Saturday, October 31, 2020


 

স্মরণ 

 


 রঞ্জন ভট্টাচার্য 

লক্ষ্মী নন্দী 

প্রয়াণ- ১লা নভেম্বর, ২০২০

 

 সম্পাদকের কথা

 হেমন্তের হলুদে বিষাদের স্পর্শ। মা ফিরে গেছেন। অশ্রুসজল করেছেন আমাদের। আসলে আমাদের সবাইকেই ফিরে যেতে হয়। মায়ের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য একটাই যে, মা আবার ফিরে আসেন কিন্তু আমরা আসবো না। তবে ব্যক্তি জীবন থেমে গেলেও, রয়ে যাবে জীবনপ্রবাহ। আর সেই প্রবাহের হাত ধরে আমরাও আসবো ফিরে অন্য নামে, অন্য বেশে। জীবন বোধহয় এইজন্যই সুন্দর। জীবন না ছেড়ে যাবার আকুলি তাই সবসময়!

হারিয়েছি অনেককে এবার। আলোর উৎসবের প্রাক্কালে তাঁদের কথা মনে হচ্ছে বারবার। বিরুদ্ধে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেলেন কত ব্যক্তি-মানুষ। হেরে গিয়েও যেন জিতিয়ে গেলেন মানবজীবনকে। বলে গেলেন নিরুচ্চারে যে, অন্যের স্বার্থে তাঁদের এই চলে যাওয়া তখনই মাত্রা পাবে যদি সম্মিলিত লড়াইয়ে আমরা মুক্ত করতে পারি এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। তাই এই দীপাবলি হয়ে উঠুক প্রকৃত আলোর উৎসব, অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণের উৎসব।



মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন দীপাবলি সংখ্যা ১৪২৭


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড 
কোচবিহার 
৭৩৬১০১
 
 প্রকাশক- রীনা সাহা 
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন দীপাবলি সংখ্যা 


 

 এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

ডঃ ইন্দ্রানী বন্দোপাধ্যায়, বিপ্লব গোস্বামী, সুবীর সরকার, রাহুল, সত্য মোদক, ইন্দ্রানী পাল, অনুনয় চ্যাটার্জি, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, উমা শঙ্কর রায়, মাথুর দাস, রীনা মজুমদার, আফতাব হোসেন, মৌসুমী চৌধুরী, সুদীপ কুমার বোস, দেবদত্তা লাহিড়ী, তপেন্দু নারায়ন রায়, বিজন মজুমদার, কমলেশ মন্ডল, সায়ান্তন ঘোষ, অতনু মৈত্র, আপরোজা খাতুন, ফিরোজ হক, চুমকি দাস, সাত্যকি, নবনীতা, অদিতি মুখার্জি (সেনগুপ্ত), নিত্য রঞ্জন, মজনু মিয়া, শ্যামল কুমার রায়, অমিতাভ সরকার, প্রনব রুদ্র, বিজয়কৃষ্ণ সরকার, মাম্পী রায়, অঞ্জলী দে নন্দী

 

 

 

 

 


 

 

 

 

 

 

 

 

 

কাল স্বরূপিনী কালী ও বঙ্গদেশে কালী পুজোর সূচনা
                ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
 
কালী নামটিতে রয়েছে  রহস্য ও মাধুর্যের অপরূপ সম্মেলন। কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকর্তীতঃ  যিনি সর্বভূতকে কলন বা গ্রাস করেন তিনি কালী। দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপটি হলেন কালী। সৃষ্টির আদিতে যখন দশ দিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন তখন তিনি একমাত্র বর্তমান ছিলেন। তিনি স্বয়ং ব্রহ্মা কেও কাজে নিয়োজিত করেন।শিব তাঁর মায়ায় বশীভূত হয়ে পদতলে নিষ্ক্রিয় শবের মত শুয়ে থাকেন । তিনি রুদ্রাণী মহাকালী তাই প্রয়োজনে জগৎ সংহার ও করতে পারেন-- 
মৃত্যুর্জিহ্বা মহামারী জগৎসংহারকারিণী
 মহারাত্রিঃ মহানিদ্রা মহাকালী অতিতামসী....
 মহানির্বানতন্ত্রে দেবীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অস্ত্রের প্রতীক বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
সৃষ্টির আদিতে সব তমোময়  শুধু মাত্র তিনি ই ছিলেন তাই তাঁর গায়ের রং ঘোর কালো। তবে সাধকরা তাঁকে দেখেন নানা রূপে নানা বর্ণে ,শ্যামা রূপা কালীর মধ্যে ভক্তরা বরাভয় মূর্তি খুঁজে পান।তাই   তিনি  সব কিছু র উর্দ্ধে ভাব ও ভক্তির  বিষয় মাত্র।
তিনি সংহার করেন ,প্রলয়কালে সব তাঁর মুখের ভিতর  লয় পায় তাই তিনি করালবদনা।
আলুলায়িত কেশ গতির প্রতীক।জীবকে মায়া ডোর থেকে মুক্তি দেন এবং  বিলাসবর্জিতা ও নির্বিকার তাই তিনি মুক্তকেশী।
তাঁর চারটি হাত , বাম ঊর্ধহাতে খড়্গ, সেই খড়্গ দিয়ে  নিষ্কাম সাধকের মোহপাশ ছিন্ন করছেন।নীচের হাতে ধরে রেখেছেন  সাধকের ,যা তত্ত্ব জ্ঞানের আধার।অন্য দুটি হাতে ভক্ত কে দিচ্ছেন বরাভয়। ভয় ও কারুণ্যের সমাহার তাঁর চার হাতে।
দেবীর গলায় মুন্ডমালা ,এর সংখ্যা পঞ্চাশ।এই পঞ্চাশ টি মুন্ড বর্ণমালার পঞ্চাশ টি বর্ণের প্রতীক।
সর্ববন্ধন যিনি দূর করেন ,দশদিক যাঁর আবরণ ভূমাস্বরূপিনী দেবীর বস্ত্রের কি প্রয়োজন ? তাঁর যোগ্য বস্ত্র পাওয়া যায় না তাই তিনি দিগম্বরী।
তাঁর দু কানে দুটি শিশুর শব কানের আভরণ এর কারণ রূপে তন্ত্র বলেছেন  -   বালকের মতো সরল সাধক ই দেবীর প্রিয় ,দুটি  শবের আভরণ তার প্রতীক।
দেবীর শ্বেত দন্ত পংক্তি সত্ত্ব গুণের প্রতীক,ঐ সাদা দাঁতের চাপে দমন করে রেখেছেন রজোগুণ, তাঁর রক্ত বর্ণের জিভ রজো গুণের প্রতীক। 
তাঁর অনাবৃত বক্ষস্থল বিশ্ব মাতৃত্বের প্রতীক।
তাঁর কোমর বেষ্টন করে আছে মৃত মানুষের হাত।হাত দিয়ে মানুষ কাজ করে,যে যেমন কাজ করে  সে পরবর্তী কালে  ফল পায় , পছন্দ মত ফল দেবার জন্য তিনি হাত গুলি জড়িয়ে রেখেছেন। মানুষের সব কাজ কালীতেই লীন হয় এটি তার ই প্রতীক।
স্বর্গ মর্ত্য ও পাতাল এই তিন লোক এবং অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের  সব কিছু  সূর্য,চন্দ্র ও অগ্নি এই তিনটি চোখে দেখেন বলেই তিনি ত্রিনয়না।
মহাকালী নিত্য ক্রিয়াশীল আদি প্রকৃতি এবং শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ।শিব শক্তির অধীন।শবাকার শিব শক্তি
যুক্ত না হলে প্রাণ ফিরে পান না,স্পন্দিত হন না। তাই জাগ্রত হবার অপেক্ষায় দেবীর মুখাপেক্ষী হয়ে পায়ের তলায় তিনি শয়ান।
শ্মশান মানুষের কর্মভোগের শেষে বিরতির স্থান।
মুক্তি দাত্রী করাল বদনার আলয় ই তাই শ্মশান। তাঁকে পেতে গেলে জাগতিক কামনা বাসনা ত্যাগ করতেই হবে।
তন্ত্রমতে শক্তি ও শিব একে অপরের পরিপূরক। কালী সৃষ্টি,ধ্বংস,পুষ্টি ও বৃদ্ধি র মূল কারণ।শিব ও শক্তির মিলনে সাম্যরস থেকে উৎপন্ন হয় বিশ্বজগৎ।
    পরবর্তী কালে  ধীরে ধীরে তান্ত্রিক আচারের মধ্যে    দুর্নীতি ঢুকে পড়ে ও দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের ফলে বাঙালি হিন্দু সমাজের সর্ব স্তরে এক মহাদেবী কে তুলে ধরার এক নতুন প্রচেষ্টা শুরু হয়। আরো বলা যায়,  ষোড়শ শতকে এমন কয়েক জন বিখ্যাত  সাধকের আবির্ভাব হয়েছিল যাঁরা প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রের পুনর্মূল্যায়ন করেন ও তন্ত্র শাস্ত্রের  যন্ত্র ও ঘটের পরিবর্তে শাক্তদেবী কালী কে প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে আমাদের বাংলায় কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত্রিতে কালীর যেরূপ মূর্তি পূজা করা হয় তার প্রতিরূপের বর্ণনা আছে আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে বঙ্গদেশে রচিত বৃহদ্ধর্মপুরাণে। সাধারণ ভাবে গৃহীত একটি মত হলো যে আনুমানিক ষোড়শ শতকে নবদ্বীপবাসী তান্ত্রিক  সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বঙ্গদেশে তান্ত্রিক উপাসনার ক্ষেত্রে শক্তিদেবীকে কালীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে নিজের হাতে মাটি দিয়ে স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রতিমা গড়ে অমাবস্যার রাতে নিজে পুজো করে বিসর্জন দিতেন।সেই অর্থে তিনি বঙ্গদেশে কালীপুজো র প্রবর্তক।তবে রাজার আনুকূল্য না পেলে কোনো সামাজিক বিধি প্রচলিত হয় না।তাই আরো দুই শ বছর পর কৃষ্ণনগরের মহারাজা কালীভক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে  প্রথম সামাজিক স্তরে কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন একথা বলা যেতে পারে।
কালী উপাসনা প্রচারে মঙ্গলকাব্য , শাক্তপদাবলী ও শ্যামাসঙ্গীতের গুরুত্ব অপরিসীম একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
পরিশেষে দেখা যায় যে পার্বত্য জনজাতির প্রিয় অনার্য দেবী  ক্রমে বঙ্গদেশে শিবের সহচরী  ও শক্তির দেবী   রূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন , শুধু তাই নয় ক্রমশঃ ভক্তের কাছে বিপদতারিনী মা  আদ্যাশক্তি রূপে আরাধিত হয়েছেন। এমনকি আত্মজা রূপে  অন্তরের সিংহাসনে স্থান পেয়েছেন ... কাল স্বরূপিনী কালী কে প্রিয়জন ভেবে মানস পুজো করেছেন ভক্তরা।কালী যে বঙ্গ দেশে বাঙ্গালীর হৃদয় জয় করে গৃহবধূ রূপে ও  ঘরে ঘরে চিরন্তন আসন পেয়েছেন তার সার্থক প্রতিচ্ছবি দেখি সাধক কমলাকান্তের পদাবলী তে কালীর রূপ বর্ণনায় --
     ''কালো রূপ দেখিলে আঁখি জুড়ায়
    কপালে সিঁদুর, কটিতে ঘুঙুর, রতন নুপূর পায়
হাসিতে হাসিতে কত দানব দলিছে,রুধির লেগেছে পায়।''


 

 

 

 

 

 

 

 

খবরের কাগজ বিক্রেতা থেকে রাষ্ট্রপতি

বিপ্লব গোস্বামী

খবরের কাজগ বিক্রেতা থেকে বিখ‍্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী, শেষে দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি।না এ কোন সিনেমার গল্প নয়।এ কোন গল্প বা নাটকের নায়কের কথা নয়। সিনেমার গল্পকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এক মহা নায়কের নাম এ.পি.জে আব্দুল কালাম।যিনি সমগ্ৰ ভারতবাসীর কাছে গর্ব।যার অনন‍্য কীর্তি ও দেশত্ববোধ প্রত‍্যেক ভারতবাসীর কাছে এক মহান অনুপ্রেরণা।

                 ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর অধুনা ভারতের  তামিলনাড়ু রাজ‍্যের উপকূল সংলগ্ন রামনাথস্বামী জেলার রামেশ্বরমে এক দরিদ্র তামিল মুসলমান মৎস‍্যজীবী পরিবারে আব্দুল কালামের জন্ম।তাঁর পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আব্দুল কালাম।তাঁর বাবার নাম জয়নুল আবেদিন ও মায়ের নাম অশিয়াম্বা।তাঁর  বাবা ছিলেন অতি দরিদ্র এক নৌকা চালক।যিনি রামেশ্বরামের ও তার সংলগ্ন ধনুষ্কোডিতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের পারাপার করতেন।অভাবের সংসার তাই অল্প বয়সেই  পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বভার পরে কালামের উপর।পড়াশোনার খরচ চালানর জন‍্য খরবের কাগজ বিক্রি করতেন তিনি।সময় সময় বাবাকে নৌকা চালাতেও সাহায‍্য করতেন।
    
              রামেশ্বরম প্রাথমিক বিদ‍্যালয় থেকে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু।তারপর রামনাথপুরম স্কোয়ার্টাজ ম‍্যাট্রিকুলেশনেরস্কুল থেকে মাধ‍্যমিক পাশ করেন।পড়াশোনায় তিনি ছিলেন সাধারণ মানের  ছাত্র কিন্তু পড়াশুনার প্রতি তার মনোযোগ ছিল গভীর ।তিনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন।রাত দুইটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন আবার ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে বাবাকে কাজে সাহায‍্য করতেন।বিদ‍্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পরিবারের আর্থিক অভাব মিটাতে তিনি সংবাদ পত্রে লিখতে শুরু করেন।

               রামনাথপুরম স্কোয়াটর্জ ম‍্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ভর্তি হন চিরুতিরাপল্লী সেইন্ট জোসেফ কলেজে।১৯৫৪ সালে সেই কলেজ থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক পাশ করেন।উক্ত কলেজে পড়ার সময় বিশিষ্ট অধ‍্যাপক চিন্নারেড্ডি ও কৃষ্ণমূর্তির সান্নিধ‍্যে তিনি বিকিরিত রশ্মির জ্ঞান অর্জন করেন ।সেই সময়ই বিজ্ঞান চেতনার আধ‍্যাত্মিক চেতনার অপূর্ব মিলন ঘঠে আব্দুল কালামের।স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰী অর্জন করে তিনি ভর্তি হন মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এম.আই.টি)।সেখান থেকে তিনি এ্যারোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং -এ ডিপ্লোমা করেছিলেন।তারপর বাঙ্গালোর হিন্দুস্তান এ্যারোনেটকিস্ লিমিটেড থেকে বিমান ইঞ্জিনিয়ারিং -এর স্নাতক ডিগ্ৰি লাভ করেন।
      
              ১৯৬০ কালাম ভারতীয় পতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার এ্যারোনটিক‍্যাল ডেভেলপমেন্ট স্টাবলিশমেন্ট অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও) তে বিজ্ঞানী হিসাবে যোগদান করে তার কর্ম জীবন শুরু করেন।সেখানে তিনি প্রখ‍্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ডঃ বিক্রম সারাভাইয়ের অধীনে কাজ করতেন।এরপর ১৯৬৯ সালে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিচার্জ অর্গানাইজেশনে (আইএসারও)স‍্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পান।১৯৮০ সালের জুলাই মাসে আটারো তারিখে তাঁর নেতৃত্বে এস এল বি -৩ রকেটে রোহিনী নামের উপগ্ৰহকে তার কক্ষপথে সফলতার সঙ্গে স্থাপন হয়।এই উপগ্ৰহ স্থাপনের ফলে ভারত একটি মাইলফলক ছোঁয়ে ফেলে।এরপর এই মহান বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে মাত্র দশ বছরে ভারত পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মিশাইল নাগ,পৃথ্বী,আকাশ,ত্রিশূল ও অগ্নি ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়।এই ক্ষেপনাস্ত্র গুলো তৈরি করে ক্ষেপনাস্ত্র শক্তির দিক থেকে ভারত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নিত হয়।মহাকাশবাহী রকেট ও ব‍্যালিস্টিক ক্ষপনাস্ত্র প্রযুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে বিপ্লব আনার জন‍্য আব্দুল কালামকে "ভারতের মিশাইল ম‍্যান" বলা হয়।

           ১৯৮২ সালে আব্দুল কালাম প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হন।সেই বছর আন্না বিশ্ববিদ‍্যালয় কর্তৃক তাঁকে "ডক্টরেট" উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।ঐ বছর স্বদেশী মিসাইলের উন্নতির জন‍্য তাঁর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় যেখানে তাঁকে সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।১৯৯৮ সালে কালামের নেতৃত্বে ভারত দ্বিতীয় বারের জন‍্য পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা করতে পরেছিল।পরমাণু বিস্ফোরণের সেই সফলতা তাঁকে ভারতের সবচাইতে বিখ‍্যাত ও সফল পরমাণু বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত করে তোলে।

             ছোটবেলা খবরের কাগজ বিক্রি করা আব্দুল কালাম ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন।তাঁর কার্যকাল ছিল ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত।তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বদা ভারতের উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন।বাচ্ছা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি অতি আন্তরিক ভাবে ভাব বিনিময় করে আনন্দ উপভোগ করতেন।রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনগনের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল অত‍্যন্ত স্বচ্ছ।তিনি জনগণের কাছে এতটাই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন যে জনগণ তাঁকে জনগণের রাষ্ট্রপতি (people's presiden)বলে অভিহিত করত।তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের অনুপ্রেরণা।মৃত‍্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্মঠ ও নিয়মানুবর্তিতা।রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েও তার জীবন যাপনের কোন পরিবর্তন হয়নি।তিনি যথা রিতি রাত দুটায় ঘুমাতে যেতেন এবং ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন।সাধারণ মানুষের জন‍্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবন খোলা।বিশেষ করে বাচ্ছাদের জন‍্য সব সময় খোলা ছিল তার দরজা।

              তিনি কতটা মানব দরদী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা কালীন একবার রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়।কারণ ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন‍্য একটা নিয়মিত রেওয়াজ আছে যে রাষ্ট্রপতি রমজানের ইফতার পার্টির আয়োজন করেন।সে অনুযায়ী আয়োজনের উদ‍্যোগ নেওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন সে পার্টিতে কত টাকা খরচা হবে।তিনি জানতে পারলেন সে পার্টিতে প্রায় ২২ লক্ষ রুপি খরচা হবে।তখন তিনি নির্দেশ দিলেন সেই টাকা দিয়ে খাদ‍্য, পোষাক ও কম্বল কিনে কয়েকটি এতেম খানায় দান করতে।এরপর নিদিষ্ট এতেমখানা বাছাই করে রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয় এবং তার কথা মত নিদিষ্ট এতেমখানায় খাদ‍্য ও পোষাক বিতরণ করা হয়।

               কালামের প্রাপ্ত পুরস্কার ও উপাধির সংখ‍্যা ছিল প্রচুর।তিনি ৪০ টি বিশ্ববিদ‍্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্ৰী লাভ করেন। ১৯৮১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মাননা প্রদান করে।তারপর তিনি ১৯৯০ সালে ভারত সরকার কতৃক পদ্মবিভূষণ সর্বোচ্ছ অসামরিট সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্ছা অসামরিক সম্মান "ভারতরত্ন" সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন।তাছাড়া তিনি ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার  কতৃক বীর সাভারকার,২০০৭ সালে  অনারারী ডক্টরেট অব সায়েন্স,২০০৭ সালে  ইক ,কে কতৃক কিং চার্লস মেডেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।এছাড়া তিনি জাতীয় নেহেরু পুরস্কার,ইন্দিরাগান্ধি জাতিয় সংহতি পুরস্কার প্রভৃতি অনেক উল্লেখযোগ‍্য পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন।

              তিনি নব প্রজন্মকে প্রজ্জ্বলিত করে রাখতে চেয়েছিলেন।তিনি শিক্ষা ব‍্যবস্থান সৃজনশীলতার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।তাছাড়া তিনি সময়োপযোগী শিক্ষা ব‍্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন।তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসতেন।ভালোবাসতেন নিজের জীবনের শিক্ষা তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে পৌছে দিতে।এভাবেই ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম‍্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে "বসবাস যোগ‍্য পৃথিবী" নামক বিষয়ে বক্তব‍্য রাখছিলেন।ভারতীয় সময় ৬ টা ৩০ মিনিটে বক্তব‍্য রাখা অবস্থায় তার হার্ট এ্যটাক হয়ে যায়।সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেথানি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সন্ধ‍্যে ৭ টা ৪৫ মিনিটে তিনি ইহলোক ত‍্যাগ করেন।

                একজন অতি সাধারণ মৎস‍্যজীবি -নৌকা চালক গরীব ঘরের ছেলে সততা,পরিশ্রম,মেধা,যোগ‍্যতা ও দক্ষতার ফলে কতদূর এগোতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ.পি.জে আব্দুল কালাম।তাঁর অনন‍্য অবদান প্রতি জন ভারতবাসীর কাছে অনুপ্রেরণা।নব প্রজন্মের কাছে তিনি আদর্শ পুরুষ।দেশবাসীর কাছে তিনি প্রণম‍্য হয়ে আছেন আর অনন্ত কাল ধরে থাকবেনও।


 

 

 

 

 

 

 

 

 প্রতিবেদন

সুবীর সরকার

ঘোরানো সিড়ির নিচ থেকে নিরবতা উঠে এলে
আর তো সেভাবে কিছুই করার থাকে না
শুধু ভাঁজ খুলে যাওয়া রুমাল
ছায়া খুঁজে নিতে থাকা বেড়াল
প্রিয় শব্দের তালিকায় যুক্ত হতে থাকে
                                       গুনগুন
 সাজিয়ে রাখা পালকি ও ভাঙা রাজবাড়ি
 নিয়ে যে প্রতিবেদন লিখবার কথা 
                                ছিল,সেটা আর লেখা
 হয় না।
 গোল  শহরের সাইডলাইনে আমি 
                            সানগ্লাস পরা রেফারি
 সূর্যাস্ত ও পাখিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখি
 গরম ভাত থেকে ধোয়া 
                               উঠছে।


 

 

 

 

 

 

 

 

 চেনা আকাশের উপকেন্দ্র ও বাকিটা

---------------------------------------------------------------------
খানিকদূর

              « স্থিরাঙ্ক »     সমাধান গণিত

                  ০}০}০}০}০}{০{০{০{০{০

        অনেকক্ষণ ~ 
                              [ মুখ →  ]]
                                               ← বিন্দু ]

     (উৎপাদন) - ৎ
                               =
                                   ভবিষ্যৎ বিয়োজক

                                       ||

                                   ভাসমান ঝুলবারান্দা


++++++++++++


অভ্যস্ত ব্যাকরণ ~ দৃশ্য 
                         আকার          স্ব ~ (+) হলো

                                        ||

                                  পাল্টালে

                                  জল = আকার (+) নি
   ]] সমান্তরাল

আকাশ    }}     মহাকাশ 
                                                           (আ)
                                     }} অথবা > (রো)
                                                  (কি)
                                                  (ছু)

        "অবিন্যস্ত ~ জ্যা"_____


শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী



 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রাচীর
        সত্য মোদক

দুরন্তপনা নেই!
নেই আবেগঘন অভিমান
এখন,
রাগ-অনুরাগ-অভিমান-চলন-
বলন-হাসি-কান্না 
সবিই কেমন যেন বিশ্বাসের পরিপন্থি৷
তোমার চোখ আমাকে নতজানু করেনা৷
তোমার গড়া প্রাচীর 
আমার হারমানায়
এখন উদভ্রান্তের মত খুঁজি .......


 

 

 

 

 

 

 

 

 মুখ

ইন্দ্রাণী পাল

আজও তবে আমাদের কথাবার্তা
নেই

বিসর্জনের প্রতিমা ভেসে যায়
খোলা চুল ভিজে বুক জরির সাজ
কবেই উড়ে গেছে নীলকণ্ঠ

যতদূর চোখ যায় তোমার মুখ
ঘুমিয়ে আছে

আমার কান্না পায়।


 

 

 

 

 

 

 

 

 বক্সাপাহাড়ে

অনুনয় চ্যাটার্জি

ভাতখাওয়া থেকে যাই সান্তালাবাড়িতে
সিঞ্চুলা পাহাড়েরা খাড়া এক সারিতে।
হাটবারে ব্যস্ততা গিয়ে দেখি ওখানে
মোমো খেতে বসে পড়ি হেমাদির দোকানে।
এর পরে চলা শুরু, গতি মৃদু-মন্দ
নাকে এসে লাগে যত জঙ্গুলে গন্ধ। 
নির্জন বাঘবনে পাখি ডাকে অজানা
বাঁক নিতে চোখে পড়ে মেঘে ঢাকা জেলখানা।
আরেকটু এগোতেই ধরে পাকদন্ডি
দুর্গের দেয়ালেতে ইতিহাস বন্দি।
পাশে পাশে নেচে চলে সুন্দরী ঝরনা
সবে মিলে বক্সা যে বিচিত্রবর্ণা।
বসা নয়, বসা নয়, সময়ের আছে মানা
সামনের পাহাড়েতে আজকের আস্তানা।
অনাবিল প্রকৃতিই এপথের নির্যাস
লেপচাখা গ্ৰাম নয়, স্বপ্নের ক্যানভাস!


 

 

 

 

 

 

 

 

 ভালবাসা

      পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

ভালবাসাকেই কবে যেন ভালবেসে ফেলেছি!
        মনের অজান্তেই, জ্ঞানের অগোচরে।

ভাবি, আমার মন কেন জানি না,
        এক বল্গাহীন ঘোড়া, বাঁধনছাড়া মোষ।
        ছুটে বেড়ায়, শুধু ছুটে বেড়ায়!
        এক ভালবাসার খোঁজে, 
        এক অনন্তের খোঁজে।

সত্যি,  কবে যেন ভালবাসাকেই ভালবেসেছি।
        জীবনের বদলে,  জীবনের কষ্টগুলোকে 
        অনায়াসে আপন করে নিয়েছি। 

ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছি অবিরাম। বহুদূর ।
        কখনো বা নিরুদ্দেশের লক্ষ্যে।


 

 

 

 

 

 

 

 

 সম্পর্ক

 উমা শঙ্কর রায়

তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো 
কি অকপট! নাকি অকপটতার আড়ালে 
                                    বিষ বাষ্প নিঃস্বরন 
ছায়া বাঁচিয়ে পথ চলা 
শুভেচ্ছার ফুলঝুরি ওয়ালে ওয়ালে 
প্লাসটার খসা ইট আমায় দেখে হাসে 
সম্মোহনের চুন সুরকি সুর্ সুর্ করে ঝরে 
দেহ তত্বের গান শুনে মন ভাল করি 
কি সম্পর্ক দেহ আর মনের?


 

 

 

 

 

 

 

 

ধনতেরাসে

মাথুর দাস


ধনতেরাসে   ধন-তরাসে

লোক-দেখানো কী আর করি !

ধন, তোর আশে  কাচের হীরে

নকল  সোনায়  ভাঁড়ার  ভরি ।


এবং ঠকি বোকার মতোই,

টের পাই তা ক'দিন বাদে ;

যখন বেচি  কিম্বা  ভাঙাই

সব  বরবাদ  ভরণ  খাদে ।


 

 

 

 

 

 

 

 

 সমুদ্রের গভীরতা

      রীনা মজুমদার

 সাগরের কূলে ভোরের
 স্বর্গীয় আলো মুখে মেখে
 ঢেউয়ের পর ঢেউ আসে
 হিসেব মেলাতে পারি না 
 সমস্ত খেলা জুড়ে যেন
 মুহূর্তের সুখ ও আনন্দটুকু ।

আর, মাঝসাগরের অপরূপ !
শান্ত সমুদ্রের উপর দিয়ে
সাগর বিহঙ্গরা নীড়ে ফেরে
 ডানার ছায়ায় ছায়ায় 
বন্ধনহীন নিবিড় প্রাপ্তি,
দিগন্ত ছুঁয়ে পূর্ণ গভীরতায়
  শুধু তোমাকে দেখি..।

 একদিন বলেছিলাম,
বাবা, আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে?

আজও, বাবার হাত ধরে আমি
   সমুদ্রের গভীরতা দেখি...
 


 

 

 

 

 

 

 

 

 

" ছোটগল্প "
আফতাব হোসেন



                                ( ১ )
“ছোট প্রাণ,ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা,নিতান্ত সহজ সরল”
----------------------------------------
আজকাল লিখতে পারি না,লিখতে গেলে কখনও কলম শুকোয় তো কখনো আবার বুক ধড়পড় করে ।আসলে মানুষ তো তাই বোধহয় মোশন পিকচার্স এর মত পরপর ইমোশনাল হিট দিতে পারি না ।ইমোশন কথাটা খুব ঠুনকো বুঝলেন, কথায় কথায় অভিমানী প্রেমিকার মত ঠোঁট ফুলিয়ে বোবা কান্নায় কাঁদে ।আমি আবার বোবা হতে পারি না,বোবা হলেই একগাদা দুঃখ চোখে এসে জমা হয়ে টল টল করে আর ঠিক তারপরেই হেসে ফেলি । কারন কাঁদার মত সৎসাহস আমার নেই ।

                                     (২)

“সহস্র বিস্মৃতিরাশি,প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারই দু চারটি অশ্রুজল ”
----------------------------------------

অপালা কে অনেকদিন থেকেই চিনি । ওয়ার্কিং এস এ হোম মেকার । সাথে একগাদা বাচ্চার ছবি । নিজের ফেসবুক প্রোফাইলটা এইভাবেই প্রায় গত 2 মাস ধরে সাজাচ্ছে । কদিন আগেই বলছিল ; 
-ঠিক করে নিয়েছি বুঝলে মেয়ে হোক আর ছেলে ফেসবুকের প্রথম আপলোড টা আমিই করবো । এ নিয়ে রজত কে বলেও রেখেছি । তবে জানো তো রজত টা ইদানিং বড্ড খিটখিটে হয়ে গেছে । গতমাসে রেবার সাথে ব্যবহার টা ভালো করেনি গো । মেয়েটা কে কোন দোষ ছাড়াই যা তা বলে ছাড়িয়ে দিল । রেবা যাবার সময় খুব কাঁদছিল । আমাকে বোনের মতই স্নেহ করতো বুঝলে ,আমি প্রেগন্যান্ট বলে মুখ বুজে সারাদিন কাজ করে যেত । রজত যে ওকে তিন মাস বেতন দেয়নি এটা আমি জানতাম না গো। রেবাও কিছু বলে নি যে এ ব্যাপারে । ওদিন রজত ফালতু ফালতু রেবার উপর ছোটপাট করে ওকে কেন ছাড়াল আজ পর্যন্ত্য বুঝে উঠতে পারিনি বিশ্বাস কর । রজত কে জিজ্ঞাসা করলে রজত কাটিয়ে গেছে , বলে দূর আমার তো এখন ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলছে । দু জনের এইটুকুন কাজ আমরাই করে নিতে পারবো ।তাছাড়া একটা প্রাইভেসি আর হাইজিন এর ও ব্যাপার আছে বলো । আর কথা বাড়ায় নি । মেয়েটা যাবার সময় খুব কাঁদছিল গো ।

- বললাম চাপ নিস না , কথা বলে দেখবোখন । তুই রেস্ট নে ।

                                    (৩)

“নাহি বর্ণনার ছটা,ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ”
----------------------------------------


- ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে কত লাগে জানিস ? 
 - ওই সব ছাড় সিজারের চার্জ জানিস এখন ?
‘ দেখ রজত মোটামোটি ভাল করে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে লাম সাম ফরটি থাউসেন্ড ক্যাশ পার মান্থ চাইই চাই , না হলে দেখ ভাই ছেলেমেয়েগুলো রাস্তার কুকুর হয়ে ঘুরে বেড়ায় , তাই তো আমি আর নীলিমা বাচ্চাই নিই নি । আগে নিজেরা কিছু সেভিংস করি । তারপর ভাবব । একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামালো মিহির ।তারপর সিগারেটে সুখটান দিয়ে বললো চলি রে । কাল আবার লকডাউন । সালা ঘরে থেকেই সারাদিন ঘ্যানঘানানি শুনতে হবে ।
 রজতের ও ইদানিং ভয় হয় ।আসলে ভয়টা ওর জন্মগত । বাড়িতে গিয়ে একটু হিসেব টা নিয়ে বসতে হবে মনে হয় ।

রজত চক্রবর্তী । একটা স্টার্ট আপ কোম্পানির পোগ্রামিং লিড । ছোট স্টার্ট আপ । বেতন খুব খারাপ না । গাদাগুচ্ছের কম্পিটিশন আর দুনিয়ার রিসেশন এর মার্কেটে চাকরি টা পেয়ে রজত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল । সেও হয়ে গেল 6 বছর আগের কথা । চাকরিটা পেয়েই টুক করে অপালাকে তুলে নিয়েছিল । হ্যাঁ ,তুলেই নিয়েছিল । না হলে ওর মত উদ্বাস্তুর সাথে কোন বাবা কি অপালাকে সঁপে দেবে ।
অপালাই বলতো দেখ না সব ঠিক হযে যাবে । তুমি শুধু নিজের ওপর ভরসা রাখ । ঠিক হচ্ছিলোও আস্তে আস্তে । 650 স্কোয়ারের ফ্ল্যাট টা অপালাই পছন্দ করেছিল । রেটটা একটু বেশি । কিন্তু সামনে একটা বড়সড় পার্ক আছে । রজত ই জোর করেছিল,,তা হ্যাঁ গো ,, এতবড় পার্কে কি আমাদের কেউ খেলবেনা ।
অপালাটা সারাজীবনই খুব লাজুক । উত্তর দিতে পারেনি কিছুই ।শুধুই লাল হয়েছিল । ঠিক সূর্য ওঠার আগে আকাশটা যেমন লাল হয়ে তেমনই ।

তবে লাল মনে হয় সুখের রঙ হতে পারে না ।সুখবর টা আসার কদিন পরেই টানা লকডাউন আর তার পরেই পিঙ্ক স্লিপ টা মেলে পেয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল রজত । কর্পোরেটর রা ছাঁটাই নোটিসকে ভালোবেসে বলে পিঙ্ক স্লিপ । 
 বললো দাদা বাচ্চাটা আসার আগেই চাকরি গেল গো । অপালাকে কি মুখ দেখাবো বল । বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি রাস্তায় দাদা । 
দামড়ে বললাম ওরে দাঁড়া, অত ভাঙ্গিস না , অপালার কথা মাথায় রাখিস । তোকে শক্ত হতেই হবে বুঝলি । এগুলো প্যান্ডামিকের সাইড এফেক্ট । ধৈর্য ধর ।সময় সবসময় খারাপ যায় না ।

                                    ( ৪)


“অন্তরে অতৃপ্তি রবে , সাঙ্গ করি মনে হবে ”
------------------------------------

USG তে পলিসিস্টিক ওভারি রিপোর্টার পর থেকেই রজত বড্ড সাবধান হয়ে গেছিল । অপালাকেও গুগুল দেখে দেখে সব বুঝিয়েছে কি করা যাবে আর কি করা বারণ । অপালা অবশ্য এ ব্যাপারে রজতকে অক্ষরে অক্ষরে মেনেও চলে । স্বপ্নটা অপালার অনেকদিনের ।  সাত মাস বয়সে মা হারা অপালা । বাবাও আর বিয়ে করেননি । মায়ের স্বাদ আর মাতৃত্বের অহংকার একসাথে মিটিয়ে নিতে চায় ও । তাই অত্যাধিক সাবধানী । তার ওপর আবার এই সব মহামারী । নাহ এত টেনশন অপালা কোনদিনও নেয়নি । মাঝে রেবাটাও নেই । অসহায় লাগে নিজের । রজটটাও কেমন জানি না হয়ে যাচ্ছে । ডাক্তার বলেছেন স্ট্রেস নেবেন না । আসলে নর্মাল ডেলিভারিকে প্রচন্ড ভয় অপালার । ওর কেন জানি না মনে হয় যদি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ওর কিছু হয়ে যায় , পুঁচকে টার কি হবে । ওই তো পাশের ফ্ল্যাটের কুমুদ দি,, কদিন আগেই তো নর্মাল করতে গিয়ে যমে মানুষে টানাটানি । তবে কুমুদ দির খুব সাহস, অপালার মত ভীতু নয় । আর তো মাত্র কয়েকটা দিন । বুকে হাত দিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে অপালা ‘আল ইস অয়েল,অল ইজ অয়েল ।’

হঠাৎ করে পিঙ্ক স্লিপ টা পাবার কারন টা বুঝে ওঠার আগেই রজতের কেমন জানি না মনে হল মাথাটা খালি ।অফিসে গিয়ে বুঝলো প্যান্ডামিকের  কো ল্যাটারল ড্যামেজ এর মধ্যে এটাও একটা । প্রফিডেন্ট ফান্ড আর epf মিলিয়ে লাখ সাতেক , সাথে বাড়ির লোন, সংসার খরচ, সন্তান এর ভরন পোষনের খরচ, নাহ মাথা খালি খালি লাগছিল । ব্যাস আবার সংঘর্ষ শুরু , প্রায় তিনমাস ধরে হাজারটা কোম্পানি ঢুঁ মেরে নট ভ্যাকেন্ট মার্কা ফিডব্যাক নিয়ে হিসেব করে রেবাকে তাড়ালো রজত। যদি কিছুটা বাঁচান যায়।

বাথরুমে ব্লেড নিয়ে প্রায় তিনবার চেষ্টা করেও এক বারও সাকসেস না পেয়ে বুঝলো ও খুব ভীতু খুউউউব । তারপর অনেক রাত না ঘুমিয়ে ভেবে মুকুলকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সোজা রয় ক্লিনিকে । ডক্টর রয় এর অনেক অভিজ্ঞতা এই সব ব্যাপারে । উনি বুঝিয়েছেন এ ব্যাপারে অপালার কোন লাইফ রিস্ক নেই , ভবিষ্যতেও অসুবিধা হবার সম্ভাবনা কম । রাতে খাবার পর পর একটা করে ক্যাপসুল তিনদিন একটানা খাইয়ে দিলেই সব খালাস । 

অনেক রাত নিজের সাথে যুদ্ধ করে রজত বুঝেছে রজতের সন্তান রাস্তার পরিযায়ী হবে না । 
নিজে হাতে অপালাকে নতুন ক্যাপসুল টা খেতে দিয়েই নিজের মুখটা আয়নায় দেখলো রজত । প্রথমবার কোন খুনিকে এত কাছ থেকে দেখলো মনে হয় ।

                                    ( ৫ )

“শেষ হয়ে হইলো না শেষ”
----------------------

- বাচ্চাটা কবে থেকে নড়বে বলো তো । অপালা অস্থির , কাল থেকে পেটে খুব টান গো ।

রজত লাল চোখে উত্তর দেয়
- দূর সে তো এখন অনেক দেরি ,তুমি খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করছো না বুঝলে । বেশি করে খাও । আর জল টা একটু বেশি খেও । দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে । আর তো মাত্র কটা দিন ।  
আর হ্যাঁ ওষুধ গুলো খেও ।
রাত্রে ঘুমোনোর আগের ওষুধ টা আবার ভুল না ।
পরপর তিনদিন.. তিনটে ডোস মাত্র। তারপর দেখবে অনেক হালকা লাগবে ।


কলিংবেলটা এর মাঝেই বাজলো ..
দরজায় রেবা ..
খলখলিয়ে বললো “ দিদিভাই আমি না তোমার মতো পোয়াতি গো ,আজকেই জানলাম, তোমাকেই প্রথম জানাতে এলুম ।”

রেবার খলবলানি হাসির মাঝেই ঘর থেকে রজতের উন্মাদ অট্টহাসির কবিতার আওয়াজ ভেসে আসলো

 " জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল
অকালের জীবন গুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা
কত ভাব , কত ভয় ভুল "।


 

 

 

 

 

 

 

 

 

অন্য সম্প্রীতি 
মৌসুমী চৌধুরী 

           শরৎ আকাশ চুঁইয়ে একটু একটু করে নেমে আসছে গলাসোনা রোদ। আজই পুজো শেষ। ফজরের নামাজটা সেরে নিয়েছে রহিমা বিবি। আজ একটু সকাল সকাল বেরোবে তারা। নবযুবক সংঘের পুজো প্যান্ডেল থেকে হালকা ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। দশমীর পুজো শেষে প্রতিবারের মতো ‌হোম আর দধিকর্মা হবে নিশ্চয়ই। তারাও পাবে প্রসাদ।পাশের ঘর থেকে টুংটুং করে পুজোর ঘন্টা বাজানোর আওয়াজটা কানে আসছে রহিমার। পুজোয় বসেছে তার সই সরোজবালা দাসী। তারা দু'জন থাকে একই দাওয়ার দুটো চালাঘরে। দাওয়ায় নিঃশব্দে শুয়ে আছে একজোড়া খঞ্জনী আর একটা একতারা। তার ঠিক উপরে বাঁশের আঁকশিতে ঝুলছে দুটো ঝোলা। একটা ঝোলা গেরুয়া রঙের আর একটা ঝোলা রঙবেরঙের কাপড়ের টুকরো জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। পরম বন্ধুত্বে ঝোলাদুটো ঝুলছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। আজ দশ বছরের বন্ধুত্ব তাদের।
             রহিমার আজও মনে পড়ে, দশ বছর আগে পাঁচদিনের জ্বরে স্বামী হাজি আশরাফ আলি যেদিন এ সংসার ছেড়ে চলে গেলেন, তখন শ্বশুরের ভিটেতে জায়গা হয় নি অন্ধ, বাঁজা মেয়েছেলে রহিমা বিবির। বাপের বাড়িও খুব গরীব ঘর, তার ওপর আম্মাজান আর আব্বাজান গত হয়েছিলেন অনেক আগেই। ভাইয়েরা কেউ আর তাদের অন্ধ বোনটির খোঁজ রাখে নি। 
        কাজ-কামাই তো কোনদিনই তেমন কিছু করতে পারত না রহিমা। ছোট্টবেলায় চোখের এক  কঠিন অসুখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল। থাকার মধ্যে ছিল আল্লাহ্‌র দেওয়া বড় সুরেলা এক গানের গলা। বাড়ির এক খামচা উঠোনে বসে গান গাইতে গাইতে শুকনো কাঠ, পাতা-লতা দিয়ে উনুন ধরিয়ে হাতড়ে হাডড়ে রোজ কোনক্রমে দুটো ভাত-তরকারি ফুটিয়ে রাখত সে। আর স্বামী আশারফ কাক-ডাকা ভোরেই ফজরের নামাজ শেষ করে কাজে বেরিয়ে যেতেন। দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি, বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর পার। ফিরে এলে রহিমাই সযত্নে বেড়ে দিত ভাত। এভাবেই চলে যাচ্ছিল নিঃসন্তান স্বামী-স্ত্রীর সংসার- জীবন। হঠাৎ একদিন ঘটল অঘটন। ডেঙ্গুজ্বরে মারা গেলেন আশরাফ আলি। বন্ধ হয়ে গেল রহিমার অন্ন-সংস্থান। প্রথম প্রথম প্রতিবেশীদের দয়ায় দু'মুঠো জুটলেও ক্রমে সেটাও হল বাড়ন্ত! অবস্থাটা একদিন চরমে পৌঁছল। একেবরে না খেয়ে মরার উপক্রম!
           আশরফ আলীর পাড়াতেই থাকত সরোজবালা দাসী। সারাদিন ট্রেনে-বাসে, এখানে-ওখানে গান গেয়ে ভিক্ষে করত। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে নিজে হাতে ভিক্ষান্ন ফুটিয়ে খেত। আউল বাউল ভিক্ষা দাসীর এভাবেই দিন গুজরান। তিনদিনের অভুক্ত রহিমা পেটের টানে এই সরোজবালার কাছে এসেই সাহায্যের হাত পাতে। সরোজবালার সাথে তার সই পাতানো ছিল অনেক আগেই। ফুরসত পেলেই রহিমা তার কাছে বসে সুখ-দুঃখের কথা কইত প্রাণ খুলে। শুনত একতারা বাজিয়ে তার খোলা গলায় বাউল গান। শুনতে শুনতে হয়তো কোন কোন দিন সন্ধে নেমে আসত প্রতিবেশীের তুলসি তলায়। 
      কিন্তু সরোজবালার তো নিজেরই চলে লোকের দেওয়া ভিক্ষেতে। তাই সে রহিমাকে বলেছিল,
--- "আমার তো ক্ষমতা নেই, সই, তোকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার। তবে আমার মতো ভিক্ষের পথে তুই যদি যেতে রাজী থাকিস, তাহলে আমি তোর সঙ্গে থাকব জীবনভর। তোর হাত ধরে পথে পথে নিয়ে যাব আমিই। আর সত্যি বলতে কি, তোকে দেখে দয়া করে লোকেরা ভালোই ভিক্ষে
দেবে।"
        সেই থেকে রহিমা তো সরোজবালার সাথেই কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর। দু'জনে একসঙ্গে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করে। একই সঙ্গে রাঁধে, খায়। একই সঙ্গে হাসে, কাঁদে।  কীর্তন-ভাটিয়ালি-লালনগীতি-জারিগান গায়। বেঁচে থাকার গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে তারা জীবন পথে। তারপর একদিন তারা দুজনে মিলে খুলে ফেলল একটি চায়ের দোকানও। নবযুবক সংঘের পাশে মাঠের ধারে। বিকেলে মাটির ভাঁড়ে চা নিয়ে নানা বয়সী খদ্দেরদের মজলিশ জমে ওঠে তাদের চায়ের দোকান ঘিরে। সরোজবালা চায়ের জোগান দেয়। আর রহিমা গান শোনায় খদ্দেরদের। 
          ওই, পুজো শেষ হয়ে গেল সরোজ- বালার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝোলাটা কাঁধে লাগিয়ে দিল রহিমার, হাতে ধরিয়ে দিল খঞ্জনি আর সরোজবালা নিজের একতারাটি হাতে নিয়ে সুর বাঁধল,
---- "আমার সর্ব অঙ্গে লিখে দিও গো শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম..."
      সরোজবালার পিছু নিল রহিমা বিবি। খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে ধোয়া টানল সে,
"মরিব মরিব সখী নিশ্চয় মরিব/কানু হেন গুণনিধি আমি কারে দিয়ে যাব..."
       পথের বাঁকে মিলিয়ে যায় তাদের গানের রেশ। পেটের সুর বাঁধা থাকে একটি তারে। মানুষের বানানো ধর্ম সেখানে আঙুল ছোঁয়াতে পারে না।


 

 

 

 

 

 

 

 

 

পুজো আসছে 
সূদীপ কুমার বোস

       আলিপুরদুয়ার জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে পূর্ণচন্দ্র বানিয়ার বাড়ি। বুড়ো বাবা মা, স্ত্রী রমা আর দশ বছরের মেয়ে কাজল ও আট বছরের ছেলে রতনকে নিয়েই তার সংসার। পেশায় কৃষক কিন্তু পূজার মরশুমে ঢাক বাজায় সে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকেই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। ঢাক বাজিয়ে শ্যমাপুজোর শেষে বাড়ি ফিরে আসে। কোনো দিনই পুজোর মরসুমে পরিবারের সাথে কাটাতে পারে না। এবছর করোনা সংক্রমণের জন্য এখনও পর্যন্ত কোন পুজো কমিটি থেকে ডাক পায়নি। 
       কাজল আর রতন খুব খুশি। জীবনে এই প্রথম পুজোতে বাবার সাথে থাকতে পারবে। 
তাই তাদের প্রস্তুতি তুঙ্গে। স্কুল বন্ধ বলে তাদের দুজনের হাতে অফুরন্ত সময়। দুজনে মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে ঢেকি শাক, কলমি শাক, শাপলা বিক্রি করে পয়সা জমাচ্ছে। বাবার মনটা খুব খারাপ তো। এবার ঢাক বাজাতে বাইরে যেতে পারছে না। তাই বাবার কাছে এবার কোন কিছুর জন্যই বায়না করবে না। স্কুল বন্ধ ছিল জন্য স্কুল ড্রেস গুলো নতুনই আছে। পুজোতে ওই ড্রেস পরেই ঘুরবে। তাদের একটাই ইচ্ছে পুজোতে বাবা, মার সঙ্গে একদিন শহরে দুর্গাপুজো দেখতে যাবে। ঠাকুমা আর দাদুকেও সাথে নেবে। শহরে গিয়ে জমানো পয়সা দিয়ে ফুচকা, এগরোল, আইসক্রিম খাবে। চিন্তা শুধু একটাই, দাদু আর ঠাকুমা অতদূর হাঁটতে পারবে তো? 
      পূর্ণচন্দ্রের স্ত্রী রমাও খুব খুশি। বিয়ের পর প্রথম স্বামীর সাথে পুজো কাটাবে। পুজোর কটা দিন যাতে স্বামীকে একটু ভালমন্দ খাওয়াতে পারে সেজন্য হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পয়সা জমাচ্ছে। পারলে গাঁয়ের গঙ্গাধর ফেরিওয়ালার থেকে একটা পায়জামা পাঞ্জাবীও কিনবে। লোকটাতো পুজোতে কোনদিনই নতুন জামা কাপড় পরতে পারেনি। 
      পূর্ণচন্দ্রের বাবা মাও খুব খুশি। কতদিন পর ছেলেটাকে পুজোর সময় কাছে পাবেন। পুজোর সময় বিদেশ-বিভুঁইয়ে কি খায় কে জানে! তাই বুড়ো-বুড়ি বার্ধক্য ভাতার পয়সা জমিয়ে রাখছেন। বুড়ি এখন থেকেই নারকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মুড়কি বানানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। ছেলেটাকে একদিন লুচি-পায়েসও বানিয়ে খাওয়াবেন। ফেরিওয়ালা এলে একটা পায়জামা পাঞ্জাবী কেনার ইচ্ছেও আছে। কতদিন ছেলেটাকে নতুন জামা কাপড় কিনে দেননি!
       পুজোতে ঢাক বাজানোর বায়না না হওয়ায় পূর্ণচন্দ্রের মনটা খুবই খারাপ ছিল। পুজোর সময় তো কখনও বাড়ির কারও জন্য জামা-কাপড় কিনতে পারত না। পুজোয় ঢাক বাজিয়ে ফিরে এসে শ্যমাপুজোর পর সবাইকে জামা কাপড় কিনে দিত। অকস্মাৎ  তার কাছে পুজোর আনন্দ ফিরে এল! এই প্রথম লটারির টিকিট কেটেছিল। তাতে দশ হাজার টাকা পেয়েছে! আনন্দে উৎফুল্ল পূর্ণচন্দ্র  বাড়ির কাউকে জানায়নি। ষষ্টির দিন বাজারে গিয়ে  রমার জন্য শাড়ি, বাবার জন্য ধুতি, মায়ের জন্য শাড়ি, ছেলে-মেয়ের জন্য জামা-জুতো কিনে নিয়ে আসবে। বাড়ির সবাই মিলে একদিন ইলিশমাছ আর একদিন মাংস ভাত খাবে। পুজোতে সবাইকে নিয়ে শহরে পুজো দেখতে যাবে। বাবা-মা এতদূর হাঁটতে পারবে না তাই বলাইয়ের টোটো বলে রেখেছে। বাড়ির লোকেরা যখন জানতে পারবে তখন দারুণ খুশি হবে! বিশেষ করে ছেলে মেয়েদুটো। এবার পুজোতে ঘুরতে গিয়ে ছেলে মেয়ে দুটো যা খেতে চাইবে তাই খাওয়াবে। মনটা আনন্দে ভরিয়ে দেবে তাদের!
       পুজো আসছে! পুজো আসছে! পুজো আসছে! ওই তো ভোরবেলায় উঠোনে শিউলির আলপনা। ওই তো পুকুরে কানাকানি করে শাপলা শালুক। নীল আকাশে অলস মেঘেরা নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। শুধু ঝাপসা চোখে পূর্ণ চন্দ্র বানিয়া দেখে তার ঢাকটা ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে বিষন্ন মুখে! একটা মন-খারাপিয়া বাতাস ঝাপটা দিয়ে যায় তার বুকে! পুজো কি সত্যিই আসছে?


 

 

 

 

 

 

 

 

 হাসি

 দেবদত্তা লাহিড়ী

                                 
যতক্ষণ সে মোবাইলে ডুবে থাকে-মুখের হাসি তার মেলায় না|প্রোফাইল জুড়ে কচি খুকিরা আর তাদের ছবি ও নেকুপুশুপনা-মেজাজটা বেশ ফুরফুরে করে দেয়|এঞ্জেল প্রিয়া আর দুষ্টু রিয়ার খান পঞ্চাশেক ছবিতে লাইক আর  ভেরী নাইস কমেন্টে ভরিয়ে ,একটা খুশীর নিশ্বাস ফেলে অনিমেষ|,মোবাইল টেবিলে রেখে,মাথার পেছনে হাতদুটি আরাম করে থিতু করে চেয়ারে এলিয়ে বসতেই চোখ যায় তনিমার দিকে|এ্যাঃ|বউএর কটমটে চাহনিটা এক নিমেষে আবেগ আর আমেজ দুটোই নিমেষে "ফুস" করে দিল বছর পঞ্চাশের অনিমেষ এর|চাহনির উত্তর না দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা পাঞ্জাবীর পকেটে চালান করে আবাসনের ছাতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে|এই এক আ্যপ বিচরণ,আরএক ঐ ছাত-এ দুখানি ই তো তার জীবনের মুক্তমঞ্চ|বাকি যা ছিল সবই তো কবেই তনিমা কেচে ঝেড়ে মেলে দিয়েছে|রাগ হলেও কিছু বলতে পারেনা সে| রোজগার বলতে নেই তার কোনদিন তেমন|ফ্ল্যাটটুকুও তনিমার বাবার দাক্ষিণ্যেই|ধুর ধুর |বউ এর কথা মনে হতেই ত্রিশ হতে চলা  নিঃসন্তান বিবাহিত জীবনের তিক্ততা সুখটানের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে মনস্হ করে অনিমেষ|
দুপুরে খাবার সময় ও মোবাইল হাতে নিতে একই বিপত্তি|দ্বিপ্রাহরিক ভাতঘুম টা তনিমা কেন যে বন্ধ করে দিল?সব বোঝে অনিমেষ-    ঐ তো তাকে চোখে চোখে রাখতে| আর কি?        সন্ধ্যার অদম্য আকর্ষণ সিরিয়াল গুলো ও তনিমাকে আজকাল আর আটকে রাখতে পারেনা|জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে অনিমেষের|একদিকে এঞ্জেল ,দুষ্টুদের হাতছানি ,অপরদিকে তনিমার কটমটে চোখের কামড়ানি|রাতে বালিশে কাত হয়ে শুয়ে লুকিয়ে ছবিতে স্তুতির বন্যা বইয়ে আর এক কাত হতেই মোবাইল টা হাত থেকে পড়ে যাবার যোগার হয় তার|বউ রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে| "পিশাচী" মনে মনে বলে মোবাইল নামিয়ে চোখ বোজে সে|একদিন ঘুম থেকে উঠে রক্তচাপ বেড়ে যায় তার।প্রোফাইলে  চোখ রাখতেই|দুষ্টু ,এঞ্জেল ওরা কেউ নেই|তন্ন তন্ন করে খোঁজে সে|নাহ্|নেই|মনটা বেজার হয়ে যায় ওর। মেয়েগুলো ওকে তালে--|গোটা দিনটা যে কিভাবে কাটে ওর|ধূসর রং টা আসলে কি,সেটা বোধহয় মনখারাপ আর শূণ্যতার সংমিশ্রণেই বোধগম্য হয়|বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে সে মনখারাপ একটা নিকষ কালো প্রতিশোধ স্পৃহায় পর্যবসিত হয়|সার্চ মোডে নাম দুটো ফেলে প্রোফাইল দুটো সে খুঁজতে থাকে|ঘন্টাদুয়েক হানা চালিয়েও ব্যর্থ হয় সে|অবসন্ন পায়ে শোবার ঘরের দিকে এগোতে বন্ধ দরজার ওপার থেকে কানে আসে তনিমার গলা|দূরভাষে|চাপা উল্লাসে কাউকে জানাচ্ছে তার সাফল্য কাহিনী|সব টা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায় অনিমেষের|সাত তাড়াতাড়ি ব্লক লিস্ট থেকে আনব্লক করে মেয়েদুটোকে রিকোয়েস্ট পাঠায় সে|জবাবে মেসেঞ্জারে দুটো ধমক আসে|সাথে অনিমেষের কমেন্টের স্ক্রিনশট|তারপর ই ওপার সব অন্ধকার|হাহাকার করে ওঠে ওর পুরুষত্ব|মাথা খুঁড়েও সে মনে করতে পারেনা কবে এমন লিখল| ভালো করে পড়ে দেখে এ ভাষা তার নয়|তবে কমেন্ট গেছে তার প্রোফাইল থেকেই|তনিমা!শুধু ব্লক করেই সে ক্ষান্ত থাকেনি|

আজকাল তনিমা বেশ খুশী খুশী থাকে|ওর খুশী হওয়াটা বুকে হাতুড়ী দিয়ে দমাদ্দম মারতে থাকে অনিমেষের|রাতে শোবার আগে তনিমা দুটি করে প্রেশার কন্ট্রোলের ওষুধ খায়|সকালে আরো দুটি|এর যাতে অন্যথা না হয় তার জন্যে সে গুনেগেঁথে সাত দিনের ওষুধ পাতা ছাড়িয়ে রেখে দেয় একটা সাদা বাক্সে |গুনতি মাফিক ওষুধ শেষ হলে আবার পুরে রাখে আগামী সাত দিনের|কড়া লক্ষ্য শরীরের প্রতি তার|অথচ দিন দুয়েক হল শরীর টা তেমন ভালো ঠেকছেনা তার|ডাক্তার দেখাবার কথাটা মনে আসে|কিন্তু শরীর খারাপ ছাপিয়ে যায় স্বামীকে শায়েস্তা করার আনন্দে|কিচেনে দাঁড়িয়ে আটা মাখছিল সে|সকালের জলখাবারের ব্যবস্হা|হঠাৎ অনিমেষ কে ডাইনিং টেবলের চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায় সে|সে তো এত সকালে ওঠবার পাত্র নয়|

একটা অস্বস্তি নিয়ে তনিমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনিমেষ|আজ তিনদিন হল তনিমার কৌটোর ওষুধ সে বদলে দিয়েছে,কিন্তু তেমন কিছু ঘটাতো দূর তনিমাকে খুশী ই দেখাচ্ছে| ভাবনার সুতো হঠাৎ ই ছিঁড়ে যায় তার|তনিমা ঘামছে|প্রবলভাবে|
মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে সমস্ত ব্যপার টা কমপ্লিট হয়ে যায়|মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সময় রান্নার গ্যাসের স্ল্যাবে মাথাটা বিশ্রীভাবে ঠুকে গিয়েছিল তনিমার|স্ট্রোক না হোক ,রক্তপাতেই...|নিশ্চিন্তে ঘরে ঢুকেওষুধ গুলো পুনরায় পাল্টে ,চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে|ঘুম ভাঙেনি বলাতে কেউ অবিশ্বাস করেনি|ঘুমের ওষুধ খায় সে শোবার আগে|ডাক্তারি প্রমাণপত্র ও রয়েছে|তাছাড়াও গোবেচারা দেখতে,সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ মানুষ অনিমেষ|এমনকি ঝগড়া করলেও তনিমার গলাই শোনা যেত|কারো কোন সন্দেহ ই এলনা মনে|জেঠিমা অপঘাতেই মরল,বেচারা অনিমেষ একা হয়ে গেল|সকলে সমবেদনা জানাল তাকে|শুধু অনিমেষ একা নক্ষ্য করল -চুল্লীতে দেহ ঢোকাবার আগে,তার মোবাইলে টুং  করে একট নোটিফিকেশন ঢুকতেই কার একটা হাত লেগে তনিমার মাথাটা তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল|চোখটাও আধখোলা হয়েছিল কি?মনে মনে অট্টহাসি হাসে সে -"এবার তাকাও দেখি কটমট করে| ?"শ্রাদ্ধশান্তি সব চুকতে সকলকে দরজার ওপারে প্রায় পগার পার করে এবার প্রাণভরে শান্তির নিঃশ্বাস নেয় সে|শোবার ঘরে ঢুকে বালিশ টা আয়েস করে মাথার তলায় দিয়ে চলতে থাকে তার একক অভিসার|মুখের হাসি আজ আবার ফিরে এসেছে তার|ঘন্টা দুয়েক বাদে দুষ্টু মিষ্টি দের ছবিতে মন ভরে আসে তার|এবার ঘুমোতে হবে|অভ্যাসমত পাশ ফিরে শুতেই হৃদযন্ত্র প্রবল আতঙ্কে বন্ধ হয়ে আসে |ঐ তো তনিমা|পাশের বালিশে|কটমটে চোখ ,সাথে মুখে একটা বিভৎস হাসি|পরদিন পরিচারিকার হাঁকডাকে অনেক বেলায় দরজা ভেঙে যখন আবাসনের বাসিন্দারা অনিমেষ এর দেহ উদ্ধার করে ,তখন ড্রইং রুমে শ্রাদ্ধবাসরের রজনীগন্ধার মালা ঝোলান ছবিতে তনিমা মিটিমিটি হাসছে|





 

 

 

 

 

 

 

 

 ফেরা

 তপেন্দু নারায়ণ রায়

বাবা অজিতকারা নাকি কাল রওয়ানা হবে?তপন জানতে চায় সুধীরের কাছে।
--কাল থেকে ওদের ভাটার শ্রমিকদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া শুরু হবে।গাড়ি নাকি মাত্র তিনটে।তিনটে গাড়িতে সব শ্রমিক একসঙ্গে যেতে পারবে না।প্রথমবারে অর্ধেক পরের বার বাকি অর্ধেক শ্রমিক নিয়ে যাবে।অজিতের সাথে ফোনে কথা হল।ওদের নাকি দ্বিতীয় ট্রিপে নিয়ে যাবে।তার মানে আরো তিন চারদিন পর অজিতেরা রওয়ানা দেবে।ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে সুধীর।
--ওরা তো তবু কয়েকদিন পর বাড়ি যাবে।ওদের ভাটা আমাদের ভাটার থেকে অনেক ভালো।আমাদের ভাটায় গাড়ির তো কোনো খবরই নেই।অন‍্যান‍্য ভাটার লোকজন তো বাড়ি চলে যাচ্ছে।আমরা যে কতদিন ভাটায় পড়ে থাকব!দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তপন।
--আসলে এই ভাটার মুন্সী,ম‍্যানেজার ভালো নয়।এদের দয়া-মায়া কিচ্ছু নেই।এতগুলো শ্রমিক এইভাবে মরা-বাঁচা হয়ে আছে,তবু এদের হেলদোল নেই।এতদিন হল একটা গাড়িও জোগাড় করল না।তারপর দুয়েকটা কাঁচা গালিগালাজ করে সুধীর।সর্দার তো লকডাউনের জন‍্য এখানে আসতে পারছে না।ও থাকলে ঠিক একটা ব‍্যবস্থা করে ফেলত।তবে তোর বিরিনদাদু বলল সর্দার নাকি আমাদের ওখান থেকেই দুটো গাড়ি জোগাড় করেছে।গাড়ি ভাটায় আনার জন‍্য নাকি বিডিও অফিসে গিয়ে অর্ডার নিতে হবে।সরকারি ব‍্যাপার কবে কি হবে কে জানে?সুধীর আরো কিছু বলতে চাইছিল,কিন্তু কথা শেষ না হতেই ঘর থেকে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যায় তপন।
--এই ভরদুপুরে কোথায় যাস।
--বিরিনদাদুর পাতরা।
পাতরা মানে কলোনি।একটা ইট ভাটায় শ্রমিকদের কয়েকটি আলাদা আলাদা কলোনি বানিয়ে রাখা হয়।এই একেকটা কলোনি একেকটা পাতরা।

বিরিন আর তপনেরা একই পাড়ার লোক।তায় আবার বিরিন হল সুধীরদের পেটি সর্দার।সর্দারের অধীনে আরো কয়েকজন পেটি সর্দার থাকে।এরা সর্দারকে শ্রমিক জোগাড় করে দেয়।তার বিনিময়ে কমিশন পায়।আবার নিজেরাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।পেটিদের কাছে আর পাঁচটা সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় তাই ভাটার খোঁজখবর বেশি থাকে।কিন্তু সুধীর যা শুনিয়েছে বিরিনের মুখেও ওইটুকুই তথ‍্য পায় তপন।বড় আশা ছিল দাদু জানবে কবে গাড়ি ছাড়বে।কিন্তু দাদুও জানেনা।একদুপুর রোদ মাথায় নিয়ে ভাটার খাঁ খাঁ পরিবেশে কোনমতে সাইকেলে প‍্যাডেল করে তপন।খাঁচার পাখি জানে না কবে খাঁচা থেকে মুক্তি মিলবে।বাড়ি থেকে দূর দেশে এনে কোনো এক দৈত‍্য বুঝি তাকে বন্দি করে রেখেছে অচিনপুরীতে।হাজার চিৎকারেও যেন তার মুক্তি নেই!


সন্ধ্যায় চায়ের আসর বসে ভাটার প্রত‍্যেক ঘরে।সেই সময় মোবাইলে করোনার খবর দেখে তারা।সেই নিয়ে আলোচনা হয় নিজেদের মধ‍্যে।আর প্রত‍্যেকদিন আরো একটু বেশি করে আতঙ্ক চেপে বসে তাদের মনে।ভয় কাটাতে খবরের চ‍্যানেল পরিবর্তন হয়।চলে বাংলা সিরিয়াল,সিনেমা বা গান।এগুলোই তখন আতঙ্কে ডুবে যেতে থাকা মানুষগুলোর নতুন করে বাঁচার রসদ।তপনরাও এই সন্ধ্যায় করোনার খবর শুনতে শুনতে ডুবে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকারে।এইসময়ই বিরিন এসে হাজির হয় তপনদের ঘরে।বিরিনকে দেখামাত্রই ফুঁসে ওঠে তপনের মা--আমাদের কি ভাটাতেই মারবেন!সব ভাটার লোক বাড়ি যাচ্ছে আর আমরা পড়ে পড়ে মরছি।গাড়ি জোগাড় করতে এতদিন লাগে।
--আঃ,চুপ করো।বউকে থামিয়ে দেয় সুধীর।কাকাকে একটু চা বানিয়ে দাও।
তপনের মা চা বানায়।একটাই ঘর।সেই ঘরেই থাকা-খাওয়া।ঘরের ছাদ টিনের ছাপড়া দেওয়া।দেয়ালগুলো ইটের ওপর ইট সাজিয়ে তৈরি।তপনের মায়ের উদ্দেশ্যে বিরিন বলে--আমিও কি আর ভাটায় শখ করে পড়ে আছি বৌমা।আমার বৌ-বাচ্চাও তো ভাটাতেই আছে।করোনায় কি তোমরাই মরবে,আমরা মরব না!
--ওইসব বাদ দেও।গাড়ির কি খবর আছে বলো।সুধীর জানতে চায় বিরিনের কাছে।
--কাল নাকি সর্দার বিডিও অফিসে পারমিশন নিতে যাবে।তারপর খবর হবে।সরকারি ব‍্যাপার।কবে কি হয় বলা যাচ্ছে না।
সকলের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় ঘরের পরিবেশ।বিদায় নেয় বিরিন।

পরেরদিন দুপুরে সুখবরটা আসে।বিডিওর অর্ডার মিলেছে।গাড়ি আজই ওখান থেকে ছাড়বে।আগামীকালই শুরু হবে ঘরে ফেরা।পাঁচ পেটি সর্দার কে কে কবে যাবে সেই নিয়ে আলোচনায় বসে।প্রথম দফা অর্থাৎ আগামীকালের যাত্রী হিসেবে তার পরিবার ও তপনদের পরিবারের নাম মনোনীত করে।খবরটা পৌঁছে যায় সব পাতরায়।চির অন্ধকারের দেশে কোথা থেকে যেন সহস্র জোনাকি উড়ে এসেছে।ভাটায় আজ আনন্দের রোশনাই।খুশীতে উড়ছে তপন কাল যাত্রা শুরু।মনের আনন্দে গান ধরে সে।সন্ধ‍্যা নেমেছে।গতকালের থেকে আজকের সন্ধ‍্যার কত পার্থক্য।পোটলা বাঁধে সুধীর আর তার বৌ।হাত লাগায় তপনও।


অনেকদিন ভালো করে ঘুম হয়নি সুধীরদের।আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে তিনজনই।অনেকদিন বাদে শান্তির ঘুম তিনজনের চোখেই।ভোর হয়ে এসেছে।ব‍্যথায় কাতরে ওঠে তপন।তপনের চিৎকারে ঘুম ভাঙে সুধীরদের।বিছানাতেই পায়খানা করে তপন।তপনকে জল দেয় সুধীর।তারস্বরে চিৎকার করছে তপন।সেই শব্দে আরো কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে।বলতে বলতে আরো একবার পায়খানা করে তপন।এরপর চোখ বন্ধ করে সে।সারা শরীর যেন ছেড়ে দেয় শূন‍্যে।জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে তার।দেরি না করে ভাটার ইট টানার একটা রিক্সাভ‍্যান জোগাড় করে তপনকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় সুধীর এবং আরো দুয়েকজন।হাসপাতালে ডাক্তার জানায় তপন আর বেঁচে নেই।যে জোনাকি পোকাগুলোর আলোয় উজ্জ্বল হয়েছিল সুধীরের মন,এক নিমেষেই তারা যেন কোথায় উধাও হয়ে সুধীরকে একা অন্ধকারে ফেলে চলে গেল।


ভাটায় খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে।তপনের মা জ্ঞান শূন‍্য।বারেবারে দাঁত কপাটি লাগছে তার।সুধীরও ধাতস্থ নয়।তপনকে কোথায় দাহ করা হবে,সেই নিয়ে কথা চলে সবার।সুধীর তপনকে 
 বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বাড়ি ফেরার বড় তাড়া ছিল তার।তাকে কি করে এখানে দাহ করা যায়!খুব তাড়াতাড়ি একখানা গাড়ি ছাড়ার ব‍্যবস্থা করা হয়।অন‍্যান‍্য শ্রমিকেরা গাড়িতে উঠে পড়ে।সবশেষে তোলা সুধীর আর তার বৌকে।তপনের কাঁথায় মোড়া দেহটা দেওয়া হয় তাদের কোলে।গাড়ি স্টার্ট দেয়।সুধীর আর তার বৌ তারস্বরে কেঁদে ওঠে--চল্ বাবা,বাড়ি চল্।


 

 

 

 

 

 

 

 

 বাঁচতে দিন

বিজন মজুমদার

লকডাউনের আগের কথা ।ভোরের ডাউন রানাঘাট লোকাল ধরে রোজ এক সবজিওয়ালী মাসিমা চাকদহ থেকে ইছাপুরে আসতেন আনন্দমঠ বাজারে সবজি বিক্রি করতে ।এই ভাবেই রুটিন মেপে দিনযাপন চলছিল তার ।সবজি বিক্রি হয়ে যাবার পর বেলা বারোটা নাগাদ তিনি আপ শান্তিপুর লোকাল ধরে বাড়ি ফিরতেন ।রোদ ঝড় জল বৃষ্টি যাই হোক না কেন, তার এই প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দে কোনদিন ব্যাঘাত ঘটেনি ।
       হ্যাঁ, তার জীবনের ছন্দ কেটে গেল সেদিন, যেদিন থেকে সারা দেশে আকস্মিক ভাবে লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেল, সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল ।লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ল !ট্রেনই হল সাধারণ মানুষের একমাত্র সহজলভ্য যানবাহন, যা বন্ধ করে দেওয়া মানে জীবনের লাইফ লাইন বন্ধ করে দেওয়া ।মানুষ ভেবে ছিল লকডাউন আর কতদিন থাকবে, সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে ।কিন্তু মানুষের অপেক্ষার আর শেষ হল না ।করোনার গতি যত দ্রুত বেড়েছে, লকডাউনের সময়সীমা তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে! ট্রেন চলাচল আজও শুরু হল না ।
        লকডাউন ঘোষিত হবার পর দেশজুড়ে চলতে থাকল চরম অব্যবস্থা! পরিযায়ী শ্রমিকেরা আর কতদিন সহায় সম্বলহীন ভাবে পড়ে থাকবেন ভিন রাজ্যে? পেটের তাড়নায় তারাও পায়ে হেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল রেললাইন অনুসরণ করে ।এতো তিন চার কিলোমিটার পথের ব্যাপার নয়, হাজার হাজার মাইল পথের ব্যাপার ।শ্রমিকদের বিশ্বাস, রেললাইন ধরে এগোলে একদিন ঠিক বাড়ির দরজায় পৌছানো যাবে !কিন্তু এত মাইল পথ চলা কি চাট্টিখানি কথা? পথে যেতে যেতে পায়ে ফোসকা পড়ে গেল, ক্ষুধার জ্বালায় অবসন্ন দেহ রেললাইনের ধারে লুটিয়ে পড়ল, কেউ কেউ পড়ল ঘুমিয়ে ।তাদের বিশ্বাস ছিল, এখন তো লকডাউন চলছে, নিশ্চয় কোন ট্রেন চলবে না, সুতরাং রেললাইনের জমিতে একটু বিশ্রাম নেওয়া যেতেই পারে ।কিন্তু কে জানত, সেই রাতই তাদের জীবনের শেষ রাত? কোথা থেকে বিনা নোটিশে একটি মালবাহী ট্রেন চলে এল, ক্লান্ত শ্রমিকের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রইলো রেললাইনে, আর পুঁটলিতে থাকা রুটি তরকারির সাথে মিশে গেল চাপচাপ রক্ত!
        না, লকডাউনের পর সবজিওয়ালীকে আর দেখা গেল না আনন্দমঠ বাজারে ।সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিও ধূসর হতে লাগলো, মন থেকে মুছে গেল মাসিমার ছবি ।লকডাউন ধাপে ধাপে বেড়ে আট নয়মাস হতে চলল ।মাঝে মাঝে দেখি, রেললাইনে দুই একটি ট্রেন চলাচল করছে ।প্রায় ফাঁকা ট্রেনই বলা যায় ।প্রতি কামরায় চার পাঁচজন করে যাত্রী! ওই ভাগ্যবান যাত্রীরা হলেন রেলকর্মী! সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশ নিষেধ ।
        একদিন বাজারে গিয়ে ভূত দেখার মতো অবস্থা হল ।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ।দেখি, মাসিমা দোকান খুলে সবজি সাজিয়ে বসে আছেন! সবজি বলতে সামান্য কটা বুনো কচু, বুনো লতি, বুনো শাক আর কয়েকটি লেবু ।আমি চোখে ভুল দেখছি নাতো? চোখদুটি ভালো করে রগরে নিয়ে তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ, এই তো সেই সবজিওয়ালা মাসিমাই!তবে চেহারা যেন অনেকটা ভেঙে পড়েb!আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, আরে মাসিমা, আপনি কেমন করে এলেন? ট্রেন তো এখনও চালু হয়নি! উনি বললেন, কি আর করব বাবা! একদিন ট্রেনের গার্ডকে আমার দুরবস্থার কথা বললাম ।উনি শুনে বললেন, এমনিতে তো সাধারণ যাত্রীদের ওঠার নিয়ম নেই, তবে আপনাকে বারণ করব না ।তাইতো আসতে পারলাম ইছাপুরে ।
         মাসিমা যে সবজি নিয়ে বসেছেন, তার একটিও তিনি কিনে আনেননি । মাসিমা বললেন, দেখো বাবা, এইতো কটা মাত্র সবজি এনেছি ।এগুলো আমার বাড়ির আনাচেকানাচে হয়ে ছিল, সেগুলোই তুলে নিয়ে এলাম ।বাজার থেকে সবজি কিনে এনে বিক্রি করব, সেই পয়সা এখন আর নেই ।লকডাউন তো সব শেষ করে দিয়েছে ।বলতে বলতে মাসিমা একটু চুপ করে গেলেন ।ভাবা যায়, এই সামান্য কয়টা সবজি বিক্রি করতে উনি সেই চাকদহ থেকে ইছাপুরে এসেছেন! অবস্থা কোথায় গিয়ে নেমেছে তাহলে!
         তারপর কেটে গেছে তিন থেকে চারটি দিন ।একটি বিশেষ কাজে ইছাপুর প্লাটফর্মের উপর দিয়ে যাচ্ছি ।তখন বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা হবে ।প্লাটফর্মের বসার জায়গায় চোখ যেতেই দেখি, বসার জায়গায় টান টান হয়ে শুয়ে আছেন মাসিমা ।মাসিমা বলে ডাকতেই চোখ মেলে তাকালেন, কিন্তু উঠে বসলেন না ।আমি তাকে বললাম, এখনও আপনি বাড়ি যাননি? মাসিমা বললেন, কি করব বাবা, ট্রেন তো সেই বেলা তিনটেয় ।এতক্ষণ আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে ।কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়, বলো! নির্জন স্টেশনে তাই একটু ঘুমিয়েই পড়লাম ,শরীর আর দিচ্ছে না বাবু!আজ যদি ঠিকঠাক ট্রেন চলত, তাহলে কি আমার এই অবস্থা হত? কে বুঝবে আমাদের কথা? একেবারে ধনে প্রাণে শেষ হয়ে গেলাম!
         আমি ভাবছি অন্য কথা ।সেই কোন সকালে চাকদা থেকে ইছাপুরে এসেছেন সবজি বিক্রি করতে । বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়তো চারটে বেজে যাবে ।এই সময়ের মধ্যে ওনার কিছু খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে! স্টেশনের সব দোকানপাট সেই লকডাউনের পর থেকে তো বন্ধ রয়েছে ।খাবার পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই!
         তবু তাকে বললাম, এত বেলা হল, কিছু খেয়েছেন মাসিমা? উনি বললেন, কি আর খাব, ওই চায়ের সাথে দুটি বিস্কুট খেয়ে এখনও পর্যন্ত টিকে আছি ।জানিনা, এভাবে আর কতদিন চলবে! সত্যি বলছি, আর কিছুদিন যদি এইভাবেprg ট্রেন স্বাভাবিক না হয়, ঠিক মরে যাব!
         খুব খারাপ লাগল ওনার কথা শুনে ।নিজেকে খুব লজ্জিত মনে হল ।সত্যি কথা বলতে কি, যারা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, তাদের জীবন লকডাউনে একেবারে শেষ হয়ে গেছে!
        অভিশপ্ত করোনা, অভিশপ্ত লকডাউন মানুষের জীবন একেবারে ব্রেক ডাউন করে দিয়েছে ।এখনও যদি ট্রেন না চালু হয়, এই ধুক ধুক করা প্রাণ গুলোর যে কি পরিণতি হবে, কে জানে!
        উপরতলার মনুষ্য করোনাকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু নিচুতলার মানুষ করোনার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বলছে, আমাদের বাঁচতে দিন, ট্রেন চলতে দিন, নইলে করোনা নয়, আমরা না খেতে পেয়েই চলে যাবো ।