হাসি
দেবদত্তা লাহিড়ী
যতক্ষণ
সে মোবাইলে ডুবে থাকে-মুখের হাসি তার মেলায় না|প্রোফাইল জুড়ে কচি খুকিরা
আর তাদের ছবি ও নেকুপুশুপনা-মেজাজটা বেশ ফুরফুরে করে দেয়|এঞ্জেল প্রিয়া আর
দুষ্টু রিয়ার খান পঞ্চাশেক ছবিতে লাইক আর ভেরী নাইস কমেন্টে ভরিয়ে ,একটা
খুশীর নিশ্বাস ফেলে অনিমেষ|,মোবাইল টেবিলে রেখে,মাথার পেছনে হাতদুটি আরাম
করে থিতু করে চেয়ারে এলিয়ে বসতেই চোখ যায় তনিমার দিকে|এ্যাঃ|বউএর কটমটে
চাহনিটা এক নিমেষে আবেগ আর আমেজ দুটোই নিমেষে "ফুস" করে দিল বছর পঞ্চাশের
অনিমেষ এর|চাহনির উত্তর না দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা পাঞ্জাবীর পকেটে চালান
করে আবাসনের ছাতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে|এই এক আ্যপ বিচরণ,আরএক ঐ ছাত-এ
দুখানি ই তো তার জীবনের মুক্তমঞ্চ|বাকি যা ছিল সবই তো কবেই তনিমা কেচে
ঝেড়ে মেলে দিয়েছে|রাগ হলেও কিছু বলতে পারেনা সে| রোজগার বলতে নেই তার
কোনদিন তেমন|ফ্ল্যাটটুকুও তনিমার বাবার দাক্ষিণ্যেই|ধুর ধুর |বউ এর কথা মনে
হতেই ত্রিশ হতে চলা নিঃসন্তান বিবাহিত জীবনের তিক্ততা সুখটানের ধোঁয়ায়
উড়িয়ে দিতে মনস্হ করে অনিমেষ|
দুপুরে খাবার সময় ও
মোবাইল হাতে নিতে একই বিপত্তি|দ্বিপ্রাহরিক ভাতঘুম টা তনিমা কেন যে বন্ধ
করে দিল?সব বোঝে অনিমেষ- ঐ তো তাকে চোখে চোখে রাখতে| আর কি?
সন্ধ্যার অদম্য আকর্ষণ সিরিয়াল গুলো ও তনিমাকে আজকাল আর আটকে রাখতে
পারেনা|জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে অনিমেষের|একদিকে এঞ্জেল ,দুষ্টুদের হাতছানি
,অপরদিকে তনিমার কটমটে চোখের কামড়ানি|রাতে বালিশে কাত হয়ে শুয়ে লুকিয়ে
ছবিতে স্তুতির বন্যা বইয়ে আর এক কাত হতেই মোবাইল টা হাত থেকে পড়ে যাবার
যোগার হয় তার|বউ রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে| "পিশাচী" মনে মনে বলে মোবাইল নামিয়ে
চোখ বোজে সে|একদিন ঘুম থেকে উঠে রক্তচাপ বেড়ে যায় তার।প্রোফাইলে চোখ
রাখতেই|দুষ্টু ,এঞ্জেল ওরা কেউ নেই|তন্ন তন্ন করে খোঁজে সে|নাহ্|নেই|মনটা
বেজার হয়ে যায় ওর। মেয়েগুলো ওকে তালে--|গোটা দিনটা যে কিভাবে কাটে ওর|ধূসর
রং টা আসলে কি,সেটা বোধহয় মনখারাপ আর শূণ্যতার সংমিশ্রণেই বোধগম্য হয়|বিকেল
গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে সে মনখারাপ একটা নিকষ কালো প্রতিশোধ স্পৃহায়
পর্যবসিত হয়|সার্চ মোডে নাম দুটো ফেলে প্রোফাইল দুটো সে খুঁজতে
থাকে|ঘন্টাদুয়েক হানা চালিয়েও ব্যর্থ হয় সে|অবসন্ন পায়ে শোবার ঘরের দিকে
এগোতে বন্ধ দরজার ওপার থেকে কানে আসে তনিমার গলা|দূরভাষে|চাপা উল্লাসে
কাউকে জানাচ্ছে তার সাফল্য কাহিনী|সব টা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায়
অনিমেষের|সাত তাড়াতাড়ি ব্লক লিস্ট থেকে আনব্লক করে মেয়েদুটোকে রিকোয়েস্ট
পাঠায় সে|জবাবে মেসেঞ্জারে দুটো ধমক আসে|সাথে অনিমেষের কমেন্টের
স্ক্রিনশট|তারপর ই ওপার সব অন্ধকার|হাহাকার করে ওঠে ওর পুরুষত্ব|মাথা
খুঁড়েও সে মনে করতে পারেনা কবে এমন লিখল| ভালো করে পড়ে দেখে এ ভাষা তার
নয়|তবে কমেন্ট গেছে তার প্রোফাইল থেকেই|তনিমা!শুধু ব্লক করেই সে ক্ষান্ত
থাকেনি|
আজকাল তনিমা বেশ
খুশী খুশী থাকে|ওর খুশী হওয়াটা বুকে হাতুড়ী দিয়ে দমাদ্দম মারতে থাকে
অনিমেষের|রাতে শোবার আগে তনিমা দুটি করে প্রেশার কন্ট্রোলের ওষুধ খায়|সকালে
আরো দুটি|এর যাতে অন্যথা না হয় তার জন্যে সে গুনেগেঁথে সাত দিনের ওষুধ
পাতা ছাড়িয়ে রেখে দেয় একটা সাদা বাক্সে |গুনতি মাফিক ওষুধ শেষ হলে আবার
পুরে রাখে আগামী সাত দিনের|কড়া লক্ষ্য শরীরের প্রতি তার|অথচ দিন দুয়েক হল
শরীর টা তেমন ভালো ঠেকছেনা তার|ডাক্তার দেখাবার কথাটা মনে আসে|কিন্তু শরীর
খারাপ ছাপিয়ে যায় স্বামীকে শায়েস্তা করার আনন্দে|কিচেনে দাঁড়িয়ে আটা
মাখছিল সে|সকালের জলখাবারের ব্যবস্হা|হঠাৎ অনিমেষ কে ডাইনিং টেবলের চেয়ারে
বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায় সে|সে তো এত সকালে ওঠবার পাত্র নয়|
একটা
অস্বস্তি নিয়ে তনিমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনিমেষ|আজ তিনদিন হল তনিমার কৌটোর
ওষুধ সে বদলে দিয়েছে,কিন্তু তেমন কিছু ঘটাতো দূর তনিমাকে খুশী ই দেখাচ্ছে|
ভাবনার সুতো হঠাৎ ই ছিঁড়ে যায় তার|তনিমা ঘামছে|প্রবলভাবে|
মিনিট
ত্রিশেকের মধ্যে সমস্ত ব্যপার টা কমপ্লিট হয়ে যায়|মাথা ঘুরে পড়ে যাবার
সময় রান্নার গ্যাসের স্ল্যাবে মাথাটা বিশ্রীভাবে ঠুকে গিয়েছিল
তনিমার|স্ট্রোক না হোক ,রক্তপাতেই...|নিশ্চিন্তে ঘরে ঢুকেওষুধ গুলো পুনরায়
পাল্টে ,চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে|ঘুম ভাঙেনি বলাতে কেউ অবিশ্বাস
করেনি|ঘুমের ওষুধ খায় সে শোবার আগে|ডাক্তারি প্রমাণপত্র ও রয়েছে|তাছাড়াও
গোবেচারা দেখতে,সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ মানুষ অনিমেষ|এমনকি ঝগড়া করলেও
তনিমার গলাই শোনা যেত|কারো কোন সন্দেহ ই এলনা মনে|জেঠিমা অপঘাতেই
মরল,বেচারা অনিমেষ একা হয়ে গেল|সকলে সমবেদনা জানাল তাকে|শুধু অনিমেষ একা
নক্ষ্য করল -চুল্লীতে দেহ ঢোকাবার আগে,তার মোবাইলে টুং করে একট নোটিফিকেশন
ঢুকতেই কার একটা হাত লেগে তনিমার মাথাটা তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল|চোখটাও
আধখোলা হয়েছিল কি?মনে মনে অট্টহাসি হাসে সে -"এবার তাকাও দেখি কটমট করে|
?"শ্রাদ্ধশান্তি সব চুকতে সকলকে দরজার ওপারে প্রায় পগার পার করে এবার
প্রাণভরে শান্তির নিঃশ্বাস নেয় সে|শোবার ঘরে ঢুকে বালিশ টা আয়েস করে মাথার
তলায় দিয়ে চলতে থাকে তার একক অভিসার|মুখের হাসি আজ আবার ফিরে এসেছে
তার|ঘন্টা দুয়েক বাদে দুষ্টু মিষ্টি দের ছবিতে মন ভরে আসে তার|এবার ঘুমোতে
হবে|অভ্যাসমত পাশ ফিরে শুতেই হৃদযন্ত্র প্রবল আতঙ্কে বন্ধ হয়ে আসে |ঐ তো
তনিমা|পাশের বালিশে|কটমটে চোখ ,সাথে মুখে একটা বিভৎস হাসি|পরদিন পরিচারিকার
হাঁকডাকে অনেক বেলায় দরজা ভেঙে যখন আবাসনের বাসিন্দারা অনিমেষ এর দেহ
উদ্ধার করে ,তখন ড্রইং রুমে শ্রাদ্ধবাসরের রজনীগন্ধার মালা ঝোলান ছবিতে
তনিমা মিটিমিটি হাসছে|
No comments:
Post a Comment