সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শে ডুয়ার্সের দেবী বন্দনা
গৌতম চক্রবর্তী
সর্বধর্মসমন্বয়ের ডুয়ার্সে দুর্গাপুজোর সূচনা
দুর্গাপুজো
শুধুমাত্র ধর্মীয় উপলক্ষ নয়। সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শেই দুর্গাপুজো
হয়ে থাকে এই শরৎকালে। তাই শ্রেষ্ঠ শারদোৎসব হচ্ছে দুর্গাপুজো। যেখানেই
বঙ্গসন্তানেরা রয়েছে সেই অঞ্চলে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে শারদ উৎসবের
সূচনা ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে ডুয়ার্স অঞ্চল একসময়ে
ভুটানের দখলে ছিল। এই অঞ্চল ব্রিটিশদের অধীনে আসার পর পুরো অঞ্চল চা
শিল্পের পীঠস্থান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মূলত চা বাগান প্রতিষ্ঠা করতে
ইংরেজরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সুতরাং ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গিতে
দুর্গাপূজার তাৎপর্য তেমন কিছু গুরুত্ব পায়নি। তাই পুজোর ব্যপ্তি বৃদ্ধি
পেতে পেতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের শারদ উৎসবের অনেক সময় লেগে যায়। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগেই ডুয়ার্সে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল।
রাজাভাতখাওয়াতে সেই সময় বনবিভাগের ডিভিশনাল অফিস থাকার জন্য বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হত। তাছাড়াও জয়ন্তী যাওয়ার রেলপথ
এখানেই শুরু হত। তাই সেই দিক থেকেও এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কাদের
উদ্যোগে দুর্গাপূজার সূচনা ঘটেছিল তা না জানা গেলেও বলা যায় রেলস্টেশনে
দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে দুর্গাপুজো হত সাতালিতে এক জমিদারের
বাড়িতে, গোপালপুর চা-বাগানে, মেটেলি কালীবাড়িতে। বেশিরভাগ চা-বাগান ইংরেজ
পরিচালিত ছিল বলে ইংরেজদের নজরে দুর্গাপুজোর তেমন সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল
না। অথচ চা বাগানগুলোর প্রায় একশো শতাংশ করণিক ছিলেন বঙ্গসন্তান।
চা বাগিচাকেন্দ্রিক দুর্গাপুজো
ইংরেজ
পরিচালিত চা বাগানগুলিতে প্রধান করণিক অর্থাৎ বড়বাবুর এক বিশেষ ভূমিকা
ছিল। সাহেব বা ম্যানেজারেরা যে কোনো বিষয়ে প্রথমে বড়বাবুকে ডেকে বলতেন।
তারপর বড়বাবু সবদিক বিবেচনা করে সমস্যার সমাধান করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
সাহেবরা সেই সমাধানকে গুরুত্ব দিতেন। এর ফলে বাগানে অন্য বাবুদের থেকে
বড়বাবুর আধিপত্য এবং গুরুত্ব সবটাই অধিকমাত্রায় থাকতো। কোন শ্রমিক কিংবা
কর্মচারী যে প্রয়োজনই হোক না কেন, বড়বাবুকে প্রথমে সমাধানের জন্য বলতে
হতো। বড়বাবুও তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেন। বাগানে কর্মরত বাঙালি
কর্মচারীরা বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছিল। বঙ্গের শ্রেষ্ঠ উৎসব
দুর্গাপূজার কথা তাদের মনে হওয়াতে তারা বড়বাবুকেই জানালেন তাদের ইচ্ছার
কথা।। এভাবে নানা টানাপোড়েন পার করে অবশেষে ১৯৩৪-৩৫ সাল নাগাদ
রাজাভাতখাওয়া অঞ্চলের কাছাকাছি ডিমা চা বাগানের হেডক্লার্ক হেমচন্দ্র
ভট্টাচার্য সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বাগানে প্রথম
দুর্গাপূজার কথা বললেন। হেমচন্দ্রবাবু দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে ইংরেজ
ম্যানেজারকে বোঝানোর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলেন। সাহেব অনুমতি দিলেন
বাগানে দুর্গাপুজো করার। সমস্ত বাঙালি কর্মচারী একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো
পূজা সম্পন্ন করতে। সেই আমলে বহু কর্মচারী স্ত্রী, পুত্র, পরিজন
পূর্ববঙ্গের বাড়িতে রেখে দিতেন আর পুজোর সময় ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে
যেতেন। সেবার যেহেতু বাগানে পুজোর ব্যবস্থা হলো তাই অনেক কর্মচারী বাড়িতে
গেলেন না। এমনকি পরিবার-পরিজনকে পুজো উপলক্ষে এই দেশে অর্থাৎ চাকরিস্থলে
নিয়ে এলেন। এইভাবেই চা বাগানে দুর্গাপুজো ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে বসবাসকারী
সকল মানুষের মনে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়।
শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে দুর্গাপুজো
সেই
আমলে প্রান্তিক কেন্দ্র ছিল শিলিগুড়ি। নেহাত কিছু লোক বাস করত বন জঙ্গল
ঘেরা ছোট্ট জনপদে। একমাত্র গুরুত্ব ছিল শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন সরাসরি
কলকাতায় যেত এবং অন্যদিকে ছোট রেলপথ যেত দার্জিলিং-এ। দার্জিলিং যাওয়ার
রেলপথের একটি শাখা পঞ্চনই জংশন থেকে কিশানগঞ্জ পর্যন্ত যেত। রেল লাইনের পাশ
দিয়ে ছিল গাড়ি যাবার রাস্তা। গরুর গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র
অবলম্বন। তাই সেই রাস্তার নাম ছিল হিলকার্ট রোড। এখনো সেই রাস্তা এই নামেই
পরিচিত। এছাড়া শিলিগুড়ির আর কোনো গুরুত্ব ছিল না। শিলিগুড়ি থেকে গরুর
গাড়ি অথবা ট্রেনে জলপাইগুড়িতে আসা যেত। কিন্তু ডুয়ার্সের সঙ্গে কোন
যোগাযোগ ছিল না। ১৯৩৭ সাল নাগা দসেবকে করোনেশন সেতু তৈরি হবার পর
ডুয়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৪০ সালে করোনেশন
সেতু সরকারিভাবে উদ্বোধন হলে ডুয়ার্সের যোগাযোগ ব্যবস্থা মজবুত হলেও
যাতায়াতে অনেক হ্যাপা ছিল। যেহেতু শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা যাবার ট্রেন
ছাড়ত সুতরাং রেলগাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেশ কিছু রেল কর্মচারী
শিলিগুড়িতে বাস করতেন। এ কথা ঠিক, যেখানেই বাঙালি কর্মচারী একত্রিত হতো
সেখানেই দুর্গাপুজোর একটা গুঞ্জন প্রতিধ্বনিত হত। এইভাবেই ইস্টবেঙ্গল রেল
কর্মচারীরা দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে তারা নিউ
সিনেমা রোডের ওপর দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। পাশাপাশিভাবে ডুয়ার্স অঞ্চলে
চায়ের দেশেও দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে একতার ঐকতান অনুরণিত হয়েছিল
বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে। চা বাগান অঞ্চলের দুর্গাপুজোর চালচিত্র খুঁজে
পেতে ফিরে যেতে হয় বিস্মৃত অতীতের গভীরে। একবিংশ শতকের আধুনিক
জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ডুয়ার্সের অধিবাসীরা হয়তো ভাবতেই পারবেন না যে সেই
আমলে ডুয়ার্সে সাংস্কৃতিক চেতনার শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর কাজ ছিল কতটাই কঠিন।
বর্তমানে পাকা সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ়। তাই অতীতের সেই
যোগাযোগহীন অখ্যাত নির্জন, বন্য শ্বাপদসংকুল প্রাঙ্গণে কবে এবং কোথায়
দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া বড়ই কঠিন।
উত্তরবঙ্গে বনদুর্গার পূজো
১৯০৫
সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরে লর্ড কার্জন কোচবিহারের তৎকালীন রাজা
নৃপেন্দ্রনারায়ণকে সঙ্গে করে কয়েকটি জায়গায় শিকার করতে গিয়েছিলেন। তার
মধ্যে একটি হল শালকুমার জঙ্গল এলাকা। সেই সময় ওই এলাকায় বসতি স্থাপন
করেছিলেন খাউচাঁদ কার্জি। ওই অঞ্চলে একদিকে ছিল বন্য জন্তুর হামলা,
অন্যদিকে ভুটান রাজ এবং ব্রিটিশদের আক্রমণ। ওই সময় গৌরীপুরের রাজা প্রভাত
চন্দ্র বড়ুয়া সহ অনেকেই জংলী হাতিকে বশ করার জন্য বহুবার শালকুমারের
জঙ্গলে এসেছিলেন। খাউচাঁদ কার্জি শালকুমার এলাকার জমিদার হবার পরে তাঁর
পরিবারের সঙ্গে কোচবিহার এবং অসমের গৌরীপুরের রাজপরিবারের যোগাযোগ ছিল।
বন্যজন্তু এবং ভুটানি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই খাউচাঁদ কার্জী জঙ্গল
লাগোয়া এলাকায় দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই পুজোর
আজীবনের দায়িত্ব নেন তাঁর এক ছেলে ধনীরাম কার্জি। এরপরে পুজোর দায়িত্ব
নেন পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে ধনীরাম বাবুর ছেলে ললিত কার্জি। তিনি কয়েকবার
পুজো করার পর দায়িত্ব নেন সেই পরিবারের সঙ্গে জড়িত খগেন্দ্র নাথ বর্মন।
দুর্গাপুজোর জন্য আলাদাভাবে তিনি জমিও দান করেন। তিনি মারা যাবার পর
সর্বজনীন হয়ে যাওয়া পুজোর দায়িত্ব নেয় এলাকার পুজো কমিটি। বর্তমানে সেই
পুজো কমিটি রাজ আমলের এই পুজো পরিচালনা করছে প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও
বেশিসময় ধরে। স্থানীয় মানুষ দ্বারা পরিচালিত এই পুজো এখন সর্বজনীন।
দুর্গাপুজোর পরেই পূজিতা হন বনদূর্গা
একই
মন্দিরে পরপর মা দুর্গা এবং বনদুর্গা অর্থাৎ ভান্ডানি পুজো হয় ময়নাগুড়ি
ব্লকের পদমতি ২ অঞ্চলের ডাকুয়াবাড়িতে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন এবং
ঐতিহ্যবাহী ডাকুয়াবাড়ির দুর্গাপুজো এবং ভান্ডানি পুজো। তবে ডাকুয়া
পরিবারে কতদিন আগে এই পুজো শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না।
পরিবারের প্রবীণতম সদস্য দেবব্রত রায় ডাকুয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম
তাদের ঠাকুরদা তারকনাথ রায়ডাকুয়া বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন এবং
একই মন্দিরে বনদুর্গা এবং মা ভান্ডানির পুজো শুরু করেন সন্তান লাভের
কামনায়। তাঁরা সন্তান লাভ করলে সেই থেকেই বাড়িতে মা দুর্গার বিসর্জনের পর
বনদুর্গার পুজো হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে দেবব্রত বাবুর বাবা রথীন্দ্রনাথ
রায়ডাকুয়া এই পুজো করতেন। দেশ বিভক্ত হয়ে ভারতে আসার পর তিনি নিজে পুজো
শুরু করেন। কিন্তু বয়সের ভারে তাঁর পক্ষে পুজো করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি
বলে তাই তাঁর বড় ছেলে নির্মল রায়ডাকুয়া এবং ভাইপো উৎস রায়ডাকুয়া পুজোর
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই ভাবেই বংশপরম্পরায় প্রতিবছর বাড়ির স্থায়ী
মন্দিরে তাঁদের এই পুজো হয়ে আসছে। পরিবারের দাবি, পুজো কবে শুরু হয়েছিল
তার সঠিক হিসেব না থাকলেও তাদের পরিবারের পুজো যে শতাব্দী প্রাচীন তা বলাই
যায়। কারণ এদেশে আসার পরে তাঁরা ৭৩ বছর ধরে পুজো করছেন এবং তাঁদের পূর্ব
পুরুষেরা বাংলাদেশের বাড়িতে অনেক আগে থেকে দুর্গাপুজো করতেন। প্রতিবার মহা
ষষ্ঠীর দিন গতবারের বনদুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে মা দুর্গাকে মন্দিরে
প্রতিষ্ঠা করা হয়। নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর পর দশমীর দিন রাতেই দুর্গা প্রতিমা
বিসর্জন দেওয়া হয়। পরের দিন সেখানেই আবার নতুন বনদুর্গা অর্থাৎ মা
ভান্ডানির প্রতিমা আনা হয়। পুজো করার পর দুর্গাকে সারাবছর মন্দিরেই রাখা
হয়। পরের বার ঠিক একই নিয়মে ষষ্ঠীর দিন দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া
হয়। ডাকুয়া বাড়ির পুজোয় শামিল হয়ে খুব আনন্দ উপভোগ করেন প্রতিবেশীরাও।
পুজোর ক’দিন এখানেই কাটান তাঁরা। বিজয়া দশমীর দিন হেলাপাকড়ি বাজারে
বিজয়া দশমীর মেলা বসে। দুর্গা প্রতিমাকে মেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান
থেকে এনে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় আর সেই রেশ কাটতে না কাটতেই পরদিন
আবার সেখানে বনদুর্গার আরাধনায় মেতে ওঠেন সকলে।
দুর্গারূপে পূজিতা গোসানিমারির দেবী কামতেশ্বরী
গোসানিমারি
হাইস্কুলের উল্টোদিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কামতেশ্বরী মন্দির। মহকুমা শহর
দিনহাটা থেকে আট কিলোমিটার দূরে গোসানিমারি কামতেশ্বর মন্দিরে কয়েকশো
বছরেরও বেশিসময় ধরে শরৎকালে দেবী কামতেশ্বরী দুর্গারূপে পূজিতা হন।
গোসানিমারি কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্টের অধীনে এই পুজোয় ভিড় করেন প্রচুর
দর্শনার্থী। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ
থাকলেও মন্দিরের দেয়ালে লেখা রয়েছে বর্তমান মন্দিরটি কোচবিহারের মহারাজা
প্রাণনারায়ণের আমলে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরের বড়
দেউড়ি কালীনাথ ঝাঁ এর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, সারা বছরইএই মন্দিরে
পুজো হয়। এর পাশাপাশি দেবী কামতেশ্বরী শরৎকালে দুর্গা রূপে, কার্তিক মাসের
দীপাবলিতে দীপান্বিতা কালী রূপে এবং মাঘ মাসে রটন্তী কালী রূপে পুজো নেন।
প্রতিপদ থেকে মূল মন্দিরে দেবীর সিংহাসনের উত্তরদিকে ঘট বসিয়ে পুজো শুরু
হয়। ষষ্ঠীর দিন মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা বেল গাছের তলায় পুজো হয়। সপ্তমী
পুজো হয়ে থাকে যজ্ঞের মাধ্যমে। গর্ভগৃহের সামনে সপ্তমীর দিন থেকে যে যজ্ঞ
শুরু হয় দশমী পর্যন্ত একটানা চলতে থাকে সেই যজ্ঞ। প্রতিপদ থেকে নবমী
পর্যন্ত প্রতিদিন জোড়া পায়রা বলি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অষ্টমীতে মোষ বলি
দেওয়া হয়। তাছাড়াও দশমীতে চালকুমড়ো বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। এ ছাড়াও
প্রতিদিন যে ভোগ দেওয়া হয় সেই মহাভোগে লঙ্কা ব্যবহার করা হয় না।
গোলমরিচ ব্যবহার করা হয়। পুজোর দিনগুলোতে মন্দিরের বাইরে মেলা বসে। পুজোর
সময় মন্দিরে ভিড় জমান দিনহাটা মহকুমার বাইরের এলাকার বহু মানুষ। কোচবিহার
হেরিটেজ সোসাইটির দিনহাটা মহকুমার সম্পাদক শঙ্খনাদ আচার্যের সঙ্গে কথা বলে
জানতে পারলাম প্রাচীন এই পুজোয় ভক্তি এবং নিষ্ঠা নিয়ে দর্শনার্থীরা
পুজোর দিনগুলিতে ভিড় করেন।
সীমান্তের দুর্গাপুজোয় নেই জাতপাতের ভেদাভেদ
জলপাইগুড়ি
জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের রায় পরিবারের দুর্গাপুজোয় সীমান্ত
গ্রামগুলির মানুষ সপরিবারে দুর্গাপুজোর আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন এবং এখানে
থাকে না জাতপাত এবং সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ। আগে গৌরাঙ্গবাজার, মানিকগঞ্জ এবং
গৌরচন্ডীধাম এই তিন জায়গায় দুর্গাপুজো হত। জলপাইগুড়ির দক্ষিণ
বেরুবাড়ির মানিকগঞ্জের নয়াবস্তির অধিকারী পাড়ায় শরদিন্দু রায়দের
বাড়িতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা শালগ্রাম শিলাটি আজও
অক্ষত রয়েছে। বাড়ির সামনে মহামায়া ধাম মন্দিরে দেবী দুর্গার পুজোর
আয়োজন করা হলেও বাহাত্তর বছর আগে প্রায় পন্চাশ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের
শালগ্রাম শিলাটি মহামায়াধাম মন্দিরের ডানদিকে আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। তার
পাশেই রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই
শালগ্রাম শিলা এনে পুজো শুরু করার পাশাপাশি দুর্গাপুজোও শুরু করেছিলেন
বর্তমান রায় পরিবার। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রায় পরিবারের
পূর্বসূরী প্রয়াত ধরণীমোহন রায়ের মাধ্যমে শালগ্রাম শিলাটি জলপাইগুড়ির
দক্ষিণ বেরুবাড়ীর অধিকারী পাড়ার নয়াবস্তিতে নিয়ে আসা হয়। এরপর ১৯৪৯
সালে মানিকগঞ্জের ডাকেরকামাত, মরিঙ্গাটারি, নয়াবস্তি গ্রামের বাসিন্দাদের
নিয়ে ধরণী মোহন রায় শুরু করেন মহামায়াধামের দুর্গাপুজো। আজও এই
পারিবারিক পুজো করে আসছেন রায় পরিবার। পুজোর চারদিন অন্নভোগ হয়। বহু
গ্রামের মানুষ ভোগ নিতে হাজির হন। মহামায়ার মন্দিরের ডানদিকে কষ্টিপাথরের
শালগ্রাম শিলাটিকে একটি চালাঘরে রাখার পাশাপাশি এই মন্দিরের পাশে কালি এবং
মনসা সহ একাধিক দেবীর থান রাখা হয়েছে।
সম্প্রীতির উৎসব শারদোৎসব
শুধু
কি দুর্গাপুজো হিন্দুদের তথা বাঙ্গালীদের উৎসব নাকি? বাঙালি মুসলিমরাও
সম্পৃক্ত হয়ে যায় এই শারদ উৎসবে। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি এবং
সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এই দুইয়ের মেলবন্ধনে ডুয়ার্সের আংরাভাসার
সজনাপাড়াতে দুর্গাপুজোয় দুই সম্প্রদায়ের মানুষের একতা ডুয়ার্সের
দুর্গাপুজোকে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। জাতপাতের সংকীর্ণ মনোভাব
থেকে বেড়িয়ে এসে প্রতিবার এখানকার মুসলিম সমাজ দুর্গাপুজোতে শুধু
অংশগ্রহণ করেন না, চাঁদা তোলা থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত হিন্দুদের
পাশাপাশি তারাও বাঙ্গালীদের শ্রেষ্ঠ উৎসবে মেতে ওঠেন।
No comments:
Post a Comment