গল্পে বাবা
লাঙল
মৌসুমী চৌধুরী
সন্ধের অন্ধকার কিছুটা গাঢ় হয়ে এলে
বারান্দায় এসে বসল সবিতা। গাছের একটাও পাতা নড়ছে না। প্রকৃতি যেন থম ধরে আছে। গাছেরা সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে গুম মেরে। পুকুরধারে ঝিঁঝি পোকাদের কনসার্ট বসেছে। পুকুরধারে ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে অজস্র চুমকির মতো ছড়িয়ে আছে জোনাকিরা। আকাশে ঢলঢল করছে পূর্ণ যুবতী এক চাঁদ। স্বচ্ছ সাদা মেঘের দল প্রেমিকের মতো রূপসী চাঁদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাঁদ তার রূপোলি আঁচল খুলে উড়িয়ে দিয়েছে নারকেল, আম, জারুল গাছের মাথায়। আকাশের দিকে চেয়ে চাঁদ আর মেঘের কানাকানি দেখতে দেখতে চোখটা ছলছল করে ওঠে সবিতার। বুকটা চুর চুর হয়ে ভেঙে যেতে থাকে। সমীরের কথা ভাবতে ভাবতে মনটা আজ বড্ড অস্থির হয়ে ওঠে তার।
আজ বিকেলে অফিসের শেষে সবিতার কম্পিউটার সেন্টারের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সমীর। তারপর সবিতাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। তখনই কথাগুলো বলেছিল সমীর,
— " তুমি কি তোমার বাবার একমাত্র সন্তান? তোমার তো আরও তিনটে দিদি
আছে। তাদের কি কোনও দায়িত্ব নেই?"
— " দ্যাখো, বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী।
সংসারে অভাব। ছোড়দি বা আমি কেউই চাকরি পাচ্ছি না। আমাদের গ্রামে টিউশনে পয়সা নেই। তাহলে কি করব, বল?"
রাগত স্বরে বলেছিল সবিতা।
— " তাই বলে যে হাতে তুমি কম্পিউটার
ধর, সেই হাতে তুমি একাই লাঙল তুলে নেবে? আর তোমার দিদিরা সব নাকে সরষের তেল দিয়ে দিন কাটাবে?"
একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে সমীরের গলায়।
— " ছোড়দিও তো চেষ্টা করছে। কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সরকারি চাকরির জন্য দিদি কতটা কষ্ট করছে দেখছি তো, আমিও যদি ওই একইভাবে সময় দিই তাহলে আমাদের পরিবারটা চলবে কিভাবে ?"
সবিতা বোঝাতে চেষ্টা করে।
— " আর আমাদের স্বপ্নের কি হবে?
মা যে তোমাকে এই অঘ্রাণেই আমাদের
বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছেন। "
মরিয়া গলায় বলেছিল সমীর।
— " এখন কোনভাবেই আমার নিজের কথা ভাবা সম্ভব নয়, সমীর। তুমি বরং অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও।"
বলেই ট্রেনের কামরায় পা রেখেছিল সবিতা। ঝমঝম করে ট্রেনটা তখন সদ্য প্ল্যাটফর্মে ঢুকেছে।
কম্পিউটার ক্লাস থেকে ফিরে এসে চুপচাপ শুয়েছিল সবিতা। বাবা তাঁর ঘর থেকেই চিৎকার করছিলেন,
— " ওরে সাবু, খেয়ে নে, খেয়ে নে , মা। এরপর তো পিত্তি পড়ে যাবে!"
দিদি এসেও ডাকাডাকি করেছিল। কোন সাড়া করেনি সে। তার খেতে ইচ্ছেই হচ্ছিল না একদম। সমীরের সঙ্গে পাঁচ বছরের সম্পর্কটা কি তবে ভেঙেই গেল?
সমীরের সঙ্গে একই কলেজে পড়ত সবিতা। সমীর তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিল তাদের। সবিতা ইতিহাস অনার্সের ছাত্রী আর সমীর ছিল অ্যাকাউন্টেসীর। কলেজ থেকে বেরিয়ে ভালো নাম্বারের জোরে ইন্ডিয়ান পোস্ট অফিসে চাকরি পেয়েছে সমীর। কথা ছিল সবিতার গ্র্যাজুয়েশান শেষ হলে বিয়ে করবে তারা। তারপর দু'জনে একসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরির পরীক্ষাগুলো দেবে। কিন্তু সবিতা গ্র্যাজুয়েশান শেষ করবার আগেই হঠাৎ তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানা বন্দী হলেন। তীব্র আর্থিক সংকটের মুখে পড়ল তাদের পরিবার। এমন কি স্নাতক স্তরে ভালো ফল করবার পরও সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল না। সবিতার বাবার রোজগার ছিল চাষভিত্তিক। তিনি তাঁর চার বিঘে জমিতে কখনও ধান, কখনও ফুল, সর্ষে, কিংবা সবজি চাষ করেছেন চিরকাল। সেই রোজগারেই বাবা তাঁদের চার বোনকে সাধ্যমতো শিক্ষিত করে তুলেছেন। দুই দিদিকে পাত্রস্থ করেছেন। কিন্তু এখন তিনি অক্ষম। কোনক্রমে হুইলচেয়ারে করে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই টুকটাক চলাফেরা করেন। বাবার মতো কর্মঠ মানুষের বর্তমান অসহায়তা প্রতিদিন কুরে কুরে খায় সবিতাকে। কি করবে ভেবে কোন কুল কিনারা পায় না।
ছোটবেলা থেকেই বাবাকে খুব লড়াই
করতে দেখেছে সবিতা। নিজের জমিতে নিজেই অসম্ভব খাটতেন তিনি। বাবাকে জমিতে কাজের জন্য কেউ কখনও খেতমজুর রাখতে দেখেনি। নিজেই তিনি চাষ করতে নেমে পড়তেন। তার বাবাকে দেখে সবিতাদের গাঁয়ের অনেকেই লড়াই করতে শিখেছে। সেই বাবা যখন চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়লেন আকাশ ভেঙে পড়ল সবিতাদের গোটা পরিবারের মাথায়। কিভাবে সংসার চলবে, কিভাবে চলবে বাবার চিকিৎসা সেই চিন্তায় হতাশ হয়ে পড়েছিল তারা। মা শহরে তিন বাড়িতে রান্নার কাজ নেবেন বলে ঠিক করলেন।
সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সবিতার। নানা দুশ্চিন্তায় কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না। ঘর থেকে থেকে বেরিয়ে উঠোন পরিয়ে পুকুরের দিকে হেঁটে যেতেই হঠাৎ পিছন থেকে বাবার ডাক শুনতে পায় সে,
— " আমায় একটু জমির দিকে নিয়ে যাবি, সাবু? ঘুম আসছে না রে, একটু হাওয়া খেয়ে আসি।"
হুইল চেয়ার ঠেলে বাবাকে নিয়ে এসে জমির ধরে দাঁড়িয়েছিল সবিতা। পুব আকাশ চিরে তখন ফিকে কমলা রঙা ভোর নেমে আসছিল পৃথিবীর বুকে। ফরসা হয়ে আসছিল চারদিক। আর করুণ চোখে বাবা তাকিয়েছিলেন বীজতলাটার দিকে। এখন আমন ধান চাষের বীজতলা তৈরির সময়। বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে একা হাতে সবটা করতেন। দিদি আর সবিতাও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসে জমিতে নেমে সাহায্য করত। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ সবিতাকে অবাক করে দিয়ে বাবা তার হাত চেপে ধরে বলে,
—" আমি আবার চাষ করব, সাবু। তুই আমাকে সাহায্য করবি।"
— " তুমি? কিভাবে বাবা? আর আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারব? ধুর...কি সব যে বল না!"
বিস্মিত হয়ে বলে সবিতা।
— " আলবাত পারবি তুই। তুই আমার মেয়ে। তোকে পারতেই হবে। "
দৃঢ় গলায় বলেছিলেন বাবা।
— "আমিই তোকে শেখাব সবটা। চিন্তা করিস না।"
বাবার চোখ-মুখ যেন জ্বলজ্বল করতে থাকে ।
— "কিন্তু বাবা, আমি যে সরকারি চাকরি করতে চাই। সেটাই আমার স্বপ্ন।"
সবিতা বলেছিল ধীর ধীরে।
— " সে চাকরি কবে কি হবে, তার কি কোন ঠিক আছে রে, মা? চাকরি-
বাকরির দিশা না পেয়ে কত ছেলেমেয়ে
হতাশ হয়ে পড়ছে। কানে তো আসে সবই। বাস্তব সমস্যা তো টিভিতেও দেখছি। সরকারি চাকরি না পেলে কি করবি? না খেতে পেয়ে মরবি নাকি? তারচেয়ে বরং নিজের জমি নিজেই চাষ করবি। চাষীর ছেলে যদি চাষী হতে পারে, তার মেয়ে কেন নয়?"
বাবা বলে চলেন আপন মনে।
তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল সবিতাদের বাবা-মেয়ের কঠিন সংগ্রাম! বাবা সবিতাকে হাতে ধরে শিখিছিলেন সব। পয়সার অভাবে ট্রাক্টর ভাড়া করতে বা খেতমজুর রাখতে পারেনি তারা। একা হাতে সবিতা জমি তৈরির কাজ, লাঙল দেওয়া থেকে বীজ বোনা সবই করতে লাগল। বাবার কাছেই সে জেনেছিল, যে পরিমাণ জমির ওপর ধান চাষ হবে তার দশ ভাগের একভাগ জমির ওপর বীজতলা তৈরি করতে হয়, দেড় ডেসিমাল বীজতলায় দুই থেকে তিন কেজি বীজ বুনতে হয় কিংবা কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক দিয়ে ধানের বীজকে শোধন করতে হয়, তাতে জমিতে ব্যাকট্রেরিয়াল বা ফাংগাল সমস্যাগুলো কমানো যায়। জমি কাদা করবার পর ধান চারা রুইতে হবে উত্তর -দক্ষিণ লাইন বরাবর। তাতে আলো বাতাস খেলবে ভালোভাবে। প্রতিটি ধানচারা লাগানোর ব্যাবধান রাখতে হবে ছয় থেকে আট ইঞ্চি। জমির কাদা মাটিতে ধান চারা পুতে দিয়ে মূলটা বেশি চেপে দেওয়া যাবে না। ধানচাষের এই রকম সমস্ত খুঁটিনাটি বাবার কাছেই শিখে নিয়েছিল সে। শিখতে শিখতে অবাক হয়ে সবিতা ভেবেছে তার মতো পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও মাটির রকম সকম বুঝে মাটি তৈরি করা, ভালো ফলন কি পদ্ধতিতে হবে ইত্যাদি চাষ- আবাদের সমস্ত বিষয়েই বাবার কত গভীর জ্ঞান! চাষের প্রতিটি স্টেপের কাজে বাবা হুইলচেয়ার নিয়ে তার পাশে পাশে থাকতে শুরু করেছিলেন। আর ঘাম ঝরিয়ে জমিতে লাঙল দিতে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে সবিতা নিজেই নিজেকে বলে গেছে,
—" ফাইট কোনি ফাইট..."
প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি লাগত সবিতার। একটু লজ্জা লজ্জাও করত। গ্রামের মানুষেরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাত। মেয়ে হয়েও নিজে লাঙল-গরু নিয়ে হাল দিয়ে জমিতে কাদা করছে, রোয়া গাড়ছে, সার ছড়াচ্ছে এসব জিনিস বোধহয় তাদের কাছে একেবারে মঙ্গল গ্রহের ব্যাপার-স্যাপার বলে মনে হচ্ছিল! কিন্তু ধীরে ধীরে সে অনুভব করেছে কৃষি ব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিতে দিতে কাজটা ক্রমে তার কাছে সহজ, চ্যালেঞ্জিং ও অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে উঠেছে। তাই আর পিছন ফিরে দেখেনি। প্রাণপনে শুধু চেষ্টা করে গেছে ভালো ফসল ফলাতে।
শেষ জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুর গড়িয়ে চলেছে বিকেলের কোলে। মৃদু বাতাস ঢেউ খেলে যাচ্ছে কচি সবুজ ধানখতের মধ্য দিয়ে। যেন আদিগন্ত সবুজ গালিচায় ছেয়ে আছে সবিতাদের পুরো জমিটা। মা আর সবিতা মিলে নিড়িয়ে দিচ্ছে জমি। হুইলচেয়ারে বসে স্মিত মুখে তাকিয়ে দেখছে তার বাবা। আর হাসতে হাসতে বাবা বলছেন,
— " এবার তো বেশ ভালো গাছ হয়েছে রে, সাবু। তোর হাতে সত্যি জাদু আছে! এবার খুব ভালো ফলন হবে দেখে নিস। আমার হাতের থেকেও বেশি। এ যে দেখছি একেবারে গুরুমারা বিদ্যে ...হাঃ হাঃ হাঃ...।"
বাবার হাসির রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই হঠাৎ মোটরসাইকেলের ভটভট শব্দ কানে আসে সবিতার। মুখ তুলে তাকিয়ে সে দেখে সেই লাল-কালো হিরোহুন্ডা মোটরসাইকেলটা চালিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছে সমীর, তার পিছনে বসে রয়েছেন একজন বয়স্কা মহিলা।
No comments:
Post a Comment