Sunday, June 2, 2024


 

ব্যক্তিগত গদ্য 


আমার বাবা

লীনা রায়


বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েকদিন। উত্তরবঙ্গ থেকে সোজা দুর্গাপুর। বৈশাখের প্রায় শেষ। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। কালবৈশাখীর দেখা নেই। বিকেল চারটে। হঠাৎ শন শন হাওয়ার শব্দ। ছুটে ব্যালকনিতে আসি। অবশেষে কালবৈশাখী। স্থান, কাল ভুলে সিঁড়ি ভেঙে সোজা ছাদে। জোর হাওয়া, ধুলো উড়ছে। আমি তার মাঝে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আমার পাগলামির সঙ্গী আমার শ্বশুরমশাই, আমার বাবা।

         ঝড় বৃষ্টির রেশ ছিল দিন দুয়েক। আবার সেই গরম। বরমশাই  কাজের সূত্রে থাকতেন বর্ধমানে। সেবার উইক এন্ডে বাড়ি এলে বাবা ওকে আমার জন্য নাইটি এনে দিতে বলেছিলেন। সেই অসহ্য গরমে নাইটির স্বস্তি – অবশ্যই বাবার কল্যানে।

          বাবা আমার একাকিত্ব অনুভব করতেন। আমার সঙ্গে বসে 'এক আকাশের নীচে ' সিরিয়াল দেখতেন। আমরা থাকতাম ডেভিড হেয়ার স্ট্রিটে। সেই পাড়াতেই থাকত জুলি, গুনু , মুনু, বেবি, মানুরা। বিকেলে বাবা ওদের ডেকে আনতেন আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য। বেশ হই হই করে বিকেলটা কেটে যেত।

        মর্নিং শিফট থাকলেই বাবার সঙ্গে বিকেলে স্কুটারে চেপে ঘুরে বেড়াতাম। বাবা আমাকে দুর্গাপুর চেনাতেন। বেনাচিতি, গান্ধী মোড়, সিটি সেন্টার, এ  জোন, কুমারমঙ্গলম পার্ক – ভিন্ন দিন, ভিন্ন জায়গা। সপ্তাহে একদিন নিয়ে যেতেন চন্ডিদাস। সবজি, মাছ কিনতে।

        এরপর প্রায় একবছর বাপের বাড়ি কাটিয়ে ছেলে নিয়ে দুর্গাপুরে আসি। তার আগে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে দাদু, ঠাকুমার কাছে। গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় আমার চুল প্রায় হাঁটু ছুঁয়েছিল। ঘরের বৌয়ের অত লম্বা চুল নাকি সংসারে অমঙ্গল আনে। কেটে ফেলবার পরামৰ্শ অনেকে দিয়েছিল। কিন্তু বাবা চুল কাটতে দেননি। বলেছিলেন আমার চুলের জন্য যদি তার সংসারে অকল্যাণ হয়, তিনি মেনে নেবেন।

       বাপের বাড়ি, গ্রামের বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে ভাবতে হয়নি। দুর্গাপুরে এসে বুঝলাম কাজটা বেশ কঠিন। সংসার , ছেলে – সব মিলিয়ে নাজেহাল। সেই সময় ছেলেকে বেশির ভাগ সময়টা বাবা সামলাতেন ।

       এরপরেই বরমশাই-এর জন্ডিস ধরা পরে। শাশুড়ি মা আমাকে বর্ধমানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।বাবার এতে মত ছিল না। নাতিকে ছাড়তে চাইছিলেন না। ঘর ভাড়া করা হল। যাবার দিন যত এগিয়ে আসছিল বাবা কেমন বদলে যাচ্ছিলেন। আদ্যপান্ত শান্ত মানুষটা কথায় কথায় রেগে যেতেন। কম কথা বলতেন। ঠিক মত খেতেন না।

        যাবার দিন বরমশাই-এর বন্ধু অলক আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল। আমার ছেলে তো অলকের কোলে গাড়িতে। দাদুভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেও না। গাড়ি চলতে শুরু করল। বাবা বাচ্চাদের মত শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির পাশে ছুটছেন।হাত বাড়িয়ে নাতিকে একটু ধরতে চাইছেন। আমরা মানা করছি। বাবা শুনছেন না। গাড়িটা  বা দিকে বাঁক নেবার মুহূর্তেও দেখলাম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন বাবা, একা।  

No comments:

Post a Comment