সম্পাদকের কথা
শ্রাবণের জলছবি হারিয়েছি অনেক আগে। এবার বোধহয় বর্ষাকেই হারাতে চলেছি।
জলকষ্টের এই সময়ে সাবধান হতে দেরি হলেও সময় আছে। সময় আছে ঘুরে দাঁড়াবার।
ঘুরে দাঁড়াতে হবে বিভেদকামী সেই সব শক্তির বিরুদ্ধেও যারা দেশের ও দশের সুস্থিতি নষ্ট করছে।
শ্রাবণ আসলে বপনের মাস। ক্ষুদ্র বীজ এই সময়েই মাটির ভেতর গিয়ে সৃষ্টি করে ফসল, জন্ম দেয় মহীরুহের।
এই শ্রাবণে আমরা কি মানবতার সেই বীজ বপন করতে পারি না যা আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে তার সেরা সৃষ্টি নিয়ে সুন্দরতর করে তুলবে?
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৬
এই সংখ্যার প্রথম পর্বে আছেন যাঁরা
উত্তম চৌধুরী, তৈমুর খান, শ্যামলী সেনগুপ্ত, মীরা সরকার, কুমকুম ঘোষ, যাজ্ঞসেনী, সুবীর
সরকার, লক্ষ্মী নন্দী, উদয় সাহা, অপরাজিতা দেবনাথ কর্মকার, পারমিতা ভট্টাচার্য,
সাহানুর হক, অভিজিৎ দাস কর্মকার
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৬
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
ইমেল -
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
স্মরণ
''এমন দিনে তারে বলা যায়''
মীরা সরকার
বাহিরে একটানা বৃষ্টি পাতের ঝর ঝর শব্দ। রোজকার মত বিষন্ন ডাক্তারের শারীরিক পরিভাষা বুঝাইয়া দিতেছে, গতিক সুবিধার নয়। আমার কন্ঠস্বর স্পষ্ট নয়।শরীর বড় বিকল। মাঝে মাঝে চেতনা পাইলে ঘর ভর্তি শুভানুধ্যায়ীদের বিমর্ষ মুখের দিকে চাহিয়া কত কী যে জানিতে চাই।
আর কত দেরি ? আমার মন যেই নিঠুরের গোপন ভালোবাসায় আবিষ্ট তার মিলন চাই যে আজ। কোন উত্তর পাই না। সকলেই আমার মরদেহ খানি অমর করিয়া রাখিতে চায়।এই ন্যুব্জ বিকল দেহখানির অমরত্ব তো আমি চাই না। যদি স্বেচ্ছায় বিচরণ নাই করতে পারিলাম ,যদি একটি আরাম কেদারায় ঠেসান দিয়া শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটা উপভোগ না করিতে পারি তবে এর মায়া ছাড়াই ভালো।
কিন্তু তা হইতে দিলে তো? প্রিয় জনের পরিচর্যা ছাড়া চলার ক্ষমতা যে আমার আর নাই সে জানি। তাই তো জড় বস্তুর মতো এই শরীর খানি উহাদের হাতে ছাড়িয়া দিয়াছি। উল্টাইয়া পাল্টাইয়া নাহাইয়া ধুইয়া উহাদের যাহা মনে আসে করিতেছে । কতবার সরবে অথবা নীরবে শুধাইতেছে আমি কেমন আছি ।
কেমন আছি আমি? প্রিয় কলম খানি কতদিন স্পর্শ করি নাই কেননা সে শক্তি এ শরীরের আর নাই, তবে কি করিয়া ভালো থাকিব? সেই ভাব সমৃদ্ধির মহাসমারোহ স্তিমিত হইয়া গিয়াছে ।শেষ লেখা লিখিয়াছিলাম "আজি আমার প্রণতি গ্রহণ করো পৃথিবী , শেষ নমস্কার অবনত দিনাবসানের বেদিতলে" ।
কবেকার কোন দূরায়ত অতীতের অজস্র কাব্য রাশির অনর্গল স্রোত আজ স্তব্ধ । বিস্মৃতপরিচয় পরিজনের মত অনেকদিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরিতে চায়। সে কোন পথে যে এলো আমি দেখিতেও পাই নাই।
কখন যেন চেতন অবচেতনের পথ বাহিয়া আমি কোন বালক বেলায় ফিরিয়া যাই।এই রোগতপ্ত ললাটে একটি কোমল স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শের জন্য তৃষিত হৃদয়ে অপেক্ষায় থাকি।
ওগো ,বহু দীর্ঘ দিন ক্লান্ত প্রতীক্ষায় আছি এ পথের শেষ কোথায় জানিতে চাই। ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো। এই দুঃখ যাপন আর নয়।
সে কি আসিবে ? খুঁজিবে আমায় সেই দক্ষিণের ঘরে ? জানি পাইবে না। সেই প্রাণের সখাটির সেই রূপ আর নাই ।সেই চির কিশোর বঁধুয়া তোমার সাথে সাথে চিরদিনের মত হারাইয়া গিয়াছে। অশ্রুনদীর সুদূর পারে আধো আলো আঁধারিতে তার বাস।
নতুন বৌঠান ,হ্যাঁ তুমি আমার নতুন বৌঠান।আমার জীবনে আসিয়াছিলে কাঁচা বয়েসের পেলব রূপটি নিয়ে ।"এনেছিলে আমার হৃদয়ের প্রথম বিস্ময় । জমে উঠেছিল আমাদের খেলাঘর। বহু লোকের সংসারের মাঝখানে চুপিচুপি তৈরি হয়েছিল আমাদের দুজনের নিভৃত জগৎ। "
তারপর কী হইল নতুন বৌঠান?"একদিন আমাদের স্বপ্নের নৌকো-বাওয়া থেকে তুমি কখন যেন একলা গেলে নেমে।সহসা জীবনের #তুমুল জোয়ারে আমি গেলাম ভেসে।তুমি ওপারে কোথায় যে হারিয়ে গেলে। আমাদের খেলাঘর গেল ভেঙ্গে । "কিন্তু তুমি যে আমার চিরবন্ধু, চির নির্ভর, চিরশান্তি।তোমার কাছে গচ্ছিত রহিয়াছে আমার অমূল্য রতন ।
আমি সম্পূর্ণ বদলাইয়া গেলাম।আমার উৎসারিত প্রাণশক্তি আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মত আমার সমস্ত প্রাণ, আত্মা, হৃদয়,শরীর নিংড়ে সৃষ্টির এক উৎসে পরিণত হইল।সারা জগতের ইচ্ছা, আনন্দ,বেদনা যেন অমৃতের স্রোত ধারা হইয়া গেল।
কিন্তু নতুন বউঠান, আমার সকল সৃষ্টি একদিকে আর তুমি একদিকে ।আমার অন্তর বুঝিতেই চাহিল না আমাদের সেই সামান্য খেলাঘরের বাসরটি আর পাওয়া যাইবে না।এ সকল সৃষ্টি আর কিছুই নয়। আমার আহত আত্মার অনন্ত রোদন। আমার গানে,গল্পে,ছবিতে,সর্বত্র শুধু তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখিবার আকাঙ্খা।তুমি দেখিবে ,তুমি শুনিবে। নহিলে সকলই শূন্য ।
আমি সমস্ত আকাশ, বাতাস,ভুবন ব্যেপে শুধু তোমার চোখের চাওয়ার হাওয়া ।যেন অশ্রুনদীর সুদূর পারের আলো আঁধারের ইশারা তোমাকে আষাঢ়ের সজল ছায়ায় কোন এক লোকে টানিয়া নিয়া যায়। আমি আমার সৃষ্টির সহস্র বাহু বিস্তারিত করিয়াও তোমার নাগাল পাই না।
ওগো ছায়াময়ী নতুন বৌঠান, তোমার মলিন দুঃখী অস্তিত্ব এই শ্রাবণের বুকের ভিতর জমা হইয়া আছে। আমার "হৃদয়ের দুকূল ভেসে যায়। "আর কি মিলবে না তোমার হাত আর আমার হাতে ?জানি দীর্ঘ জীবন এক অপরিচয়ের প্রাচীর তুলিয়াছে ।
মনে হইত হাহাকার করিয়া বলি "তুমি কি আছো আমার অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিবার জন্য?"এই সৃষ্টির সম্ভার তুমি জানো তোমার জন্য অন্য অর্থ বহন করে। পৃথিবীর কেহ তাহা জানিবে না।
আজ রোগশয্যায় অন্তিম শয়নে বারে বারে নিরন্তর এক সংশয়ে থাকি তোমার চির অপেক্ষমান কিশোর বঁধুয়ার হাতখানি কি শেষবারের মত ধরিবে না? তোমার রথ আসুক না আজ আমার দুয়ারে। এই ধাবমান কালের রথে তুলিয়া কি নিবে না মোরে, জীবনের সিন্ধুপারের শেষযাত্রায়।?
ওগো নতুন বৌঠান তোমার কাঁকন পরা শ্যামল দুখানি হাতে আজ আমার চির অপেক্ষমান হাত দুখানি সঁপিয়া দিতে চাই ,বড় দীর্ঘ এ জীবনের শেষ ক্ষণে।
''তবু অনন্ত জাগে''
কুমকুম ঘোষ
...."তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা
বসন্ত নিকুঞ্জ আসে বিচিত্র রাগে"
২৫শে জুলাই,১৯৪১ সাল শুক্রবার রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো তাঁর সাধের ও সাধনার আত্মাভূমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে এলেন জন্মভূমি কলকাতায়। অপারেশন এ তাঁর আপত্তি ছিল, পছন্দ করতেন বায়োকেমিক, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। সে বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মত ছিল----"শনি যদি আমার মধ্যে রন্ধ্র পেয়েই থাকে - তাকে স্বীকার করে নাও। মিথ্যে তার সঙ্গে যুঝে লাভ কি। মানুষকে তো মরতে হবেই একদিন। একভাবে না এক ভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ।ক্ষতি কি তাতে? মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?(#গুরুদেব--রানী চন্দ)।
তবু কাছের লোকজন ও ডাক্তারদের পরামর্শে (মতভেদ থাকলেও) তাঁকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে আসা হলো,কবি এলেন তাঁর পিতৃ-পিতামহের গৃহে, যেখানে ভেতরের এক ঘরে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন আশি বছর আগে। কবিগুরুর এই প্রত্যাবর্তনের খবর গোপন রাখা হয়েছিল তাই হাওড়া স্টেশনে জনসমাগম ছিলনা। তিনি এলেন এবং তাঁকে জোড়াসাঁকোর "পাথরের ঘর" এই রাখা হলো।এটি একসময় ঠাকুরবাড়ির "বসার ঘর" হিসেবে ব্যবহার হতো।
পুরাতন কে বিসর্জন দিয়ে নবীনের আবাহন তাঁর লেখায় বারে বারে ফিরে এসেছে তাই "অপারেশন" করিয়ে পুরনো শরীরকে পালিশ ও নব উদ্যম দেবার যে আয়োজন সেসময় তাঁকে ঘিরে চলেছিল তাতে তাঁর সায় থাকেই বা কি করে।রানী মহালানবিশ এর "বাইশে শ্রাবণ" স্মৃতি গ্রন্থেও কবির সেই মনোবাঞ্ছা র কথাটি ধরা আছে----"গাছ থেকে শুকনো পাতা যেমন আপনি ঝরে যায় , পক্ক সুপারি যেমন বৃন্ত থেকে আপনি খসে পড়ে , আমারও ঠিক তেমনি ভাবেই সহজে বিদায় নেবার ইচ্ছে চিরকাল"।
.... "তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে".......
তবু, তোরজোর চলতে লাগলো। কবিকে সঠিক দিন জানানো হয়নি ,প্রত্যেকেই এড়িয়ে যান কবি অপারেশন এর প্রসঙ্গ তুললেই।
#২৬ শে জুলাই ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ এর সাথে গল্প করেন কবি।হাসি ঠাট্টা পুরনো দিনের কথা বলেন আর হাসেন আশি বছরের কাকার সাথে সত্তর বছরের ভাইপো। বিকেলের দিকে তাঁকে গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।কবি কষ্ট পান বেশ।জ্বর আসে তাঁর, কাঁপতে থাকেন তিনি।দুই রানী( রানী মহালানবিশ ও রানী চন্দ) এবং আরও কয়েকজন কবিকে কম্বল চাপা দিয়ে ধরে রাখেন। অবশেষে কবি ঘুমিয়ে পড়েন।
পরদিন #২৭ শে জুলাই। সকালে উৎফুল্ল কবি মুখে মুখে কবিতা রচনা করেন "সকাল বেলার অরুণ আলোর" মতো--"প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে --
কে তুমি?
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়---
কে তুমি?
পেল না উত্তর।।
রানী চন্দ লিখছেন --"কবিতার কয়েকটা জায়গায় বলে বলে কাটাকুটি করালেন"। তারপর শোয়া অবস্থাতেই দেখলেন লেখাটি ও কয়েকটি শব্দ পাল্টে দিলেন। শুনতে চাইলেন নিজের লেখা কবিতা--"বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়"।
ওদিকে "পাথরের ঘর" এর পূর্বদিকের বারান্দায় "অপারেশন থিয়েটার" বানানো হয়েছে।কবিকে কিছুই জানতে দেওয়া হয়না।
#২৯শে জুলাই বিকেলে রচনা করলেন আরো একটি কবিতা।রানী চন্দ ( কবি তাঁকে দ্বিতীয়া বলতেন, প্রথমা বলতেন রানী মহালানবিশ কে) সেটি লিখে নিলেন--"দুঃখের আঁধার রাত্রি"। সেখানে কবি জীবনের "এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক" এর কথা লিখলেন।
কবিতাটি বলা শেষ হলে আপন মনেই বললেন--"ভয়কে ভয় করলেই ভয়"।
সেদিন এমনকি অপারেশন করানোর ব্যাপারে কিছু জানতেও চাইলেন।যা হবার তাড়াতাড়ি হোক--এই ছিল তাঁর মত।সবাই জানতো সেটা পরদিনই।
পরদিন #৩০শে জুলাই । রবীন্দ্রনাথ সকালবেলায় তাঁর "দ্বিতীয়া" রানীকে মুখে মুখে বললেন জীবনের শেষ সৃষ্টির বাণী বন্ধ সমূহ---১৪ই শ্রাবণ,১৩৪৮ সাল।রচিত হলো--
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী!
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছে নিপুণ হাতে
সরল জীবনে!
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।"
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে-ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভান্ডারে।
দীর্ঘ কবিতা টি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন কবি। চুপ করে গেলেন। আবার সাড়ে ন'টার সময় তাকে ডেকে কবিতার শেষ তিনটি চরণ বললেন---- "অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।।"
বেলা দশটায় বৌমা প্রতিমা দেবীকে চিঠি লিখলেন কবি।ড্রাফট দেখে কাঁপা হাতে সই করলেন "বাবামশায়"।
সেদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় কবিকে অপারেশন থিয়েটারে তোলা হলো। লোকাল অ্যানাসথেসিয়া করে সমাধা হলো পুরো কাজটি।কবির কষ্ট হয়েছিল খুব কিন্তু পাছে অন্যদের অসুবিধা হয় তাই এতটুকু শব্দ করেন নি।ক্লান্ত শ্রান্ত কবিবর কে আবার আনা হলো ঘরের মধ্যে।
এত কষ্টের মধ্যেও কবি নাকি হাসি ঠাট্টার সুরেই কথা বলেছিলেন সেদিন। এমনকি যে ডাক্তার (ডাঃ ললিত বন্দোপাধ্যায়) তাঁর অপারেশন করেছিলেন তিনি ব্যথা লেগেছে কিনা জানতে চাইলে বললেন--"কেন মিছে- মিথ্যে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে"(গুরুদেব: রানী চন্দ)।
.."ছুটির বাঁশি বাজাল যে ওই নীল গগনে
আমি কেন একলা বসে এই বিজনে।"...
#৩১শে কবি অল্প কথা বললেন--
#১লা আগষ্ট কবি কোন কথাই বললেন না।
#২রা আগষ্ট আবার কথা বললেন, রানীকে বকলেন।একজন ডাক্তার জানতে চাইলেন -কি কষ্ট হচ্ছে আপনার?
"গুরুদেব স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললেন, এর কি কোন বর্ণনা আছে?"সেদিন দুপুর থেকেই কবি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
#৩রা প্রতিমা দেবী কলকাতায় এলেন। ডাক্তারের আনাগোনা তো চলছেই। একইভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন কবি পরদিন ও।
#৫ই আগষ্ট ডাঃ নীলরতন সরকার(তিনি অপারেশন এর বিরুদ্ধে ছিলেন)কে নিয়ে এলেন ডাঃ বিধান রায়। যতক্ষণ তিনি ছিলেন অচেতন কবির ডান হাতের ওপর নিজের হাতটি বোলাচ্ছিলেন পরম মমতায়। সেই মুহুর্তের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ রাণী চন্দ দিয়েছেন : "যাবার সময়ে সার নীলরতন গুরুদেবের মাথার কাছ পর্যন্ত এসে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন, গুরুদেব কে আবার খানিক দেখলেন, তারপর দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেলেন।কি তাঁর মনে ছিল কি জানি! কিন্তু যাবার সময়ে তাঁর ঘুরে দাঁড়িয়ে গুরুদেব কে আর - একবার দেখে নেবার ভঙ্গিটির মানে যেন অতি স্পষ্ট হয়ে গেল আমাদের কাছে।"
পরদিন ৬ই আগষ্ট। পূর্ণিমা। জোড়াসাঁকোর বাড়ী সেদিন লোকারণ্য।সবাই কবির সংবাদ জানতে চান।
"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।"
২২শে শ্রাবণ,১৩৪৮ : সকাল হলো। পূর্ব দিগন্তে অরুণ আলোক রেখা দেখা দিলো। কবির শয্যার পাশে তাঁর সুহৃদ-স্বজন আশ্রমিক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কেউ উপাসনা করছেন,কেউ মন্ত্র পাঠ করছেন--ওঁ পিতা নো'হসি , পিতা নো বোধি"। বারান্দা থেকে মৃদু কন্ঠে গান ভেসে আসে--" কে যায় অমৃতধামযাত্রী"।
বেলা ন'টার সময় অবস্থা দেখে কবিকে অক্সিজেন দেওয়া শুরু করলেন ডাক্তাররা। কবির নিঃশ্বাস সেই একই রকম ক্ষীণ।ক্রমে সেই ক্ষীণ শ্বাস ক্ষীণতর হয়ে যেতে লাগল। কবির পায়ের উষ্ণতা ও কমে আসতে লাগল।
বেলা ১২ টা বেজে ১০ মিনিট। কবি অমৃতধামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
শ্রাবন ২২
যাজ্ঞসেনী
আকাশে থমকে আছে এলোচুল কালোমেঘ। এত মানুষের কান্না জমে গিয়েছে আকাশে যে, বৃষ্টি অপেক্ষা করছে বুকে বাঁধ বেঁধে। কিন্তু, তার ভিতরটা ভেঙে যাচ্ছে দমকা হাওয়ার মত।
কবি শুয়ে আছেন ধ্যানমগ্ন। যেন একটু পরই জেগে উঠে বলবেন, বাতাসে এত বিষণ্ণ ধ্বনি সমাগম কেন? কিন্তু, পার্থিব মৃত্যু শুধু তাঁকে বিছিন্ন করেছে শরীর থেকে। অবিচ্ছিন্ন তাঁর সৃষ্টিরাও ঈষৎ বিষণ্ণ। তারা মৃত্যুহীন। অথচ মৃত্যু কেড়ে নিয়ে গেল স্রষ্টাকে।
কবিকে কে যেন একটি চিঠি লিখেছিল অমলিন মনের লেখনীতে। সেই চিঠিটি হঠাৎ নিজে থেকে বাতাসে উড়ে গেল নিরুদ্দেশ পথে। বিষণ্ণ বাতাস ক্ষীণস্বরে বলল, হে প্রণম্য, বিদায়।
" যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে"
অপরাজিতা দেবনাথ কর্মকার
১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবন।জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির বাইরে সে সময় তখন জনসমুদ্র।সারা কলকাতা যেন ভেঙে পড়েছে সেখানে।কবির মহাপ্রয়াণের খবর বেতারে ছড়িয়ে পড়া মাত্র শহরের নানা প্রান্ত থেকে এসেছে শোক মিছিল।বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে নিবেদন করতে এসেছে শেষ শ্রদ্ধা।অধৈর্য জনতার কোলাহল বেড়েই চলেছে-তাঁরা কবির শেষ দর্শন লাভের জন্য উন্মুখ।
বেলা সাড়ে তিনটে পর্যন্ত চলে শোকার্ত জনতার শ্রদ্ধা নিবেদন।দুপুর সাড়ে বারোটায় ' আকাশবাণী ' গুরুদেবের দেহাবসানের খবর ঘোষণা করে-তারপর রাত্রি পর্যন্ত আকাশবাণীতে চলে রবীন্দ্র-প্রণামের অনুষ্ঠান।নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় তাঁর স্বরচিত কবিতা-গান ' ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে '।বীরেন্দ্রনাথ ভদ্রের আবৃত্তি শ্রোতাদের আরও শোক বিহ্বল করে তোলে।
বেতারে এবং পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় মৃত্যুখবর পাওয়া মাত্র বন্ধ হয়ে যায় হাইকোর্ট,মহাকরণ,কর্পোরেশন, বিভিন্ন রেল-দপ্তর,সমস্ত শিক্ষায়তন,দোকান-বাজার,ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান,সিনেমা ও খেলাধুলা।অগণিত মানুষের গন্তব্যস্থল তখন জোড়াসাঁকো।
প্রচন্ড রোদ উপেক্ষা করেও কবির শেষ বিদায় লগ্নে লক্ষ্য লক্ষ্য লোকের ভিড় নামে রাস্তায়।যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই শুধু লোকের মাথা।
শোকযাত্রার পথ নির্দিষ্ট হয়েছে এইভাবে-আপার চিৎপুর রোড-বিবেকানন্দ রোড-চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-কলুটোলা স্ট্রিট-কলেজ স্ট্রিট-কর্নওয়ালিস স্ট্রিট-গ্রে স্ট্রিট-বি কে পাল এভিনিউ হয়ে নিমতলা।এ-সব পথ তখন লোকে লোকারণ্য।বাড়ির ছাদে,অলিন্দে ও গাড়ি বারান্দায় শুধু মহিলাদের ভিড়।সেখান থেকে শোনা যাচ্ছে শঙ্খধ্বনি,ছড়ানো হচ্ছে খই আর গোলাপ জল,সেইসঙ্গে ঝরে পড়ছে রাশি রাশি ফুলের তোড়া আর মালা।
শবযাত্রায় শবাধার বহনের জন্য সে সময় কাড়াকাড়ি পড়ে যায়-একদল কাঁধে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দল এসে কাঁধে তুলে নেয়।সমগ্র পথ 'বন্দে মাতরম' ও 'রবীন্দ্রনাথ কি জয়' ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে।কোথাও আবার রৌদ্রপীড়িত ঘর্মাক্ত শোকযাত্রীদের উপরে বালতি ভরা জল ঢেলে দেওয়া হয়েছে কিংবা বিলি করা হয়েছে হাতপাখা।বন্ধ হয়ে গেছে যানবাহন চলাচল।
এরপর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট থেকে শবযাত্রা গ্রে-স্ট্রিট ও বি কে পাল এভিনিউ হয়ে নিমতলা শ্মশান ঘাটে যখন পৌঁছায় তখন বিকেল ৫-৪০ মিনিট।সে সময় সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়।কলকাতার নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই এসেছেন রৌদ্রতাপ ও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে।
প্রচন্ড ভিড় সামলে অবশেষে ঘণ্টাতিনেক অপেক্ষার পর রাত্রি সওয়া আটটা নাগাদ শেষকৃত্য আরম্ভ হয়।পাঁচমন চন্দন কাঠ দিয়ে সাজানো হয়েছে চিতা, সেইসঙ্গে রাখা হয়েছে দু'মন ঘি আর দশ সের সুগন্ধী উপকরণ।এখানে উল্লেখ্য কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ অন্তঃষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হতে পারেননি।অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি শ্মশানের দিকে রওনা দিলেও প্রচন্ড ভিড়ের জন্য সেখানে পৌঁছতে তো পারেনইনি-উপরন্তু তাঁর অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় মাঝপথ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়।তাই মুখাগ্নি সম্পন্ন করেন কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র ও সুরেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুবিরেন্দ্রনাথ।তাঁকেও শ্মশানে আনা হয় নদীপথে নৌকায়।আদি ব্রাহ্মসমাজের নিয়মানুসারেই সম্পন্ন হয়েছে শেষকৃত্য।আকাশে কখনও মেঘ,কখনও চাঁদ।রাত্রি ন'টা নাগাদ নেমে এসেছে ধরিত্রীমাতার অশ্রুস্বরূপ বৃষ্টিধারা।কিন্তু তাতে চিতার আগুনের কোনও ক্ষতি হয়নি-বিন্দুমাত্র কমেনি তার তেজ,যে দেবোপম দেহের রূপে ও সৌন্দর্যে বিশ্ববাসী মুগ্ধ ছিল তাঁকে সে ভস্মীভূত করেছে।
কবিতা
কালজানি নদীটিও
উত্তম চৌধুরী
সে অনেক কথায় কথায় বৃষ্টি নামে গানবাড়িছাদে
রোদে রোদে ছিল যে পাখিরা ভিজে ওঠে মেঘের আবাদে।
তারপর আমরাও ভিজি
ভিজে ওঠে রাতের শরীর,
মুখোশের গলি ছেড়ে দিয়ে
উঠে আসি আলোপথে ধীর।
সে অনেক ভুলভাঙাপথে নদীগুলো ছুটে ছুটে আসে,
চোখে মুখে আদর ছিটিয়ে তুলে নিই হৃদয়ের পাশে।
তারপর যে যেদিকে পারে
খুলে দেয় আলোর ঠিকানা,
সারারাত আবেগরেখায়
অলিগলি সব হয় চেনা।
সে অনেক জারুলপলাশ এঁকেছিল ছবির শহর,
আজ সব অতীত সরণি, ঝুঁকে আছে চিলেকোঠাঘর।
তার কিছু গল্প আমি জানি
আর জানে বোধিবৃক্ষটিও,
কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া জানে
আর কালজানি নদীটিও।
তিনটি কবিতা
তৈমুর খান
১
এবাগানে ফুল ফুটবে
এবাগানে হলুদ রঙের সব পাতা
এবাগানে পাখিরা ডাকে না ;
তবু রোজ বসন্তকে ডাকি
এলোকেশী বাসন্তীর ঘরে
আলো জ্বেলে রাখি।
সমীরণ, খেলে যাও —
হৃদয় এখনও মরেনি
এখনও কোকিল জেগে আছে
শুধু কোকিলকণ্ঠ নেই
এখনও নৈঃশব্দে মর্মরিত হয় ভাষা
এবাগানে ফুল ফুটবে
শুনে যাও নিহিত বারতা।
২
শ্রাবণকুমারী
আমাদের একফালি ছাদেই আকাশ নেমে আসে
শ্রাবণের কুমারী আকাশ —
তার অদৃশ্য নূপুরশব্দে জেগে থাকি সারারাত
আজ মন যদি ভিজতে চায়
ওকে ভিজিয়ে নেবো —
ফুলের গন্ধের মতো ফুটুক হৃদয়...
বিবাহ
ঘরে ঘরে বেজে উঠছে শাঁখ
শ্রাবণ সন্ধ্যায় আমার বিবাহ হল
মেঘকুমারীর সাথে
জলে জলে সঙ্গম ছয়লাপ
চারিদিকে শব্দ ছড়িয়ে যায়
সন্ধ্যামাখা শব্দের আলোতে
মেঘের সংলাপ ঝরে বৃষ্টির ফোঁটায়
আমাকে ভেজাতে আসে মেঘকুমারীরা
অবলীলা এখানে পড়ে থাকে
জাগরণে ঘুমের বাতাস বয়ে যায়
শ্রাবণবিছানা জুড়ে জলীয় বিলাস
আমাকেও উষ্ণ করে আসঙ্গ লিপ্সায়
বাদল মেঘের নিচে লেখা কবিতা
সুবীর সরকার
তুমি ঝড়ের মত এসেছিলে।তুমি জঙ্গী শিবিরের মত এসেছিলে
তুমি তান্ডব হয়ে ঢুকে পড়েছিলে আমার
ভেতর
আমি আকুল হয়ে চেয়েছিলাম ভারী
বর্ষণ
শ্যওরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কেমন শিউরে
উঠেছিল আমার গা
হালাউ হালাউ দুধের ঘটি
চা ফ্যাক্টরির মূল গেট
সতীশের হাটের নিঃসঙ্গ লণ্ঠন
বারবার মৃত্যুর মুখে থেকে ফিরে আসা এক
তান্ত্রিক আমি
প্রতিদিন রুমাল বদলাই
আমার ঠোঁটের শিস ডেকে আনে মাঠের সমস্ত
ফড়িং
লন্ডভন্ড করে দেব শপিংমল
চুরমার করে দেব বিউটি পার্লার
লাল করে দেব সমস্ত সবুজ
সিগন্যাল
মাতালের মাথা থেকে উড়ে যাওয়া টুপি
বৃষ্টির মধ্যে মিশিয়ে দিচ্ছি রূপকথাগুলি
হাউজওয়াইফেরা আসলে তো লিরিকাল
ব্যালাডের মত
বিতর্করেখার নীচে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সব
পুরোন প্রেম
তুমি মিউজিক শুনছো স্নানাগারে
নদীজলে মিশে যায় মহার্ঘ এপিক
দেওয়াল জুড়ে স্প্রে প্রিন্ট ...
উদয় সাহা
সমুদ্র যতই ভেঙে ফেলুক সাঁকো
সবটা জুড়ে তুমিই জেগে থাকো...
(১)
আমার আপাদমস্তক নাগরিক বর্ম।ভেতরে আবহমান গ্রাম্যজীবন। রাতের অন্ধকারে এখনো জ্বালাই মোমবাতি। সেই মোমের আলোতে ফুটে ওঠে কাদায় আটকে যাওয়া এক নৌকোর কথা। আকুল তৃষ্ণায় আগুন চোখে এক মাঝির কথা। আমার যাতায়াতের পথের পাশে এখনো বেঁচে আছে ছবি না হওয়া ছবি সব--- ঘুঘু ডাকা দুপুর, পলাশের কুঁড়ি, ব্যাকরণহীন পুকুরপাড়, জেলে বৌ, অলীক জ্যোৎস্না, ঝাঁকি জাল। সেই মাঝি দুপুর হলে চাঙরায় বসে খবরের কাগজ পড়ে। আমার লিখতে না পারা কবিতা আর সেই বুড়ো মাঝির প্রিয় স্বপ্নগুলোর মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে । আমরা দু'জনেই ব্যর্থ। আমরা বিলাপ করি সকলের অগোচরে। আমরা চেষ্টা করছি সাধ্যমত শীতের পোশাক কিনবার।
(২)
'যীশু চোখ মারলেন শ্রীকৃষ্ণকে... ' আমাদের উঠোনে কালো মেঘের মহড়া চলে সারাবছর। একটা আপোষ, একটা বোঝাপড়া, একটা বন্ধুত্ব এখানে রামধনুর মত। নান্দনিক। আনন্দীবৈঠা। শ্যাম্পেনের ফোয়ারায় প্লাবিত হয় শীতের সব বকুলফুল। লক্ষণরেখার কনসেপ্ট থেকে বছর শেষে কোন সুদ আসেনা। তাই চোরকাঁটা লাগবার ভয়। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের জন্য তৈরি করেছি ভিন্ন রঙের ভিন্ন ঢঙের লাইন অব কন্ট্রোল।
(৩)
আমাদের বাড়িতে দুধ দিয়ে যায় যে ' মাসি ', তিনি কী সুন্দর করে বাড়িতে এসে মা-কে ডাকেন, " মউসি দুউউধ... " আর আমার মা সেই সুরেই প্রত্যুত্তর দিয়ে বলেন, " আয়ি মউসি "...
তবুও থামেনা গুলির আওয়াজ। বন্ধ হয়না ভাঙা সেতুর গান।আসন পেতে রাখা খাবার জায়গায় হঠাৎ মেঝেতে কেউ ঢেলে দেয় কলসির জল। বুকের বাম দিকে ভেজা পাটের গন্ধ, চড়ুইভাতি। বুকের ডান দিকে পোড়া ডিজেল, বিস্ফোরক বারুদ.... একটা ককটেল।
(৪)
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিল। শান্ত দৃশ্যে ভিড়ে গেছে রক্ত। আর জলে মিশে গেছে দুধ। আমরা হয়ে উঠছি প্রাপ্তবয়স্ক। কোলবালিশ একটা ভালোলাগার বস্তু । তাই আমাদের দু'পাশে দুটো নৌকো। আমরা জানিনা কোন নৌকোতে রাখবো দেশের মান, দেশের মেয়ে, দেশ মা...
(৫)
শিক্ষক মশাই কালো বোর্ডে বেশ বড় বড় করে দুটো বাক্য লিখলেন--মানুষ মারা যাচ্ছে ; মানুষ তো মারা যাচ্ছে রোজই। এরপর প্রবল হাওয়া শুরু হয়। সব জানলা দিয়ে শুধু হাওয়া আর হাওয়া। তুফান আছড়ে পড়ে। শিক্ষক মশাই এবার বোর্ডে লেখেন ---- লবণ আন্দোলন। আমাদের কপালে গুড়ো গুড়ো নুন। শক্ত হয় আমাদের মুঠো।
(৬)
আঙুল তুলে কথা বলে কালো কোট।আমরা ডুবে যাই পালং শাকের খেতের মায়ায়। তবু--
"জননীর কাঠের ভিতরে
রক্ত পড়ে।
উল্লাসের আছে কিছু বেড়া।
হেমন্তের চেনাঘর আছে আধো টেরা।
অনন্ত বাহিরে
রক্ত পড়ে।
রক্ত পড়ে দুর্গাপ্রতিমায়।
এখন সহজে, সবই যায় ----
রক্ত পড়ে দুর্গাপ্রতিমায়। "
দূর থেকে শাহজাহান দেখছেন তাজমহল। আর আমি দেখছি বৈরাগী সাধু চলেছেন নিকটস্থ মসজিদের দিকে...
ছুটি শেষে
পারমিতা ভট্টাচার্য
গেরস্থালি ফাঁকা ক'রে দিয়ে চলে গেল।
আজ দেড়টার ট্রেন, ...লেটও ছিল না !
এবার মাসখানেক হইচই ...গরমে হস্টেল ছুটি থাকে।
লাগেজ অনেক বেশি,..সবটা কি নিয়ে যাওয়া যায়,
একবারে?
খুচরো ছুটিতে এসে নিয়ে যাবে'খন !
অথবা, আমরা যদি.. যেতে পারি,...ওর শহরেতে....
আপাতত রেখে যাওয়া খুচখাচ বাক্সে গোছাতে
বিড়বিড় ; ―জামাগুলো আলমারি ভরে ,জুতোজোড়া স্যাঁতস্যাঁতে, র্যাকে রাখি ;
গায়ের গন্ধটা.....কী করি?কী করি?
হতভম্ভ বসে থাকি!
সারাঘর জুড়ে বই,
চাওয়া
সাহানুর হক
চুপ থেকেও কথা বলা হয়ে যায়
কখনো দুচোখের পলকের বিরতিক্ষণে
কখনো ভীতু নিঃশ্বাসের ঘন ঘন ছন্দে
কখনো রক্তরাঙা ঠোঁটের পয়লা স্পর্শে
এভাবে দূরত্ব কমে, ঘনত্ব বেড়ে যায়
কাছাকাছি, পাশাপাশি এভাবে থাকা যায়
এক বছর,দু বছর,চাইলে হাজারটা বছর !
তোকেঃ ১২
অভিজিৎ দাসকর্মকার
... নষ্ট নয় ঘাম ঝরিয়েছি,
প্রতিটি ফোঁটাই তোর নামে লেখা_____
বৃষ্টি আসুক ; অনর্গল আছড়ে পড়ুক...
অন্ধ-আলোর দরজার পাশে জড়িয়ে ধরুক ২টি অবয়ব আর বাতাস খেলুক নিঃশ্বাসে ___
আজ নীল রুমালটা দিস____
কারণ আগে তো এমন হয় নি-
দীর্ঘপথ একাকিত্বেই অপচয় হয়েছে
চিল্কা নামক বস্তুটি যতবার পায়ে এসে পড়েছে___
রাস্তার মাঝখানে বসে গেছে আচ্ছন্ন যৌবন__
তাই হয়তো বটগাছ আর আমার ছায়া ভারই লাগে____
হে ভগবান দিব্বি করে বলো?----
তখন আমার ১৮ বছরের তাৎপর্যে কি উপন্যাস লেখা হোত?
স্বাধীনতা
আমার মুক্তি
শ্যামলী সেনগুপ্ত
সেই অপার-আনন্দ বেলায় ঘুম ভেঙে দেখতাম বেশ একটা অন্যরকম হাওয়া বইছে । বিরাট লম্বা সেই বাঁশটা যেটা সারাবছর চালের ছাঁচায় চারটে লোহার কড়ায় বন্দি হয়েথাকে সেটা মুক্তির আনন্দে যেন চকচক করছে । বাবা সুতলি পুলি এসব নিয়ে ব্যস্ত, বাবার সহকারীর হাতে সেই তেরঙ্গা কাপড়।সুতরাং দিনটি বিশেষ একটা দিন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তারপর গাঁদাফুলের পাপড়ি দিয়ে কেউ একজন আল্পনা দিতে বসতো । ফুল ছাড়িয়ে ঝুরো বানানোর দায়িত্ব ছিল আমার । তাড়াতাড়ি স্নান করে সুন্দর জামা পরে বসে যেতাম ফুলের ঝুরো বানাতে । একটা অদ্ভুত হাওয়া বইতো । রেডিওটা বেশ জোরেই চালিয়ে দিতো বাবা---'কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট- -' কেমন যেন অদ্ভুত একটা চাঞ্চল্য তৈরি হতো । বুঝতাম না , বোঝার বয়সও নয় । ফুল ছড়িয়ে আকাশে তেরঙ্গার বন্ধন-মুক্তি ঘটলেই ' জনগণমন ' র অবিশ্বাস্য ভালোলাগা টিউন ছড়িয়ে যেতো গোল করে ঘিরে দাঁড়ানো সকলের মুখে মুখে । তারপর সেলাম ঠুকে জয়হিন্দ বলা হয়ে গেলেই মায়ের বানানো নাড়ু খেতো সকলে । তারপরই দেখতাম একটু দূরে বেঁটেমতো নারকেল গাছের নীচে যেখানে খাসির পেট চিরছে রেজ্জাক , বাবা সেখানে গিয়ে বলে আসতো ,সিনা দেবে রেজ্জাক- -'
এই তেরঙ্গাই আমাদের জাতীয় পতাকা , এই জনগণমন আমাদের জাতীয় গান , এইদিনই আমার দেশ স্বাধীন হয়েছিল এসব যখন বুঝতে শিখলাম , তখন কেন , কী--র প্রাবল্যে অস্থির করে তুলতাম সকলকে । স্বাধীনতা ঠিক কেমন জিনিস সেটা অনুধাবন করতে পারতাম না । সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া যাবে না , চিত্রোৎপলার বাঁধের ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে পাশের গ্রাম অর্জুনপুরে যাওয়া যাবে না। খড়ের গাদার ওপর উঠে স্লিপ খেয়ে নেমে ইজের ছিঁড়বে বলে খড়ের গাদায় ওঠা যাবে না ।এত এত ' না ' এর মুখোমুখি হয়ে মনে হয়েছিল স্বাধীনতা আসলে বড়দের হাতে ।
কালের নিয়মে বড় হয়ে , পড়ন্ত বেলায় এসে মনেহয় স্বাধীনতা আসলে বড়দেরও নয় , ধনী মানী জ্ঞানী কেউই স্বাধীনতার মালিক নয় ।মুক্তধারার ধনঞ্জয় বৈরাগী অথবা অচলায়তনের ঠাকুর্দা সকলেই একটা নিয়মে বাঁধা । একটা নিয়ম শেকল পরতে শেখায়, আরেকটা নিয়ম শেকল ভাঙতে কিন্তু শেকল ভাঙারও যে একটা নিয়ম আছে । নিয়ম মেনে শেকলটি না ভাঙলে অথবা শেকল ভাঙার পরে নিয়মটি মানা হলো না বলেই তো পরিচিত হলাম জ্যাকোবিন শব্দের সঙ্গে ।
' আমার মুক্তি ওই আকাশে ' ! কি করে আকাশে মুক্তির দিশা পাব?সেখানেও তো মাটির টান ধরে রেখেছে অদৃশ্য সুতোটি । ডানা মেলারও যে একটা নিয়ম আছে সে পাখি হোক বা উড়োজাহাজ ।নিয়মের বাঁধনে বাঁধা আছে সব । নিয়ম মেনে ঋতু বদলে যায়, নিয়ম মেনে গাছে নতুন পাতা আসে ফুল ফোটে ফল ধরে , নিয়ম মেনে উজান থেকে ভাটির দিকে বয়ে যায় জলস্রোত , নিয়ম মেনেই রক্তস্রোত প্রবাহিত হয় মানব শরীরে । তাহলে মুক্তি কোথায়? স্বাধীনতা অথবা মুক্তি মানে কি?এক নিয়মের শেকল ভেঙে অন্য নিয়মে জড়িয়ে পড়া ?
বরং একটু পালটে নিই ভাবনা-সমূহকে । আমার যা খুশি তাই করব এটাই কি স্বাধীনতা ? সে তো চরম উচ্ছৃঙ্খলতা!সে তো জমিয়ে রাখা শক্তিসমূহকে কেন্দ্র-বহির্ভূত করা । সে তো ধ্বংসের উপক্রমণিকা । তাহলে মুক্তি? তাহলে স্বাধীনতা ? স্বরাজ আর স্বাধীনতা কি এক ? জানা নেই । তবে জেনেছি দিগন্ত-বিস্তারী জলরাশির সামনে দাঁড়ালে যে শক্তি আমাকে জলের দিকে টানতে থাকে গভীরতার খোঁজে অথবা টাইগারহিল থেকে সূর্য ওঠা দেখার আগে যে রঙের খেলা চলতে থাকে সেই রঙীন কণায় মিশে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা জন্মে ---তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মুক্তি ।
খোলসটি খুলে রাখলে সেই মুক্তির সন্ধান মেলে । আর স্বাধীনতা তো নিজেই শৃঙ্খলবদ্ধ একটি শব্দ - - -
পরিবেশ
শঙ্খিনী
লক্ষ্মী নন্দী
শঙ্খিনী, জমিদারের বড় ছেলে অরিন্দমের ঘরের পিছন দরজা দিয়ে, সকলের অলক্ষ্যে নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই মিষ্টি সুরে বেজে উঠলো অরিন্দমের ডিজিটাল ঘড়িটা।তবু কোনও দিকে না তাকিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেলো ক্ষুধার্ত শঙ্খিনী। এদিকে ধরফর করে বিছানার থেকে নেমে হাতে ব্রাশ নিয়ে সোজা চলে গেলো অরিন্দম বাথরুম। স্নান খাওয়া হতেই বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। অরিন্দম দত্ত ইসলামপুরে বিডিও হয়ে জয়েন করে এসেছে ছ-দিন অাগেই। কোয়াটারে সেটেল করার দিনটা ঠিক করে রেখে ছিলো এই রবিবারই। এদিকে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট ধরে খেয়েও শঙ্খিনীর খাওয়া তখনও গলা দিয়ে নামে নি।তবুও সে রেল লাইনের ধার ঘেসে ঘেসে ধীর গতিতে জমিদারের বাড়ির দিকেই ফিরে অাসছিলো। এমন সময় একটা মেল ট্রেন....যাই হোক শঙ্খিনীর কোনও ক্ষতি হয়নি।সে সময় মতো এসে পৌঁছে গেল অরিন্দমের ঘরে। বই পাগল অরিন্দমের বইয়ের ব্যাগটা তখনও গাড়িতে ওঠানো হয়নি। ড্রাইভার চা খাচ্ছে বারান্দায়।অার অরিন্দম বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে অারও একবার তার দরকারি কাগজ পত্র দেখে নিচ্ছে। শঙ্খিনী দেখলো অার দেড়ি নয়। এবার তার লুকানোর পালা।অরিন্দমের ঐ বিশাল ব্যাগে যেখানে অনায়াসে দুটো বড় মানুষ বই ছারা ঢুকে যেতে পারে। সেখানে শঙ্খিনীর জন্য যথেষ্ট। এভাবেই নিজেকে অাড়াল করে গাড়িতে উঠে পরেছে শঙ্খিনী। জীবনে এই প্রথমবার সে গাড়িতে চরলো।অরিন্দমের গায়ের গন্ধ থেকে শঙ্খিনী কিছুুতেই দূরে থাকতে চায়না।ছ -মাস ধরে একই ঘরে সে অার অরিন্দম রাত কাটিয়েছে। বইয়ের নতুন পুরোনো বিকট গন্ধে অস্থির শঙ্খিনী চলন্ত গাড়ীতেই সুযোগ বুঝে অরিন্দমের বেশ অনেকটা কাছে চলেও এসেছে। তৃপ্তির নিশ্বাস নিতে নিতে এক সময় নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে মোহিত শঙ্খিনী।এমন সময় অরিন্দম ড্রাইভার কে বলেন দাড়াও দাড়াও সামনে একটু চা খেয়েই কোয়াটারে যাই।মিনিট কুড়ির মধ্যে অরিন্দমরা ফিরেও অাসে। হঠাৎ ড্রাইভারের চিৎকার স্যার গাড়িতে ঢুকবেন না। অরিন্দম ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতেই। বিভিন্ন সংলাপের দংশন শুরু হয়। কেউ কেউ মারতে উদ্দ্যত হয় শঙ্খিনীকে। শঙ্খিনীর জীবনে নেমে অাসে নিষ্ঠুর এক অনুরাগহীন প্রতিকুলতা।ইসলামপুরের নতুন বিডিও অরিন্দম দত্ত -প্রাণচঞ্চল শহরে ভীরের মাঝে দাঁড়িয়ে বলে, 'অাপনারা প্লিজ ওকে মারবেন না। যোগ্য জায়গায় খবর দিন। অরিন্দম নিজেই ফোন তুলে নেয় কানে। যোগাযোগ করে বনদপ্তরের সঙ্গে। গাড়িতে তখনও দরজা জানালা বন্ধ করে নজরবন্দি রাখা হয়েছে শঙ্খিনীকে।হয়তো তখনও অবুঝ শঙ্খিনীর প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল অরিন্দমের পায়ের শব্দ কম্পনের অপেক্ষায়।ইতিমধ্যে বনবিভাগের লোক এসে শঙ্খিনীকে নিয়ে যায়।সন্ধ্যার মধ্যে নতুন কোয়াটারে ঢুকে যায় অরিন্দম। কিন্তু এতো ক্লান্ত তবুও অরিন্দম সারা রাত চোখ বন্ধ করতে পারেনি। শুয়েশুয়ে শঙ্খিনীর অাতঙ্ক চর্চা করেছে।অার শঙ্খিনী? সে কি বন-বাদারে ঘুরে ঘুরে খুঁজেছে দীর্ঘ ছয়মাস একই ঘরে রাত কাটানো সেই চেনা পুরুষের গন্ধ। সার্থক অরিন্দমও সাপটিকে অতো লোকের মধ্যের থেকে বাঁচাতে পেরেছে সে।কারন অরিন্দম জানে কিছু কিছু বিষাক্ত মানুষের থেকেও বেশি প্রয়োজন এই সরীসৃপ প্রাণী গুলোর বেঁচে থাকা।।।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৬ প্রথম পর্ব
No comments:
Post a Comment