Saturday, April 5, 2025


 

হরিমাধবদার সান্নিধ্যে 

   দীপায়ন ভট্টাচার্য 


কিশোর বয়স থেকেই যখন কোচবিহারের বিশিষ্ট নাট্যজন নীরজ বিশ্বাস, কানন মজুমদার, ষষ্ঠী ভৌমিক এঁদের সংস্পর্শে এসেছিলাম, তখনই উত্তরবঙ্গের নাটকের আলোচনার সূত্রে বালুরঘাট ত্রিতীর্থের প্রাণপুরুষ হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের কথা বারবার উঠে আসত। তখনও নাটমঞ্চে তাঁর দেখা পাইনি — সে সুযোগ এসেছিল আরও পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পর ১৯৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত `নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরে` সুযোগ পেয়ে গেলাম শিক্ষার্থী হিসেবে। এর আগে আমাদের নাট্যসংস্থা ইন্দ্রায়ুধ-এর নিজস্ব পরিসরে কোনো কোনো বিশিষ্ট নাট্যজনের কাছে নাট্যচর্চার খুঁটিনাটি বোঝবার সুযোগও হয়েছিল, কিন্তু নাট্য আকাদেমির প্রশিক্ষণ শিবিরের অভিজ্ঞতা ছিল আরো বিস্তৃত। কোচবিহার, অবিভক্ত জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, তখনকার পশ্চিম দিনাজপুর এসব জেলার নাট্যশিক্ষার্থীদের নিয়ে সেই শিবির আয়োজিত হয়েছিল শিলিগুড়ির নবনির্মিত দীনবন্ধু মঞ্চে । তখনকার বাংলা থিয়েটারের মহীরুহদের অনেকেই প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন সেই শিবিরে। তাঁদেরই মধ্যে ছিলেন সদাপ্রসন্ন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়। 

শুরু থেকেই সব প্রশিক্ষকের সাথে আমাদের গড়ে উঠেছিল দাদা-ভাইয়ের আন্তরিক সম্পর্ক। হরিমাধবদার নাট্যমেধা, নাটকের জটিল বিষয়কে সরল করে পরিবেশন করবার নৈপুণ্যের পরিচয় তখনই পেয়েছিলাম। ওই ভরাট গলায় নাটক পাঠ, তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মর্মবস্তু বিশ্লেষণ তখনই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলেছিল। সেই নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির এবং পশ্চিমবঙ্গের নানা জোনের, সম্ভবত আরও তিনটি প্রশিক্ষণ শিবির থেকে, বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির কেন্দ্রীয় নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল কোলকাতার গিরিশ মঞ্চে। সেখানে নির্বাচিত হয়ে আবার সুযোগ পেলাম বাংলার নাট্যনক্ষত্রদের কাছে নাটকের তত্ত্ব -তথ্য ও প্রয়োগের গভীরতর পাঠ নেবার। আবারও পেলাম হরিমাধবদাকে, গিরিশ মঞ্চেই দেখলাম বালুরঘাট ত্রিতীর্থ প্রযোজনা (সম্ভবত) "মন্ত্রশক্তি" নাটকে হরিমাধবদার মনোজ্ঞ নির্দেশনা ও অভিনয়। গ্রামীণ জীবনের নানা মিথ ও রিচ্যুয়ালের খুঁটিনাটি নিপুণভাবে উঠে এসেছিল সেই প্রযোজনায়। আর ছিল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মোক্ষম আঘাত — যা আজকের সমাজেও একটি প্রয়োজনীয় কৃত্য — উত্তরের থিয়েটারের অগ্রপথিক অভিভাবক হিসেবে হরিমাধবদা যে পথের দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করিয়েছিলেন। 

এরপর চলে আসি ১৯৯১ সালের কথায়। সে বছর ২৭শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর কোচবিহার রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির ও কোচবিহার জেলা নাট্যোৎসব। তখনও প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন হরিমাধবদা। আমি ছিলাম আয়োজকের একজন। সেই উপলক্ষে ৩রা নভেম্বর কোচবিহার জেলা পরিষদ হলে “সাম্প্রতিক বাংলা নাটকের গতিপ্রকৃতি” বিষয়ক আলোচনা সভায় সর্বশ্রী অরুণ মুখোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দন সেন, নৃপেন্দ্র সাহা, ড. দিগ্বিজয় দে সরকার প্রমুখের পাশাপাশি আমিও ছিলাম আলোচক হিসেবে। মনে পড়ে, সেই আলোচনায় তিনি এবং আমি মূলত উত্তরবঙ্গের নাট্যচর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। সেবার এঁদের কারও কারও সাথে হরিমাধবদা আমার বাড়িতেও এসেছিলেন। নিজগুণে অর্জন করেছিলেন আমার বর্ষীয়ান মায়ের স্নেহমিশ্রিত সম্ভ্রম। এরপর হরিমাধবদার সঙ্গে আবার আলোচনার টেবিলে দেখা হল ১৯৯৫ সালে আকাশবাণী শিলিগুড়ি কেন্দ্রে  “বাংলা থিয়েটারের দুই শো বছর” বিষয়ক আলোচনায়। অনুষ্ঠানটি অনেকের ভাল লাগার মূলে হরিমাধবদার বাচনিক নৈপুণ্য।

২০১১ অথবা ২০১২ সালে শিলিগুড়ি সংলগ্ন ফুলবাড়ি দূরদর্শন কেন্দ্রে আনন্দ ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় আমি আর হরিমাধবদা আলোচনায় আবার মগ্ন হলাম বাংলার থিয়েটার নিয়ে। সেই সময় প্রকৃতির সহজতার সঙ্গে থিয়েটারকে মিশিয়ে দেবার এক আগামী ভাবনার সংকেত তাঁর কথায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু তার পূর্ণতার ছবি আর আমাদের দেখার সুযোগ হল না। হয় তো বয়সের প্রসারণ আরও  এগিয়ে যাওয়ার পথ আটকে দাঁড়াল। দীর্ঘদিন যাবৎ উত্তরবঙ্গের নাট্যচর্চার তথ্যানুসন্ধানের সূত্রে ২০১২ সালের ২৮শে অক্টোবর আমি নিজেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বালুরঘাট ত্রিতীর্থ নাট্যদলের প্রাণকেন্দ্র গোবিন্দ অঙ্গনে। হরিমাধবদা স্বয়ং সস্নেহে মধুর হেসে স্বাগত জানালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন সংস্থার সম্পাদক কমল দাসের সঙ্গে। কাজ শুরুর আগেই ভরপেট জলযোগের আয়োজন করতে ভুললেন না। উৎসাহিত করলেন।  তারপর দীর্ঘ তথ্য সংগ্রহের মুখড়া ধরিয়ে দিয়ে তিনি মগ্ন হলেন নাটকের অন্য কাজে। অনুজ নাট্যযাত্রীকে কীভাবে উদ্দীপ্ত করতে হয় সেই প্রকরণ তিনি জানতেন। 

তাঁর চলে যাবার পর আমরা সেকথা বুকে ধরে রাখব। নাটকের সংগঠন, নির্দেশন, কথন, লিখন সব বিষয়েই সহজাত দক্ষতা ছিল তাঁর। তারই সাক্ষ্য বহন করে তাঁর নির্দেশিত ও বালুরঘাট ত্রিতীর্থ প্রযোজিত বিশে জুন, মন্ত্রশক্তি, দেবাংশী, জল, দেবীগর্জন প্রভৃতি নাটক। তাঁর কলমে নির্মিত আগাথা ক্রিস্টির রচনা অবলম্বনে দশপুতুল, মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে জল, এছাড়াও দেবাংশী, মাতৃতান্ত্রিক, পত্রশুদ্ধি, গোধূলি বেলায় প্রভৃতি নাটক সৃজনশীলতায় তাঁর কুশলতার কথা বহুদিন ধরে আমাদের বলবে। শুধু নিজস্ব সংস্থাতেই তো নয়, দুই দিনাজপুরের বা অন্য জেলার আরো কিছু নাট্যসংস্থার সম্পদ ছিল তাঁর রচিত বা নির্দেশিত কিছু নাটক। তিনি আজ আমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে অজানা গন্তব্যে গেলেও, আমাদের অন্তর ধরে নেবে যে তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, পাশে আছেন। 

No comments:

Post a Comment