ব্যক্তিগত গদ্য
বাবা আমার রোল মডেল
বিপ্লব গোস্বামী
আমার বাবা হচ্ছেন আমার রোল মডেল। কারণ বাবার মধ্যে যে সব গুণ দেখেছি তা অন্য কারো মধ্যে খোঁজে পাইনি। আমার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। তিনি শুধু দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে উঠেননি। তাঁর সারাটা জীবন ছিল যুদ্ধময়। কখনো বা দরিদ্রতা, কখনো বা সামাজিক দায়িত্ব পালন, আর কখনো পারিবারিক সমস্যা। কিন্তু কোন সমস্যাই তাঁকে তাঁর কর্তব্য পালন আর দায়িত্ববোধ থেকে সরাতে পারেনি। নিষ্ঠা ও কর্তব্যের সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
আমাদের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের সিলেটের বড়লেখার অন্তর্গত ছোটলেখা গ্ৰামে।আমাদের পরিবারটি ছিল বড়লেখার এক সম্ভ্রান্ত পরিবার। অনেক নাম ডাক ছিল ।আমার প্রপিতামহ ছিলেন হেডমাস্টার। দাদু ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। আমার পিসি ছিলেন পাঁজন। প্রত্যেকজনই ছিলেন মায়না পাস। সেকালে যদিও মেয়েদের লেখাপড়ার তেমন প্রভাব ছিল না। কিন্তু আমাদের পরিবারের প্রত্যেকজন মহিলা ছিলেন শিক্ষিত। দেশভাগের সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে আমার পিতামহ এদেশে চলে আসেন। তখন বাবার বয়স পাঁচ বছর। আমার বড় পিসেমশাই ছিলেন শিক্ষক। দেশ ভাগের সময় যে দাঙ্গা হয়েছিল সে দাঙ্গায় বড় তিনি খুন হয়ে যান। এরপর বড় পিসি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। আমার বাড়িতেই থাকতেন। ওঁর কোন সন্তান ছিল না। তাই তিনি আমাদেরকে সন্তানের স্নেহ দিতেন। বাবা বড় পিসিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। নিজের মায়ের মতো সেবা যত্ন করতেন। পিসিমাকে সব সময় আনন্দ ফুর্তির মধ্যে রাখতেন। কোন দিন তাঁর সেবা যত্ন ত্রুটি করেননি।
বাবার মধ্যে ছিল সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা,কর্ তব্যপরায়নতা,নিয়মানুবর্তিতা, বাগ্মীতা, ক্ষমা, দয়া, সরলতা, শিষ্টাচার প্রভৃতি দশটি ঐশ্বরিক গুণ। একজন ব্যক্তির মধ্যে এত সব গুণ থাকতে পারে তা আমি অন্য কারো মধ্যে খুঁজে পাইনি। তাই বাবাকেই আমার রোল মডেল মেনে নিয়েছি। ছোট বেলা থেকেই বাবার এইসব গুণ দেখে দেখে বড় হয়েছি। বাবার কিছু গুণ আমাকে খুব আকৃষ্ট করত। বাবার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল নিয়মানুবর্তিতা। বাবা সব সময় রুটিন মাফিক কাজ করতেন। সময়ের কাজ সময় মত করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিয়ম মাফিক জীবন যাপন করেছেন। অবাক করার বিষয় হলো বাবার বয়স যখন আশি তখনও বাবা নিয়ম মেনে চলতেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে ঠাকুর পূজো দিয়ে ঘন্টা দুই এক যোগ ব্যায়াম করতেন। এভাবেই নিয়ম মেনে দিনের শুরু করতেন আর নিয়ম মেনে দিন শেষ করতেন।
তাছাড়া বাবার মধ্যে দায়িত্ববোধ ছিল খুব বেশি। নিজে যেমন দায়িত্ব পালনে খামতি করতেন না ঠিক সেরকম অন্যকেও দায়িত্ব পালনে অনুপ্রেরণা দিতেন। আমি ও আমার বড় দাদা সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে বাবা তাগাদা দিতেন। আবার বন্ধের দিনে আমরা যখন স্কুলের যাওয়া জন্য তৈরি হতাম না তখন বাবার কাছে কৈফিয়ত দিতে হত। কেন স্কুলে যাচ্ছিনা? আজকে কিসের বন্ধ? আরও কত কি। তাছাড়া বাবা ছিলেন খুব নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল। তিনি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন। বাবার কাছে শিখেছি নিষ্ঠা ও দায়িত্ব সহকারে নিজের পেশাগত জীবনের কর্তব্য পালন করতে।
বাবা ছিলেন একজন সুবক্তা। বাবা সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় খুব সুন্দর করে বক্তৃতা দিতে পারতেন।তিনি অতি সহজেই মানুষের মন জয় করে নিতেন। বক্তব্য রাখার দেওয়ার কৌশল আমি বাবার কাছ থেকেই শেখেছি।
তাছাড়া বাবার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল সততা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও বাবা কখনও সততা ত্যাগ করেননি। বরং সততাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন। এই সততাই তাঁকে উন্নতির চরমে পৌছে দিয়েছিল।
বাবা ছিলেন খুব সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ। তাই তো তাঁর কোন শক্র ছিল না। তিনি ছিলেন অজাতশক্র। সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। জীবনে কোন দিন বাবার রাগ দেখিনি। কেউ কিছু বুঝতে না চাইলে বাবা তাকে যুক্তি দিয়ে বুঝাতেন। বাবার সঙ্গে কখনো কারো ঝগড়া হয়নি। তাছাড়া বাবার অন্যতম গুণ ছিল ক্ষমা। অতি সহজেই বাবা ক্ষমা করে দিতেন। কেউ যদি অপরাধ করে ক্ষমা চেয়ে দিত তবে বাবা তাকে ক্ষমা করে দিতেন। বাবা ছিলেন খুব দয়ালু স্বভাবের মানুষ। দারিদ্র্য ও অসহায়দের প্রতি বাবার একটা আলাদা ভালোবাসা ও মায়া ছিল। বাবা তার সাধ্য মতো গরীবদের সাহায্য করতেন।
আজ বাবা নেই কিন্তু বাবার শেখানো নীতি শিক্ষা আমার পথের পাথেয়। আমি বাবার শেখানো পথ ধরেই হাঁটছি। বাবাকে অনুপ্রেরণা করে আমার লক্ষ্যের দিকে চলছি। বাবা আমার অনুপ্রেরণা। আমার আদর্শ।
No comments:
Post a Comment