Tuesday, March 4, 2025


 

রঙ লাগালে বনে বনে

অনিতা নাগ 



দুপুর বেলার দুটো ঘন্টা একেবারে নিজের মতো করে কাটায় অনামিকা। হেরফের হয়না তা নয়। সে’দিন একটা প্রজাপতি বারবার জানলায় এসে বসছে। কি সুন্দর রঙীন তার পাখা। কি যেনো বলছে কানে, কানে! এই মেয়ে বেড়াতে যাবি তোর ছোটবেলায়? চল না চল। সেখানে মনের পাখনা মেলে যতো ইচ্ছে ঘুরে বেড়াস। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়! গাছের পাতায় তখন বিষন্ন রোদের মাখামাখি। অনামিকা প্রজাপতির পাখায় ভর করে মনকে নিয়ে ছুট লাগালো ছোটবেলায়। ঐ যেখানে দুপুরে ঘুমন্ত মায়ের পাশ থেকে সন্তর্পনে বারান্দায় বেড়িয়ে আসতো, সেইখানে। পাড়ার দাদারা এ'খান ওখান থেকে ডালপালা, শুকনো কাঠ সব এনে জড়ো করে রেখেছে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সকলে মিলে ন্যাড়াপোড়া বানাবে।কোন পাড়ার ন্যাড়াপোড়ার আগুন বেশী দূর যাবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলে। সেসব দিয়ে একটা বড় কিছু বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে মুখ চোখ এঁকে একটা বিশালাকায় কিছু বানানো হতো। রাতে, পাড়ার সকলের কাজকর্ম সারা হলে,ন্যাড়াপোড়ায় আগুন দেওয়া হতো। আকাশে তখন চাঁদের আলোর লুটোপুটি। আর সকলে মিলে গেয়ে উঠতো ‘আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল,পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বলো হরিবোল’। কি আনন্দ, কি আনন্দ। তখন হোলিকা দহনের গল্প জানা ছিলো না। মা বলতেন চারদিকের শুকনো গাছের ডালপালা যেমন পরিস্কার হতো, তেমনি এই তাপে মশা, পোকা সব কমে যেতো। হয়তো তাই হতো। পরের দিন দোল। অনামিকাও রঙ খেলতো সকলের সাথে। সবার আগে ঠাকুরের পায়ে আবির দেওয়া, তারপর বাড়ীর সকলের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করা। তারপর পেতলের পিচকারিতে রঙ ভরে দাঁড়িয়ে থাকতো। নিজেরাই ভিজে একশা হতো। দাদাদের তো চিনতেই পারতো না। বাঁদরে রঙ মেখে ভূত সেজে ঘুরতো সব। মন উড়ে চলে, এ'ঘর, ও'ঘর, স্মৃতির অলিন্দে।

দোল বললেই উজ্জ্বল সব রঙ, রাশি রাশি আনন্দ। মালপো, প্যারাকি, নানান মিষ্টি। গোপাল, কৃষ্ণ ঠাকুর, দাদু ঠাকুমা, বাবা, মা, বন্ধু, নানান টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ কেমন আনমনা করে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় ঠাকুর ঘর থেকে ভেসে আসে পাঁচালির সুর ‘দোল পূর্ণিমার নিশি, নির্মল আকাশ, মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস’। পূজো শেষ হলে প্রসাদ। তখন ক'দিন প্রসাদে মঠ, ফুটকড়াই, মুড়কি। কি যে প্রিয় ছিলো! সক্কলে খেতো। এতো স্বাস্থ্য সচেতনতার বালাই ছিলো না। দোলের ক'দিন আগে থেকেই তো হৈহৈ। দোলের সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার এক সাহিত্যচর্চার আসরে দাদা নিয়ে যেতো। কতো নাচ, গান, আবৃত্তি। তারপর রাতের খাওয়ায় গোটা একটা ডিম থাকতো। পাতে গোটা একটা ডিম পাওয়ার কি যে আনন্দ ছিলো! অনামিকা চোখ বন্ধ করে প্রজাপতির পাখায় ঘুরে বেড়ায়। এঘর, ওঘর, অলিন্দ পেরিয়ে উঠোন, ছাদ। ঐ যে পুরোনো জামা বার করে কেচে দিয়েছেন মা। দোলের দিন ঐ জামা পড়ে রঙ খেলবে। তখন পলাশ, শিমুল ছবিতেই দেখেছে। ঐ নিয়ে মাথাব্যথা ছিলো না। স্কুল পেরিয়ে কলেজ। কলেজে বসন্ত উৎসবে বড় আনন্দ হতো। সবাই মিলে সে’এক অপূর্ব উদযাপন! হঠাৎ মুঠোফোনের টুংটাং শব্দে রঙিন প্রজাপতিটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো! মনের দরজা পেরিয়ে আনমনা অনামিকা বাস্তবে ফেরে। চোখ আটকে যায় ক্যালেনডারের পাতায়। আর ক’দিন পরই দোল। এখন দোল যতো না পালিত হয়, হোলির রমরমা তার থেকে বেশী। বিভিন্ন প্যাকেজে আজকাল দোলের উৎসব হয়। কতো চাকচিক্য, কতো কালার কোড, ড্রেস কোড। কতো রঙের বাহার। হার্বাল রঙ, হার্বাল আবির। তখন সে’সবের বালাই ছিলো না।




বসন্তে প্রকৃতিও আপন রঙে সেজে উঠে। শিমুল, পলাশ, অশোকে, কিংশুকে কতো রঙ আর রূপের বাহার। ব্যাস্ত তিলোত্তমার আনাচে কানাচে মুঠো মুঠো লাল, হলুূূদ,কমলা রঙ কেমন যেনো নেশা ধরায়। অনামিকার বাস যেখানে সেই আবাসনে শিমুল আর রুদ্রপলাশের রঙের কতো বাহার। গাছের তলায় লাল রঙের লুটোপুটি। আপন নিয়মে সে ফোটে আবার ঝরে যায়। রঙের নেশায় মন হারিয়ে যায়। দূর থেকে একটা সুর ভেসে আসে ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে’। সারাজীবন ঐ রঙ টুকুই তো আগলে রাখার চেষ্টা। শ্রীকৃষ্ণ দোল পূর্ণিমায় শ্রীরাধিকাকে প্রথম রঙ দিয়েছিলেন। তারপর সখী সহ কৃষ্ণ-রাধার রঙ খেলা। এ'রঙ প্রেমের রঙ, সমর্পণের রঙ। সেই প্রেম, সেই সমর্পন আজো বৃন্দাবনে গুঞ্জরিত হয়। দোল উৎসবে মেতে উঠেন আপামর বৃন্দাবনবাসী। দোল ফাগুনের এই রঙ তো শুধু রঙ নয়। এই রঙ ভালোবাসার, বিশ্বাসের, সৌহার্দ্যের। অনামিকাদের আবাসনেও হোলিকা দহন হয়। আধুনিকতার বেড়াজালে সাজানো একটা স্ট্রাকচর, নির্দিষ্ট বেষ্টনীতে। চাঁদের আলোয় হোলিকা দহন হয়। অশুভের বিনাস হোক, এই প্রার্থণা। যুগ পাল্টায়। যুগের সাথে পাল্টে যায় জীবন বোধ, তার উপস্থাপনা। অনামিকা ভাবে তবু বেঁচে থাকুক আমাদের সংস্কৃতি। এই নবীনদের হাতেই তো আগামী দিন এগিয়ে চলবে। তাদের দিন তো ফুরিয়ে এলো। খেলা ভাঙার খেলা চলছে। কবে হঠাৎ সুখের বাসা ফেলে যাওয়ার ডাক আসবে জানা নেই। তার আগে নিত্য নিজেকে ভরিয়ে নেওয়া। রঙ ছড়িয়ে আছে জীবনের প্রতিটি পাতায়। রোজকার যাপনে না পাওয়ার পাল্লাকে ছাপিয়ে উঠুক পাওয়ার আনন্দ। তখন আর চারপাশটা কালো লাগবে না। সেই আলোয় নিত্য পূর্ণ হয়ে উঠা। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়, চুলে যখন রূপোলী ঝিলিক, অনামিকা তখনও নিত্য রঙ খুঁজে বেড়ায়। পথে ঘাটে, গাছের পাতায়, টবের ফুলে, নিত্য যাপনে। সব রঙ মিলে-মিশে কেমন এক আশ্চর্য্য মায়াময়তা। নিজের মনেই গুনগুন করে অনামিকা ‘রঙ যেনো মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে’। এখন তো আপনি আর কোপনি। চিরাচরিত প্রথায় ঠাকুরের চরণে রঙের অর্ঘ্য দেওয়া। তারপর প্রিয়জনদের ছবিতে প্রণাম। সকলের আজ সুদূরে বাস। নাগাল পাওয়ার জো নেই। ছেলে, মেয়ে জামাই, নাতি সব প্রবাসে। ভিডিও কলে উৎসব যাপন। বুড়োবুড়ি নিজেরাই নিজেদের রাঙিয়ে নেয়। সে'দিন পূজোর নৈবেদ্যে ফুটকড়াই, মুড়কি,মঠ। অনামিকা আগলে রাখে পরম্পরাকে, তার ভালোলাগাকে, জীবনের রঙকে সামলে রাখে পরম আদরে আর সোহাগে। মনে মনে গুনগুন করে  
‘ কে, রঙ লাগালে বনে বনে,ঢেউ জাগালে সমীরণে।
   আজ ভূবনের দুয়ার খোলা দোল দিয়েছে বনের দোলা
            দে দোল! দে দোল! দে দোল!’।

ছবি- লেখক 

No comments:

Post a Comment