Sunday, August 3, 2025


 

মুনা 

অনলাইন শ্রাবণ  সংখ্যা ১৪৩২


 সম্পাদকের কথা

একটাই কথা শুধু। স্বাধীনতা আসুক। মুক্তি আসুক। 


ছবি সৌজন্য- দ্যা ইকোনোমিক টাইমস 


মুনা 

অনলাইন শ্রাবণ  সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি- বাবুল মল্লিক 

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

বেলা দে, গৌতমেন্দু নন্দী, কবিতা বণিক, চিত্রা পাল, শুভেন্দু নন্দী,

পূর্বা দাস, দ্যুতিপ্রিয়া সাহা, জয়তী ব্যানার্জী, মৌসুমী চৌধুরী, 

বটু কৃষ্ণ হালদার, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, রুদ্র, অভিজিৎ সেন, 

নিবেদিতা দে, রীনা মজুমদার, রাণা চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় সাহা,

অনিতা নাগ, লীনা রায়, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, 

শিশির আজম, তন্ময় ধর, অপর্ণা সাহা, অমিতাভ চক্রবর্ত্তী, 

মিষ্টু সরকার, প্রতিভা পাল, অর্পিতা মুখার্জী, উৎপলেন্দু পাল,

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিত ব্যাপারী, প্রাণেশ পাল, মোঃ আব্দুল রহমান,

রেজাউল করিম রোমেল, মাথুর দাস, মজনু মিয়া, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী, 

জোয়া আখতার 




শক্তিরূপেণ

পূর্বা দাস


ও মেয়ে তুই দুপুর রোদে মেঘ জমতে দিস না, 

ডানপিটে তোর পাখনাগুলোয় জঙ ধরতে দিস না।


গল্পেরা যদি খরস্রোতা হয় হোক না তবে তোর

নীল কুয়াশায় নীলিয়ে দিস ধূসর হতে দিস না।


ভাঙছে শরীর পুড়ছে হৃদয় চুপিসারে তোর পাহাড় গড়,

দিনের শেষে নিজের কাছে লড়াইটা তুই একাই লড়।


ও মেয়ে তুই মিথ্যে বসে আগলে রাখিস তাসের ঘর,

বিশ্বজোড়া আঁচল যে তোর দুগ্গা মা তুই ত্রিশূল ধর।


তবু যদি বসন্তে তোর অবাধ্য প্রেম আসে,

বেগমবাহার শাড়িতে যেন আকাশের ছায়া ভাসে।


ও মেয়ে তুই প্রেমের আধার চিরহরিৎ অরণ্য, 

হোস না কৃপণ উজাড় করিস অমৃত তোর অনন্য।


সাজিয়ে গুছিয়ে মানিয়ে সব ফের যদি হয় ভোকাট্টা,

ও মেয়ে তুই আলাদীন হ, গোপনে জ্বলুক প্রদীপটা।


ঝমঝমিয়ে প্লাবন এলে ফিনিক্স হয়ে উড়বি,

ও মেয়ে তোর জীবনজোড়া রক্তপাতের দিব্যি।


নরপিশাচের বুক চিরে দে, মুর্ছা যাক এ সভ্যতা,

ও মেয়ে তুই দধীচি হ, শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।



অঙ্কণে - দ্যুতিপ্রিয়া সাহা ( ষষ্ঠ শ্রেণী)






ছবি সৌজন্য- দ্যা ইকোনোমিক টাইমস 


 





শব্দ হীন ন্যায় 

জয়তী ব্যানার্জী 


        নিশুতি শহরের কোলে 
কান্না নামে নিঃশব্দে,আলো নিভে যায় দালানে ----প্রতীক্ষার শূন্যদ্বারে।
 
           নিমেষে ছাই হয়ে গেল স্বপ্ন,
               রক্তিম সেই শহর ;
প্রতি রাতে আর জোছনা নামে না ক্যান্টিনের দরবারে।

              শ্বেত পাথরের দেয়াল লাগা কিশোরী মুখের হাসি, আর জি করের অলিন্দে বেজে ওঠে এক দুঃস্বপ্নের রাত্রি।

            সেই দুঃস্বপ্নের সব শীতল দেয়ালে জমে উঠে রক্তের প্রতিচ্ছবির কবর। 
         খুঁজি মায়ের চোখে আশ্বাস,
              বন্ধুদের মুঠোফোনে নিরাপত্তা যে বিহ্বল_____ নিঃশব্দে জ্বলে আলোর রোশনাই, 
          সতীর্থরা হাঁটে মাথা নত,
  প্রতিবাদের স্তব্ধ কণ্ঠে, নির্যাতনের ছায়া আজও ওড়ে সেই গগনে।
       প্রশ্ন জাগে, কতটা বেদনা ঢেকে রাখে সাদা চাদর ,
কতটা অন্ধকারে এসে ভবিষ্যতের নির্মাণ কবর ,
          পড়ে আছে যেন অজানা প্রতিক্ষা্য জাল বিস্তারে
সত্য হারায় খবরে খবরে,
       বিচারে বিলাপে দাঁড়িয়ে আছে জনতা 
            প্রতিবাদের দীপ্তি ওঠে।

 মেয়েটির স্মৃতিতে জেগে ওঠে____ ন্যায়ের অঙ্গীকারে,
       শব্দ নেই ;শুধু কাঁপে হৃদয় _____নিপীড়িতা নামের পাঁজরে ।

স্তব্ধ অলিন্দ এ হাহাকার 
           কার বিহান গড়ে, 
শুরু ছিল চিকিৎসার,
         শেষ টা রক্তাক্ত করিডোরে,
        সেই কন্যার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা 
        লুটিয়ে গেল মাটির গভীরে।

      দেয়ালে আঁকা ভবিষ্যৎ চিত্র মুখের আলো নিশিলা রাতে 
        প্রাণের প্রচেষ্টায় ঝরল চোখ_____ সেই মৃত্যু পথের সাথে।

          কে বল বাতির নীচে আলো, প্রহরায় আস্তরণে নির্ভরতা, অন্ধকারে গুমড়ে কাঁদে এই শহরের বিবেক ও মমতা।
 তবু আশার আলো জ্বলে ওঠে জেগে থাকা চোখে 
           অন্ধকার যতই হোক_____ প্রতিবাদের শপথ কণ্ঠে বুকে___ চিৎকার মুখর পথে পথে,
         সকলে ই
                  চাই "সুবিচার "
দেখো ,
            প্রতিবাদ কখনো বৃথা যায় না ,হাজারোবার মনুষ্য জাতি দাঁড়ায় পাশাপাশি দীপ্ত শপথ নিয়ে ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে নারী এ নতূন দর্শন যাচে।

            তুমি ছিলে সূর্যসম
                  আজ হলেই দীপ্তস্মৃতি তোমার যে যন্ত্রনা জেগে থাক ভবিষ্যতের চেতনায়।

          ওই নারী 
          শত শিক্ষার আঁধার 
              স্বপ্নে গড়া ছিল ভবিষ্যৎ ধূসর সব শ্বাপদ নির্দিষ্ট ঘরে নিঃশব্দ এক মৃত্যু হল রচিত। 
        
          জড়ানো খবরের ভরে দেশ
             আহত আত্মার চিৎকার ন্যায়বিচারের শিকল ধরা 
           প্রতিবাদ ওঠে হাহাকার ।
      যদিও বা ফুটে ওঠে ঘাতকের ছায়া সেই রক্ষী ,সেই সংযত বাহার----
            এখনও কলঙ্কের ছাপ সারা গায়ে। রক্তাক্ত কাগজ বলে ____আঘাত যন্ত্রণায় বিখত দেহ
         কন্ঠের ভাঙ্গা হার  
               ক্ষতবিক্ষত মাঠ 
দাবি উঠেছে চতুর্দিকে____
            নারীর নিরাপত্তা,
                সুবিচার চাই
             মায়ের শপথ, মৃন্ময়ী নয় রক্তময়ীর হোক এই দায় ।
      বিদ্রোহী কবির অভিযোগ-----
          মা, তুমি এসো না,
                মানবেই পারি নি রক্ষা ভূতলে নারীর আমাদের 
              ঘুমোতে মানা। 

                মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদ জ্বলে, চারিদিক থেকে তদন্ত আসে , দোষী পাক শাস্তি জনমানষে।

            উত্তাল স্পন্দন নগরে নগরে জনতার সমাবেশ ,সম্মানের, নিরাপত্তার স্বপ্ন বুকে----- আবার গড়ি নতুন দেশ।

         ওরে অন্ধকার,
             চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস তুই করিস কতো,তোর অমানুষতা হেরে যায় মানুষের সঙ্গে।
            ইতিহাসে আবারও যত, শোকের সুরে ভোরূআলোয় নতুন স্বপ্ন বোনে,
          " আর নয়"
             প্রতিজ্ঞায় এ হৃদয়
               বিচার চায় সকলে একসঙ্গে।

চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসে কালো কালো মেঘের ভিতর জন্ম নেয় প্রতীক্ষা ,
রবে না ভয়, রবে না সংশয়,
           শঙ্খ বাজে, জেগে ওঠে প্রজ্ঞা।

           সবাই মিলে গড়ি সমাজ----- যেথায় মর্যাদা নিরাপত্তা অটুট,
          তোমার মৃত্যু হোক সেতু,
ন্যায়ের অলংকার যত স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল।


 





এটুকু থাক...

মৌসুমী চৌধুরী 


জোলো হাওয়ায় বিষন্ন শব্দেরা 
পাক খেতে খেতে নেমে আসে একমনে।
সারাদিন বৃষ্টির ঝিপ ঝিপ সিম্ফনিতে
যখের ধন 'এই মন খারাপটুকু'
 গলে গলে চলে যেতে চায়! 
থাক না, থাক না এ টুকুই,
 থাক না এই অপেক্ষা, 
হাতের তালুর উল্টোদিকের পাতায়
 বিন্দু বিন্দু জল মুছে ফেলা,
 এই কান্না ভেজা রক্ত রুমাল থাক না
 থাক না জেগে দ্রোহকাল...
থাক না এই আশার দোলায় দোলা! 

কদম ফুলও কি রাত জেগে রক্তাক্ত শোনে
ডাকাতিয়া বাঁশির তুমুল আলাপ?


 




বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়

তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...


বিপক্ষে 

বেলা দে

মেয়েটা সমাজসেবী হতে চেয়েছিল, হতে চেয়েছিল একজন ভালো ডাক্তার, বরাবরের মেধাবী ছাত্রী পূরণ করতে চেয়েছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে, কিন্তু অধরাই  রয়ে গেল জীবন। দুর্মতি শাসকের নেকনজরে পড়ে  চলে যেতে হল দুনিয়ার বাইরে, এমন এক অসভ্য রাজনীতির এঁদো ডোবায় পড়ে নিজেকেও অপরাধী বলে মনে হয় হায়রে পোড়া কপাল কপট রাজনৈতিক খেলায় পাশার ঘুটি হয়ে ঘুরছে মানবদল। কোনোদিন কি এর সমাধান হবে না। পুত্তলিকা বানিয়ে রেখেছে পুলিশ প্রশাসন থেকে আইন আদালত, ডাক্তার থেকে হাসপাতালের অধ্যক্ষ পর্যন্ত। টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়েছে মানবিক ধর্ম সংস্কার রাজপাট। ওদের শাস্তি কেউ কি দিতে পারবে না কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ হয়ে কেউ আসতে পারে না। প্রাণ হারালো মানবিক ধর্ম পালন করতে গিয়ে অসহায় মেয়েটা, ও যে আপনার আমার ঘরেরই কন্যা। ওদের বর্বরোচিত কার্যকলাপ

টের পেয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর সাক্ষী হল। রাজ্য তথা দেশ, দেশ থেকে বিদেশ নাড়িয়ে দিয়েও সুবিচার পেল না মেয়েটা। প্রমাণ লোপাটের মত অহিতাচার করেও ধামাচাপা দিয়ে দিল। সেমিনার কক্ষে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ পড়ে ছিল জেনেও কিছুই করার ছিল না বাবামায়ের, মৃত সন্তানের মুখখানি দেখতে চেয়েছিল একবার, তড়িঘড়ি প্রমাণ লোপাটের জন্য এত নীচ হতে পারে কোনো রক্তমাংসের মানুষ। এই বিপথগামী দুরাচারী আজও সমাজের বুকে দেশেবিদেশে বুক চেতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উচ্চ আদালত সি বি আই অব্দি মুখে সেলোটেপ আটকে লুকিয়ে পড়েছে সরকার জুজুর
ভয়ে, এর মধ্যে ওদেরও নিশ্চয়ই ভাগ বাটোয়ারা আছে। হাইকোর্ট তুলে দিল তদন্তের ভার CBI এর হাতে তাতে কি হল চরমতম অপরাধী সন্দীপ ঘোষ ছাড়া পেয়ে গেল। একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পরেও কেন CBI পিছু হটে গেল? 

কি হয়েছিল সেদিন ৯ই আগস্ট সকাল ৭টায় সেমিনার কক্ষে এক অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব উত্তাল হয়ে পরলো?  ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর রাত ১২টায় খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ডাক্তার মেয়েটা, সারাদিন কাজের পর একটু ঘুমোবে বলে সেমিনার রুমে গিয়েছিল, সকাল বেলা সে হয়ে গেল মৃত লাশ, সমস্ত কক্ষে সিসি টিভি থাকা সত্বেও সেমিনার রুমে কেন ছিল না? মৃতদেহের পাশে যে হেডফোন পাওয়া গেছে সেটা সঞ্জয় রাই এর পরে তাকে সেই রুমে দেখা যায় সেটা খোঁজ করতে। সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় ৪৫ মিনিট মদ্যপ অবস্থায় সেমিনার রুমে ছিল সে প্রমাণও মেলে, কেন ছিল?

 এ মৃত্যু আত্মহত্যা বলে বাবা-মা কে জানিয়ে দেওয়া হয়, বিশ্বাস করেনি তারা, মেয়েকে ওরা জানে বলে বিশ্বাসের সাথে কথা বলে  "আমাদের মেয়ে আত্মহত্যা করার মেয়ে নয় ওর মনোবল প্রবল" পুলিশের এই উদাসীনতা কেন? বুঝতে বাকি নেই জনগণের। MLA থেকে কাউন্সিলার পর্যন্ত পৌঁছে যায় শ্মশানে যাদের মেয়ে  তারা কেন হল বলির পাঁঠা, মেয়েকে কাটাছেঁড়া করার আভে দেখতেও দিল না। রাত পোহাতেই শুরু হল সেমিনার কক্ষের ভাঙ্গাচোরা কি ছিল সেখানে লুকানো?  গজনানন্দের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় শতেক আঘাতের চিহ্ন ছিল মেয়েটার শরীরে অথচ  পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি। রাত দখল করেছে মেয়েরা সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ লাঠি চার্জের মত ঘৃণ্য কাজ করে। we for Justice/ Justice for RGkar স্লোগানে স্লোগানে দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিছিলের পর মিছিল দিন নেই রাত নেই ঘর সংসার সব ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে জনতা _শৈশব থেকে কৈশোর আবালবৃদ্ধবনিতা কৃষক মজুর থেকে আধিকারিক অশক্ত পঙ্গুত্ব পর্যন্ত, এখনো আমজনতা কি ভাবছে আমরা এই রাজত্বেই থাকবো একবার আসুন না সুচিন্তক মানুষ কি বলে।


 



বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়

তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...

পক্ষে 


বটু কৃষ্ণ হালদার

আগস্ট মাস আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাস হোল বিজয়ের মাস।হাজার সন্তানের আত্ম বলিদান এর মধ্য দিয়ে ভারত বর্ষ দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। তাই প্রতিবছর সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এই দিনটা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত পালন করা হয়। আগস্ট মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা দিবস পালনের আগাম প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক তার কয়েকদিন আগেই কলকাতার বুকে আরজিকর হাসপাতালে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ধর্ষণ কাণ্ডের রোমহর্ষ ঘটনা। সেই অমানবিক নিষ্ঠুর পাশবিকতার ভায়াল ভয়ংকর চিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ভারত বর্ষ নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষ এই অমানবিক নৃশংসতা দেখে আঁতকে উঠেছিল।

হাসপাতাল হল দিন আনা খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের কাছে মন্দির। আর ডাক্তার হলো সেই মন্দিরের পূজারী। ২০২৪ সালের ৯ই আগস্ট হাসপাতাল নামক মন্দিরের মধ্যেই ডাক্তার নামক পূজারী মৌমিতা দেবনাথের অর্ধ অর্ধনগ্ন মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেয়েটি একা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। আরজিকর হাসপাতালে অশিক্ষিত, মূর্খদের ডাক্তারি ডিগ্রির সার্টিফিকেট বিতরণ চলছিল। জাল ঔষধ থেকে শুরু করে কিডনি পাচার সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল মেয়েটা। শেষে জীবনটাই চলে গেল।

সেই ঘটনার পরে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। সেই সঙ্গে প্রতিবাদের নামে রাত দখল,দিন দখল,রাস্তা দখল,ফুটপাত দখল আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হলো বিশ্বের মানুষ। আবার এক শ্রেণীর আন্দোলনকারীরা রাস্তা আটক করে নাটক নাচের আন্দোলন শুরু করেছিল। কিন্তু প্রায় এক বছর হয়ে গেল। মেয়েটা বিচার পেল না। কি জানো বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আর ধর্ষিতারা কোনদিনই বিচার পাবে না কারণ এই বাংলায় প্রতিমুহূর্তে ধর্ষকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জনগণের টাকায় উকিল নিযুক্ত করা হয়। ধর্ষক গুন্ডা মস্তানরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান পথপ্রদর্শক। আর ধর্ষিতাদের কপালে নানান অজুহাত সেঁটে দেওয়া হয়।তাদের জীবনের দাম টাকা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। টাকা দিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে ধর্ষক কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের আত্মীয় পরিবারবর্গ জড়িত থাকে। তাই তাদের কোন বিচার হয় না। এখানে আইন ব্যবস্থা থাকলেও নেতা-মন্ত্রীদের জন্য সবকিছুতেই ছাড় কারণ তারা যে জনসেবক। জনসেবক এর নামে যদি একটু আধটু ধর্ষণের মতো ছোটখাটো ভুল ত্রুটি করে ফেলে তার জন্য আইন ও কোন ব্যবস্থা নেয় না। শুধুমাত্র আরজিকরের ঘটনা নয় এর আগে বহু ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনা এই বাংলায় ঘটেছে।

২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে সরকার বলেছিল মেয়েটির চরিত্রে দোষ ছিল। দর কষাকষি নিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গে বচসা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বারাসাতের কামদুনিতে ঘটেছিল এক চরম ভয়াবহ ধর্ষণকাণ্ড।  এই ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে শুধু বাংলার মানুষ নয় গর্জে উঠেছিল দেশের মানুষ।প্রতিবাদীদের মাওবাদী তকমা জুটে ছিল সরকারের থেকে। হুমকি দেয়া হতো, জেল খাটানোর ভয় দেখানো হত। কামদুনিতে ধর্ষিত বোনটি সম্পর্কে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে উক্তি ছিল:_" শরীর থাকলে যেমন জ্বর জ্বালা হয়/ তেমনি একটু আধটু রেপও হয়"। ২০১৪ সালে সিউড়ি ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকারের বয়ান ছিল:_"বাচ্চা ছেলেরা একটু আধটু দুষ্টুমি করবে না?" ২০১৫ সালে কাকদ্বীপ ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল,রেপ হলে ৪০ হাজার আর হাফ রেপ  হলে ১৫ হাজার টাকা পাবেন। একথায় স্পষ্ট  প্রমাণ হয় আমার দলের ছেলেরা রেপ করবে তার জন্য আমি জনগণের করপরিসেবা টাকা দিয়ে তা ভরপাই করব।কার্যত বলে রাখা ভালো এখান থেকেই মানুষরূপী হায়নারা ধর্ষণ করার জন্য আরো বেশি বেশি উৎসাহিত হয়েছিল। এরপরেও বাংলার মানুষদের হুঁশ ফেরেনি।আজও বহু মহিলারা ছাত্রীরা ধর্ষকদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দলটির পতাকা কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,মিটিং মিছিলে যায়। এখানেই শেষ নয়, ক্লাইমেক্স আরো বাকি।

এরপরে ২০১৫ সালে পশ্চিমবাংলার রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের মেলা শুরু হতে থাকে। কাটোয়া ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল ছোট্ট একটা সাজানো ঘটনা। একইভাবে রানাঘাট ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল, সরকারকে বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে। ২০২২ সালে হাঁসখালি তে ধর্ষণকাণ্ডে সরকার সরাসরি বলেছিল লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল,মেয়েটি প্রেগন্যান্ট ছিল। সারা পশ্চিমবাংলায় জুড়ে ধর্ষণের জেরবার হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণ। ২০২৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের মাসেই আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যায় আরো এক জঘন্য নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড। যেখানে সমগ্র বাংলার মানুষ নয়,সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সেখানে আর পাঁচটা ধর্ষণ ও খুন হত্যাকাণ্ডের মতো এই ঘটনাটাকেও জল দিয়ে ভাত গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে দিয়েছে।

এই বাংলা ছিল শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি, মূল পিঠস্থান। এই বাংলার মাটি গঙ্গার জলের মতো খাঁটি ও পবিত্র কারণ এই মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছেন, বিবেকানন্দ,ভগবান রামকৃষ্ণ,রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,কবি কৃত্তিবাস,সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মত মহান জ্ঞানীগুণীরা, এই মাটিতেই জন্মেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ,ক্ষুদিরাম বসু,মাতঙ্গিনী হাজরা,বাঘা ,চিত্তরঞ্জন দাস, মাস্টারদা   সূর্য সেন,নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহান বিপ্লবীরা।মহান মনীষী ও বিপ্লবীদের নাম গুনে হয়তো শেষ করা যাবে না যারা এই বাংলার মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এমন উজ্জ্বলতম নজির আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। আমরা ইতিহাসে ইতালিতে সর্বপ্রথম নবজাগরণের কথা শুনেছিলাম। অথচ সারা ভারতবর্ষে জুড়ে সেই নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মাটিতে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন,বন্ধা ভারতবর্ষকে মুক্তির আলো দেখিয়ে ভারতবর্ষের মাটি কে উর্বর করে তুলেছিল পশ্চিমবাংলার মহা মনিষীদের চিন্তাধারা।তাইতো বলা হত পশ্চিমবাংলা যা ভাবে তার দুইদিন পর সমগ্র ভারতবর্ষ ভাবে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল সেই বাংলার মাটি থেকে। সমগ্র ভারতবর্ষের যত না বিপ্লবী শহীদ হয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি এই বাংলার বিপ্লবীরা দেশের জন্য স্বাধীনতা আনতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাইতো সমগ্র বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষ বলতে পশ্চিম বাংলার নাম প্রথমে আসে। ভারতবর্ষ বলতে চিনতো স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রাজা রামমোহন রায় সেইসঙ্গে ব্রিটিশ শক্তির কাছে হুংকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। সেই পশ্চিমবাংলা কে এখন সবাই চেনে কয়লা,গরু,ইট,বালি,ত্রিপল চোর। নারী শিশু পাচার কেন্দ্র। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত জেল খাটা নেতা-মন্ত্রীদের আখড়া। আবার এই সময় আঙ্গুল তুলে বলছে নারী নিরাপত্তাহীন ধর্ষণের রাজ্য। এই প্রবাদটি নতুন করে বাংলার মুকুটের সংযোজন হল।পশ্চিমবাংলার জনগণ হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে লজ্জায়,ঘেন্নাই মাথা নিচু হয়ে আসছে।অথচ যারা এই সমস্ত কে প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের এতটুকু লজ্জা বোধ নেই।


 




বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়

তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...


বিপক্ষে 

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য 

৯ই আগস্ট, ২০২৪। সব ব্যক্তিগত লাভক্ষতির তুচ্ছাতিতুচ্ছ হিসেবকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সতেজে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল শহর কলকাতা। আত্মকেন্দ্রিক, উদাসীন, অমানবিক, স্বার্থপর, হৃদয়হীন। দীর্ঘসময়ব্যাপী প্রচলিত এই সমস্ত দুর্নামকে ভেঙে গুঁড়িয়ে আকাশ ফাটিয়ে সমগ্র কলকাতা সেদিন গর্জে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। সরকারি একটি নামী মেডিক্যাল কলেজের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি তরুণী ডাক্তারের হাসপাতাল চত্বরের মধ্যেই ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় সেদিন কোনও রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, বরং সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে মুখর হয়েছিল গোটা কলকাতার আকাশ বাতাস। এরপর সময় গড়াল। প্রতিবাদের ঢেউ আরও আরও শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ল কলকাতা ছাড়িয়ে গোটা বাংলায়, দেশের কোণে কোণে, বিদেশের মাটিতেও। ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে সারা দেশ একসাথে রাত জাগল নতুন অঙ্গীকার বুকে নিয়ে। দেশের স্বাধীনতার সাতষট্টি বছর পর প্রথমবারের জন্য আবারও এক অনন্য স্বাধীনতার আওয়াজ উঠল লক্ষ নারীর গলা চিরে। ‘রাতদখল’ ডাকে সাড়া দিয়ে শহরের রাজপথগুলো ভরে গেল আজকের নারীদের কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার, সুরক্ষা ও স্বাধীনতার দাবিতে। 

উল্টোদিকে ঘটনার মাত্র একদিন পরেই ঘটনাস্থলে কর্মরত কলকাতা পুলিশের সিভিক কর্মী সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় কলকাতা হাইকোর্টে। ৯ই আগস্টের ঘটনার তিন দিন পর কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের তদন্তের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে সিবিআইয়ের হাতে ঘটনার তদন্তভার দেয়। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট, পলিগ্রাফ পদ্ধতি, অন্তর্বর্তী তদন্ত, ফাস্ট ট্র্যাক বিচারব্যবস্থা সমস্ত পেরিয়ে অবশেষে এ বছরের গোড়ায় এসে ১৮ই জানুয়ারি ধৃত সঞ্জয় রায়কে ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে শিয়ালদহ দায়রা আদালত এবং ২০শে জানুয়ারি তার আমৃত্যু কারাবাসের সাজা হয়। কর্মস্থলে মৃত্যুর জন্য তরুণী ডাক্তারের পরিবারকে রাজ্য সরকারের তরফে ১৭ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেওয়া হয়। বিরলের মধ্যে বিরলতম নয় বলেই এ ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সম্ভব নয়, জানান দায়রা কোর্টের বিচারপতি অনির্বাণ দাস। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। তবে এ রায়ের পরেও বিচারপ্রক্রিয়া চলছে এখনও, চলছে তদন্তও। মার্চ মাসের আঠাশে হাইকোর্টে পেশ করা রিপোর্টে সিবিআই জানায় যে বিষয়টি সম্ভবত সাধারণ ধর্ষণ ও মৃত্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সুদূরপ্রসারী এবং বহুধাব্যাপ্ত আর্থিক নয়ছয়, অনিয়ম ও ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ঢাকতেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। গত বছরের ১৪ই আগস্টের রাতদখল কর্মসূচী চলাকালীনই মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ ও ঘটনাস্থলে দুষ্কৃতীদের মদতে ভাঙচুরও সন্দেহাতীত নয়। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর সহযোগীদের পরবর্তীতে পুলিশি হেফাজতও নিঃসন্দেহে বিষয়টিতে গভীরতর ষড়যন্ত্রের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

আসলে গোটা বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষই এ ঘটনায় বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতায় ধৈর্য্য হারাবেন। অভয়া ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেধাবী এক মেয়ে যার গল্প এ বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর ঘরে ঘরে। ফলে তার এই পরিণতি ছুঁয়েছে সেই প্রত্যেকটি মানুষকেই যারা আজও স্বপ্ন দেখে আদর্শ আর মূল্যবোধের জোরে সব অশুভ শক্তিকে একদিন হারিয়ে দেবেই। এ অকালমৃত্যুতে প্রতিবাদের ঢল তাই নাড়িয়ে দেয় বৃহত্তর সমাজকে, গড়ে নতুন ইতিহাস। কিন্তু বাস্তব হল ক্ষমতাবান অশুভ শক্তি যখন তার কায়েমী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে সর্বশক্তি নিয়ে জীবনমরণ খেলায় নামে, শুধু আবেগ দিয়ে সে যুদ্ধে জেতা যায় না। সেকারণেই সকলের চোখের আড়ালে খুব সুচতুরভাবে গায়েব হয়ে যায় যাবতীয় জরুরি তথ্যপ্রমাণ, তদন্তে ইচ্ছাকৃত অসহযোগিতা ও ঢিলেমিতে নষ্ট হয় অমূল্য সময়, প্রকৃত অপরাধী অনায়াসে বেঁচেবর্তে থাকে আইনের ফাঁক গলে। আসলে এ সমস্যা বিচারব্যবস্থার নয়। বিচার হয় আদালতে পেশ করা প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে, দক্ষ আইনজীবীর যুক্তিযুক্ত মারপ্যাঁচের মুন্সিয়ানায়। সেখানে ফাঁক থাকলে বিচারব্যবস্থারও হাত বাঁধা। তবু এ ঘটনার রেশ এখনও যে থেমে যায়নি, আদালতের ভেতরে ও বাইরে হাজারো বিরুদ্ধতার চোখে চোখ রেখে সদর্পে লড়ে চলেছে আজও, সেটাই আশা জাগায় শেষমেষ। দেরিতে হলেও সুবিচার হোক একদিন, ন্যক্কারজনক এ ঘটনাটির বর্ষপূর্তির দোরগোড়ায় এসে এইটুকুই শুধু প্রার্থনা। 


 




বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়

তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...

রুদ্র 

পক্ষে 

গত বছর আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় ঘটনাটি আজও আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। একটি কিশোরী, যাকে সমাজ রক্ষা করতে পারেনি, আইনের হাতে যার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা যায়নি—তার রক্ত যেন এখনও রক্তাক্ত করে রেখেছে আমাদের নৈতিক অবস্থানকে।

ঘটনার পরপরই দেশের নানা প্রান্তে প্রতিবাদ শুরু হয়—সড়ক অবরোধ, মোমবাতি মিছিল, সামাজিক মাধ্যমে ঝড়। তরুণ সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী—সবার কণ্ঠে একটি দাবি: বিচার চাই। কিছুদিনের জন্য প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তদন্তের আশ্বাস আসে। মিডিয়া একে "ব্রেকিং নিউজ" করে তোলে। কিছুদিন পর—অন্য আরেকটি ঘটনা, নতুন এক বিতর্ক, এবং পুরনো ঘটনাটি চাপা পড়ে যায় কাগজের নিচে।

এই চক্রটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। যে সমাজে একের পর এক বর্বরতা ঘটে, সেই সমাজ প্রতিবাদে সাময়িক উত্তেজিত হয়, কিন্তু অপরাধের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে সাহস পায় না। এ যেন একটা অভ্যস্ত চেতনার মিছিল—আন্দোলন হবে, পোস্টার উঠবে, স্লোগান উঠবে, তারপর আবার নীরবতা।

প্রতিটি ভয়ংকর ঘটনার পর একটা অদৃশ্য দেওয়াল দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়—“তদন্ত চলছে,” “আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা,” “সঠিক প্রমাণ নেই”—এইসব কথার আড়ালে বিচারপ্রক্রিয়া লুকিয়ে পড়ে বছরের পর বছর। আমরা দেখতে পাই, যাদের হাতে দায়িত্ব, তাদের মুখে ভাষা থাকে, কিন্তু হৃদয়ে দায় থাকে না।

এখানেই আসে প্রশ্ন—আমরা কি কেবল প্রতিবাদ করেই দায়িত্ব শেষ করি? নাকি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোতে এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যেখানে অপরাধীর চেয়ে অপরাধহীনদের নিরাপত্তা বড় হয়ে ওঠে?

বিচারপ্রক্রিয়ায় বিলম্ব মানে অপরাধীকে সময় দেওয়া, আবারও সাহস জোগানো। এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে প্রতিদিন মৃত্যু ও লজ্জার মধ্যে বেঁচে থাকার শাস্তি দেওয়া। একেকটি বিচারহীনতা একেকটি নতুন অপরাধের জন্ম দেয়।

তাই আমি বলি, বিতর্ক জরুরি, প্রতিবাদ অপরিহার্য, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার নির্ভরযোগ্য বিচারব্যবস্থা। আমরা চাই—শুধু আন্দোলনের উত্তাপ নয়, চাই সুবিচারের আলো।

একটি সমাজ তখনই সভ্য হয়, যখন সেখানে বিচার হয় সময়মতো, প্রকাশ্যে, এবং সঠিকভাবে। যদি তা না হয়, তবে আমরা কেবল নতুন নতুন “আগস্টের ঘটনা” লিখে যাব ইতিহাসের অন্ধকার পাতায়। 




 



পুরস্কার

অভিজিৎ সেন 

                             

একমাত্র মেয়ে প্রতিভা চৌধুরী। অত্যন্ত মেধাবী ও সরল মনের। স্কুল জীবন থেকেই ধৈর্যশীলা, দয়ালু,সেবা পরায়ণতার মনোভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সহপাঠীর জ্বর, পেটব্যথা, মাথাব্যথা,হাত পা কেটে গেলে,  স্কুলে কারো কোন শারীরিক সমস্যা হলে সে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে এসে সেবা শুশ্রূষা শুরু করে দিত । হঠাৎ কেউ শ্রেণিকক্ষে বমি করে দিলে সে‌ নির্দ্বিধায় জল এনে পরিষ্কার করে, রুগীর সেবায় লেগে যেত। আবার পরীক্ষাতেও সবসময় প্রথম স্থানই পেয়ে এসেছে। বিদ্যালয়ের সকলেই তাকে পছন্দ করতো। শিক্ষক,শিক্ষিকারা তাকে খুব স্নেহ করতেন । ভালোবেসে তাঁরা 'ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল' বলে ডাকতেন । সে স্থির করে নিয়েছিল ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে। একদিন সে ডাক্তার হলো। তবে তার লড়াই সহজ ছিল না। 
                
                   মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে প্রতিভা। বাবা প্রভাত চৌধুরী একটি বহুতল আবাসনে নাইট গার্ডের কাজ করে। মা তনুজা চৌধুরীকে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়, তার বাবা ততটা সময় দিতে পারেনা বলেই। বাড়িতে সেলাই মেশিন আছে, পাড়ার মেয়ে বউদের কাপড় সেলাই করে সংসারের কিছুটা অভাব দূর করার চেষ্টা করে। মেয়ের কাছের মানুষ তার মা । মায়ের কাছেই যতো আবদার। তবে সে পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য বুঝতো । কখনোই অপ্রয়োজনীয়,অবান্তর আবদার করতো‌ না ।
                 
          প্রতিভা অসম্ভব মেধাবী হওয়ার কারণে শিক্ষাজীবনে দয়ালু শিক্ষকদের থেকে সাহায্য পেয়েছে।
ডাক্তারী পড়ার বিপুল খরচ দয়ালু মানুষের সাহায্য নিয়ে করতে হয়েছে। তার পরেও পরিবার বাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হয় লেখাপড়ার জন্য।শেষে সে ডাক্তার হলো। লড়াই সফল হলো। সেদিন শুধু তার পরিবার নয় তার শুভানুধ্যায়ীরাও খুব খুশি হয়েছিল।
        ‌‌                 
        ডাক্তার হবার পর থেকে দিনরাত এক করে দিত মানুষের সেবায়। একাজে যেন তার ক্লান্তি নেই । ক্লান্ত শরীরেরও প্রবল উৎসাহ নিয়ে আবার রোগীর সেবায়  নিজেকে সঁপে দিত, কাজটিকে মনে প্রাণে ভালোবাসতো বলেই । পাড়ার মানুষ অসুখ হলেই তার কাছে ছুটে আসতো, সবাই জানতো সে ফিরিয়ে দেব না, যতো রাতই হোক না কেন ! এ মেয়ের সেবা শুশ্রূষা করতে কোনো ক্লান্তি বোধ নেই। বেশিরভাগ সময় বিনা পয়সাতেই চিকিৎসা করতো। চিকিৎসাকে সে পেশা হিসেবে নয় সেবা হিসেবে 
মন থেকে গ্রহণ করেছিল। এই মানসিকতা তার স্কুল জীবন থেকেই লক্ষ্যনীয়। দিন নেই, রাত নেই কেউ এসে তার কাছে চিকিৎসার সাহায্য চাইলে সে ছুটে যেত। তার মনে কোন ভয় ছিল না। সে ভাবতো সে তো চিকিৎসক মানুষের সেবা করে, তার আবার কী ক্ষতি হবে? কেই বা ক্ষতি করবে?সমাজ চিকিৎসকে চিরকাল ভগবানের মতন দেখে। তার মনে হতো তার বিপদে তার পাশে মানুষেরা এসে দাঁড়াবে । তার তো এ সমাজে কোন শত্রু নেই। সব সময় সে হাসিমুখে সকলের সাথে কথা বলে। কেউ কটূ কথা বললেও‌ হাসি মুখে বিবাদ এড়িয়ে যায়। বাড়িতে, পাড়ায়, বাড়ির বাইরে, কলেজে, চিকিৎস‌ক হিসাবে তার কর্মস্থলে কেউ বলতে পারবে না সে কখনো কারো সঙ্গে অসভ্যতা করেছে, ঝগড়া-বিবাদ করেছে। নরম তুলোর মতো, মনের মেয়ে ডাঃ প্রতিভা চৌধুরী। 
               
            ছিপছিপে গড়নের, দীর্ঘাঙ্গী,গৌরবর্ণা প্রতিভা। বয়স চব্বিশের মেয়েটি কোনোদিন নিজের মুখের দিকে, চেহারার দিকে ঠিক করে তাকিয়ে দেখেনি, দেখার ইচ্ছা হলেও জীবনের লক্ষ্য পূরণের দিকেই ছিল তার একমাত্র  ধ্যান ও সাধনা। সৌন্দর্য, বিলাসিতা, রূপচর্চার জন্য তার কাছে বিন্দু মাত্র সময় ছিল না । আজ জীবনের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নিজেকে নিয়ে ভাববার মতো অবসর সময় আজ তার আছে। নির্জনে একা একা আজকাল যখন সে বসে তখন নিজের সঙ্গে কথা বলে,নিজেকে আয়নায় বারে বারে দেখে । নিজের রূপ দেখে নিজে লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে ওঠে। আজকাল সে সেজেগুজে কাজের জায়গায় যেমন যায় বাইরে বের হলেও আয়নার সামনে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে শুরু করে দিয়েছে। 
                     
                বাবাকে আর নাইট গার্ডের কাজে যেতে দেয়না,মাকে সেলাইয়ের কাজে বসতে দেয়না। লেখাপড়ার জন্য বাড়ি বন্ধকের টাকা শোধ দিয়েছে।পুরোনো বাড়িটাই সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। খুব সামান্য ভিজিট নিয়ে সে রোগীর চিকিৎসা করে । যে দিতে পারে না তাকে হাসিমুখে চিকিৎসা করে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার পরিচিত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো দূরে দূরে।এমন দয়ালু ডাক্তারের অভাব চিরকালেই ছিল আমাদের সমাজে। তার উপরে সে হলো একজন মহিলা। বিশেষ করে মহিলারা তার কাছে বেশি আসতেন,তাদের বহু সমস্যা তার কাছে সহজেই বলতে পারার জন্য। তাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরেই একটি বস্তি আছে। সেখানে সে প্রতি রবিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ভলেন্টারি সার্বিস নিজে থেকেই দিতে শুরু করেছে ডাক্তারি পাশ করার পর থেকে । এই কাজটা করে সে মনে মনে শান্তি পেতো । তার মনে হয় সমাজের প্রতি তার যে দায়িত্ব আছে, মানুষের কাছে যতো ঋণ আছে এভাবে কিছুটা হলেও শোধ হবে । ডাক্তারি পড়া চলাকালে বহু সহৃদয় ব্যক্তিরা তাকে আর্থিকভাবে এবং বইপত্র‌ দিয়েও সাহায্য করেছিল। তাই তার মনে হয় বস্তির অসহায়, দরিদ্র্য, অশিক্ষিত, দুর্বল, খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে সাহায্য করলে তার কিছুটা দায়িত্ব পালন করা হবে । বস্তির একটি প্রাইমারি স্কুলের খোলা বারান্দায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে বস্তির লোকেদের চিকিৎসা করতে থাকে। সে যেমন দয়ালু মনের মানুষ,তেমনি সুচিকিৎসক । 
                 
           বাড়ির লোক এবং পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা তাকে এবার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বলে। তারা বলে,"তোর বাবা-মায়ের বয়স হচ্ছে, তোর বিয়ে হলে তারাও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। তোর এবার বিয়ে করা উচিত। তোর জন্য ভালো ছেলের অভাব হবে না । " সে কথা শুনে প্রতিভা শুধু হেসে মনে মনে একটু লজ্জাবোধ করে এবং মাথা নীচু করে কিছু কথা না বলে চলে যায় । বিয়ের কথাটা তার এখন আর খারাপ লাগে না। তারও মনে হয় যদি একজন মনের মতন সাথী হতো । সে তার বাবা-মাকে বলে দিয়েছে তাদের পছন্দেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু কোন ডাক্তারকে বিয়ে করবেনা। সে এমন ছেলেকে বিয়ে করতে চায় যে তার অবস্থাটা ভালো করে বুঝতে পারবে। যেহেতু সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে তাই বাবা-মাকে একা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেনা। বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব সে তার বাড়ি থেকেই পালন করবে অন্য কোথাও গিয়ে নয়। আমাদের সমাজে এটা এখনো স্বাভাবিক নয় তবে অসম্ভব নয়। কেউ ঘরজামাই হয়ে থাকতে চায় না। আবার অনেকেই লোভে পড়ে,কর্মহীন বলে এমন বিবাহে রাজি হয়ে থাকে এমন দৃষ্টান্তও আছে,এসব মানুষ বেশিরভাগ সময় গলার কাঁটা মতন আচরণ করলেই, জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সুখের বদলে অ-সুখই ঘিরে ধরে যা দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ে দুরারোগ্য ব্যাধির মত সমস্ত শরীরে ও মনে । তাই প্রতিভা খুব ভেবেচিন্তে জীবনে বিবাহের সিদ্ধান্ত নিতে চায়। 
         
            গত রাতে একটু দেরি হয়ে গেছে ঘুমোতে। বাড়িতে কলেজের জীবনের কিছু বন্ধু-বান্ধবী এসেছিল । সন্ধ্যা থেকে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে যায় । ফলে পরের দিন ভোরে ওঠা হলো না। একটু দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে দুজন কাজের লোক রেখেছে। একজন রান্নার ও অন্যজন বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য। মা-বাবাকে প্রতিভা শেষ জীবনে সুখী করতে চায়। ওরা আজীবন বহু কষ্ট করেছে । কাজের মানুষ দুজনেরই নিজের বলতে‌ আর কেউ নেই। এবাড়ি এখন ওদেরও বাড়ি। অল্প দিনের মধ্যে পরিবারের লোকেরা এদের যেমন আপন করে নিয়েছে, তেমনি এরাও তাই করেছে।মনেই হবে না এরা কাজের লোক। প্রতিভা যেদিন সময় পায় সেদিন এদের সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে । ওরা বাধা দিলেও মানে না। সে বলে,"আমি অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। ছোট বেলায় লেখাপড়ার পাশাপাশি রান্না থেকে শুরু করে সকল কাজেতে মাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছি । আমার কোথাও তাই অসুবিধা পড়িনি। ডাক্তার হয়েছি বলে সংসারের কাজ করা ছেড়ে দেব? তোমরা চিন্তা করোনা আমার কোন অসুবিধা হবে না।"এই বলে সে নিজেই রান্না করতে শুরু করলো। আজ সে বাবার পছন্দের মাছ রান্না করবে । ইলিশ-ভাপা । বাড়িতে ছয় সাত মাসে হয়তো একদিন হয়েছে আগে । আর্থিক দুরবস্থার জন্য সেটা সম্ভব হতো না। তবে বাড়িতে যেদিন 'ইলিস-ভাপা' হতো সেদিনটি প্রতিভার কাছে হয়ে উঠতো রীতিমতো উৎসবের দিন। আজ অবস্থার পরিবর্তনেও প্রতিভা ও তার পরিবার আগের মতই সহজ সরল জীবনযাপন করার মধ্যেই আনন্দ খোঁজে।                   
           
                 প্রতিভা ঠিক যেমন একজন জীবনসঙ্গী আশা করেছে তার মা-বাবা, শুভাকাঙ্ক্ষীরাও‌ তেমনই অনুসন্ধান করে চলেছে। প্রতিভার এই সিদ্ধান্তে অকাট্য বাস্তব-সত্য আছে বলেই তারা বাবা-মা মেনে নিয়েছে। এমনকি মেয়েকে বলেছে যদি তার কাউকে পছন্দ হয় তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। গরীব হলেও উদার ও সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ এরা । জাত-ধর্মের সুচিবায়ুতা এদের কখনই ছিল না। মেয়েকেও তেমন ভাবে গড়ে তুলেছিল। মেয়েকে তারা ছোট থেকেই চেনে। মেয়ে কখনো তাদের অবাধ্য হয়নি। কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নি। মেয়ের লক্ষ্য যে অসহায়,দরিদ্র্য, দুর্বল মানুষের চিকিৎসা করা। এর জন্য স্বার্থত্যাগ করতে হয়। প্রতিভা তার মন ও মানসিকতাকে ছোট থেকেই একটু একটু করে গড়ে তুলেছে।তার জীবন-সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্র বিপরীত হলে কোন ভাবেই মঙ্গলের কারণ হবে না। 
               
             পথ,নদী চলতে চলতে বাঁক নেয়। শুরু হয় ভিন্ন যাত্রা । জীবনও বাঁক নেয় যুক্ত হয় নূতন মাত্রা। প্রতিভার জীবনে হঠাৎ একদিন প্রবালের সাথে দেখা হলো। না, না তাকে সে আগে থেকে জানতো না। প্রথম পরিচয়। একবার মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে তারা একটি পাহাড়ি এলাকায় এসেছিল। তিন দিনের ক্যাম্প। সেখানেই তাদের থাকতে হয়েছিল । প্রবাল সেনগুপ্তের সাথে এখানেই প্রথম পরিচয় । যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির দ্বারা বিষয়টি পরিচালিত হচ্ছে প্রবাল তাদের প্রতিনিধি হয়ে এখানে এসেছে। প্রথম পরিচয়েপ্রবালকে আলাদা মনে হয়েছে। সে জানতে পারে প্রবাল অনাথালয়ে বড়ো হয়েছে। পথ-দুর্ঘটনায় তার মা-বাবা মারা গেলে তাকে উদ্ধার করে ফায়দা ডিসুজা এখানে নিয়ে আসে, তখন তার বয়স তিন। এখানেই তার জীবন অন্য অনাথ শিশুদের মতো কাটে । ফাদার ডিসুজা টেইলর তাকে এখানে নিয়ে আসে। আদর যত্নে বড়ো করে বাকি শিশুদের মতো। ওকে অন্যের হাতে তুলে দেয় নি।ফাদার শিশুগুলোকে প্রগতিশীল শিক্ষা দিয়েছে কিন্তু কখনোই ধর্মান্তরিত করে নি । তিনি বিশ্বাস করতেন সব মানুষই যেহেতু এক ঈশ্বরের সন্তান তখন জাতের বিভাজন মনের ক্ষুদ্রতা,সংকীর্ণতা ছাড়া কিছুই না। প্রবাল এখান থেকে পড়াশুনা করে। খুব ভালো ছাত্র ছিল। অনায়াসে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি করতে পারতো, কিন্তু  সে সমাজ সেবাকে,অনাথ শিশুদের, বৃদ্ধাশ্রমের মানুষদের সেবায় নিজেকে আজীবন নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । জীবন যাপনের জন্য একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকায় সহ: সম্পাদকের কাজ করে। মূল লক্ষ্য অনাথ শিশুদের, বৃদ্ধাশ্রমের মানুষদের পাশে সব সময় থেকে তাদের সেবা- শুশ্রূষা করা । দুজন যেন একে অপরের যথার্থ পরিপূরক । " খুঁজিয়া পাইলো যেন হাঁড়ির মতো সরা " এ যেন চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু ও ফুল্লোরার মিলন । উভয়ের বন্ধুত্ব গভীর হলো। দুজনের জীবনের লক্ষ্য মিলে গেছে। আর কোন বাধা নেই। বাড়ির কোন অমত নেই। এরপর থেকে প্রতিভার দিনে দিনে যেন রূপ সৌন্দর্য আরও‌ আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে লাগলো। প্রেমে পড়লে এমনি হয়ে থাকে সাধারণত ।পাড়ার লোকেরাও খুশি, ছেলেটির অমায়িক ব্যবহারে । ছয়‌ মাস পরে বিয়ের একটি ভালো দিন আছে,বিয়ে তখন হবে ঠিক হলো।
         
         বিয়ের তারিখ যতই এগিয়ে আসছিল প্রতিভা ততই যেন আনমনা হতে শুরু করেছিল। নির্জনে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগছিলো তার। তার উপর কাজের চাপও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে । কাজের সময় তার অন্য বিষয়ে খেয়াল থাকে না। চিকিৎসার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে দূর গ্ৰামে, বিপদসংকুল ও এমনকি অগম্য স্থানেও যেতে হয় তাকে ।
         
     এই তো তিন দিন আগের ঘটনা শহরের একটি ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় রোগী দেখে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সে একাই চলাফেরা করে দিনে ও রাতে। সে মনে করে তার কোন শত্রু হবেই না। সে কাউকেইঘৃণা করে না। সে মানুষের সেবাতেই বিশ্বাস করে । পথের মানুষই তার পরিচয় জানতে পেরে কতোবার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। তার মনে হয় মানুষকে বিশ্বাস না করার চেয়ে পাপ ও অন্যায় যেন কিছু নেই। রাত নটা হবে। তখনই পথঘাট একেবারে জনমানব শূন্য । পথে রাতের শাসন শুরু করেছে কুকুরের দল। যে বাসস্টপে এসে দাঁড়ালো প্রতিভা, সেখানে কোন লোক নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে কোথা থেকে কতগুলো মদ্যপ লোক এসে প্রায় তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মুখ দিয়ে ছুটছে দুর্গন্ধ। একে অপরে নোংরা ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। প্রতিভার পড়নে ডাক্তারি ইউনিফর্ম । এমন ভাবে দুই এক মিনিট পার হওয়ার পর একটি যাত্রীবাহী বাস এসে দাঁড়ালো। সে বাসটাতে কোন যাত্রী নেই ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর ছাড়া। প্রতিভা একবার ভাবলো যাবে কি না ? পরে মনে হলো ভয়ের কী আছে এমন ভাবে কতই না সে যাতায়াত করেছে। মিনিট দশেক পরে সে তার স্টপেজে নেমে যাবে। প্রতিভা গাড়িতে উঠলো পেছনে পেছনে উঠলো মদ্যপের দলটিও । প্রতিভার সরল মন ওদেরকে অবিশ্বাস করলো না । গাড়ি চলার একটু পর থেকেই ওই মদ্যপের দলটি কেমন লোভী লোভী চোখে প্রতিভার দিকে তাকিয়ে আছে । আর নিজেদের মধ্যে কী জানি বলাবলি করছিল । প্রতিভার এর আগে কখনো এমন অস্বস্তি হয়নি। আজকাল তার এসব দেখলে কেমন জানি অস্বস্তি হয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে এটা তার কেন যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মদ্যপ লোকগুলোর মধ্যে একজন তার দিকে এগিয়ে আসছিল। প্রতিভার মনে মনে এবার ভয় হতে শুরু হল। তার প্রবালের কথা মনে হল। মনে হচ্ছে যদি সে তার সাথে থাকতো হয়তো তার ভয় লাগতো না। মদ্যপ ব্যক্তিটি ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই গাড়িটি একটি স্টপেজে এসে থামলো। সেখান থেকে জনা আটেক সশস্ত্র পুলিশ উঠে এলো গাড়িতে,দেখে মদ্যপের দলটি ভয় পেয়ে গেল। যে এগিয়ে আসছিল সে দ্রুত নিজের দলে যোগ দিলো। পুলিশদের দেখে শান্ত ভদ্র হয়ে বসে থাকলো । পাঁচ মিনিট পরে প্রতিভা তার নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে গেল। সেদিন সত্যিই সে বড্ড ভয় পেয়েছিল । মদ্যপগুলির হিংস্র লোভী চোখগুলো তাকে রাতের বেলাও ঘুমের মধ্যে তাড়া করছিল । প্রিয় মানুষটিকে চিৎকার করে ডাকছিল, কিন্তু সে শুনতে পারছিল না, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল। কিছুতেই প্রিয় মানুষটিকে ধরতে পারছিল না। আর পেছনে দাঁত,নখসহ রক্তচক্ষুর হিংস্র দলটি ছুটে আসছিল তাকে ধরবার‌ জন্য । ভয়ে প্রতিভা কেঁপে উঠছিল, একেবারে ঘেমে যায়। মদ্যপের দলটি প্রায় তাকে ধরে ফেলে, বিছানায় সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বসে। তখন রাতের আঁধার মুছে সবেমাত্র ভোরের সূর্যোদয় হয়েছে। প্রতিভা বুঝতে পারলো সে বিভৎস স্বপ্ন দেখেছে ।               

       বিয়ের আর মাত্র ১৫ দিন বাকি ‌‌। প্রায় সকল আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে। পাড়ার লোকেরই এ ব্যাপারে সবচেয়ে আগ্ৰহ ও উৎসাহ বেশি। বিয়ে বাড়ির হাজার কাজ। তারা আনন্দের সাথে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের। প্রতিভা সেদিন তার মাকে বলল আজ সে ডিউটির পরে কিছু কেনাকাটি করে বাড়ি ফিরবে । তাই একটু দেরি হবে । তার মা বলল, "বিয়ের আগে কটা দিন না হয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে। আমি কি তোমার সঙ্গে যাবো" । প্রতিভা বলল,"তুমি আবার কষ্ট করে যাবে কত রাতে ডিউটি শেষ হবে কে জানে। যদি তাড়াতাড়ি ডিউটি শেষ হয়ে যায় তবে আমার কিছু কেনার আছে সেগুলো কিনতেই যাব। তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। তুমি চিন্তা করোনা" । সেদিন তার রাত্রি ৮টার মধ্যে ডিউটি শেষ হয়ে গেল। নাইট ডিউটি ছিল কিন্তু তার বদলে আর একজন রাজি হলো। প্রতিভা বিয়ের জন্যে কিছু কেনাকাটি করবে, মেয়েদের অনেক কিছুরই প্রয়োজন থাকে, মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই বোঝে‌, তাই সহকর্মী ডাক্তার মহিলাটি তাকে বাজারে যাওয়ার সুযোগ করে দিলো । 
               

           
          পথে যেতে যেতে একবার মনে হলো প্রবালকে ডেকে নিলে কেমন হয় ? পরে ভাবলো না থাক আর কদিন পরেই তো একসাথেই থাকবো । মনের মধ্যে দোটানা চলছে তখন। এক সময় সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে প্রবালকে ফোন করল । প্রবাল দেখলো প্রতিভার ফোন এসেছে মোবাইলে, ফোনটি রিসিভ করে বলল,"বিশ্বাস কর আমার মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে এখনই ফোন করবে। ভাবতে ভাবতেই তোমার ফোন চলে এলো। তুমি তো এখন ডিউটিতে আছো।"প্রতিভা বলল আজ নাইট ডিউটি আমি করব না, অন্য একজন করবে। আমি একটু বাজারে এসেছি কিছু কেনাকাটি করার জন্য।"প্রবাল বলল ভালো করেছো । আমার এখন হাতে কোন কাজ নেই। চুপচাপ অনাথ আশ্রমে আমার ঘরে বসে আছি। তুমি চাইলে আমি তোমাকে সঙ্গ দিতে পারি ।" সামান্য কয়টা জিনিস কিনব । বেশি দেরি হবে না। আমি বাড়ি চলে যাব। তুমি ভেবোনা,একা একা কতই না এভাবে বাজারে এসেছি। কেনাকাটা করেছি। আবার বাড়িও ফিরে গেছি একা একাই । তুমি আবার কত দূর থেকে আসবে,আকাশটাও ভালো না যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। দেখো কী গভীর কালো মেঘ করেছে ? বৃষ্টির সাথে হৃদয় কাঁপানো বজ্রপাত শুরু হয়ে যাবে। না না থাক তোমাকে আসতে হবে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি বাজার করে ফিরে যাব, বাড়ি ফিরে তোমাকে ফোন করবো, রাগ করলে না তো?"প্রবাল বললো,"না না। তুমি সাবধানে এসো, এসে আমাকে ফোন করো।"
      
                   প্রতিভা নিউমার্কেটের লেডিস এম্পোরিয়াম থেকে বরাবর জিনিস কেনে। তার পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে খুব দ্রুত বেড়িয়ে পড়ল। আকাশের কালো মেঘ  আরো ভয়াল হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। আর অল্প সময়ের মধ্যেই প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হবে। একবার বৃষ্টি শুরু হলে টানা সময় ধরে হতে পারে। বলতে না বলতেই বৃষ্টি নেমে গেল। পুরো একটি ঘন্টা দোকানে বসে থাকতে হলো। বৃষ্টির সঙ্গে ছিল প্রবল ঝড়ো হাওয়া। সেই হাওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু চতুর্দিকে 
গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে শহরের রাস্তায়। পথে কোথাও জল জমে আছে। খুব সামান্য লোকই বাইরে আছে। জন মানব শূন্য পথে চলতে শুরু করল প্রতিভা । তাদের বাড়ি থেকে শহর মিনিট কুড়ির পথ । কিন্তু আজ যেন এই পথ অন্তহীন হয়ে গেছে । গভীর অন্ধকার,তার উপরে লোডশেডিং এবং নির্জন পথ সব মিলিয়ে যেন একটি বিকট চেহারার রূপ নিয়েছে। বাড়ি ফিরবে পথে একটিও টোটো বা অটো নেই। অগত্যা তাকে হাঁটা পথেই বাড়ির দিকে রওনা হতে হলো । শহরের কিছু শর্টকাট গলিপথ আছে। যে দিক দিয়ে গেলে খুব শীঘ্র বাড়ি পৌছানো যায় । সেই গলি পথগুলো খুব সংকীর্ণ। সেসব পথে রাতের বেলা নোংরা লোকের ভয়ে অনেকে যেতে চায় না। তবে প্রতিভা সেসব এলাকাতেও চিকিৎসা করেছে। সে পথ ঘাট গুলো তার কাছে ভয়ের নয়। তাই সে সাহস করে শহরের রাজপথ ছেড়ে নির্জন গলিপথে এগিয়ে চলেছে। সে ভেবেছে এই বৃষ্টির দিনে, বজ্র বাদলের দিনে কেউ আর গলির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকবে না। 

                       তবে আজ গলিপথটিতে পা দিয়েই প্রতিভার গা টা কেমন যেন শিউরে উঠলো । এমন তার কখনোই হয়নি। মনে হল গলির প্রতিটি বাঁকে ওঁত পেতে অপেক্ষা করে আছে কিছু হিংস্র জন্তু। তাদের চোখগুলো গাঢ় অন্ধকারে যেন জ্বলজ্বল করছে। তারা দল বেঁধে আছে শিকারের অপেক্ষায় । শিকার নাগালের মধ্যে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রতিভা মনে মনে একটু ভয় পেলেও পর মুহূর্তে মনে এসব নেতিবাচক ভাবনাকে স্থান না দিয়ে সাহসে ভর করে এগিয়ে চলে এবং নিজেকে বুঝিয়েছে ভয় পেলে ভয় আরো চেপে বসে। জীবনে কত একা একা এমন গলিপথে,অন্ধকারে তাকে যেতে হয়েছে। কিছু হয়নি। আজও হবে না। এই বিশ্বাস নিয়ে তার জীবন, তার দর্শন। আজও এই বিশ্বাস নিয়েই সদা হাস্যমুখী মানুষের বেদনায় যে কাতর হয়ে ওঠে, যে রোগীর চিকিৎসা কে পেশা নয় জীবনের ধর্ম করে নিয়েছে সেই প্রতিভা জীবনে এমন বাস্তবের মুখোমুখি হবে মুহূর্তের জন্যও কল্পনাও করেনি ।

                   প্রতিভা অন্ধকার গলিটির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। গলিটি যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই বাঁকের মুখে এগিয়ে যাওয়ার সময় কিছু মানুষের চাপা গলায় ফিসফিসানির আওয়াজ যেন শুনতে পেলে। গলিটির বাঁকেরমুখ থেকে কিছুটা পথ খুবই নির্জন। পথের ডান পাশে একটি প্রাচীর ঘেরা পরিত্যক্ত ভাঙ্গা বাড়ি আছে ।প্রতিভার ভয় হতে লাগলো সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল । হঠাৎ দমকা হওয়ার মতো একদল মদ্যপ মুহূর্তের মধ্যে চিলের মতো ছো মেরে প্রতিভাকে নির্জন পরিত্যক্ত অন্ধকার বাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরেছে একজন।সে চিৎকারে করার চেষ্টা করে কিন্তু পারছেনা । এরপর হাত পা শক্ত করে বেঁধে দেয়,শরীরের পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করেও কিছু করতে পারলো না। বুঝতে পারলো জানোয়ারগুলোর সঙ্গে জোরে পেরে উঠবে না । ওদের সবাইকে চিনতে পেরেছে।বাস‌স্টপের সেই মদ্যপের দলটি । জংলি ইঁদুরের মতো প্রতিভার হাড়,মাংশ, রক্তবিন্দু পর্যন্ত খাচ্ছিল জানোয়ারগুলো। প্রতিভার রাগে, ঘৃণায়, যন্ত্রণায় দুচোখেরকোণ বেয়ে ঝরে পড়ছিল জলবিন্দু হয়ে তার মা-বাবার মুখ, প্রবালের মুখ, পাড়ার মানুষদের মুখ ‌। ভেসে যাচ্ছিলো তার আদর্শ, ভেসে যাচ্ছিলো সমাজ সেবা ও কৃচ্ছ সাধনা । পরের দিন অর্ধ মৃত থ্যাতলানো প্রতিভার শরীরটি সেখানে পড়ে ছিল । অজস্র ক্ষতের চিহ্ন সারা শরীর জুড়ে ।আঁচরের দাগ,বিন্দু বিন্দু রক্ত জমে কালো হয়ে আছে মেঝের অনেকটা জায়গা জুড়ে । এ মেয়েকে আর চেনা যায় না আগের মতন । প্রতিভা জীবিত আছে কিন্তু সে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শুধু চোখ দুটো মৃত মাছের মতো চেয়ে আছে স্থির হয়ে। অজস্র ‌প্রশ্ন তীক্ষ্ণ জ্বলন্ত শলাকার মতো ঝরে পড়ছিল। অসংখ্য 'কেন' রাতের জোনাকির মতো ঘুরছিল তাকে ঘিরে। শরীরে ও মনে যে আঘাত পেয়েছে এটাই হয়তো ছিল তার সেবা ও শুশ্রূষার উপযুক্ত পুরস্কার, আমাদের বিকৃত মানসিকতার।

                    পরের দিন তার গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনে এলাকার মানুষ সেখানে ছুটে গেল। প্রতিভাকে দেখেই তারা চিনতে পারল। ইনি তো ডাঃ প্রতিভা চৌধুরী যিনি আমাদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। আজ তার এই অবস্থা দেখে সকলে রাগে ফেটে পড়লো,বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। পুলিশে খবর দেওয়া হলো। বাড়ির লোকেরা জানতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো। পাড়ার লোক ভেঙে পড়লো । প্রতিভার কাছ থেকে পুলিশ অপরাধীদের তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করলো। প্রতিভা বলার মতো অবস্থায় তখন ছিল না। পরে সব বিবর্ণ দিয়েছে। পুলিশ এলাকার লোকেদের চাপে পড়ে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে বাধ্য হয়েছে মাত্র দুই দিনের মধ্যেই ।
               
         যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে অপরাধীরা কিছুদিনের জন্য কারাবাস করে আবারও পুরনো জীবনে ফিরে গেলো। এদের কোন পরিবর্তন হলোনা, কোন অনুশোচনাও হলো না মনে। নেশা, এদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে আবেগ,বিবেক এবং মনুষ্যত্বকে । তদন্ত করতে গিয়ে অপরাধী এবং তাদের পৃষ্টপোষকদের শেকড় যে কতো গভীর ও দৃঢ় বোঝা গেল। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দিল, সবটাই অলৌকিক ভাবে ধোঁয়াশায় ঢাকা । কিছুদিন হৈচৈ হলো। প্রতিবাদে মিছিল হলো। খবরের কাগজে গরম গরম খবর বের হলো। নিউজ চ্যানেলগুলি বিতর্কের ঝড় তুললো । পক্ষ-বিপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করল। তারপর পরিবেশ আবারও শান্ত হয়ে গেল। আমরা সবাই নিজের নিজের চক্রব্যূহতে অভাব অনটনের সঙ্গে, নিত্য দিনের চাহিদার সঙ্গে, যন্ত্রণার সঙ্গে, বাস্তবের রুক্ষতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে এমন নৃশংস, জঘন্য, অপরাধের ঘটনা মনের শক্ত মাটির নীচে চাপা পড়ে গেল । অসহায়ের মতো আমরা ভুলে গেলাম প্রতিভার যন্ত্রণা, প্রতিভার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ক্ষমাহীন অপরাধ । প্রতিভাকে দেখে মনে হয় হঠাৎ কোনো গাছের উপর বজ্রাঘাত হলে সেই সবুজ পল্লবীত সতেজ ছায়া দানকারী গাছটি যেমন পুড়ে ছাই হয়ে যায় আজ প্রতিভার তেমনি হয়েছে । অথচ শিকারির দল বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমাজের বুক দাপিয়ে। এরা বেলাগাম, বেপরোয়া এবং সংরক্ষিত । অপেক্ষা করছে পরবর্তী শিকারের । আরেকটি প্রতিভার।