Saturday, October 31, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

অন্য সম্প্রীতি 
মৌসুমী চৌধুরী 

           শরৎ আকাশ চুঁইয়ে একটু একটু করে নেমে আসছে গলাসোনা রোদ। আজই পুজো শেষ। ফজরের নামাজটা সেরে নিয়েছে রহিমা বিবি। আজ একটু সকাল সকাল বেরোবে তারা। নবযুবক সংঘের পুজো প্যান্ডেল থেকে হালকা ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। দশমীর পুজো শেষে প্রতিবারের মতো ‌হোম আর দধিকর্মা হবে নিশ্চয়ই। তারাও পাবে প্রসাদ।পাশের ঘর থেকে টুংটুং করে পুজোর ঘন্টা বাজানোর আওয়াজটা কানে আসছে রহিমার। পুজোয় বসেছে তার সই সরোজবালা দাসী। তারা দু'জন থাকে একই দাওয়ার দুটো চালাঘরে। দাওয়ায় নিঃশব্দে শুয়ে আছে একজোড়া খঞ্জনী আর একটা একতারা। তার ঠিক উপরে বাঁশের আঁকশিতে ঝুলছে দুটো ঝোলা। একটা ঝোলা গেরুয়া রঙের আর একটা ঝোলা রঙবেরঙের কাপড়ের টুকরো জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। পরম বন্ধুত্বে ঝোলাদুটো ঝুলছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। আজ দশ বছরের বন্ধুত্ব তাদের।
             রহিমার আজও মনে পড়ে, দশ বছর আগে পাঁচদিনের জ্বরে স্বামী হাজি আশরাফ আলি যেদিন এ সংসার ছেড়ে চলে গেলেন, তখন শ্বশুরের ভিটেতে জায়গা হয় নি অন্ধ, বাঁজা মেয়েছেলে রহিমা বিবির। বাপের বাড়িও খুব গরীব ঘর, তার ওপর আম্মাজান আর আব্বাজান গত হয়েছিলেন অনেক আগেই। ভাইয়েরা কেউ আর তাদের অন্ধ বোনটির খোঁজ রাখে নি। 
        কাজ-কামাই তো কোনদিনই তেমন কিছু করতে পারত না রহিমা। ছোট্টবেলায় চোখের এক  কঠিন অসুখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল। থাকার মধ্যে ছিল আল্লাহ্‌র দেওয়া বড় সুরেলা এক গানের গলা। বাড়ির এক খামচা উঠোনে বসে গান গাইতে গাইতে শুকনো কাঠ, পাতা-লতা দিয়ে উনুন ধরিয়ে হাতড়ে হাডড়ে রোজ কোনক্রমে দুটো ভাত-তরকারি ফুটিয়ে রাখত সে। আর স্বামী আশারফ কাক-ডাকা ভোরেই ফজরের নামাজ শেষ করে কাজে বেরিয়ে যেতেন। দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি, বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর পার। ফিরে এলে রহিমাই সযত্নে বেড়ে দিত ভাত। এভাবেই চলে যাচ্ছিল নিঃসন্তান স্বামী-স্ত্রীর সংসার- জীবন। হঠাৎ একদিন ঘটল অঘটন। ডেঙ্গুজ্বরে মারা গেলেন আশরাফ আলি। বন্ধ হয়ে গেল রহিমার অন্ন-সংস্থান। প্রথম প্রথম প্রতিবেশীদের দয়ায় দু'মুঠো জুটলেও ক্রমে সেটাও হল বাড়ন্ত! অবস্থাটা একদিন চরমে পৌঁছল। একেবরে না খেয়ে মরার উপক্রম!
           আশরফ আলীর পাড়াতেই থাকত সরোজবালা দাসী। সারাদিন ট্রেনে-বাসে, এখানে-ওখানে গান গেয়ে ভিক্ষে করত। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে নিজে হাতে ভিক্ষান্ন ফুটিয়ে খেত। আউল বাউল ভিক্ষা দাসীর এভাবেই দিন গুজরান। তিনদিনের অভুক্ত রহিমা পেটের টানে এই সরোজবালার কাছে এসেই সাহায্যের হাত পাতে। সরোজবালার সাথে তার সই পাতানো ছিল অনেক আগেই। ফুরসত পেলেই রহিমা তার কাছে বসে সুখ-দুঃখের কথা কইত প্রাণ খুলে। শুনত একতারা বাজিয়ে তার খোলা গলায় বাউল গান। শুনতে শুনতে হয়তো কোন কোন দিন সন্ধে নেমে আসত প্রতিবেশীের তুলসি তলায়। 
      কিন্তু সরোজবালার তো নিজেরই চলে লোকের দেওয়া ভিক্ষেতে। তাই সে রহিমাকে বলেছিল,
--- "আমার তো ক্ষমতা নেই, সই, তোকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার। তবে আমার মতো ভিক্ষের পথে তুই যদি যেতে রাজী থাকিস, তাহলে আমি তোর সঙ্গে থাকব জীবনভর। তোর হাত ধরে পথে পথে নিয়ে যাব আমিই। আর সত্যি বলতে কি, তোকে দেখে দয়া করে লোকেরা ভালোই ভিক্ষে
দেবে।"
        সেই থেকে রহিমা তো সরোজবালার সাথেই কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর। দু'জনে একসঙ্গে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করে। একই সঙ্গে রাঁধে, খায়। একই সঙ্গে হাসে, কাঁদে।  কীর্তন-ভাটিয়ালি-লালনগীতি-জারিগান গায়। বেঁচে থাকার গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে তারা জীবন পথে। তারপর একদিন তারা দুজনে মিলে খুলে ফেলল একটি চায়ের দোকানও। নবযুবক সংঘের পাশে মাঠের ধারে। বিকেলে মাটির ভাঁড়ে চা নিয়ে নানা বয়সী খদ্দেরদের মজলিশ জমে ওঠে তাদের চায়ের দোকান ঘিরে। সরোজবালা চায়ের জোগান দেয়। আর রহিমা গান শোনায় খদ্দেরদের। 
          ওই, পুজো শেষ হয়ে গেল সরোজ- বালার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝোলাটা কাঁধে লাগিয়ে দিল রহিমার, হাতে ধরিয়ে দিল খঞ্জনি আর সরোজবালা নিজের একতারাটি হাতে নিয়ে সুর বাঁধল,
---- "আমার সর্ব অঙ্গে লিখে দিও গো শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম..."
      সরোজবালার পিছু নিল রহিমা বিবি। খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে ধোয়া টানল সে,
"মরিব মরিব সখী নিশ্চয় মরিব/কানু হেন গুণনিধি আমি কারে দিয়ে যাব..."
       পথের বাঁকে মিলিয়ে যায় তাদের গানের রেশ। পেটের সুর বাঁধা থাকে একটি তারে। মানুষের বানানো ধর্ম সেখানে আঙুল ছোঁয়াতে পারে না।

No comments:

Post a Comment