Sunday, August 3, 2025


 




বিতর্ক–আন্দোলন হয়, প্রতিবাদ হয়

তবু বিচার অন্ধকারেই রয়...


বিপক্ষে 

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য 

৯ই আগস্ট, ২০২৪। সব ব্যক্তিগত লাভক্ষতির তুচ্ছাতিতুচ্ছ হিসেবকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সতেজে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল শহর কলকাতা। আত্মকেন্দ্রিক, উদাসীন, অমানবিক, স্বার্থপর, হৃদয়হীন। দীর্ঘসময়ব্যাপী প্রচলিত এই সমস্ত দুর্নামকে ভেঙে গুঁড়িয়ে আকাশ ফাটিয়ে সমগ্র কলকাতা সেদিন গর্জে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। সরকারি একটি নামী মেডিক্যাল কলেজের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি তরুণী ডাক্তারের হাসপাতাল চত্বরের মধ্যেই ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় সেদিন কোনও রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, বরং সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে মুখর হয়েছিল গোটা কলকাতার আকাশ বাতাস। এরপর সময় গড়াল। প্রতিবাদের ঢেউ আরও আরও শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ল কলকাতা ছাড়িয়ে গোটা বাংলায়, দেশের কোণে কোণে, বিদেশের মাটিতেও। ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে সারা দেশ একসাথে রাত জাগল নতুন অঙ্গীকার বুকে নিয়ে। দেশের স্বাধীনতার সাতষট্টি বছর পর প্রথমবারের জন্য আবারও এক অনন্য স্বাধীনতার আওয়াজ উঠল লক্ষ নারীর গলা চিরে। ‘রাতদখল’ ডাকে সাড়া দিয়ে শহরের রাজপথগুলো ভরে গেল আজকের নারীদের কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার, সুরক্ষা ও স্বাধীনতার দাবিতে। 

উল্টোদিকে ঘটনার মাত্র একদিন পরেই ঘটনাস্থলে কর্মরত কলকাতা পুলিশের সিভিক কর্মী সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় কলকাতা হাইকোর্টে। ৯ই আগস্টের ঘটনার তিন দিন পর কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের তদন্তের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে সিবিআইয়ের হাতে ঘটনার তদন্তভার দেয়। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট, পলিগ্রাফ পদ্ধতি, অন্তর্বর্তী তদন্ত, ফাস্ট ট্র্যাক বিচারব্যবস্থা সমস্ত পেরিয়ে অবশেষে এ বছরের গোড়ায় এসে ১৮ই জানুয়ারি ধৃত সঞ্জয় রায়কে ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে শিয়ালদহ দায়রা আদালত এবং ২০শে জানুয়ারি তার আমৃত্যু কারাবাসের সাজা হয়। কর্মস্থলে মৃত্যুর জন্য তরুণী ডাক্তারের পরিবারকে রাজ্য সরকারের তরফে ১৭ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেওয়া হয়। বিরলের মধ্যে বিরলতম নয় বলেই এ ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সম্ভব নয়, জানান দায়রা কোর্টের বিচারপতি অনির্বাণ দাস। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। তবে এ রায়ের পরেও বিচারপ্রক্রিয়া চলছে এখনও, চলছে তদন্তও। মার্চ মাসের আঠাশে হাইকোর্টে পেশ করা রিপোর্টে সিবিআই জানায় যে বিষয়টি সম্ভবত সাধারণ ধর্ষণ ও মৃত্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সুদূরপ্রসারী এবং বহুধাব্যাপ্ত আর্থিক নয়ছয়, অনিয়ম ও ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ঢাকতেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। গত বছরের ১৪ই আগস্টের রাতদখল কর্মসূচী চলাকালীনই মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ ও ঘটনাস্থলে দুষ্কৃতীদের মদতে ভাঙচুরও সন্দেহাতীত নয়। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর সহযোগীদের পরবর্তীতে পুলিশি হেফাজতও নিঃসন্দেহে বিষয়টিতে গভীরতর ষড়যন্ত্রের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

আসলে গোটা বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষই এ ঘটনায় বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতায় ধৈর্য্য হারাবেন। অভয়া ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেধাবী এক মেয়ে যার গল্প এ বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর ঘরে ঘরে। ফলে তার এই পরিণতি ছুঁয়েছে সেই প্রত্যেকটি মানুষকেই যারা আজও স্বপ্ন দেখে আদর্শ আর মূল্যবোধের জোরে সব অশুভ শক্তিকে একদিন হারিয়ে দেবেই। এ অকালমৃত্যুতে প্রতিবাদের ঢল তাই নাড়িয়ে দেয় বৃহত্তর সমাজকে, গড়ে নতুন ইতিহাস। কিন্তু বাস্তব হল ক্ষমতাবান অশুভ শক্তি যখন তার কায়েমী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে সর্বশক্তি নিয়ে জীবনমরণ খেলায় নামে, শুধু আবেগ দিয়ে সে যুদ্ধে জেতা যায় না। সেকারণেই সকলের চোখের আড়ালে খুব সুচতুরভাবে গায়েব হয়ে যায় যাবতীয় জরুরি তথ্যপ্রমাণ, তদন্তে ইচ্ছাকৃত অসহযোগিতা ও ঢিলেমিতে নষ্ট হয় অমূল্য সময়, প্রকৃত অপরাধী অনায়াসে বেঁচেবর্তে থাকে আইনের ফাঁক গলে। আসলে এ সমস্যা বিচারব্যবস্থার নয়। বিচার হয় আদালতে পেশ করা প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে, দক্ষ আইনজীবীর যুক্তিযুক্ত মারপ্যাঁচের মুন্সিয়ানায়। সেখানে ফাঁক থাকলে বিচারব্যবস্থারও হাত বাঁধা। তবু এ ঘটনার রেশ এখনও যে থেমে যায়নি, আদালতের ভেতরে ও বাইরে হাজারো বিরুদ্ধতার চোখে চোখ রেখে সদর্পে লড়ে চলেছে আজও, সেটাই আশা জাগায় শেষমেষ। দেরিতে হলেও সুবিচার হোক একদিন, ন্যক্কারজনক এ ঘটনাটির বর্ষপূর্তির দোরগোড়ায় এসে এইটুকুই শুধু প্রার্থনা। 

No comments:

Post a Comment