কাল স্বরূপিনী কালী ও বঙ্গদেশে কালী পুজোর সূচনা
ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কালী
নামটিতে রয়েছে রহস্য ও মাধুর্যের অপরূপ সম্মেলন। কলনাৎ সর্বভূতানাং
মহাকালঃ প্রকর্তীতঃ যিনি সর্বভূতকে কলন বা গ্রাস করেন তিনি কালী।
দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপটি হলেন কালী। সৃষ্টির আদিতে যখন দশ দিক অন্ধকারে
আচ্ছন্ন তখন তিনি একমাত্র বর্তমান ছিলেন। তিনি স্বয়ং ব্রহ্মা কেও কাজে
নিয়োজিত করেন।শিব তাঁর মায়ায় বশীভূত হয়ে পদতলে নিষ্ক্রিয় শবের মত
শুয়ে থাকেন । তিনি রুদ্রাণী মহাকালী তাই প্রয়োজনে জগৎ সংহার ও করতে
পারেন--
মৃত্যুর্জিহ্বা মহামারী জগৎসংহারকারিণী
মহারাত্রিঃ মহানিদ্রা মহাকালী অতিতামসী....
মহানির্বানতন্ত্রে দেবীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অস্ত্রের প্রতীক বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
সৃষ্টির
আদিতে সব তমোময় শুধু মাত্র তিনি ই ছিলেন তাই তাঁর গায়ের রং ঘোর কালো।
তবে সাধকরা তাঁকে দেখেন নানা রূপে নানা বর্ণে ,শ্যামা রূপা কালীর মধ্যে
ভক্তরা বরাভয় মূর্তি খুঁজে পান।তাই তিনি সব কিছু র উর্দ্ধে ভাব ও
ভক্তির বিষয় মাত্র।
তিনি সংহার করেন ,প্রলয়কালে সব তাঁর মুখের ভিতর লয় পায় তাই তিনি করালবদনা।
আলুলায়িত কেশ গতির প্রতীক।জীবকে মায়া ডোর থেকে মুক্তি দেন এবং বিলাসবর্জিতা ও নির্বিকার তাই তিনি মুক্তকেশী।
তাঁর
চারটি হাত , বাম ঊর্ধহাতে খড়্গ, সেই খড়্গ দিয়ে নিষ্কাম সাধকের মোহপাশ
ছিন্ন করছেন।নীচের হাতে ধরে রেখেছেন সাধকের ,যা তত্ত্ব জ্ঞানের আধার।অন্য
দুটি হাতে ভক্ত কে দিচ্ছেন বরাভয়। ভয় ও কারুণ্যের সমাহার তাঁর চার হাতে।
দেবীর গলায় মুন্ডমালা ,এর সংখ্যা পঞ্চাশ।এই পঞ্চাশ টি মুন্ড বর্ণমালার পঞ্চাশ টি বর্ণের প্রতীক।
সর্ববন্ধন
যিনি দূর করেন ,দশদিক যাঁর আবরণ ভূমাস্বরূপিনী দেবীর বস্ত্রের কি প্রয়োজন
? তাঁর যোগ্য বস্ত্র পাওয়া যায় না তাই তিনি দিগম্বরী।
তাঁর
দু কানে দুটি শিশুর শব কানের আভরণ এর কারণ রূপে তন্ত্র বলেছেন - বালকের
মতো সরল সাধক ই দেবীর প্রিয় ,দুটি শবের আভরণ তার প্রতীক।
দেবীর শ্বেত দন্ত পংক্তি সত্ত্ব গুণের প্রতীক,ঐ সাদা দাঁতের চাপে দমন করে রেখেছেন রজোগুণ, তাঁর রক্ত বর্ণের জিভ রজো গুণের প্রতীক।
তাঁর অনাবৃত বক্ষস্থল বিশ্ব মাতৃত্বের প্রতীক।
তাঁর
কোমর বেষ্টন করে আছে মৃত মানুষের হাত।হাত দিয়ে মানুষ কাজ করে,যে যেমন কাজ
করে সে পরবর্তী কালে ফল পায় , পছন্দ মত ফল দেবার জন্য তিনি হাত গুলি
জড়িয়ে রেখেছেন। মানুষের সব কাজ কালীতেই লীন হয় এটি তার ই প্রতীক।
স্বর্গ
মর্ত্য ও পাতাল এই তিন লোক এবং অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব কিছু
সূর্য,চন্দ্র ও অগ্নি এই তিনটি চোখে দেখেন বলেই তিনি ত্রিনয়না।
মহাকালী নিত্য ক্রিয়াশীল আদি প্রকৃতি এবং শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ।শিব শক্তির অধীন।শবাকার শিব শক্তি
যুক্ত না হলে প্রাণ ফিরে পান না,স্পন্দিত হন না। তাই জাগ্রত হবার অপেক্ষায় দেবীর মুখাপেক্ষী হয়ে পায়ের তলায় তিনি শয়ান।
শ্মশান মানুষের কর্মভোগের শেষে বিরতির স্থান।
মুক্তি দাত্রী করাল বদনার আলয় ই তাই শ্মশান। তাঁকে পেতে গেলে জাগতিক কামনা বাসনা ত্যাগ করতেই হবে।
তন্ত্রমতে
শক্তি ও শিব একে অপরের পরিপূরক। কালী সৃষ্টি,ধ্বংস,পুষ্টি ও বৃদ্ধি র মূল
কারণ।শিব ও শক্তির মিলনে সাম্যরস থেকে উৎপন্ন হয় বিশ্বজগৎ।
পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে তান্ত্রিক আচারের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে পড়ে ও
দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের ফলে বাঙালি
হিন্দু সমাজের সর্ব স্তরে এক মহাদেবী কে তুলে ধরার এক নতুন প্রচেষ্টা শুরু
হয়। আরো বলা যায়, ষোড়শ শতকে এমন কয়েক জন বিখ্যাত সাধকের আবির্ভাব
হয়েছিল যাঁরা প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রের পুনর্মূল্যায়ন করেন ও তন্ত্র
শাস্ত্রের যন্ত্র ও ঘটের পরিবর্তে শাক্তদেবী কালী কে প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে
আমাদের বাংলায় কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত্রিতে কালীর যেরূপ মূর্তি পূজা
করা হয় তার প্রতিরূপের বর্ণনা আছে আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে বঙ্গদেশে রচিত
বৃহদ্ধর্মপুরাণে। সাধারণ ভাবে গৃহীত একটি মত হলো যে আনুমানিক ষোড়শ শতকে
নবদ্বীপবাসী তান্ত্রিক সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বঙ্গদেশে তান্ত্রিক
উপাসনার ক্ষেত্রে শক্তিদেবীকে কালীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।বৃহদ্ধর্মপুরাণ
অনুসারে নিজের হাতে মাটি দিয়ে স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রতিমা গড়ে অমাবস্যার
রাতে নিজে পুজো করে বিসর্জন দিতেন।সেই অর্থে তিনি বঙ্গদেশে কালীপুজো র
প্রবর্তক।তবে রাজার আনুকূল্য না পেলে কোনো সামাজিক বিধি প্রচলিত হয় না।তাই
আরো দুই শ বছর পর কৃষ্ণনগরের মহারাজা কালীভক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ
শতকের মধ্যভাগে প্রথম সামাজিক স্তরে কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন একথা বলা
যেতে পারে।
কালী উপাসনা প্রচারে মঙ্গলকাব্য , শাক্তপদাবলী ও শ্যামাসঙ্গীতের গুরুত্ব অপরিসীম একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
পরিশেষে
দেখা যায় যে পার্বত্য জনজাতির প্রিয় অনার্য দেবী ক্রমে বঙ্গদেশে শিবের
সহচরী ও শক্তির দেবী রূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন , শুধু তাই নয় ক্রমশঃ
ভক্তের কাছে বিপদতারিনী মা আদ্যাশক্তি রূপে আরাধিত হয়েছেন। এমনকি আত্মজা
রূপে অন্তরের সিংহাসনে স্থান পেয়েছেন ... কাল স্বরূপিনী কালী কে প্রিয়জন
ভেবে মানস পুজো করেছেন ভক্তরা।কালী যে বঙ্গ দেশে বাঙ্গালীর হৃদয় জয় করে
গৃহবধূ রূপে ও ঘরে ঘরে চিরন্তন আসন পেয়েছেন তার সার্থক প্রতিচ্ছবি দেখি
সাধক কমলাকান্তের পদাবলী তে কালীর রূপ বর্ণনায় --
''কালো রূপ দেখিলে আঁখি জুড়ায়
কপালে সিঁদুর, কটিতে ঘুঙুর, রতন নুপূর পায়
হাসিতে হাসিতে কত দানব দলিছে,রুধির লেগেছে পায়।''
No comments:
Post a Comment