Saturday, October 31, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

আমার ছেলেবেলা 

অতনু মৈত্র

 

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই ছেলেবেলার কিছু ঘটনা থাকে যা আমৃত্যু পর্যন্ত মনে থেকে যায়। ছেলেবেলার স্মৃতি বড়োই সুখকর হয়ে থাকে। আমার জীবনের সেইরকম কয়েকটি ভুলে না যাওয়া সাধারণ ঘটনাই এখানে রোমন্থন করছি।

আমার বয়স তখন সাত-আট বছর হবে, আমাদের বাড়ির কিছুটা দূরে একটা পুকুর ছিল। ঐ পুকুরের পাড়ে একটা বড়ো মাটির ঢিবি ছিল। মাঝে মাঝে আমরা বন্ধুরা মিলে যেতাম ঐ ঢিবির উপরে ডিকবাজী খেতে। ডিকবাজী খেতে খেতে গড়িয়ে ঢিবির নীচে আসার মজাটাই আলাদা ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো, কে সবার আগে গড়িয়ে ঢিবির নীচে নামতে পারে। ঢিবির মাঝে বরাবর কয়েকটি ছোট ছোট গর্ত ছিল। যদিও আমরা কোনদিন দেখার চেষ্টা করিনি ঐ গর্তের ভিতরে কি আছে? এইরকমই একদিন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ডিকবাজীর প্রতিযোগিতা চলছিল। গড়িয়ে নিচে নামতে নামতে অনুভব করলাম পিঠে ঠান্ডা কি একটা স্পর্শ করলো। ডিকবাজী খাওয়ার আনন্দে তখন কিছুই মনে হয়নি। নীচে আসার পর উপরে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। দেখলাম প্রায় দেড় হাত লম্বা একটা সাপ যন্ত্রণায় ছটপট করছে। আমার এক বন্ধু ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে "সাপ সাপ"। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কিছুটা দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, আমাদের চিৎকার শুনে তিনি ছুটে আসেন। কাছে এসে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন "কি হয়েছে?" এক বন্ধুর কাছে তিনি পুরো বর্ণনা শুনে ঢিবির উপরের দিকে তাকান। সাপটিকে দেখে তিনিও ভীতি প্রদর্শন করেন। বলেন "আরে এটা তো শাঁখামুটী সাপ, তোমাদের কাউকে কামড়ায়নি তো?" আমরা সমস্বরে উওর দিলাম "না"। জবাব শুনে তিনি বললেন "তোমরা আজ বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছো, ঐ সাপ কামড়ালে আর রক্ষে থাকতো না। আর কোন দিন এদিকে এসো না"। সত্যি সেদিনের পড়ে আর কোনদিন সেই মাটির ঢিবিতে আর খেলতে যাইনি।

আরোও একটু বড়ো হলাম, তখন আমার বয়স বারো কি তেরো বছর হবে। বার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিন ছিল। তারপর একমাসের লম্বা ছুটি।  তাই মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল। কয়েকজন  বন্ধু সাইকেলে করে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। ফেরার পথে একটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাগান দেখলাম। বাগানের একপাশে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। গাছটিতে পাকা পাকা পেয়ারা ফলে রয়েছে। দেখে বড়ো লোভ হলো, বন্ধু দের বললাম "চল পেয়ারা পাড়ি"। যেই বলা সেই কাজ,  সাইকেল গুলো ব্যাগ সমেত পাঁচিলের পাশে রেখে, পাঁচিল টপকে গাছে উঠে আনন্দে পেয়ারা খেতে লাগলাম। আমাদের মধ্যে অবশ্য একজন বলেছিল, যদি কেউ দেখে নেয় তাহলে কি হবে? আমি তখন তাকে বলেছিলাম "এই ভরদুপুরে কে তোকে দেখবে?" সেই সুপক্ক পেয়ারার স্বাদই আলাদা ছিল। আমরা পেয়ারা পাড়তে এতটাই মশগুল ছিলাম, আশে পাশে কে কি করছে সেটা নজরে আসেনি। আমার এক বন্ধু কয়েকটি পেয়ারা পেড়ে ব্যাগে রাখতে দিয়ে দেখে, আমাদের সাইকেল গুলো আছে কিন্তু ব্যাগগুলো নেই। সে চিৎকার করে আমাদের ডাকলো। তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে দৌড়ে ছুটে এসে দেখলাম সত্যি সাইকেল থেকে ব্যাগ গুলো উধাও। দূরে দেখলাম লাইট পোষ্টের গায়ে দাঁড় করানো একটি সাইকেলের উপরে আমাদের ব্যাগ গুলো ঝোলানো। আর তার পাশে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না, তিনিই সেই বাগানের মালিক। চুড়ির আনন্দ, ধরা পড়ে যাওয়ার ভীতিতে বদলে গেলো। ভদ্রলোকটির কাছে গিয়ে বললাম "কাকু এই ব্যাগগুলো আমাদের"। ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বললেন "তোমরা স্কুলে গিয়ে কিছু্ই শেখোনি, তাই এই ব্যাগগুলো আমার কাছেই থাক। ওগুলো তোমাদের স্কুলের হেডমাস্টার মশাইকে জমা দিয়ে আসবো। তোমরা উনার থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে নিও। যাও এখন পেয়ারা পারো। " এটা শুনে আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম, বললাম "কাকু আর হবে না। প্লিজ ছেড়ে দিন"। এসব শোনার পর, ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে ব্যাগ সমেত সাইকেল নিয়ে হাঁটা দিলেন। আমরাও গেলাম তার পিছনে। কিছুটা দূরে পাঁচিল দেওয়া একটি বাড়িতে তিনি ঢুকলেন। বুঝলাম এটা উনার বাড়ি। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভদ্রলোক বাড়িতে ঢুকতেই উনার মা বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন "এতোগুলো ব্যাগ কোথা থেকে আনলি?" তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “এঁরা কারা?" ভদ্রলোক জবাব দিলেন " তুমি পড়াশোনা করবে তাই নিয়ে এলাম, আর ওরা আমাদের বাগানে পিয়ারা পারছিল।" এইকথা শুনে বয়স্কা ভদ্রমহিলা সব বুঝতে পারেন। একটু মুচকি হেসে তিনি বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। তখন ভদ্রলোকটি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন "তোমারা দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও পেয়ারা পারো, না হয় বাড়িতে যাও"। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, একজন বন্ধুতো আবার কান্না জুড়ে দিলো। আমরা সমবেত ভাবে ভদ্রলোকটিকে বিভিন্ন অনুনয় বিনয় করতে লাগলাম। এমন সময় সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা বেড়িয়ে এলেন। তাঁর দুই হাতে একথালা মিস্টি এবং একজগ জল। আমাদের তিনি ডাকলেন। ভদ্রলোকটি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন "যাও মা তোমাদের ডাকছেন"। আমরা গেট খুলে তাঁর কাছে যেতেই তিনি বললেন "এগুলো খেয়ে নাও, স্কুল ছুটির পর তো কিছুই খাওয়া হয়নি। এটাই তোমাদের শাস্তি। না বলে কারো বাগান থেকে কিছু নিলে, সেটাকে চুড়ি বলে। আর কোনদিন এরকম কাজ করোনা"। তারপর উনি তাঁর ছেলেকে উদ্যেশ্য করে বললেন "তুইও পারিস বটে, কটা পেয়ারাই তো নিয়েছে। ব্যাগগুলো দিয়ে দে"। ভদ্রলোক তখন বাধ্য ছেলের মতো ব্যাগগুলো ফেরত দিয়ে বলেছিলেন "যখন পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করবে আমার কাছে আসবে। ওভাবে গাছে উঠবে না, আঘাত লাগতে পারে"। মিষ্টিগুলো খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম সেদিন। ঘটনাটি খুবই সাধারণ, কিন্তু ভদ্রলোকটির শিক্ষা দেবার পদ্ধতি এবং ঐ বয়স্কা ভদ্রমহিলার অমায়িক মিষ্টি ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেছিলো সেদিন।

আর একটু বড়ো হলাম, পাড়ার ক্রিকেট এবং ফুটবল টিমের নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠলাম। পাড়ার পূজা পার্বণ, আচার অনুষ্ঠান সমস্ত রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতো। মহালয়ার আগের দিন পাড়ার ক্লাবে বন্ধুদের সাথে রাতজেগে পিকনিক, তারপর চলতো চুরি। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন চুরি। কারো গাছের ডাব-নারিকেল, কারো আখের ঝাড় কেটে সাফ্, আবার কারো গাছের বাতাবি লেবু ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক সময় যেই বাড়িতে চুরি করতে যেতাম, সেই বাড়ির কূলপ্রদীপও আমাদের সাথে থাকতো। তবে বছরে ঐ একটা দিনই আমরা এসব কাজ করতাম। পাড়ার বড়োরাও এসব জানতেন। কখনো ধরা পড়লে একটু ভৎসনা করে ছেড়ে দিতেন।

কোন এক মহালয়ার রাতের একটা চুরির ঘটনাই আজ বলবো। এক বাড়িতে নারিকেল গাছে উঠেছি ডাব পাড়তে। গাছটা একটু উঁচু ছিল, আর পাঁচিলের ধারে ছিল। আমি গাছের ওপর থেকে পাঁচিলের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন বন্ধুকে ডাব চালান করছিলাম। তারাও সেগুলো নীচে দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের চালান করছিল। অকস্মাৎ একটা ডাব আমার হাত ফসকে নীচে মাটিতে পড়ে যায়। সেই আওয়াজে বাড়ির মালিক আলো জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে আসেন। নীচের সবাই ততোক্ষণে যে যার মতো পগাড় পাড়। কিন্তু এই অধম গাছের উপর আটকে পড়লাম। নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করার চেষ্টা করেছিলাম, তবুও ভদ্রলোক টর্চের আলোয় আমার একটি পা দেখে নেন। আর তৎক্ষণাৎ তাঁর চিৎকার শুরু হয়ে যায়। বেগতিক দেখে কয়েকটি দোমালা নারিকেল ভদ্রলোকটির চারিপাশে ছুড়তে লাগলাম। এতে উনি খুব ভয় পেয়ে যান। তারপর উনি দৌড়ে বাড়ির বারান্দায় ঢুকে চিৎকার করতে থাকেন। সেই সুযোগে কোনরকমে গাছ থেকে নেমে পালিয়ে বেঁচেছিলাম সেদিন। বুকে অনেকটা কেটে গেছিলো, তবু ধরা না পড়ার আনন্দ সেই কষ্টকে ছাপিয়ে গেছিলো।

আর একটি ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। ঘটনাটি ঘটেছিল কোন এক শীতের সন্ধ্যায়। মাধ্যমিক পাশ করে science নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছি। তখনকার সমাজ বলাবাহুল্য এখন কার মতো এতোটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছিল না। দুটি কিশোর কিশোরী পাশাপাশি হেঁটে গেলে পাশ দিয়ে গুঞ্জন শোনা যেতো। যাদের কিশোরী জুটতো তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আর যাদের জুটতো না। তারা ছিল ঐ আঙুর ফল টকের দলে। আমি তখন ঐ দ্বিতীয় দলেই পড়তাম। এক শীতের সন্ধ্যায় প্রাইভেট টিউশনি করে সাইকেলে করে ফিরছিলাম। আমার কিছুটা সামনে একজোড়া রোমিও, জুলিয়েট সাইকেলে করে পাশাপাশি যাচ্ছিল। জুলিয়েটের ডান হাত রোমিওর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ছিল। রাস্তাটা একটু সরু ছিল। উল্টো দিক থেকে একটা  বেরসিক মারুতি চলে এলো। অগত্যা জুলিয়েট রোমিওর সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিল। কারন দুজনে এভাবে পাশাপাশি গেলে মারুতি যেতে পারবে না। জুলিয়েট সামনে চলে গেলো, রোমিও তার পিছনে। আর এই অধম ছিলাম ঠিক রোমিওর পিছনে। আমার একটু তাড়া ছিল, তাই মারুতি চলে যাবার পর, রোমিওকে পাশ কাটিয়ে যেই জুলিয়েটকে পাশ কাটাতে যাবো। তখনই দূর্ঘটনা ঘটে গেলো। জুলিয়েট খপ্ করে আমার সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো "বাড়িতে গিয়ে এখন তুমি কি করবে?" । প্রথমে একটু অবাক হলেও পরোক্ষনেই বুঝতে পেরেছিলাম, আসল ব্যাপারটা। উত্তর দিলাম "একটু ছোটবাইরে যাবো "। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে জুলিয়েট তাকাল আমার দিকে। আমি মুচকি হেসে সেদিন জুলিয়েটকে জবাব দিয়েছিলাম "wrong number, আমি না পিছনে আসছে"।


No comments:

Post a Comment