Sunday, June 2, 2024


 


অতীত যখন চোখের পাতায় 


পিতা 

বেলা দে 

বয়সে খুব ছোট হলেও পুরুষতন্ত্র বলে যে একটা সমাজব্যবস্থা চলছে সেটা বোঝার ক্ষমতা হয়েছিল।স্নানের সময় বাবার তেলের বাটি, সাবান, জল সামনে রাখা। পাদুকাখানি (খড়ম) পায়ের সামনে এগিয়ে ধরা এসব ছিল মা অথবা দিদিদের নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে।জন্ম দিলে জনক পালনকরলে পিতা কিন্তু সব পিতা কি কর্তব্যে অবিচল থেকে ঠিকঠাক পিতা হয়ে উঠতে পারেন-সেটা মনে হয় অনেকটা সময়কালের উপর নির্ভর করে। 

সে আমলে বহু পিতাকে দেখেছি সন্তানের উপর ঔদাসিন্য,পিতার পুরুষোচিত আচরণে আমার আত্মজ ও আত্মজারা পিতার দায়সারা পিতৃত্বে ভুক্তভোগী ছিল অনেকাংশে, সে নেই আজ তবুও এই করাঘাত, আমি সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম বলে দুর্বলতা  আমার প্রতি একটু বেশিই ছিল।বাকি ছয় ভাইবোন আপনি আজ্ঞে ছাড়া তুমি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। একজনের নাম ধরে হাঁক দিলে বিদ্যুৎ গতিতে তাঁর কাছে হাজির হয়ে আজ্ঞে বলে সম্বোধন করে সামনেদাঁড়িয়ে পড়েছে।ভয়ে বাবা শব্দটা বেমালুম ভুলে গেছে,পৌঁছাতে পারেনি তাঁর অন্তরের কাছাকাছি। প্রাণখোলা সান্নিধ্যটুকুও পায়নি। মাত্র আট বছর বয়সে সে তাঁর পিতাকে হারিয়ে জলপাইগুড়িতে শিয়ালপাড়াস্থিত নি:সন্তান কাকা কাকিমার কাছে চলে আসে সেখানেই প্রথাগত বিদ্যার শুরু। ফনিন্দ্রদেব ইন্সটিটিউট থেকে ম্যাট্রিকুলেশনা প্রথম, দেশবিভাগের আগেই ব্রিটিশ রাজত্বকালে। জীবনে প্রথম বই দ্বিতীয় হয়নি কোনদিন। সে বছরই রংপুর কলেজে পড়াকালীন আরও এক দু:সংবাদ তাঁর কেরিয়ার শেষ করে দিল, ফালাকাটায় বাবার দিদি জামাইবাবু কলেরা মহামারিতে একদিনেই মারা যায় তিনটি কচি সন্তান রেখে। ফালাকাটায় চলে আসতে বাধ্য হয় ওদের দেখভালের জন্য।  সব শেষ করে সেখানেই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু এবং  বসবাস।অনেকে বলে চরমতম দুটি আঘাত তার ভিতর কাঠিন্য এনে দিয়েছে।বাইরেটা ছিল বাবার অনেকটা নারকেলের খোলের মত ভেতর নরম। স্বভাবে স্বল্পভাষী, একরোখা,জেদী, মিথ্যাচাবিরোধী মানুষটাকে দুনিয়া নির্দয় বললেও আমি তার কোলঘেসা ছিলাম বলে লক্ষ্য করেছি চুপি চুপি কাঁদতে, কলকাতায় ছোড়দিদি শশুরবাড়ি চলে গেলে আর দার্জিলিঙয়ে সেজদাদা চাকুরী স্থলে রওনা হয়ে গেলে একাকী লুকিয়ে কেঁদেছে। প্রচারবিহীন মানুষটা এত প্রতিভা কি করে স্যুটকেশে আড়াল করে রেখেছে কেউ কোনদিন জানতেও পারেনি, জেনেছে মৃত্যুর পরে, আগে তালাবদ্ধ  অবস্থায় থাকতো। আমি জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি শহরের শিল্পপতি সত্যেন্দ্র প্রসাদ রায়ের মুখে।খুব প্রিয় বন্ধু ছিল বাবার। আমার মেজদা শৌলমারী সাধুর সংগে তিন বছর কাটিয়ে এসেছে ঠিকানাবিহীন, প্রতিপল প্রতিমুহূর্তে কাটিয়েছে বাবা অস্থিরতার  মধ্যে খোঁজ করেছে নানাভাবে। মেজদাদাকে ছোট থেকে দেখেছি প্রতি সকালে" পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম****-****প্রিয়ন্তে  সর্বদেবতা" এই পিতৃমন্ত্র জপ করতে। চিরকাল আবডালে থাকা মানুষটাকে তবুও তো একজন গুরুত্ব দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment