মহৎ হৃদয়
শুভেন্দু নন্দী
"-কি সুন্দর ঝকঝকে বিকেল। নীল আকাশে এক ঝাঁক সাদা বক ডানা মেলে উড়ছে। সামনে খরস্রোতা নদী। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। শেষ রশ্মি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত এক বাগানবাড়ি। ভেতরে প্রচুর পুরনো গাছ- জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে প্রাচীর। মাঝে মাঝে ভেঙে পড়েছে দেওয়ালের আস্তরন। হঠাৎ চারিদিকে প্রবল অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। গাছগুলো যেন দৈত্যাকারে সামনের দিকে জঙ্গল ভেদ করে ধেয়ে এলো। পৈশাচিক সুরে কে যেন অট্ট হাস্য করে বলে উঠলো,
- সমরেশ! তোকে কিছুতেই ছাড়বোনা। আমার দিকে লক্ষ্য করে তুইই-তো গুলি ছুঁড়েছিলি। অবশ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলো। কিন্ত তাতে কি ? Attempt to murder-তো খুনেরই সামিল"
আরে! এতো জগাই ! সবাই তো ওকে যমের মত ভয় করে ওর সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্য।
- কিন্ত আমি তো গুলিটা করিনি। সত্যি বলছিরে। করিনি
- কি রে দাদা! বলছিস কীরে তুই? কাকে এই ভর সন্ধ্যায় খুন করার কথা বলছিস ? আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না রে....
সমরেশ ভাবলেশহীন হয়ে চারিদিক তাকালো। এখন তো সত্যিই বিকেল! তা হোলে এই সুন্দর দৃশ্য, জঙ্গল, জগাই-এর তেড়ে-ফুঁড়ে আসা- সবটাই কী স্বপ্ন? ভাই-এর কথায় সম্বিত ফিরে এলো। সে তার দেখা স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি করে বলতে লাগলো,
- বুঝলি ভাই, দশ বছর পূর্বে ঘটা একটা ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছিনা। স্বপ্নে সব সময়েই সে হাজির হয় বিশ্রীভাবে।
- তা না হয় বুঝলাম। কিন্ত তোর হাতে বন্দুক কি করে এলো ? ভালো করে ভেবে বলবি।
- সে সময় ছোট্ট ছিলি রে তুই ! বাবার সাথে মাঝে মাঝেই যেতাম বনে,জঙ্গলে,নদীর চরে। বাবা শিকার করতে ভালোবাসতেন তো ! তাই সঙ্গে সবসময়ই বন্দুক থাকতো। আর তাতে গুলি ভরা। নিরাপত্তার কারনে বাড়িতে এই বন্দুক রাখা,আর ঘোরাঘুরির সময় কাছে রাখা। তোআমি তা চালানো শিখেও নিয়েছিলাম....
- তাহলে বন্দুক নিয়ে একাই ছিলি, জঙ্গলে শিকার করার অভিপ্রায়ে?"
-হ্যঁরে! সেটাই হোলো আমার "কাল" বুঝলি ? তমোনাশের সাথে হঠাৎ দেখা হোয়ে গেলো। আমার বন্ধু, তুই তো জানিস। সে বললো, তোর হাতে তো দারুন টীপ। ঐ দেখ। জগাই আসছে - ওর ওপর প্রয়োগ করে দেখা দিকি একবার?
-কি সাংঘাতিক কথা বলছিস,তুই এক্কেবারে ছেলেমানুষের মতো?
- ঠিক আছে। আমাকে একটু বন্দুক চালানো শিখিয়ে দিবি ভাই?
-অন্যমনস্কভাবে এ ব্যাপারটায় ট্রিগার টিপে ওকে শেখানোর ফাঁকে আচমকাই বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে গেলো। আর হোলো প্রচন্ড শব্দ। ঘটনার আকস্মিকতায় তমোনাশ পালিয়ে গেলো জঙ্গলের মধ্যে। আর আমার হাতে বন্দুক দেখে আমাকেই জগাই culprit বলে ধরে নিলো। আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ওকে কিছুতেই convince করাতে পারলামনা যে একাজ আমার নয়....
-তারপর?
-জগাই এগিয়ে আসার উপক্রম করলো সবেগে। ইতিমধ্যে ধূলিধূসরিত ঝড়ের তান্ডব হোলো শুরু। তখন তো সন্ধ্যাবেলা ছিলো। অন্ধকার আরও ঘন হোলো। সেই সঙ্গে মেঘের প্রচন্ড গর্জন। আকাশ ভেঙে নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। হাওয়ায় গাছপালা যেন দুলতে লাগলো। ওকে আর দেখা গেলোনা ঐ ঘনঘোর অন্ধকারে। এক সময়ে জঙ্গলে সে হারিয়ে গেলো। আমিও দূর্গানাম জপ করতে করতে সিক্তবস্ত্রে অবশেষে বাড়ি ফিরলাম।
-তবে গল্পটা এখানেই শেষ হোলে ভালো হোতো, বুঝলি ভাই?
- মানে? জগাইদা কী থানায় F.I.R. করেছিলো? তমোনাশদারই বা কি খবর ? জগাইদা কী বরাবরই এরকম ?
- নারে। একদম না। আসলে সৃষ্টিকর্তা রূপের বিতরণ করার সময় ভালোরকম কার্পণ্যতা করেছিলেন - যার জন্য চেহারায় এক অদ্ভূত রকমের অস্বাভাবিকতা ছিলো। তার ওপর ছোটবেলায় "বসন্তে" মুখে ভয়ানকভাবে ক্ষতের বিশ্রী দাগ দুঃর্গ্রহের মতো বয়ে বেরাতে হোতো সবসময়ে দারুণভাবে। ক্লাশে সবাই তাকে দারুণভাবে ঠাট্টা, বিদ্রুপ করতো। ভীষণ হীনমন্যতায় ভুগতে সে। অথচ জ্ঞান, বুদ্ধিতে ঈশ্বর তাকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্ত ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় তার ইতি হয়েছিলো। যেটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিছু করেনি আমার against-এ থানায়। হঠাৎ সেদিন দেখা হয়েছিলো তমোনাশের সাথে সুদীর্ঘ প্রায় দশ বছর পরে। তার কাছে শুনেছিলাম সব কিছু। সে এক করুন কাহিনী।
- কি হয়েছিলো ?
একটু বিরতির পর সমরেশ শুরু করলো।
-তমোনাশ বলেছিলো- আমি জগাইদের পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে ও এখন অনেক শান্ত। আসলে বাড়িতে পরিবেশ ছিলো অশান্ত। বাবা বেহেড মাতাল। আকন্ঠ মদ পান করে করে লিভার পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। চিকিৎসার বাইরে একদম চলে গিয়েছিলো। আর মা ক্ষোভে,দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলো। দুটো এই দুর্ঘটনার পরে আনমনা হয়ে চলতে চলতে একদিন লক্ষ্য করলো একটা বাচ্চা ছেলে ব্যাগ নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, আর সেই সময় উল্টো দিকে একটা চলমান বাস
আস্তে দেখে তাকে ছিটকে রাস্তার ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো জগাই। ছেলেটি রক্ষা পেলো কিন্ত গাড়িটি তার ওপর সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে চলে গেলো।
- তারপর দাদা, কি হোলো?
- তমোনাশের কথামতন গতকাল গিয়েছিলাম হাসপাতালে। দেখলাম আপাদমস্তক ব্যান্ডেজ বাঁধা। শুধু চোখ দুটো খোলা। যমে মানুষে টানাটানি চলছে। তমোনাশকে দেখে কেঁদে ফেললো আর আমাকে বললো, " সেদিনের ঘটনার জন্য আমাকে ক্ষমা করিস।" এই ছিলো তার শেষ কথা। অবশেষে সমস্ত চিকিৎসা বিফল করে চলে গেলো সে চিরতরে না ফেরার দেশে।
No comments:
Post a Comment