Sunday, August 3, 2025


 

আবর্তন

অনিতা নাগ 

আজকাল এই এক রোগ হয়েছে অনুর। দুপুরবেলায় সব কাজ সেরে ঘরে এলেই মনটা পালাই পালাই করে। বর্ষার মেঘের সাথে মন হারানোর খেলাটা জমে ভালো। জানলার পর্দাটা সরালে গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ আজও দেখা যায়। ওই খোলা আকাশটা অনুর বড্ড আপন। ঋতু বদলের সাথে সাথে ওই টুকরো আকাশে কতো যে রঙের খেলা চলে! ওই আকাশের সাথে ভেসে ভেসে চলে মন হারানোর খেলা। আজ কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতেই এক দমকা হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। পড়ে রইলো সংসার, রইলো পড়ে রাজ্যপাট। অনু তখন পৌঁছে গেছে সেই ছোটবেলার দিনগুলোয়। তাদের পৈতৃক বাড়ীতে। যেখানে পুরো বাড়ী জুড়ে অবাধ বিচরণ তার। তাদেরও একটা ঘর ছিলো। সেই ঘরে দুটো জানলা, আর দরজা খুললে একটা বারান্দা। ওই বারান্দায় জীবনের কতো যে গল্প! ওই ঘরেই ছিলো একটা মিটসেফ, যাতে থাকতো রাজ্যের ধনরত্ন। আচার, জেলি, জ্যাম। মা সব ওখানে রাখতেন। দুপুর বেলা মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি উঠে বারান্দায় চলে যেতো অনু। কতো ফেরীওয়ালা যেতো হাঁক পেড়ে পেড়ে। এক বয়স্ক দাদু আসতো, মুখে বসন্তের দাগ, রোগা, ঢ্যাঙা চেহারা। কাঁচের বাক্সে মণিহারী জিনিষ থাকতো। সাইকেলের সামনে কাঁচের বাক্সটা লাগানো থাকতো। কাঁচের বাক্সে রঙিন চুড়ি। দাদু হাঁকতো বেলোয়ারী চুড়ি, মণিহারী….। সাইকেলের হাতলে একটা লাঠির গায়ে হরেক রঙের ফিতে, লাল, কালো কার, সেফটিপিন, আরো কতো কিছু থাকতো। ইচ্ছে হতো ছুট্টে চলে যায়। কিন্তু দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার সাহস ছিলো না। পাড়ার বাকীরা সকলে কিনতো। পাশের বাড়ীতে রূপারা ভাড়া থাকতো। অনুর বন্ধু ছিলো। হিন্দুস্তানী। ওর বাবার খাটাল ছিলো। সারাদিন ওদের বাড়ীতে কতো যে লোকজন আসতো। সব হিন্দুস্তানী। রূপার মা’কে পাড়ার সকলের সাথে অনুও বৌ বলে ডাকতো। বৌ কিনতো কাঁচের চুড়ি। ওরা তো কাঁচের চুড়িই পরে। বৌ ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতো। অনুকে বলতো নিবে তুমি কুছু? অনু পালাতো ঘরে। মা জানতে পারলে বকবে যে! মা বলতেন পূজোর সময় জামার সাথে ম্যাচ করে ফিতে কিনে দেবে। ওতেই শান্তি। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে বড়ো ভালো লাগতো। ক্রমশঃ সুরটা দূরে মিলিয়ে যেতো। বেলোয়ারী চুড়ি, মণিহারী…।

 মেঘ ছুটে চলে। অনু বলে এই মেঘ, একটু সবুর কর না, আর একটু থাকি। ওই যে রাস্তার এক কোণে টালির টুকরো দিয়ে এক্কা দোক্কার ঘর আঁকা। বিকেলে খেলবে সকলে মিলে। ও বাবা! মাধুরী কতো তেঁতুল নিয়ে এসেছে। ওর বাবার দোকান আছে। আলু, পিয়াজ, আদা, রসুন, সাথে তেঁতুল ও থাকে। মাধুরী নিয়ে আসে অনুদের জন্য। ইজেরের ট্যাঁকে করে লুকিয়ে আনে। কেউ একটু নুন আনে। তারপর বড়দের লুকিয়ে কলাবাগানের একটা কোণে সব বন্ধুরা মিলে তেঁতুল খাওয়া! আহা! কি সুখ! এই বুড়ো বয়সেও অনুর জিভে জল এসে গেলো! আহা! কি স্বাদ! এখন তো একটু টক বেশী খেলেই নানান বিপত্তি। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসে শুনতে পেতো আরেকটা সুর। ঘুগনি, ভেজিটেবল চপ। ওই চপ-কাকুর সুরটা একবারে অন্যরকম ছিলো। অনেক দূর থেকে ওই সুরটা শোনা যেতো। কোনোদিন বাৰীতে ঘুঘনি কেনা হতো। কি আনন্দ সে'দিন! গরমের সময় ওই কাকুটাই লাল শালু জড়ানো মাটির হাঁড়ি করে কুলফি বিক্রি করতো। আর ছিলো আইসক্রীম। ফুচকার গাড়ীর ঘড়ঘড়ে আওয়াজ ছাপিয়ে যেতো আইসক্রিমের গাড়ীর আওয়াজ। লাল, সবুজ, কমলা, কতো রঙের আইসক্রিম পাওয়া যেতো। আর মাটির ভাঁড়ে ঝুরো বরফ। কোনোদিন পাঁচ পয়সা পেলে ঝুরো বরফ কিনে খেতো। মাটির ভাঁড়ে লাল, সবুজ, হলুদ সিরাপ দেওয়া ঝুরো বরফ। কতো স্মৃতি। মেঘ ছুটে চলে। অনু বলে এই মেঘ, একটু সবুর করো। আর একটু থাকি। মেঘের কি থামলে চলবে! কতো কাজ তার। এ’ দেশ থেকে ও’দেশ ভাসিয়ে নিয়ে চলে। পেছনে পড়ে থাকে পুরোনো দিনের স্মৃতি। মেঘ বলাকার পাখার সাথে ভেসে চলে মন। ছোট থেকে কতো বিবর্তন। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে মেয়ে জীবন। এক জীবনে কতো ভূমিকা। বাড়ীর ছোট মেয়েটি থেকে আজকের পরিণত জীবন। মেয়ে বেলা এগিয়ে চলে। সব সময় ছন্দ মেলে না। তবু মেলাতে হয়। ওই যে মা ঠাকুমা শিখিয়েছেন মানিয়ে নিতে হয়। আসল কথা ওটাই। মানিয়ে নেওয়া। বড্ড কঠিন কাজ। ওই কঠিন কাজটা করতে হয়। সব মেয়েদের করতে হয়। সে যতো আধুনিক আর যতো স্বাধীণই হোক। অনুদের জীবনের সাথে আজকের মেয়েদের জীবনের অনেক তফাৎ। আজ মেয়েরা এগিয়ে চলেছে আপন লক্ষে। তবু কতো বাধা। কতো বিপদ। এই তো সে'দিন রাজ্যের সরকারী হাসপাতালে, সরকারী ডাক্তার মেয়েটি খুন হয়ে গেলো। কেউ কোনোদিন শুনেছে! অন ডিউটি ডাক্তার মেয়েটিকে মেরে ফেললো, শুধু মানিয়ে নেয় নি বলে, মেনে নেয় নি বলে। একবছর হয়ে গেলো। আজো বিচার পেলো না সে মেয়ে। কতো আন্দোলন, কতো মিছিল, কতো রাত দখল। কিচ্ছু হলো না। অনুও তো প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলো। স্কুলের বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলো ধর্ণা মঞ্চে। সে’ বছর ঠাকুর দেখতে যায় নি। সেই সময়টায় আন্দোলনকারীদের অনশন মঞ্চে ছুটে গিয়েছিলো। যে দেবীর আবাহনে এতো উৎসব, এতো আনন্দ সেই দেবীও তো এক মেয়ে! মা’র কাছে প্রার্থণা করেছে বিচারের। কিচ্ছু হয় নি। একটা বছর কেটে গেলো। ক্ষমতা যার বিচারও তার। তবু আশা করে বিচার আসবে। সেই মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার হবে। হবেই। যুগ পাল্টেছে। ধর্মের কল আর বাতাসে নড়ে না। অসুর বিনাশিনী দেবীকে জাগাতে হবে। আভরণ আর আবরনের মোহজাল কাটিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে নিজের ভিতরের আমিকে। সবার আগে নিজেকে সম্মান করতে হবে। আপোষ করা চলবে না। আনমনা মন চমকে ওঠে মুঠোফোনের ঝনঝনানিতে। আর সেই সুযোগে মেঘগুলো কেমন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। ও’ মেঘ, এতো জল তুই কোথায় লুকিয়ে রাখিস! অঝোর ঝরন শ্রাবন জলে কোন বিরহিনীর ব্যথা বয়ে নিয়ে বেড়াস তুই! উদাস হয় মন। বুকের ভিতরটা কেমন টনটনিয় ওঠে। মেঘের সাথে ভাসিয়ে দেয় তার সব ভালোলাগা, সব মনখারাপ, সব কষ্ট। জানে মেঘ বলাকা ঠিক সামলে রাখবে। আবার কোনো দিন মেঘবলাকার সাথে ভেসে যাবে অনু। ও মেঘ, তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরিয়ে দিস বুকে বয়ে নিয়ে চলা সব ব্যথা। বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘোর কাটে অনুর। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নামবে। ফিরতে হবে আপন রাজ্যপাটে। মেঘ পিওনের খামের মধ্যে ভরে রাখে তার স্মৃতির পুটুলি। ওই যে’কদিন স্মৃতি আছে! সেই কদিন এই স্মৃতিগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা। তারপর গুগল খুঁজে আগামী প্রজন্ম জানবে কেমন ছিলো সে যুগের কথা। গুগল কি বলতে পারবে তেঁতুল মাখা কেমন খেতে ছিলো! বলতে পারবে ঝুরো বরফের স্বাদ! কে জানে! জেনেই বা কি করবে সে! অনু তার ছোটবেলাকে পরম আদরে আর সোহাগে আগলে রাখে আপন মনের আঙিনায়। এই টুকুই তার বেঁচে থাকার শক্তি। এ’ জীবনের যে’কটা দিন আছে, চারদিকে শুধু আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করে। এতো আলো যে সেই আলোয় সব অন্ধকার মুছে যাবে। জীবন দেবতার কাছে একটা প্রদীপও যদি জ্বালতে পারে! অনুর বাবা, মাও ঠিক এমন করেই ভাবতেন। হয়তো এমন ভাবেই জীবন তার আবর্তনে চলতে থাকে। শুধু পাত্র- পাত্রী বদলে যায়। বদলে যায় সমাজের মানদন্ডের মাপকাঠি। অনুর ঘোর কাটে কর্তার ডাকে। সন্ধ্যে হয়ে গেলো যে! ঝটপট অগোছালো মনকে বাক্স বন্দী করে ফেরে জীবনের মঞ্চে। সন্ধ্যাদীপ জ্বেলে দেয়। গরম চায়ের পেয়ালা নিয়ে গা এলিয়ে দেয় সোফায়। মুঠোফোনে রবি কবির গানের সুর ভেসে আসে…….
“যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেনো পাই শেষে
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে”।।

No comments:

Post a Comment