আমার ভিতর ও বাহিরে....
পিতা ও পুরান
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী
" পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমম্তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা ।।"
বার বাড়িতে আমাদের ঠাকুরঘর ছিল টিনের দোচালা । ছোটো , চার বাই চার হাত সাইজের , সেখানে অধিষ্ঠিত ছিল গৃহদেবতা রূপী শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গ । বাবা রোজ দুইবেলা এই ঘরে আসন পেতে বসতেন , পুজো শেষ হলে পিতা ধর্ম পিতা স্বর্গ উচ্চারণ করতেন , যা আমরা কুড়ি পঁচিশ হাত দূরে বসে থেকেও কানে পেতাম ।
এখনো সে উচ্চারণ কানে প্রতিধ্বনিত হয় , পিতার স্বর শুনতে পাই বলেই পিতা প্রসঙ্গে আসা ।
তাসখেলার রাত-
এ পাড়া সন্ধ্যাবাতির পর থেকেই নিস্তব্ধ হতে শুরু করে , আওয়াজ বলতে , রান্নাঘর থেকে উঠে আসা ভাতের বগবগানি আর কখনো কড়াইয়ে তেলের সঙ্গে জলের তর্জন-গর্জন । আটটার পর হঠাৎ এক আধটা বাড়ির লোক জেগে থাকে বটে , তাদের বাচ্চাকাচ্চারা বই ঘাটাঘাটি করে জন্য। বাবা এই সুযোগে ধনী জেঠুর বাড়ির বারান্দায় কয়েক হাত তাস পিটিয়ে আসে। অথবা অন্যদের পেটানো দেখে মজা নেয়। তবে দশটা পর্যন্ত , কেননা এর পর জেঠু আর বাইরে খোলামেলা থাকবেন না। তিনি দরজার মুখে বসেন আর দোনলা বন্দুকটায় টোটা ভরিয়ে রেখে দেন বা পাশে হাঁটুর ছুঁয়ে আঙ্গুলের পাহারায়। কোনো কোনো রাতে কাছারী ঘরে যাত্রাগানের মহড়াও হয় , তাস গোটানো থাকে। সে রাত একটু গভীর হয়। সবাই উঠে গেলে বুড়াকাকা তাস তুলে , শতরঞ্চি ঝাড়া দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এরা ধনী জেঠুর প্রজা। বাদবাকি খেলোয়াররা তখন বাড়ী মুখো । সবাই মিলে হাঁটতে থাকে সদর কাচা রাস্তা ধরে , এভারেডি তিন ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলে । শ' খানেক গজ গেলে নুটুকাকা কমে , তারপর আরো শ' দুয়েক পর বাবা পৌঁছে যায় বাড়ীর কলতলায় , হাত পা ধুয়ে ঠাকুর ঘরে নারায়ণ শিলা শয়ান দিয়ে তবে ঘর। ঠাকুর ঘর থেকে বাবা বাঁশের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে যেই , বাইরে ক্যাঁক আওয়াজ হল শুনতে পেলাম। কিসের আওয়াজ? আমরা দুইভাই পিড়ি পেতে ভাত খাচ্ছিলাম , মা সামনে বসে দরজার দিকে পিঠ রেখে। সবাই চমকে উঠে পিঠ খাড়া করে বসলাম , বাবা দরজা একটু ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করলো। বুঝতে বেশি সময় লাগেনি বাবার। অস্ফুটে তার উচ্চারণ কানে এল , ইস , কুকুরটাকে বাঘে নিয়ে গেল রে !
মার্বেলের থলি -
আমাদের একখানি সাদা কাপড়ের থলি ছিল। সর্ষের বীজের মিনিকিট মতো। আমরা দুই ভাই ওটাকে মার্বেলের ভান্ডার বানিয়ে ফেলেছি। এমন নেশা। শ' খানেক ছোটো বড় নানান সাইজের মার্বেল সব সময় আমাদের সঞ্চয়ে থাকতো।
গরমের দিন, স্কুল ছুটি। বাবা বল্ল , সকাল সকাল ধনীবাড়ীর পাট খেত থেকে এক বস্তা ঘাস কেটে আনা। মাঠে ঘাস-টাস কম। গোরুর পেট ভরে না, খিদে থাকলে দুধ কম। আমাদের বাড়ী থেকে উত্তরে আধা মাইলটাক গেলে একটি নদী আছে। মানে ছিল। নদীর পাড়ের জমিতে বিঘা বিঘা জমিতে পাটের আবাদ । ঘাসও তেমন কোমর সমান উঁচু।
দাদা আর আমি একটি বস্তা আর কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সঙ্গে মার্বেলের থলি।
চড়া রোদ । মাঝরাস্তায় শ্রীদামদের বাড়ির পাশে বড় বাঁশবন , সেখানে ঘন কালো ছায়া । ঠান্ডা জায়গা । ওখানে খেলা চলছে । বস্তার ভিতর কাস্তে রেখে আমরাও লেগে গেলাম । কোনদিক দিয়ে যে সময় চলে গেছে বুঝতেই পারিনি । হঠাৎ কে যেন যেন বল্ল , ঐ পালা , তোদের বাবা। দেখলাম বাবা আসছে লাঠি নিয়ে । মার্বেলের থলি ও ব্যাগ নিয়ে দে দৌড়, বাড়ীর দিকে। কলতলায় দুইভাই তাড়াতাড়ি গায়ে জল ঢেলে দিলাম। স্নান করবো। জানি, ভেজা গায়ে বাবা মারবে না কখনো। কোনোরকমে গা মুছেই রান্নাঘরের পিড়িতে। ভাত খাবো , খেতে বসলে শত্রুকেও বাধা দিতে নেই, বাবার শিক্ষা।
খেয়ে উঠে দাদা চলে গেল পায়খানায়, আমিও জমিতে আড়ালে গিয়ে প্যান্ট খুলে বসে থাকলাম। এদিকে বাবাকে তাসের আড্ডা টানছে । ধনী জেঠুর অস্ফুট ডাক। আমরা বসেই আছি, তো আছিই। এটাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা, যে দোষ করেছি। বাবা ধৈর্য হারিয়ে চলে গেল আড্ডায়, শাসানি দিয়ে গেল, রাতে হবে। আমাদের ওভাবে বসে থাকার কাজও শেষ হল। রাতে বাবা বাড়ী ফিরতে ফিরতে দশটা হবে জানি। তখন আর পায় কে! শিবঠাকুরের ,তো চোখ ছোটো করে ঘুমে ঢুলতে শুরু করে দেবো, তাহলেই মারা তো দূর , তালপাতার বাতাস পাবো ঠান্ডা ঠান্ডা , বাবার হাতেই।
যাত্রাপালা -
বারোয়ারী দুর্গাপূজার মাস তিনেক আগে থেকেই শুরু হয় মহড়া । মুকুন্দদের দালানবাড়ির একটা বারান্দাঘরে। রোজ সন্ধ্যেয় সেখানে কুশীলবরা হাজির । সপ্তমী অষ্টমী নবমীর রাতে বাঁধা প্যান্ডেলে যাত্রাপালা । চারখানা কাঠের চৌকি , চারকোণাতে চারখানা পেট্রোম্যাক্স বাতি । বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা গলি সোজা সাজঘরের দিকে ।
বেশি হত মারকাটারি পালা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শাহজাহান, কখনো সীতার বনবাস , কখনো বা দুঃশাসনের ঊরুভঙ্গ পালা। পুরুষ অভিনেতারাই , যারা একটু গায়ে গতরে, তারাই শাড়ি ব্লাউজ পরে সাজতো নারী , কেউ ঘসেটি বেগম , কেউ মেহেরুন্নিসা , কেউ মুমতাজ , কেউ সীতা বা শূর্পনখা , কেউ বা দ্রৌপদী বা গান্ধারী। বাবা গোলগাল চেহারার। মুখ্য নারী চরিত্র ছিল বাবার বাঁধা।
আমাদের ছেলে ছোকড়াদের ব্যাপক কৌতুহল , মহড়া দেখবো। কিভাবে অভিনয় করে অভিনেতারা , কিভাবে হাসে নকল হাসি , কিভাবে মেয়েলি গলায় কথা বলে । আরো একটা বিষয়ে উৎসাহ আমাদের ছিল খুব । ব্লাউজের ভেতরের গোপন রহস্যটা কি! কী দিয়ে অমন ফোলায় বুক ! আমরা গোটা পাঁচেক বেপরোয়া ছেলেও তাই তৈরি। দরজার ফাঁক বা জানালার ফুটো দিয়ে ভেতরে কান্ডকারখানা দেখতে।
দলটার নাম ছিল ভবানী অপেরা। ভবানী রেশন ডিলারের নাম। জয়বাংলার সময় যে কয়েকশো রিফিউজি খাস জায়গায় আশ্রয় পেয়েছিল তাদের খাদ্য বস্ত্র গুড়ো দুধ সাপ্লাই করে বেশ কামিয়েছে। গুড়ো দুধের বস্তা ফুটো করে আমরা খেতাম, তার কি অমৃত সমান স্বাদ! সে অবশ্য অন্য গল্প ।
সেদিন সত্যিকারের এক মহিলা অভিনেত্রীও মহড়ায় হাজির , তাকে যে ছুকড়ি বলে সেটা পরে জেনেছিলাম । জনা দশেক পুরুষ অভিনেতার মাঝে একজন ছুকড়ি , তার ঢলাঢলি দেখলাম , কোনো কোনো পুরুষ অভিনেতা মাথা নামিয়ে বসে , কেউ হাসছে , কারো চোখে লন্ঠনের আলোয় এক অন্য দৃষ্টি । ছুকড়ি কোমর খেলিয়ে বুক ঝাঁকিয়ে নাচছে , তুরু রু রু তুরু রু রু , তেরা মেরা পেয়ার শুরু । চোখে চকচক করছে প্রায় সবার । সোমরসে কিনা , জানি না । তবে বাবা তো সেসবের ধারে কাছে থাকে না ।
আসরে বাবারা সবাই। বাবারা মানে বাবা এবং তার সঙ্গী সাথী । কৃষ্ণ হয় যে , সেই সুনীল নামে কোঁকড়া চুলের লম্বা লোকটি আমাদের দেখে ফেলেছে । তাড়া খেয়ে দৌঁড়ে পালালাম ।
মাঠের গা ছুঁয়ে পাকা রাস্তা । সেখানে টাকমাথা এক শ্যাঁওড়া গাছ । নির্জন । রাত হলে ওপথ একা কেউ মাড়াতে চায় না । গাছের নিচে আমরা চুপচাপ বসে রইলাম । কুশীলবরা ফিরছেন । শুনলাম নানান কথা , একজন বলছে , মাস্টারদা , এই ছুকড়ির পেছনে লাখ খরচা করার মানেই হয় না ।
মাস্টারদা একটি জবাব দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সেই বয়স তার মানে বোঝার মত ছিল না ।
রোজ সকালে আমরা বস্তা পেতে পড়তে বসি । বাবা ভোর থাকতেই কুশোকাকার বাড়ি থেকে গরম চিড়া নিয়ে আসে । সকালে ভাতটা বাবাই বসায় রোজ , মার অনেক কাজ , ঘর পোঁছা , লেপা , ঠাকুরঘর পরিস্কার করা । মা পরে এসে ডাল আলুভাজা করে দেয় , সেই খেয়ে আমরা দুইভাই স্কুল যাই । ভাত নামিয়ে বাবা গরম দুধ আর গরম চিড়া জামবাটিতে দেয় । রোজকার রুটিন ।
পরদিন বাবা বাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে , গতকাল মুকুন্দর বাড়ী গেছিলি ? আর যাবি না , রিহার্সাল দেখলে যাত্রা দেখে মজা নেই । গলা কেমন যেন শান্ত আর ঠান্ডা মনে হল ।
ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম । বাবা ইশারায় খেতে বলে চলে গেল । আর কখনো মহড়া দেখতে যাওয়ার সাহস হয়নি ।
No comments:
Post a Comment