চিঠি
প্রিয় বাবা
পৃথিবীর কেবল একমাত্র মানুষ তুমি আমার কাছে।তুমিই জন্মদাতা।তুমিই পিতা।তুমিই জনক।যাকে আমি আমার মন খুলে সব বলতে হয়না।বলার আগে বুঝে নেয়।এসব কথা বোঝার জন্য কেবল তোমার মতো একজন মানুষই যথেষ্ট।নিরক্ষর বলে তুমি আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করবার জন্য দিনমজুরের কাজ করে উঠোনে নড়বড়ে খুঁটিতে হেলান দিয়ে জাল বুনতে।অবসর সময়ে সাইকেলে করে বাড়িতে এসে চাটাই মাদুর ঝাঁটা কুলো বুনতে।আর রাতে পড়া বন্ধ করে ঘুমোতে যতক্ষণ না যাই।ততক্ষণ পর্যন্ত ঘুমোতে যেতেন না।বসে ঢুলতেন ঘুমের চোটে।তোমার এই অসুস্থ ছেলেকে কাঁধে নিয়ে পকেট বাঁচিয়ে গাড়ি বাদ দিয়ে পথে হেঁটে ছেলেকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া।নিজেদের পেটে একটুও দানাপানি না দিয়ে সেই টাকায় ঔষধ কিনে বাড়ি ফেরা।আমার প্রথম শিক্ষক, অণুপ্রেরনা।যিনি জমিজমা মায়ের গহনা অলংকার বিক্রি করে।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। মুখে রক্ত তুলে রোজগার করে।রক্ত জল করা আয়ের প্রায় সমস্তটুকু অংশ আমার শিক্ষাখাতে ব্যয় করে আমাকে শিক্ষিত করবার জন্য। মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য। নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য। যে অগ্রন্য ভূমিকা পালন করেছ। তোমার হাত ধরলে বুকে বড় সাহস জাগে।যাকে কখনও পড়তে শেখেনি।ভাঙতে দেখিনি। ভেঙে পড়তে দেখিনি। কাঁদতে দেখিনি। যে মানুষটা মাথার ছাতার মত। যে পরিবারের জন্য সব কিছু করতে পারে। পরিবারের সবার স্বপ্ন দায় দায়িত্ব যার কাঁধে অর্পন করা আছে। আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। চোখের জল ঝরঝর করে পরে মাটি ভেজিয়ে দেয়।মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত হয়। বিশ্বাস করতে পারিনা কীভাবে একজন পুরুষ মানুষ এত্তসব সামলে নিতে পেরেছে বা পারে।বাবা তুমি অবর্ণনীয়।তোমাকে বর্ণনা করা যায় না।তুমি বলেই বলতে পারছি অন্য কেউ হলে হয়তো এসব কথা সাবলীল ভাবে বলতে পারতাম না।আর কখনও বলব না।তখন প্রচণ্ড ছোট আর ছেলেমানুষ ছিলাম।তখন এত্তসব বুঝতাম না। রাজ কি সুন্দর পুজোয় ঝকঝকে পোশাক পরেছে। সন্দীপ দামী দামী খাবার খায়।স্কুলের স্তম্ভের আড়ালে দাঁড়ায়ে থাকতাম ফ্যালফ্যাল চোখে।কত ছেলেমেয়ে খাবার খাচ্ছে।এটা কীভাবে বুঝে সুঝে মাকে প্রতিদিন এক টাকা করে করে দিতে বলেছিলে মাকে।আমি একটু বাবাকে আলাদা চোখে দেখি।তুমি আমার জীবনে ছায়ার মতো।বাস্তব নায়ক।যার হাতের লেখা থেকে কাজকর্ম পর্যন্ত অনুসরণ অনুকরণ করেছি করতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করতে হবে।আমি এমন বাবা পয়েছি ভাগ্য ভালো।এত অভাবের মধ্যেও মুখ ফুটে যা চেয়েছি দেরি হলেও তা পেয়েছি।যেদিন মেলায় খেলনা বন্ধুদের জন্য বাহানা করেছিলাম।নিজেরা না খেয়ে আমায় বন্ধুক কিনে দিয়েছিলে।মিন ধরে এসে ঘরে ঢুকেছে সেই ঢোকার মুখে সুরজিতের ভালো খাওয়া দাওয়া পোশাকের কথা বলতে।হঠাৎ রেগে চটাস চটাস চড় মেরেছিলে গালে।বাবা এসে গায়ে হাত বুলিয়ে বুলে দিল 'মা তোমাকে মেরেছে?ওকে বকে দেব।কি দরকার আমার কাছে বলো তুমি। আমি বলেছিলাম জিন্স প্যান্ট আর জিন্সের জ্যাকেট আর মাছ মাংস ডিম কাঁকড়া ইত্যাদি। তুমি বলেছিলে অনেক দাম বাবা।তবে আজকের নয় তুমি মাধ্যমিকে যদি স্টার পাও তবে সাইকেল সমেত জিন্সের জামা প্যান্ট আর যা যা বলেছ সব এনে দেব।তারপর কোথায় যে মুখ ফুরিয়ে বলে এখন বুঝি সেই সব কথার মানে।মানেটা হল তারপর থেকে ওভাবে আর চাইনি।চেয়েও দেখিনি।এইসব একটা কথার মর্ম এত গভীর?একটি কথার মানে বুঝতেই যে এত সময় লাগে বুঝি?এইজন্য হয়তো কি মধ্যবিত্ত জীবনে শৈশব তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় এবং গিয়ে ছেলে মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুঝতে শেখে বড় হয়ে যায়?তুমি শপথ করে নিয়েছিলে তাস পাশা বড়শির নেশা তারচয়ে বড় নারীর নেশা।নিজের পায়ে যতক্ষন না দাঁড়াতে পারবি ততদিন এগুলোর নেশায় পড়বি না।চাকরি নেই।ছাটাই হয়েছে।আর যে ভাড়াটে বাড়িতে আমি থাকি।সে বাড়িও ছাড়তে পারছি না। আর যদি ছেড়েও দিই। সামনে ভোট।ভোটে বাড়ি যাব।তোমার সাথে কথা হবে।আবার এই শহরে এত ভাল পজিশনের ঘর।সমস্ত ব্যবস্থাই ভাল।বাড়ির মালিক ও মালকিনের ব্যবহার ও খুব ভাল।নিজের ছেলের মতই দেখে।আবার আমার অফিসের কাছাকাছি ছিল।এইসময় যদি ছেড়েও দিই। পরে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।তখন বড় মুস্কিলে পড়ব।আবার সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে যদি বাড়ি চলেও যাই তবে সব শেষ হয়ে যাবে।এর ফাঁকে ফাঁকে যদি কোথাও ইন্টারভিউ দিয়ে একটা কাজ জোটাতে পারলে কেল্লাফতে। কিন্তু এই জনবিস্ফোরণ কর্মসংকোচ কর্মসংকট যুগে একটা কাজ চাই বললে তো সহজে হাতের কাছে পাওয়া যায় না। প্রতিদিন কাগজপত্র গুছিয়ে সি.ভি নিয়ে সেজে গুজে ফরমাল পোশাকে বেরিয়ে পড়ি অফিসের দরজায় দরজায়।পায়ের শুক তলা খইছে।ঘাম ঝরে ক্লান্তি হয় খুব।এদিক ওদিক ছোটাছুটিতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। টেনশনে টেনশনে জর্জরিত। কী হবে!ভাল করে পেটে ভাত যাচ্ছে না।এখন মনে মনে হয় আমার জীবনের কোন দাম নেই।বুঝলাম কর্মহীন পুরুষের খালি পকেটে থাকা খুব বেদনার। কারণ একটা পুরুষ শুধুমাত্র একার জন্য বাঁচে না। তাকে ঘর বাইরে সমাজে অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। বাবা তুমি ছাড়া এসব কথা আর কেউ বুঝবে না।বাবা তুমি আমার জন্য যা করছ তার এক সিকি যদি করতে পারতাম? নিজেকে সুপুত্র হিসেবে বুক বাজিয়ে বলতে পারতাম। মা তোমাকে এই মা দিবসে বিশেষ করে কিছু দিতে পারলাম না। অনেক ইচ্ছে ছিল আমার বাবাকে রাজার মত রাখব। অনেক ভাল রাখব।জীবনের সব দুঃখ মুছে দেব।পাশে থাকব।কাছেই রাখব।চোখের জল ফেলতে দেব না।হতাশা হতেই দেব না।সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ না করে আবার নতুন করে আমি দুঃখ দিয়ে ফেললাম ক্ষমা কর।আজ আমার হাতে কোন কাজ নেই। তোমাকে সেবা করবার সকল মুহুর্ত।আমি কি করে তোমার কাছে হাত পাতব বাবা।ছেলেদের কাছে এটা বড় অপমানজনক।তেত্রিশ বয়স হয়েছে।বড় হয়েছি।বড় লজ্জা লাগে।নিজের মধ্যে একটা খারাপ লাগা বাসা বাঁধে।এখন তোমাকে আমার দেওয়ার কথা না করে আমাকে হাত পাততে হচ্ছে। বড় দুর্ভাগ্যজনক। বাবা আমি জানি তুমি আমায় ভুল বুঝবে না।সত্যি বলছি তোমার ছেলে আর কখনও ভুল করবে না বাবা।এই পিতৃ দিবসে এমন কিছু লেখা আমার ঠিক হয়নি। তবুও এটা যে চরম সত্য। আর কতদিন সত্য চেপে রাখব বাবা?সত্য চেপে রাখতে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে হবে। জীবন দুর্বিশহ হয়ে উঠবে। জীবন জটিলতায় ভুগবে। তার আগে সব বলে বুকের পাথর সরিয়ে দিলাম। তুমি সুস্থ স্বাভাবিক থেকো সর্বদা।তোমাকে কথাগুলো বলে বেশ হালকা মনে হচ্ছে আজ। আর কথা না বাড়িয়ে অত্যন্ত একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা করছি।বাবা এই চিঠির উত্তর দিও।
ইতি
বিনীত
তোমার স্নেহের তপু
তপন মাইতি
No comments:
Post a Comment