ও আমার মাতৃভাষা, সোনা রোদের গান
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি লিখেছেন মায়ের ভাষা সোনা রোদের মতোই উপভোগ্য একটি বিষয়। একটি শিশু জন্মানোর পর " মা " একটা শব্দ আপনা আপনি শিখে যায়। ধীরে ধীরে সে সব কথা শিখে যায়, যার বেশিটাই অনুকরণে এবং মা-বাবা, আত্মীয় -পরিজনের প্রচেষ্টায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, " শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান "।
জলপাইগুড়ি জেলায় ৩৮ টি জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। এই ৩৮ টি জনগোষ্ঠীর ভাষা বা ডায়ালেক্ট ও আলাদা আলাদা, আবার একটি মাতৃভাষার কথ্য রূপও (Dialect) এলাকা বিশেষে আলাদা। বোড়ো এবং রাজবংশী ভাষায় ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি খুব বেশী করে প্রত্যক্ষ করি। চা বলয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ সাদরি ভাষায় কথা বলেন।
বাংলা এবং বাঙালির জয়যাত্রা সমানেই অব্যাহত আছে। একটা ছোট বিষয়ের ওপর আলোকপাত করলে বিষয়টা কিছুটা হলেও পরিস্কার হবে। পশ্চিমবঙ্গে CBSC স্কুলের সংখ্যা ২৬০, হিন্দি মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা ৯৯৮ টি, ICSC স্কুলের সংখ্যা যেখানে ৩৫৩১ টি, সেখানে বাংলা মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা ৬১২৯ টি।
যে সকল ছাত্রছাত্রী ইংরেজি বা হিন্দি মাধ্যমে পড়াশোনা করে তারা বাংলা ভাষাকে পছন্দ করে না, বাংলা ভাষায় কথা বলে না বা রবীন্দ্র সংগীত গায় না, শোনে না বা পছন্দ করে না, এমনটা একেবারেই নয়। তবে আশংকা এবং উদবেগের বিষয় যেটা, তা হ'ল বাংলা ভাষার ভুল বানান লেখা, ভুল উচ্চারণ এবং বিকৃত ভাবে পরিবেশন করা। অপশব্দের ক্রমাগত বাড়বাড়ন্ত এবং প্রয়োগ।
বাংলা ভাষার ধ্রুপদী সম্মানের জন্য বর্তমানে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে। আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা সমিতির এদেশ, বাংলাদেশ এবং বিদেশের সব শাখাগুলো এই দাবীতে সোচ্চার হয়েছেন। বর্তমানে সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কান্নাড়ি মালায়ালাম ও ওড়িশি ভাষা এই ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে দেড় হাজার বছরের পুরনো ভাষা।
সর্বশেষ সংযোজিত ভাষা ওড়িশি ভাষা ও বাংলা ভাষার মতো মূল প্রাকৃত ভাষা থেকেই জন্ম নিয়েছে।
বাংলা ভাষা ধ্রুপদী সম্মান পেলে এই মিষ্টি ভাষাটি ভারতীয় সব বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে বাংলা ভাষার বিভাগ সৃষ্টি হবে। আমরা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হব।
বাংলা ভাষাকে আরও জনপ্রিয় করতে আমাদের সকলকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। কথায় বলে, " পরিবর্তন ঘর থেকেই শুরু হয়।" আমরা প্রত্যেকে যদি নিজেদের বাড়ীর নাম, নামের ফলক, গাড়ীর নম্বর ফলক, চিঠির বাক্সের ওপর লেখা ঠিকানা, দোকানের সাইনবোর্ডে, বাংলায় লিখি তা হলে গোটা রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরেও বাংলা ভাষার প্রসার ঘটবে।
সাম্প্রতিক কালে UNESCO বাংলা ভাষা কে বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক কথায় আমরা খুশি কিন্তু কোনো একটি জনগোষ্ঠীর মানুষের সাথে দীর্ঘদিন বসবাস করলে এ কথা বোঝা যায় তাদের মাতৃভাষাও খুবই মিষ্টি। সাদরি এবং রাজবংশী মানুষের সাথে দীর্ঘদিন থাকবার পর আমি নিজে ব্যাক্তিগত ভাবে এই দুটি ভাষাকে হিন্দি, পাঞ্জাবি, অসমীয়া ভাষার মতোই বলবার চেষ্টা করি,শুধুমাত্র সেই ভাষার মিষ্টতার কারণে।
SSK এবং MSK এর শিক্ষক শিক্ষিকারা সেই জনগোষ্ঠীভুক্ত হলে বা একই ভাষাভাষীর মানুষ হলে প্রাথমিক এবং প্রাক প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থার আরও প্রসারিত হবে।
ত্রিপুরা সরকার ৯০ হাজার জনগণের ভাষা " বিষ্ণুপুরী মনিপুরী " ভাষার মাধ্যমে সেই রাজ্যের প্রাথমিক স্তরে পঠন পাঠনের ব্যাবস্থা করলেও, আমাদের রাজ্যের দীর্ঘ দিনের দাবি রাজবংশী ভাষাকে অষ্টম তপশিলে স্থান দেন নি। তবে এটা আশার বিষয় সরকারি বদান্যতা ছাড়াও মিষ্টি রাজবংশী ভাষায় অসংখ্য কবিতা প্রবন্ধ এবং উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আগামী দিন গুলোতে কুরুক, সাদরি, বোড়ো, টোটো, মেচ, রাভা প্রতিটি ভাষায় গান কবিতা সরকারি মান্যতার সাথে সাথে জনপ্রিয়তা লাভ করবে আশাকরি।
এছাড়াও বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্তরে উন্নতিকরন নিয়ে আবেদন নিবেদনে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাড়া দিয়েছেন, যেটা আজকের দিনে অত্যান্ত আনন্দের বিষয়। সাম্প্রতিক কালে ইংল্যান্ড এ বাংলা ভাষা কে সেই দেশের দ্বিতীয় ভাষার স্থান দিয়েছেন, এটা খুবই ভালো লাগা একটা বিষয়।
No comments:
Post a Comment