Sunday, August 3, 2025


 

ধাপ্পা

লীনা রায়


গ্রীন পার্ক সোসাইটি – শহুরে কংক্রীটের জঙ্গলে এক আলাদা পৃথিবী। ঝকঝকে, তকতকে চারদিক। চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তার দু' পাশে কৃষ্ণচুড়া, সোনাঝুরি আর অমলতাস। চারদিক শুনশান। শুধু গাছের পাতায় বাতাসের সর সর শব্দ। গাছের পেছনে সার সার বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে সযত্নে লালিত ফুলের বাগান। এখানকার রাস্তায় ভীড় নেই, যান বাহনের অধিক্য নেই। ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান নেই। অযথা জটলা নেই। নেই স্লোগান, মিটিং, মিছিল। এখানে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট বাড়ি নেই।

এটি একটি অভিজাত পাড়া। বাড়ির সামনের নেম-প্লেট দেখেই তাদের সামাজিক অবস্থান বোঝা যায়। বেশির ভাগ বাড়ির কর্তা গিন্নি সুপ্রতিষ্ঠিত। হাতে গোনা যে কয়েকজন গৃহবধূ আছে, তারা প্রত্যেকে সমাজসেবী। এন জি ওর সঙ্গে যুক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকে। আর সপ্তাহে তিনদিন কিটি পার্টি করে। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হল এদের বয়স মধ্য ত্রিশ থেকে ষাট পার।

এস আর চ্যাটার্জি সোসাইটির নতুন বাসিন্দা। স্ত্রী সুনন্দা, দুই পুত্র আর আধ ডজন পরিচারক নিয়ে তাদের সংসার। সুনন্দা চ্যাটার্জির বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তার ফিগার, ত্বকের জেল্লা চল্লিশের কোন মহিলাকে টেক্কা দিতে পারে। কথা বলার মুন্সিয়ানায় সহজেই গ্রুপের মধ্যমনি হয়ে উঠল সুনন্দা।

সুনন্দার গল্পে বার বার তার স্বামী, সন্তানদের কথা আসে। তার কথাতেই বোঝা যায় সংসারে তার কদর কতটা। তার সুখ সব্বার চোখে পড়ে। প্রথম প্রথম তার মিশুকে স্বভাব সবার মনে ধরে। কিছুদিন পর ওর সুখ, সৌন্দর্য দেখে অন্যদের আফশোস হতে লাগলো। এরপর পালা করে এলো হিংসে আর রাগ। সবার মনে হল সুনন্দা মিথ্যে বলছে। নয়ত তুক তাক জানে।

রহস্য ভেদ করার জন্য তদন্ত শুরু হল। কাজে লাগানো হল বাড়ির পরিচারকদের। খবর যা পাওয়া গেল তাতে কেউ খুশি হতে পারেনি। জানা গেল সুনন্দার ছেলেরা খুব বাধ্য। মা অন্ত প্রাণ। আর গত তিন মাসে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একবারও মনোমালিন্য হয়নি। সবার মনে হলো এমনটা হওয়া অসম্ভব। কাজেই সুনন্দা খুব চতুর আর অভিনয় করে পুরোটা সামলে নিয়েছে এটা সবাই বুঝে গেল।

এরপর চিন্তা ভাবনা শুরু হলো কিভাবে সুনন্দার মুখোশ খোলা যায় সেটা নিয়ে। গোপন মিটিং হল। ঠিক হলো পরের কিটিতে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা হবে। তখন সুনন্দাকে প্রশ্নের প্যাঁচে ফেলে সত্যিটা বের করা হবে। কিটি পার্টিতে খেলা শুরু হল। সুনন্দা কাছে জানতে চাওয়া হল তার জীবনের আফশোসের কথা।

সুনন্দা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে একটু হাসলো। সবার মনে হল সেই হাসিতে বিষাদ মাখা। মনে মনে সবাই খুশি। এবার সুনন্দা বলতে শুরু করল,
–খুব ইচ্ছে ছিল নরওয়েতে হানিমুনে যাবার। মাঝ রাতে সূর্য দেখব ওর পাশে বসে। কিন্তু হয়নি। গিয়েছিলাম সুইজারল্যান্ডে। তবে সেই আফশোস আর নেই। ফার্স্ট এনিভার্সারিতেই আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল।

সবাই চুপ। প্ল্যান ভেস্তে যাবার দুঃখ সবার মুখে স্পষ্ট। কোন রকমে ইচ্ছের বিরুদ্ধে হাততালি দিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করা হলো। এরপর ঠিক হল পরের কিটিতে সুনন্দাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হবে।
পরের কিটিতে সুনন্দা এলো না। যদিও জানিয়েছে ওর অসুস্থতার কথা। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। ওদের মনে হয়েছে হয়ত ও কিছু আঁচ করেছে। তাই মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে আসেনি। পরের কিটিতে কিন্তু সুনন্দা এলো। খাওয়া দাওয়া, তাস খেলায় পার্টি জমজমাট। হঠাৎ গল্পের ছলে একজন সুনন্দাকে জিগ্জ্ঞেস করল ওদের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হয় কিনা। প্রশ্ন শুনে সুনন্দা তো প্রথমে লজ্জা লজ্জা মুখ করে একটু হাসলো। তারপর বলল,
_ওমা, ঝগড়া হয় তো। খুব হয়। তবে ঝগড়া করে একটুও সুখ নেই।
কেউ একজন অবাক হয়ে বলল,
–মানে?
–মি. চ্যাটার্জি একদম ঝগড়ুটে নয় তো।
এতটুকু বলেই হাসিতে ফেটে পড়ল সুনন্দা। হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার দাঁতে, চোখের মনিতে। তারপর ধীরে ধীরে সারা শরীরে। আগে এই হাসিটাই সংক্রমিত হতো সবার মধ্যে। কিন্তু আজ হলো না। একজন বিরক্ত হয়ে তাড়া দিলো। সুনন্দা বলতে শুরু করল।
-আমার রাগ হলে একটু চেঁচিয়ে ফেলি। আর চেঁচালেই আমার রাগ কিছুটা কমে আসে। তখন ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াই।
-তারপর?
-তারপর দশ স্টেপ হাঁটি।
-তারপর?
-গুনে গুনে কুড়ি সেকেন্ড অপেক্ষা করি। তারপর ঘুরে ওর দিকে ছুটে আসি। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ধাপ্পা’……

No comments:

Post a Comment