ঘর থেকে আটমাইল
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
'ভ্রমণ' এই শব্দটি তিন অক্ষরের হলেও এর ব্যপ্তি অপরিসীম। এর পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের মাঝের সময়টুকু যে অনাবিল আগ্রহ ও দুরন্ত প্রতীক্ষায় কেটে যায়,তার আনন্দ সীমাহীন। আবার তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই চটজলদি সিদ্ধান্তে কোনো সফর যদি ডানা মেলে, হঠাৎ পাওয়া সে আনন্দও তুলনাহীন। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, চোখ ভরে সুন্দরকে দেখা, মন দিয়ে উপলব্ধি করা ও যা দেখছি সেগুলি সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনে নেওয়া সম্ভব হলে পরিপূর্ণ এক ভ্রমণকে মুঠোয় ভরে নিয়ে ফেরা যায়।
'তিন-চূড়ো পাহাড়ের দেশে
গোধূলিতে ডুলি ক'রে আমি চলি দূর গাঁয়ে
তিন- চূড়ো পাহাড়ের শেষে.....
চলে চলে ডুলি চলে ওই পাহাড়ের গাঁয়ে,
তিন-চূড়ো পাহাড়ের দেশে।।। '
সুনির্মল বসু
পাহাড়কে কাছ থেকে দেখার অমোঘ টানে আমাদের সফর এবার ডানা মেলেছিল কালিম্পং- এর পথে আটমাইলের দিকে।তবে কবিতার মতো গোধূলি বেলায় নয়, খুব সকাল সকাল আমাদের যাত্রা হলো শুরু।কালিম্পং- এর সৌন্দর্য্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই। মনোরম এই যাত্রাপথে আবহাওয়া দারুণ ভাবে সাথ দিয়ে চলেছিল আমাদের।পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে কানায় কানায় যে মনকাড়া ভালোলাগার খনি তা থেকে মণিমুক্তো কুড়িয়ে নেওয়াতে এতটুকুও যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার নিঃশর্ত দায়িত্ব যেন বর্তেছে আবহাওয়ার ওপর।রোদ ঝলমলে নিসর্গের মাঝে দৃশ্যমান পাহাড়ের সঙ্গে শুভদৃষ্টির আনন্দে যেন এতটুকুও ঘাটতি না হয়,প্রকৃতির কড়া প্রহরায় আবহাওয়া সেই দায়িত্বপালন করে চলেছিল নিরলস ভাবে।পাকদন্ডী পথ বেয়ে চলমান পাহাড় তার মোহময়ী রূপ নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলেছিল অবিরাম।কোমল,রোদ ঝলমলে একটি সকাল শান্ত এক দুপুরে পৌঁছে গিয়েছিল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চেয়ে আশ্চর্য এক মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়েছিল মন। নাম জানা,না জানা অজস্র ফুল স্বাগত জানিয়েছিল ঢাল বেয়ে নীচে নামা পাহাড়ি চলার পথে। সেও এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বটে। মাথার ওপর স্বচ্ছ নীল আকাশের দুধসাদা উড়োমেঘের দল কেবল সাক্ষী ছিল ধাপে ধাপে খাঁজকাটা সেই বন্ধুর পথযাত্রার। বেশ লাগছিল দলেবলে কিছুটা ভয় আর বাকি পুরোটাই আনন্দ নিয়ে এভাবে এগিয়ে যেতে।এদিকে আমাদের সকলের যাবতীয় লাগেজ ব্যাগগুলি পিঠে নিয়ে কী আশ্চর্য তৎপরতায় হোমস্টের দায়িত্ব প্রাপ্ত মানুষটি বহু আগেই পৌঁছে গেছেন জাগয়ামতো।নেমে চলার কোনো এক বাঁকে এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে দেখেছিলাম হয়তো বা।
এরপর থমকে দাঁড়াবার পালা। পাহাড় কাছ থেকে আগে দেখিনি এমন তো নয়। কিন্তু এই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তা ধারণারও বাইরে ছিল। নীল সাদা আকাশের গায়ে স্তরে স্তরে সবুজ ঢেউ এঁকে যে পাহাড় নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছিল,এমন অপরূপ পাহাড় আগে কখনো দেখিনি। ঝকঝকে রোদ সোনার জলে প্রাণময়তার ছবি এঁকে দিচ্ছিল এর গায়ে। মন বলছিল এই পরম পাওয়ার মুহূর্তগুলোর জন্যই বেঁচে থাকা।
ফুলে লতায় পাতায় চমৎকার ভাবে সাজানো হোমস্টে টি নেহাত ছোট নয়। ধাপে ধাপে সুদৃশ্য সব কটেজ পাহাড় আর সবুজ গাছপালাকে সঙ্গে করে হাতে আঁকা ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন।প্রকৃতির নিজস্ব ধাপ বেয়ে সেগুলিতে ওঠা নামার বন্দোবস্ত। কটেজগুলি নির্মানে পিলার হিসেবে বাঁশের ব্যবহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।এছাড়া পাটি ও ছনের দৃষ্টিনন্দন দেওয়াল ও ছাদ অত্যন্ত মনোগ্রাহী। এদের ঘিরে থাকা রংবেরঙের ফুলেরা সমস্ত জৌলুসটুকু জড়ো করে স্বর্গীয় সুন্দর করে তুলেছে আটমাইলের এই জায়গাটিকে।
আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটির জানালায় চোখ রাখতেই অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সাক্ষী রইলাম। এতটুকুও বাধা নেই এখান থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ পাহাড়কে লুটেপুটে নেওয়ার। শুধু চোখদুটো বিছিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। একটা গোটা পাহাড়ের মালিক তখন অপার দৃষ্টিসুখ।সঙ্গে রয়েছে সবুজ বনানী।একটা ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ কেটে গেছিল জানা নেই।
পায়ে পায়ে পথচলা এরপর দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে। রান্নার দোতলা বাড়িটি হোমস্টের একপাশে স্বতন্ত্র ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটির পাশ ঘেঁষে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠে খোলামেলা একটি বারান্দার মতো খাবার ঘর।এর রেলিং ধরে সামনের অপূর্ব পাহাড়ের আর সবুজের গালিচা বিছোনো উপত্যকার দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন দাঁড়িয়ে থাকতে মন চায়।খাবারগুলিও অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পরিবেশন, পরিচ্ছন্নতা, আপ্যায়ন সবকিছুর বিচারে সেরার দাবি রাখে। বিশেষ করে শেষপাতের ডেজার্ট হিসেবে যে কাস্টার্ড ছিল,তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে।
একটু বিশ্রাম নিয়েই ফের সবাই একজোট ওই খাবার জায়গায়। গল্প, হাসি, আনন্দ সহযোগে চা ও টায়ের আড্ডা তখন জমজমাট।মুঠোফোনে সেইসব মুহূর্তদের বন্দী করতে করতে কখন যে আলোর জড়োয়ার গয়নায় গা মুড়েছে পাহাড়ের আনাচকানাচ খেয়ালই করিনি। ভালোলাগায় বিবশ হয়ে শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় সন্ধেবেলার এই পাহাড়ের দিকে। নেপথ্যে আবহাওয়া সাথ দিয়ে চলেছিল বলে সবটা এত উপভোগ্য হয়েছিল সেদিন।এরপর ঘোলাটে রাতের আকাশের গা ফুঁড়ে পাহাড়কে কবিতা শোনাতেই যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিল আধভাঙা চাঁদ।নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করতে করতে মনকাড়া রাতের খাওয়া সারা হলো।এবারও মন জয় করল ডেজার্ট।মায়াবী রাতের আধভাঙা সেই মায়াবী চাঁদের তখনও পাহাড়ের কানে কানে কিছু পংক্তি বলা বাকি।
রাতের বেশিটাই তন্দ্রার ঘোরে কেটে গিয়েছিল। নির্ঘুম চোখ কতবার যে জানালার কাছে গিয়ে পাহাড়কে দেখে দেখে ফিরে এসেছে তার ঠিক নেই। এ সময়টুকু ছিল একেবারে নিজস্ব।মৌনতার মাঝে প্রকৃতির এই সান্নিধ্য ছিল এক অপার প্রাপ্তি।রাত কেটে একসময় আবছা আলোর ভোর এসে হাজির হয়েছিল চোখের সামনে।
পাহাড় ছোঁয়া আকাশের গায়ে তখন রং ধরছে একটু একটু করে। পাখিরা দায়িত্ব নিয়ে জাগিয়ে তুলছে চরাচর।ভোর থেকেই তাদের গল্প শুরু। অবিরাম কথার মালায় জড়িয়ে নিচ্ছে দিক দিগন্তকে। চোখ মেলছে পাহাড়িয়া আলো। আধো আলো আধো অন্ধকারের সেই পাহাড়িয়া গল্পের বেশিরভাগ পৃষ্ঠাতেই পাখিদের ছবি আঁকা।
ঘুম জড়ানো পাহাড় রাতের আদর করে পরিয়ে দেওয়া আলোর নেকলেস খুলবে কিনা সে নিয়ে গড়িমসি করতে করতে একসময় স্নিগ্ধ এক আলোর আবেশ এসে জড়িয়ে নিল তাকে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে কুসুম কোমল এক রোশনাইয়ে পাহাড়কে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দিল।এরপর সদ্য জেগে ওঠা সূর্য কোমল হাতে মুঠোভরা আবির ছড়িয়ে দিল পাহাড়ের গায়ে।আকাশের ময়দানেও তখন রঙের খেলা। ভোরবেলার প্রকৃতি রাঙিয়ে উঠছে এভাবেই।নির্জনতার মাঝে ভোরের আলাপ চলছে শুধু পাখিদের। আকাশ, পাহাড়, পাখির দল জেগে উঠলেও ঘুমে জড়িয়ে আছে হোমস্টের কটেজগুলি।শব্দ, বর্ণ, রূপ, রস গন্ধে প্রকৃতি তাই আরো বেশি নিজের মতো করে সুন্দর তখন।
এই আলোর খেলা চলতে চলতে কখন একপাল উড়োমেঘ এসে পাহাড়কে লুঠ করে নিয়ে চলে যায় কোন নিরুদ্দেশের ঠিকানায়।জানালার ছবিতে তখন দুধসাদা আকাশের একচ্ছত্র আধিপত্য। মনেও হয়না সেখানে সামান্য কিছু আগেও শৈলশ্রেণী তার স্তরে স্তরে মনোলোভা সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজমান ছিল। খামখেয়ালি মেঘের মর্জিতে আবার ডানা ভর করে একসময়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখা পাহাড়ের গা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে সকালের আলোর সংকেতে দৃশ্যমান করে পাহাড়কে। আংশিক মেঘলা এই সকালে মেঘ পাহাড়ের এই অবিরাম লুকোচুরি খেলার সাক্ষী থাকতে থাকতে অপার বিস্ময়ে ছেয়ে যায় মন।তারপর হঠাৎই মুখভার করা আকাশ বৃষ্টিজলে ধুয়ে দেয় আটমাইলের প্রকৃতিকে। সেও এক আলাদা ভালোলাগা। বৃষ্টিস্নাত কটেজগুলি থেকে শুরু করে রকমারি ফুলের দল, চারিদিকের আরামদায়ক সবুজ সবকিছুই আলাদা এক মাত্রা পেল যেন এই বৃষ্টির ছোঁওয়ায়। বৃষ্টি থামতেই আবার রূপসী পাহাড়ের হাতছানি।
জলখাবারের পর্ব সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আটমাইল থেকে।মনের ক্যানভাসে রয়ে গেল কুড়িয়ে পাওয়া সেই আলোর বৃত্তান্ত। প্রকৃতির অকৃত্রিম এই রমনীয়তার কাছে, সকলে মিলে সুন্দর করে কাটানো মুহূর্তগুলির কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম বারংবার।সবুজে সবুজ অরণ্য ঘেরা হোমস্টে, সামনের হাসমুখ পাহাড়,হরেক কিসিমের ফুল ও সহজ সরল অতিথিবৎসল কিছু মানুষ তখন একযোগে আবার ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমাদের।সময়ে ডুলি বেয়ে আমরা তখন আবারও পাহাড়কে পাশে রেখে এবং প্রাপ্তির একরাশ ভালোলাগাকে সঙ্গী করে ফিরতি পথের যাত্রী সবাই।
No comments:
Post a Comment