Monday, October 5, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দেবীপক্ষ
       মৌসুমী চৌধুরী

         নাক পর্যন্ত মুখোশে ঢাকা মেয়েটাকে তখন থেকে লক্ষ্য করছে সুদীপা। চোখদুটো বড় চেনা! কে ও? চেনা-অচেনার আলো- আঁধারি খেলে যেতে থাকে মনে! কোথায় যে দেখেছে ওই চোখ!...নাহ্, কিছুতেই মনে পড়ছে না! 
                ঘিঞ্জি গলির ভেতর টালির চালের
নিচু নিচু ঘর। মহানগরের আকাশ ছেয়ে শরৎ নেমেছে শ্যাওলা-ধরা টালির চালেও। কে যেন আকাশটাকে সাবান ফেনায় কেচে-ধুয়ে সাফ করে নীল দিয়ে মেলে দিয়েছে মাথার ওপর! ওদের পাড়া জুড়ে শিউলির সাদা পাপড়ি আর কমলারঙা বোঁটায় মলিন আগমনী-ক্যানভাস! নিজ নিজ ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েগুলো। চাতক প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে এগিয়ে আসা সুদীপাদের দলটার দিকে। আজ তারা ত্রাণ নিয়ে এসেছে খিদিরপুর এলাকার যৌনপল্লীতে। সেখানেই হঠাৎ সুদীপার চোখে পড়ে মেয়েটিকে। মুখোশে ঢাকা মুখে জেগে আছে আকুতিময় দুটি চোখ ! 
          সদ্য কলকাতার উপকণ্ঠে একটি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগদান করেছে সুদীপা। আগে সে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকারি করত সুুন্দরবনের শেষতম দ্বীপ জি-প্লটের একটি স্কুলে। সুদীপার বাড়ি কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায়। সেখান থেকে অতদূরে সু্ন্দরবনের জল-জঙ্গল অঞ্চলে কাজ করতে প্রথম প্রথম খুব কষ্টই হত। তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছিল পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। ওদের সহজ সরল জীবন, খিদের জ্বালায় বাঘ-কুমীরের সঙ্গে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করা, গভীর অরণ্যে গিয়ে কাঠ-মধু সংগ্রহ করে আনা, নদীতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরে পেট চালানো প্রভৃতি সব যেন একটা অদৃশ্য শক্তি যুগিয়েছিল সুদীপার মনে। তারপর তো সেখানেই কাটিয়েছিল দীর্ঘ দশ বছর। 
         প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকা পদের জন্য  স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে সুদীপা বাড়ির কাছে চলে এসেছে সবে মাত্র কয়েক মাস হল। তারপরই এই "এসো বন্ধু হই" সংস্থাটির সাথে যুক্ত হয়েছে ছেলেবেলার এক সহপাঠীর মাধ্যমে। এটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। হাওড়ার উলুবেড়িয়া থেকে হুগলীর মানকুন্ডু,কলকাতার গড়িয়া থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বুড়ুল --- প্রভৃতি বিভিন্ন স্কুলের শতাধিক  প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা সামাজিক উন্নয়নের কাজে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একজোট হয়েছেন। নিজেরাই সামর্থ্য অনুযায়ী  গড়েছেন ত্রাণ তহবিল। করোনা-সংক্রমণের আবহে লকডাউনের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় দুঃস্থদের রান্না-করা-খাবার, চাল-ডাল-আালু, স্যানিটাইজার, মুখোশ প্রভৃতি পৌঁছে দিচ্ছে  তাদের সংস্থাটি। এই কাজে অংশ নিতে পেরে পৃথিবীর এই অসুখ আবহে মনটা একটা পরম প্রশান্তিতে ভরে ওঠে সুদীপার। 
         জৈষ্ঠের প্রবল গরমে পাখা বন্ধ, কারণ বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছেন বাড়ির মালিকেরা। কেননা মেয়েদের কারও এক মাসের, কারও দু'মাসের আবার কারও বা আরও বেশিদিনের ভাড়া বাকি! করোনার আবহে তাদের পাড়ায় আর কেউ ঘেঁষছেন না। রোজগারপাতি তাই বন্ধ। অসহ্য গরমে ভিক্টোরিয়ার সামনের ফুটপাথ কিংবা গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে বসলেও পুলিশ মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের। মেয়েরা গ্রামে ফিরতে চাইলেও পারছে না, গ্রাম থেকেও তাড়িয়ে দিচ্ছে। শিউলি, মীনা, রেহানাদের কথা শুনতে শুনতে মনটা বড্ড ভারী হয়ে উঠছে সুদীপার। তাদের সংস্থা তো নিতান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া। তাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু! কিভাবে এদের এত জনের জ্বলন্ত হাঁ-মুখ তারা বন্ধ করবে!  
      ত্রান বিলোতে বিলোতে সেই মেয়েটিকে আবার লক্ষ্য করছিল সুদীপা। কেমন যেন ম্রিয়মাণ! যেন আড়ষ্ট হয়ে আছে! তাকে দেখেই কি এতটা কুণ্ঠিত হয়ে আছে মেয়েটি? কেন? সে কি মেয়েটির পূর্বপরিচিতা? তার পরিচিতা কেউ রেডলাইট এরিয়ায়? আর ভাবতে পারে না সুদীপা! মুখোশে আবৃত মুখটা চিনতেও তো পারছে না!
          সরককারি পদ্ধতি মেনে,  দূরত্ব বজায় রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার জিনিস, ঔষধ ইত্যাদি বিলিবন্দেজ যখন শেষ হল তখন পশ্চিমাকাশে টুকরো টুকরো পেঁজাতুলো  মেঘের ফুলকারিতে গেরুয়ারঙা গোধূলি যেন আকাশময় আগমনী গান ধরেছে। হাঁ করে দেখছিল সুদীপা। প্রকৃৃতি কাউকে ফেরায় না। এই তথাকথিত নষ্টা মেয়েগুলোর মাথার ওপরের আকাশটিতেও প্রকৃৃতির কি অপরূপ রঙের খেলা!  ভাবতে ভাবতে  অন্যমনস্ক সুদীপা তার দলবল থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কেউ একজন তার পা জড়িয়ে ধরে। সম্বিৎ ফিরে পায় সে! চমকে দেখে সেই মেয়েটি! এবার আর মুখে মুখোশ নেই। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনেপড়ে যায় , আরে এ তো সেই জি-প্লটের বিধবা পাড়ার মেয়ে ফুলেশ্বরী! জি-প্লটের  বিধবা পাড়ায় একজনও পুরুষ সদস্য বেঁচে ছিল না। মেয়েদের স্বামীরা কোন না কোনভাবে বাঘ বা কুমীরের পেটে গেছে। এই ফুলেশ্বরীর বরকেও বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, পরদিন জলার ধারে পাওয়া গিয়েছিল তার বাঘে খুবলানো শরীরটা! ফুলেশ্বরীর মেয়ে কুসুম তো তার পুরোনো স্কুলের ভীষণ মেধাবী ছাত্রী!
        ফুলেশ্বরী ততক্ষণে তার পা জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেছে,
--- "আমারে যে এখেনে দেইখে গেলেন, গেরামে গিয়ে বলবেন না দিদিমুণি। কুসুমরে আমি অনেকদূর পড়িয়ে চাকরি করাতে চাই। ভালো ঘরে বিয়ে দিতে চাই। আমার কালো ছায়া যেন মেয়েটার উপর না পড়ে!"
--- তুমি এখানে পৌঁছলে কি করে? তুমি যে কলকতায় কাজে এসেছিলে সেটা তো শুনে- ছিলাম তোমার মেয়ের কাছে।
--- হ্যাঁ গো দিদিমুণি। সিধু দালালটা আমাকে কাজের নাম করে এনে প্রথম আমার ঘরে বাবু ঢোকায়। তারপর বহু হাত ঘুরে এখেনে পৌঁছেছি।
---- বাড়িতে ফিরে গেলে না কেন?
---- কি হবে সেখেনে ফিরে? পেট তো কিছু মানবে নি দিদিমুনি! বরং এখন বাড়িতে প্রত্যেক মাসে টাকা পাঠাই। আমার কুসুম ঠিকমতো পড়ালেখা করছে। কুসুমরে তুমার মতো দিদিমুণি বানাইবার স্বপন দেখি!
        সহসা ঝাপসা হয়ে ওঠে সুদীপার চোখ। অনুভব করে তার চারপাশটা কাশফুলে ভরে গেছে। ঘিঞ্জি যৌনপল্লীতে মা দূর্গা যেন এসে দাঁড়িয়েছেন অসুখ সময়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে! দেবী পক্ষের সূচনায় একটা আলোর বেণু বাজতে থাকে সুদীপার বুকে!

No comments:

Post a Comment