অলীক কথন
বাবাই
মিষ্টু সরকার
প্রকৃতি তার সন্তানের খেয়াল ঠিকই রাখে , রাখে তার কর্মের হিসাব। যেদিন তুমি চলে গেলে তোমার চারপাশের রাস্তায় লাল পতাকা আলো করে ছিলো। চলে যাওয়া, এক অন্য জগতের আহ্বান যেনো, তার ভালবাসার রঙের সাথে।
একটা জীবন তোমার সার্থক তোমার কর্মে। ধনসম্পদ সবার থাকে না, তাও কিছু কিছু মানুষ ধনী হয়, তুমি তাদেরই একজন। রাজার মতো বেঁচে গেলে, কোন কিছু চিন্তা না করেই ।
"আচ্ছা তোমার কি মনে হয় নি কখনো যে তোমার একটা মেয়ে আছে, তার কি হবে ??"
সন্তানের মা-বাবাদের দেখছি একটু স্বার্থপর হয়, সেটুকু ও কি পারোনি আমার জন্য ! এমন সময় ছেড়ে গেলে যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তোমাকে। এগুলো একদিনের কথা নয় বহু বছরের কথা, আজও তোমার ছবির সামনে দাঁড়াতে পারিনা, অস্থির লাগে। হটকারী-তা বড় প্রিয় তোমার ; তাই অসময়ে যাবার সিদ্ধান্ত !!
ভালো কিছু মনে পড়ছে না, সব ভুলে গেছি, অনেকদিন হয়ে গেছে, বুঝলে !!
তোমার লেখা গানের খাতা গুলো অনেকবার চাইলাম তোমার লোকদের কাছে, কেউ দিল না আমায়। কিছুই রেখে গেলে না, একটা স্থির হয়ে যাওয়া ছবি ছাড়া। জানো এখন কত ভালো ভালো ক্যামেরা ওয়ালা মোবাইল পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়ে যেমন খুশি ছবি তোলা যায়। যেন এখন আমিও তোমার মতো একটু আধটু লিখি, তোমার প্রিয় গানগুলো গাই, যেগুলো তুমি শুনতে চাইলে আমার রাগ হত , এখন সেগুলো তোমাকে শোনাই , "তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে" -- এবারও একটা অনুষ্ঠানে গেয়েছি। তোমার ভাবনা গুলো আমাকে তোমার কাজগুলো করায়, কতকিছু তোমাকে কিনে দেবার ছিলো ?? এখন আমি আর মাথা গরম করি না, ভুলে গেছি বোধহয়। তুমি চলে যাবার পরেও দু একবার নামের চিঠি, তোমার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে, তোমার স্কুল তোমাদের সংবর্ধনা দিল, তুমি , বিশ্বনাথ কাকু তোমাদের জন্য আমরা ছেলে, মেয়েরা গেলাম , তোমার নামের সংবাদ কাগজে বেরোলো, যদিও কাগজটা দেখলে আমার হাসি পায়, তাও তো বেরিয়েছে, যে তুমি সবার মরণোত্তর সভা ডেকে বেড়ালে, তোমার নামে কোন সভায় যাইনি। তোমার নামে সম্মেলনের মঞ্চ হল সে বছর, তুমি বলতে তুমি চলে গেলে এসব হবে তোমার জন্য, কি মজা তোমার ! যা দেখতে পাবে না তার জন্য অপেক্ষা। তোমার টানেই ওই ABTA OFFICE টা তে যাই।
মরে গেলে জানো কিছু মানুষ সম্মান পায়, তুমিও পেলে, তুমি তো এতেই খুশি, তোমার শুধু হাসি পায়। সবার কথায় নয় , অনেক মানুষ আছে যারা তোমাকে সত্যি ভালবেসে ছিলো সেই দুর্দিনেও, থাকতে যদি বুঝতে পারতো, তুমি দেখে যেতে পারতে। তুমি তো ভাবতে সবাই তোমাকে ভালোবাসে !! আমাদের হাসি পেতো, তোমার "তুলি" তখন এত ছোট তারও মনে হতো , "দাদু কি বোকা" , "দাদু আমার কিচ্ছু বোঝে না" -- এত সরল কেউ হয় । এর পরের জন্মে সরলতার সাথে একটু জটিল বুদ্ধিও নিয়ে এসো। পাকা সোনার গয়না তৈরী হয় না, সেটা তো জানো।
নিজে চলে গেলে মা কেও নিয়ে গেলে ! মাকে তুমি কি সাথে করে নিয়ে এসেছিলে বাবাই ?? কেনো নিয়ে গেলে ?? মা'কে তুমি ছাড়া অনেক কষ্টে আট -টা বছর রেখেছি, কোনো অযত্ন করিনি। অযত্নে একটাই হলো, সেটা মনের। সেটা সুস্থ করার সব উপায় আমার জানা ছিল না। তোমার অভাব কি করে পূরণ করব আমি ?? তোমার বন্ধু কিছু মানুষ তোমার পরপরই তোমার কাছে চলে গেছে, যারা আছে তাদের দেখে মনে একটা ভালোলাগা কাজ করে। মনে হয় তোমাকে দেখতে পাই। মৃত্যু বড়ো নিষ্ঠুর, আমাদের বাড়িটা সবাই চলে গিয়ে একটা শ্মশান হয়ে গেছে। এই বাড়িটার তোমাকে এই সময় খুব প্রয়োজন ছিল। এত মৃত্যু সকলের এত কষ্ট তুমি দেখে দিতে পারতে না। তাই তুমি আগেভাগেই চলে গেলে । তোমার শারীরিক কষ্ট দেখে এক সময় আমার মনে হয়েছিল, এ সংসারে যাবতীয় কষ্ট তুমি নিজে- র মধ্যে নিয়ে নিলে, কিন্তু দেখালাম আমি পুরোটা সঠিক না । তোমাকে আমার একটি কথা বলা হয়নি। "হয়তো আমি তোমাকে কিছু একটা বলতে পারিনি, তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও,।" তুমি যা যা আমাকে করতে বলেছিলে, আমি সবই করেছি সাধ্য মতো। শুধু একটা ঠিকঠাক চাকরি পাইনি। তুমি এখন থাকলে দেখতে পেতে চাকরি বাজারের অবস্থাটা।
তুমি চলে যাবার খবর পেয়ে তোমার প্রকৃত বন্ধু, প্রকৃত স্বজনরা , তোমার দেশের বাড়ির লোকেরা, কতজন এসে দেখা করে গেছে। আর আমার মা তুমি চলে যাবার ১৩ দিন ধরে অনর্গল কথা বলে, আর সেভাবে কথা বলেনি। যে মাকে আমি ভয় পেতাম, সেই আমার সব কথা শুনত।
অনেক কিছু করার ছিলো, যেগুলো করার জন্য আমার তোমাকেই শুধু দরকার। সেই গুলো একা করার সময় হাঁপিয়ে উঠি। জীবনের অনেক রদ বদল ঘটে গেছে, তোমাদের শিক্ষা যেনো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে সবসময়, এটাই প্রার্থনা করি ।
বাবাইয়ের কথা বলতে গিয়ে সব এলোমেলো ভাবনা, এত বছর পর উল্টোপাল্টা ভাবে আসছে, কি লিখবো কি লিখবো না কিছুই বুঝতে পারছি না, আমারে লেখা যে বা যারা পড়বে বুঝতে পারবে । আমার বাবা হিমাংশু সরকার, যদিও ডাক নাম কালী সরকার হিসেবে সবাই চেনে। সৎ , নির্লোভ, পরোপকারী, উদার মনের, কখনো রাগী,জেদী একজন মানুষ। পেশার প্রাথমিক শিক্ষক আমার বাবা এত পান খেতে বলে ছাত্ররা নাম দিয়ে দেয় "পান খাওয়া মাস্টার"। খুব ছোটো বেলায় (মাত্র 9 বছর বয়সে)বাবাকে হারিয়ে বেশ কিছুটা সময় মামার বাড়িতে মানুষ। চার ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ভাই। খুব কষ্ট করে এদেশে পড়াশোনা, চাকরি, সাংসারিক দায়িত্ব। তার মধ্যেই মেয়েকে নিজের মনের মত করে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে বড় করতে এক পা ও পিছপা হয়নি মানুষ টা। যুগের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল বাবাই। তার সবটুকু এগিয়ে যাওয়া দিয়ে আমাকে মানুষ করেছে। জীবনের সব ভালো যে টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় না, সব ভালো সে কষ্টটুকু বাবাইয়ের কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। বাবাই শুধু আমার বাবা আমার দাদা সিদিদের কাকা। কিছুটা বাবার মতো , কিছুটা বন্ধুর মতো। তার থেকে সাথে ৮থেকে ৮০ যত ধরনের কিম্ভূতকে মাকার গল্প আছে সব শেয়ার করা যায়। নতুন কিছু করা, পুজোয় ঘুরতে যাওয়া , গল্পের মজলিসে প্রধান স্থান নিয়ে নানা গল্প বলা আমার বাবাই। আমরা বাড়িতে এতগুলো ভাই বোন, আমাদের বাইরে যাবার প্রয়োজন খুব কম পড়তো। আর নানা ধরনের হাবিজাবি সাংসারিক ঝামেলার পরও আমাদের বেশিরভাগ ভাই বোনদের টান একই আছে । এই গল্পের আসরটা আমরা ভীষণ মিস করি।
বাড়ি শশুর বাড়ি সব জায়গায় সমান গুরুত্ব সমান দায়িত্ব এই নির্লোভ মানুষটি বারবার পালন করে এসেছেন। সরল মানুষ বলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজ টা তাকেই বেশি করতে হতো অথবা সে না বুঝেই সে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তো। এক্ষেত্রে অনেক সময় অপমান জুটত। তখন বাবাইক কাঁদতে দেখেছি। ছেলেরা কাঁদে না, এ তথ্য আমার বাবাইয়ের জানায় ছিল না । আমারও বিশ্বাস ছেলেদেরও কেঁদে মন হালকা করা উচিত। তবে তাদেরও শরীর হালকা থাকে, অসুখ বিসুখ কম হয় সম্পর্ক গুলো বাঁচে। জানলেও বিশ্বাস করত নাকি না সন্দেহ ? শুধু সমঅধিকারের স্বপ্ন দেখতো মানুষটা। সেই স্বপ্নের বীজ মেয়ের মাঝে পুঁতে দিয়ে আমার বাবাই চললো ভোলা, রইলো ঝোলা।
No comments:
Post a Comment