Monday, September 9, 2019

কবিতা ভুবনে চার  সংযোজন 



 শৌভিক রায় 



সর্বযুগে কবিতা ভুবনে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে এসেছে। ফর্ম ভাঙা, নতুন আঙ্গিকে ভাবনাকে প্রকাশ করা, একমাত্রিকতা থেকে বহুমাত্রিকতার স্তর স্পর্শ করা ইত্যাদি ব্যাপারগুলি একদম আদি থেকে বর্তমান অবধি কবিতার ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায়। 

সম্প্রতি চারজন তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ হাতে এসেছে। প্রকাশকালের ক্রম অনুসারে সেই চারটি কাব্যগ্রন্থের কথা বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় অনিমেষ সরকারের 'নপুংসক ফিনিক্স`গ্রন্থটির কথা। ডুয়ার্সের তরুণ অনিমেষ বেশ কিছুদিন ধরে কবিতা লিখছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তারুণ্যের চপলতা সত্বেও তার কবিতায় জীবনবোধের গভীরতা পাঠককে আকৃষ্ট করে। কর্পোরেট পাবলিসিটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটিতে ৬৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রথমদিকের কবিতাগুলি খানিকটা দীর্ঘ, পরবর্তীতে কবিতার আকৃতি ছোট হয়ে এলেও বিষয়বস্তুর অভিঘাত কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। 'পুংসক ফিনিক্স` দিয়ে শুরু হওয়া কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা 'নপুংসক ফিনিক্স`ও মাঝে রয়েছে 'ভাইরাস ফিনিক্স' নামে একটি কবিতা। অনিমেষের ব্যক্তি জীবনের ছায়া এই তিনটি কবিতায় কমবেশি নজরে আসে এবং ফিনিক্সের মতোই কবিতা ভুবন থেকে হারিয়ে গিয়েও প্রবলভাবে কবির যেন পুনরায় উত্থান হয়। 'পাখি আদতে মা ও একটি অদৃশ্য নারী` কবিতাটির নামকরণই যথেষ্ট ছিল। বাকি কবিতায় এই কথায় ধ্বনিত হয়েছে নানা লাইনে। চোরা যৌনতা, ডুয়ার্সের পরিব্যাপ্ত দীর্ঘ প্রকৃতি ও তার অপার সৌন্দর্য, সেখানকার মিশ্র সংস্কৃতির স্পর্শ, হতাশায় ভোগা যুবক মনন, সম্পর্কের টানাপোড়েনে জাত বিশ্বাসহীনতা ইত্যাদিকে উপজীব্য করে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন কবিতা। শব্দের অদ্ভুত ব্যবহারে চমক দিতে পেরেছেন অনিমেষ 'অর্চন এবং', 'বিহুল', ''আম্রপালি`, '৭২'-সহ বেশ কিছু কবিতায়। বইটির কাগজ ও মুদ্রণ ভাল হলেও বাঁধাই ভাল নয়। রাজা বিশ্বাসের প্রচ্ছদ ভাবনা যথেষ্ট ভাল হলেও যথাযোগ্য মুদ্রণের অভাবে সেভাবে ফুটে ওঠে নি। অনিমেষ সরকার লম্বা রেসের ঘোড়া হতে পারবে যদি মানসিক চঞ্চলতা কমিয়ে স্থিত হতে পারে, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন হাতছানি থেকে নিজেকে গুটিয়ে সত্যিকার সাধক হতে পারে। 





ছাপান্নটি কবিতা নিয়ে নবনীতা ভট্টাচার্য্যের 'সাঁকো ভাঙার গান` কাব্যগ্রন্থটি সুখ-পাঠ্য। নবনীতা বহুদিন থেকে লিখছেন। প্রিন্ট মিডিয়ায় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। সম্পাদনাও করেছেন একসময়। তাই তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা মতো বেশ ভাল সৃজন পাওয়া গেছে। নবনীতার কবিতার বৈশিষ্ট্য হল সারল্য। খুব সহজ শব্দে অনায়াস দক্ষতায় তিনি গভীর কথা বলে দিতে পারেন। এই সহজবোধ্যতা অনেকে কবির ক্ষেত্রে বিপক্ষে গেলেও, নবনীতা ভট্টাচার্য্যের কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর অলংকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যখন তিনি উচ্চারণ করেন 'ধানক্ষেত চা বাগান বুজে উঠেছে/ সভ্যতার ইমারত/ চারদিকে দেওয়ালের আড়াল/ কার্নিশ বেয়ে ওঠে/ সাঁকো ভাঙার শব্দ;, তখন শহুরে দেখানদারির ভণ্ডামি নয়, বরং সচেতন এক কবিকে পাওয়া যায়। এরকম সচেতনতা বেশ কিছু কবিতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কবিতা আত্মরতির পর্যায় থেকে যাত্রা করেছে বৃহৎ স্বার্থের দিকে। প্রত্যাশিতভাবেই নবনীতা কোনো পথ দেখান নি, শুধু বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। মগ্ন পাঠক তাঁর কবিতা পাঠ করে নিশ্চয়ই পথ খুঁজে নেবেন, একথা ভাবা যেতে পারে। নবনীতার কবিতার স্বার্থকতা এখানেই যে, তাঁর কবিতা ভাবতে শেখায়। আসলে কবিতা কেন, সামগ্রিকভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে আমরা নতুন কথা আর কিছু বলতে পারিনা। কেননা সবকিছু বলা হয়ে গেছে। তাহলে কিভাবে আলাদা হচ্ছে আজকের সাহিত্য? আলাদা হচ্ছে, শব্দ চয়নে। নবনীতার সেই চয়ন সামান্যের মধ্যে অসামান্যের জ্যোতি এনেছে। কিছু বানান ভুল থাকলেও সামগ্রিকভাবে গ্রন্থটি ভাল লাগে। বইয়ের কাগজ ও বাঁধাই যথেষ্ট ভাল। 'কবি মানস' প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদও (প্রচ্ছদশিল্পী- চারু পিন্টু) মনোগ্রাহী। 




শব্দসাঁকো থেকে সদ্য প্রকাশ পেয়েছে রিয়া দাসের আঁকা সুন্দর প্রচ্ছদে রাতুল দত্তের 'চুপকথা`। মোট ৫৮টি কবিতা মলাটবন্দি হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থটিতে। রাতুলের কবিতায় সবসময় এক অদ্ভুত বিষন্নতা থাকে। কোনো মরমীয়া কবি যেন কোনও এক অন্তরালে বসে তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে অবলোকন করে চলেছেন কাল ও দেশ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ সেই দর্শন শানিত ভাবনায় টুকরো টুকরো হয়ে ধরা পড়ছে তাঁর কবিতায়। এই নির্মাণ আপাতভাবে সহজ মনে হলেও, অত্যন্ত নির্মম। কেননা কোনো দর্শন সর্বদা সুন্দর হয় না। লোভ, ক্ষোভ, চাতুর্য ও প্রলোভনে ভরা এই দুনিয়ায় সত্যটাকে খুঁজে বের করে তাকে কথায়, বিশেষ করে কবিতায়, ধরা যথেষ্ট শক্ত। ভাল লাগছে যে, রাতুল সেটা পেরেছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাতুলকে এখনও বহু দূর যেতে হবে, কিন্তু তাঁর এই প্রয়াস জারি থাকলে অবশ্যই আগামী তাঁর জন্য উজ্জ্বল হবে। খুব ভাল লাগে 'বাবা` কবিতাটি। এই নির্মানটি সর্বস্তরের পাঠককে স্পর্শ করবে বলে আমার ধারণা। 'একুশের প্রেম`, 'ঘন্টা ঘর`, 'অন্ধকার নেমে এলে`, 'বাঁশি` ইত্যাদি কবিতাগুলি পড়বার রেশ রয়ে যায় অনেকক্ষন। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় কাব্যগ্রন্থের নাম যে কবিতাটি থেকে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ 'চুপকথা` কবিতাটি। রাতুলের শব্দ প্রয়োগে অভিনবত্ব রয়েছে। বেশ কিছু কবিতায় ফর্ম ভাঙার চেষ্টাও স্বাগত। তবে অনেক কবিতায় একটি বিষয়বস্তু ঘুরেফিরে এসেছে। এটি কোনো দোষের না হলেও পাঠকের পড়বার ক্ষেত্রে সামান্য একঘেয়েমি আসতে পারে। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থে কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। সব মিলে রাতুল দত্তের 'চুপকথা` পাঠ অন্য অভিজ্ঞতা।   



তাপস দাস উত্তরের প্রতিশ্রুতিমান তরুণ কবি। তাপসের কবিতার বহুদিনের পাঠক হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, তাপসের নির্মাণ এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো। শব্দকে নিয়ে খেলা করা তাপসের অনায়াস দক্ষতা। সেই দক্ষতাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। 'রাত তোমাকে ফর্সা করে দেয়/ ব্লাউজের বোতাম খুলতেই সারাঘর ধবধবে গ্রহ`....এই জাতীয় বাক্য পড়লে সহজেই বোঝা যায় যে, এই সৃষ্টি তাপসের। সত্যি বলতে, তাপসের একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি হচ্ছে। যদি তাপস সেই ধারাকে বজায় রাখতে পারে, তবে আগামীদিনে বাংলা কবিতা তার কাছ থেকে অনেককিছু পাবে এই বিশ্বাস রাখি। তবে, তাপসকেও স্থিতধী হতে হবে। ডুব দিতে হবে আরও গভীরে। মোট ষাটটি কবিতা রয়েছে কাব্যগ্রন্থটিতে। ড্রামাটিক মনোলগ 'ভুলকে ভূল লিখে দেখুন`, 'অন্য পাপ`, 'উপাদান` ইত্যাদি কবিতাগুলি যে সামাজিক চিত্রকে তুলে ধরে তা যেন বড্ড চেনা। অন্যদিকে 'আহত সৈনিকের গল্প', 'সেপ্টিপিন ও পাখির ঠোঁট', 'তুমি ও সজনে ফুল` ইত্যাদি অন্য প্রেমের কবিতা। তাপসের কবিতায় মা বারবার ঘুরেফিরে  আসেন। এই কাব্যগ্রন্থেও 'মা ও ভাত` মায়ের কথা বলেও এমন এক বিষয়কে স্পর্শ করে যা সর্বজনীন। প্রতিটি কবিতায় নিজের মতো করে আলাদা ও বহুমাত্রিক। তাপসের এই যাত্রা দেখতে বড্ড ভাল লাগে। পৌষালি প্রকাশনীর কাজ ভাল হয়েছে। মুদ্রণ ও কাগজের গুণমান খুব ভাল। সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন সৌরভ মিত্র। আগামীতে তাপস দাসের আরও সৃষ্টি দেখবার ইচ্ছে রইল।           

No comments:

Post a Comment