কখনোই ফুল হাতা নয়। হাফ হাতা৷ একটু ঢিলে ঢালা৷ কনুইয়ের নীচ ছুঁয়ে। এই সমস্ত পোশাক এখনো আলমারিতে যত্ন করে রাখা আছে৷ মাঝে মাঝে গন্ধ শুঁকি। বুকটা ভরে ওঠে৷ ভালো লাগে৷ 

এখন জীবন ঘটনাবিহীন৷ গ্রীষ্মের দুপুরে লক্ষ্য করি শুকনো পাতার সাথে রুক্ষ্ম ধুলার উড়ে যাওয়া। আর থেকে থেকে পিপাসা জেগে ওঠে৷ বাবার পিপাসা। একজন জামাই-এর কী কী কর্তব্য-কর্ম, দায়িত্ব, সে সম্পর্কে বাবা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন৷ অর্থ দিয়ে পাশে দাঁড়াতে না পারলেও শারীরিক ও মানসিকভাবে সবসময় বাবা সকলের পাশে থাকতে চেয়েছেন৷ 

ঠাকুরদা চলে গেছেন বহু বছর আগে৷ আমি তখন অনেক ছোটো। আমি ঠাকুরদাকে সামনাসামনি দেখিনি৷ দেখতে পাইনি৷ ঠাকুমার সাথে সময় কেটেছে অনেকটা। দুহাজার পাঁচ নাগাদ যখন ঠাকুমা ভিনগ্রহে পাড়ি দিলেন, আমি সেদিন দেখেছিলাম একটা শক্তকান্ড গাছকে শিশুর মতো কাঁদতে। তাই দিদার সাথে সময়ে সময়ে খুনসুটি করলেও বাবা ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন দিদাকে৷ 

জৈষ্ঠ্যমাস জামাইষষ্ঠীর মাস৷ এই সময় মনে মেঘ জমে। বিষণ্ণ জামরঙা মেঘ৷ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠি৷ ছটফট করি৷ আকাশ পানে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না৷ দেখি নিশ্চুপ পতঙ্গেরা হাওয়ায় ওড়াউড়ি করে শুধু৷ বাবা দেখে যেতে পারেননি তাঁর ছেলেরাও 'জামাই' হয়েছে৷ ষষ্ঠীর নিয়ম-উপাচার আমাদের জন্যেও আছে। যেমন ছিল বাবার৷ কেনাকাটা আমাদেরও আছে৷ যেমন ছিল বাবার। কিন্তু আত্মায় একমাত্র বাবার শুভ্র অবয়ব। এখনো উজ্জ্বল। দ্যুতিময়৷ 

তখন কৈশোর ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সমকাল। এখন কেবল তপ্ত বাতাস৷ একজন ধূসর মানুষ বসে আছেন শুকনো নদীর ঘাটে৷ নীরব। নিস্তব্ধ। প্রতীক্ষায়৷ ধু-ধু নদী হেঁটে পেরোলেই আমবাগানের ছায়া। শরতের কাশবন। 


No comments:

Post a Comment