বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়
তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...
পক্ষে
বটু কৃষ্ণ হালদার
আগস্ট মাস আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাস হোল বিজয়ের মাস।হাজার সন্তানের আত্ম বলিদান এর মধ্য দিয়ে ভারত বর্ষ দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি পেয়েছিল। তাই প্রতিবছর সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এই দিনটা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত পালন করা হয়। আগস্ট মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা দিবস পালনের আগাম প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক তার কয়েকদিন আগেই কলকাতার বুকে আরজিকর হাসপাতালে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ধর্ষণ কাণ্ডের রোমহর্ষ ঘটনা। সেই অমানবিক নিষ্ঠুর পাশবিকতার ভায়াল ভয়ংকর চিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ভারত বর্ষ নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষ এই অমানবিক নৃশংসতা দেখে আঁতকে উঠেছিল।
হাসপাতাল হল দিন আনা খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের কাছে মন্দির। আর ডাক্তার হলো সেই মন্দিরের পূজারী। ২০২৪ সালের ৯ই আগস্ট হাসপাতাল নামক মন্দিরের মধ্যেই ডাক্তার নামক পূজারী মৌমিতা দেবনাথের অর্ধ অর্ধনগ্ন মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেয়েটি একা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। আরজিকর হাসপাতালে অশিক্ষিত, মূর্খদের ডাক্তারি ডিগ্রির সার্টিফিকেট বিতরণ চলছিল। জাল ঔষধ থেকে শুরু করে কিডনি পাচার সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল মেয়েটা। শেষে জীবনটাই চলে গেল।
সেই ঘটনার পরে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। সেই সঙ্গে প্রতিবাদের নামে রাত দখল,দিন দখল,রাস্তা দখল,ফুটপাত দখল আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হলো বিশ্বের মানুষ। আবার এক শ্রেণীর আন্দোলনকারীরা রাস্তা আটক করে নাটক নাচের আন্দোলন শুরু করেছিল। কিন্তু প্রায় এক বছর হয়ে গেল। মেয়েটা বিচার পেল না। কি জানো বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আর ধর্ষিতারা কোনদিনই বিচার পাবে না কারণ এই বাংলায় প্রতিমুহূর্তে ধর্ষকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জনগণের টাকায় উকিল নিযুক্ত করা হয়। ধর্ষক গুন্ডা মস্তানরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান পথপ্রদর্শক। আর ধর্ষিতাদের কপালে নানান অজুহাত সেঁটে দেওয়া হয়।তাদের জীবনের দাম টাকা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। টাকা দিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে ধর্ষক কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের আত্মীয় পরিবারবর্গ জড়িত থাকে। তাই তাদের কোন বিচার হয় না। এখানে আইন ব্যবস্থা থাকলেও নেতা-মন্ত্রীদের জন্য সবকিছুতেই ছাড় কারণ তারা যে জনসেবক। জনসেবক এর নামে যদি একটু আধটু ধর্ষণের মতো ছোটখাটো ভুল ত্রুটি করে ফেলে তার জন্য আইন ও কোন ব্যবস্থা নেয় না। শুধুমাত্র আরজিকরের ঘটনা নয় এর আগে বহু ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনা এই বাংলায় ঘটেছে।
২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে সরকার বলেছিল মেয়েটির চরিত্রে দোষ ছিল। দর কষাকষি নিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গে বচসা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বারাসাতের কামদুনিতে ঘটেছিল এক চরম ভয়াবহ ধর্ষণকাণ্ড। এই ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে শুধু বাংলার মানুষ নয় গর্জে উঠেছিল দেশের মানুষ।প্রতিবাদীদের মাওবাদী তকমা জুটে ছিল সরকারের থেকে। হুমকি দেয়া হতো, জেল খাটানোর ভয় দেখানো হত। কামদুনিতে ধর্ষিত বোনটি সম্পর্কে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে উক্তি ছিল:_" শরীর থাকলে যেমন জ্বর জ্বালা হয়/ তেমনি একটু আধটু রেপও হয়"। ২০১৪ সালে সিউড়ি ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকারের বয়ান ছিল:_"বাচ্চা ছেলেরা একটু আধটু দুষ্টুমি করবে না?" ২০১৫ সালে কাকদ্বীপ ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল,রেপ হলে ৪০ হাজার আর হাফ রেপ হলে ১৫ হাজার টাকা পাবেন। একথায় স্পষ্ট প্রমাণ হয় আমার দলের ছেলেরা রেপ করবে তার জন্য আমি জনগণের করপরিসেবা টাকা দিয়ে তা ভরপাই করব।কার্যত বলে রাখা ভালো এখান থেকেই মানুষরূপী হায়নারা ধর্ষণ করার জন্য আরো বেশি বেশি উৎসাহিত হয়েছিল। এরপরেও বাংলার মানুষদের হুঁশ ফেরেনি।আজও বহু মহিলারা ছাত্রীরা ধর্ষকদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দলটির পতাকা কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,মিটিং মিছিলে যায়। এখানেই শেষ নয়, ক্লাইমেক্স আরো বাকি।
এরপরে ২০১৫ সালে পশ্চিমবাংলার রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের মেলা শুরু হতে থাকে। কাটোয়া ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল ছোট্ট একটা সাজানো ঘটনা। একইভাবে রানাঘাট ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল, সরকারকে বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে। ২০২২ সালে হাঁসখালি তে ধর্ষণকাণ্ডে সরকার সরাসরি বলেছিল লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল,মেয়েটি প্রেগন্যান্ট ছিল। সারা পশ্চিমবাংলায় জুড়ে ধর্ষণের জেরবার হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণ। ২০২৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের মাসেই আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যায় আরো এক জঘন্য নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড। যেখানে সমগ্র বাংলার মানুষ নয়,সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সেখানে আর পাঁচটা ধর্ষণ ও খুন হত্যাকাণ্ডের মতো এই ঘটনাটাকেও জল দিয়ে ভাত গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে দিয়েছে।
এই বাংলা ছিল শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি, মূল পিঠস্থান। এই বাংলার মাটি গঙ্গার জলের মতো খাঁটি ও পবিত্র কারণ এই মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছেন, বিবেকানন্দ,ভগবান রামকৃষ্ণ,রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,কবি কৃত্তিবাস,সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মত মহান জ্ঞানীগুণীরা, এই মাটিতেই জন্মেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ,ক্ষুদিরাম বসু,মাতঙ্গিনী হাজরা,বাঘা ,চিত্তরঞ্জন দাস, মাস্টারদা সূর্য সেন,নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহান বিপ্লবীরা।মহান মনীষী ও বিপ্লবীদের নাম গুনে হয়তো শেষ করা যাবে না যারা এই বাংলার মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এমন উজ্জ্বলতম নজির আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। আমরা ইতিহাসে ইতালিতে সর্বপ্রথম নবজাগরণের কথা শুনেছিলাম। অথচ সারা ভারতবর্ষে জুড়ে সেই নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মাটিতে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন,বন্ধা ভারতবর্ষকে মুক্তির আলো দেখিয়ে ভারতবর্ষের মাটি কে উর্বর করে তুলেছিল পশ্চিমবাংলার মহা মনিষীদের চিন্তাধারা।তাইতো বলা হত পশ্চিমবাংলা যা ভাবে তার দুইদিন পর সমগ্র ভারতবর্ষ ভাবে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল সেই বাংলার মাটি থেকে। সমগ্র ভারতবর্ষের যত না বিপ্লবী শহীদ হয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি এই বাংলার বিপ্লবীরা দেশের জন্য স্বাধীনতা আনতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। তাইতো সমগ্র বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষ বলতে পশ্চিম বাংলার নাম প্রথমে আসে। ভারতবর্ষ বলতে চিনতো স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রাজা রামমোহন রায় সেইসঙ্গে ব্রিটিশ শক্তির কাছে হুংকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। সেই পশ্চিমবাংলা কে এখন সবাই চেনে কয়লা,গরু,ইট,বালি,ত্রিপল চোর। নারী শিশু পাচার কেন্দ্র। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত জেল খাটা নেতা-মন্ত্রীদের আখড়া। আবার এই সময় আঙ্গুল তুলে বলছে নারী নিরাপত্তাহীন ধর্ষণের রাজ্য। এই প্রবাদটি নতুন করে বাংলার মুকুটের সংযোজন হল।পশ্চিমবাংলার জনগণ হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে লজ্জায়,ঘেন্নাই মাথা নিচু হয়ে আসছে।অথচ যারা এই সমস্ত কে প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের এতটুকু লজ্জা বোধ নেই।
No comments:
Post a Comment