পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও গভীর সম্পর্ক পিতা মাতা আর সন্তানের। অত্যন্ত গর্বের বিষয়, পিতা মাতার কাছে সন্তান মূল্যবান সম্পদ। সন্তানের সুখে পিতামাতা সুখী। সন্তানই দেশের ও সমাজের ভবিষ্যত।
শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর একটা সময় সন্তানদের নিজস্ব মতামত তৈরী হয়ে যায়। গুরুত্ব পূর্ণ সময় হলো সেটাই। আপনার সন্তান কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সে এই পৃথিবীর সম্পদ। তার প্রতি জোর করে আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছে চাপিয়ে দিতে পারবেন না। এতে সফলতা পাবেন না।
সব সময় সত্যি বলতে শেখান। উন্নত সংস্কার দিন সন্তানকে। মানবিক হতে দিন। টিফিন পিরিয়ডে ভাগ করে খেতে দিন খাবার। সুযোগ সন্ধানী নয় উপকার করতে শেখান। মনে রাখবেন অন্যের সন্তানও ততোটাই প্রিয় তার পিতা মাতার কাছে।
আমরা যদি আমাদের সন্তানদের আলোকিত ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তবে আলোর পথের যাত্রীদের কথা ভাববো। যেমন বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর এঁদের অস্তিত্ব ও চিন্তা-চেতনা পৃষ্ঠপোষণ, শীর্ষায়নের কথাও চিন্তায় রাখবো। তারা পরীক্ষিত আলোর দুঃসাহসী অভিযাত্রী। গভীর আঁধারের বুক চিরে তারা আলো হাতে এগিয়ে যায় আত্মস্বার্থ ভুলে। নিজের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে সন্তানের পাাশে থাাকার দায় আমরা কেউ কি এড়াতে পারি? পারি না। ভয়হীন হৃদয়ে বাস করে বীরের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে অন্তরে পুষে রেখে আলোর আসা যাওয়ার পথকে কন্টকহীন করতে হয়। হাজার দিন ভেড়ার মতন বেঁচে থাকার চেয়ে একদিন সিংহের মত তীব্র আলোয় বেঁচে থাকার ভিতরে বাস করে বীরের ইচ্ছা। বিজয়ীদের মুখেও শুনি সেই একই কথার প্রতিধ্বনি। ওদের সাহসী ভূমিকা পালন করতে দিন।
তুলনা নয় এক সন্তানের সঙ্গে কখনোই আরেক সন্তানের তুলনা করা যাবে না। কেউ কারো মতো হয়না। প্রতিটি মানুষই আলাদা স্বত্তা নিয়ে আসে ।তার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা ভাবনা ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় নিজের মতো করে। দুই সন্তানের মধ্যে দুরকম কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।
কোনো কারণে দুই সন্তানের মধ্যে মতবিরোধ লড়াই বা খুনসুটি হলে বাবা-মা কখনোই কোনো পক্ষ নেবেন না। সন্তানদের সমস্যা সমাধান করতে শেখান। একজন নালিশ করতেই পারে, এই নালিশকে উত্সাহিত করা উচিৎ নয়। একজনকে পক্ষপাতিত্ব করলে অপর জনের মনে ক্ষোভ আসবে। ক্ষোভ তৈরী হতে দেবেন না ওদের মনে। এর ফলে বিরোধ বাড়বে।
ক্রমাগত উপদেশ দিয়ে যাবেন না। তারা দেখে শিখবে, পর্যবেক্ষণ করে শিখবে।পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে মা বাবা কে বিশেষ ভাবে ভাবতে হবে। প্রত্যেক সন্তানের জন্য পিতা মাতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।তাই কোনো সন্তানের আচরনে পিতা মাতা বিমুখ হলে সন্তানকে নির্যাতন করা হবে।
হঠাৎ করেই রেগে গিয়ে ভুলও করতে পারে। তার ভুল গুলো আলাদা করে বুঝিয়ে ভালবেসে প্রশংসা করে বরং উৎসাহিত করুন । জড়িয়ে ধরুন সন্তান আপ্লুত হবে।
সন্তানের মধ্যে মতবিরোধ হলে ওদের মনের আবেগ প্রকাশ করতে দিন, ওদের বলতে দিন, ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবেন না। তবে কটুবাক্য ব্যবহার করলে শাসন করুন।
পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন শিশুদের সামনে পারিবারিক কলহ করবেন না, অপরের সমালোচনা করবেন না। অপরকে সম্মান করতে শেখান। বাবা-মা নিজেদের ভাইবোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবেন, যা শিশুদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে।
শিশুকে ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের কৌশল, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সামাজিক দক্ষতা শেখান। সমাজ আছে থাকবে তাই আত্মম্ভরিতা নয় ভব্যতা শেখান। নিজেদের ঝামেলা বন্ধ দরজার ভেতরে মিটিয়ে নিন। অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে বারবার একই কথা বলবেন না।
প্রত্যেকের সাফল্যকে আলাদাভাবে উদযাপন করতে হবে। প্রশংসা করতে হবে, একজনকে দিয়ে আরেকজনের প্রশংসা করাতে হবে, উপহার দেওয়াতে হবে।
সন্তানও মা বাবার ভুল গুলো ধরতে পারে সে ক্ষেত্রে এক জন সাপোর্ট করতে পারে তবে সেই জনকে বেশি ভালোবাসতে গিয়ে মা বাবার আর এক সন্তানের প্রতি অবিচার করা উচিৎ নয়। মনে রাখতে হবে যে সন্তান আপনার ভুল গুলো ধরিয়ে দিল সেই সন্তানই আপনাকে বেশি সন্মান করে। পিতা মাতার সঠিক ব্যবহার ও সুস্থ সংস্কৃতি কিন্তু সন্তানের আচরনে প্রকাশ পাবে।আপনার সন্তান উন্নত মানের মনন শক্তির অধিকারী হবে।
‘সিবলিং রাইভালরি’র কোনো লক্ষণ কোনো সন্তানের মধ্যে দেখা দিলে বাবা-মাকে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সন্তানদের বিষয়ে দুজনের অভিন্ন মতামত থাকতে হবে। প্রতিটি মানুষ আলাদা। কোনো মানুষই পারফেক্ট নয় ।তার রুচি ,বোধ বুদ্ধি, ধারণা যোগ্যতা সব কিছুই আলাদা তাই মা বাবার উচিৎ দুই সন্তানকে আলাদা ভাবে বুঝতে চেষ্টা করা।
নির্দিষ্ট কয়েক দিন পর পর পারিবারিক সময় নির্ধারণ করে সবাই একসঙ্গে গুণগত সময় (quality time) কাটাতে হবে। একটা সময় একসাথে খেতে পারেন। মুভি দেখতে পারেন। ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দিতে হবে সন্তানকেও । কাউকে বাদ দিয়ে আনন্দ উৎসব করা চলবে না। আবার পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সবার মতামত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি দুজনকেই আলাদা করে কিছুটা সময় দিতে হবে, যাতে দুজনেই মনে করে যে তারা বাবা-মাকে বিশেষভাবে পাচ্ছে। ভুলে যাবেন না যোগ্য সন্তান দেশের ভবিষ্যত। ভারতের বাইরেও বহু দেশে একাধিক সন্তানের মাতা পিতা আছেন। তারা তাদের সন্তানদের সুপরিকল্পিত ভাবে পরিচর্যা করছেন ও তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে সুখে দিন যাপন করছেন। মনে রাখতে হবে সে সব দেশে বৃদ্ধ পিতা মাতার স্থান কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম নয়।
ভারতবর্ষের লোকজন সুখী নয় । World happiness report অনুযায়ী 149 টি সুখী দেশের মধ্যে ভারতের স্থান 139তম। প্রথম স্থান ফিনল্যাণ্ডের তারপরে সুইজারল্যান্ড ,নরওয়ের শেষতম স্থান আফগানিস্তানের। ফিনল্যাণ্ডের প্রায় ত্রিশ শতাংশ মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না।
অথচ এই আমাদের দেশে এত ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ আর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভুরি ভুরি প্রতিষ্ঠান সে দেশেই এমন হাল। ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের তো অল্পেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাদের বস্তুকেন্দ্রিক মনোভাব থাকা উচিত না। যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট। আমরা সবাই জানি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের মনে অসন্তুষ্টি আনে যা তার মনের সুখ কেড়ে নেয়। হিংসা ও পরস্রীকাতরতা জন্ম নেয়। যার ফলাফল ভয়ঙ্কর।
সন্তান বড়ো হয়েছে বলে অনেক পিতা মাতা নিজেদেরকে ধার্মিকতার আড়ালে দূরে সরিয়ে রাখেন। আনন্দ অবসরে সন্তানরা পিতা মাতাকেই খোঁজে তখন পিতা মাতার উচিৎ তাদের সাথে থেকে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তান একাকীত্বে ভোগে ও ভুল বন্ধু বান্ধবের মাঝে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে নিজেকে বদলে ফেলে।
বন্ধুত্ব পূর্ণ ব্যবহার করবেন তবেই সন্তানও সহজে সামান্য বিষয়ে আপনার মতামত চাইবে। মন খুলে কথা বলবে।
ভারতে আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের অভাব নেই। কুলগুরু, কুলদেবতা, অমুক বাবাজির শিষ্য তমুক বাবাজির শিষ্যা , নিরামিষ আমিষের বিচার, অষ্টপ্রহর নামগান , নিত্যপূজো , বারোমাস পূজা পার্বন, , প্রার্থনা, দৈনিক আশ্রম কিংবা মন্দিরে পাঠ শোনা, ঘরে ঘরে নিত্যপূজা, বিভিন্ন ধরনের ঈশ্বর ভিত্তিক লোকাচার, হাতে সুখী থাকার জন্য আংটি, বার , ব্রত আরও কত কি। তবুও আত্মহত্যা থেকে যুব সমাজ কে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। যুব সমাজ কে সঠিক গুণগত মানের সংস্কার দিতে হবে। নইলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়বে। এজন্য কি সন্তানই দায়ী ? গাছ ও জমি যতই ভালো হোক সঠিক পরিচর্যা না পেলে সঠিক ফসল হবে কি ?
পিতা মাতার পর শিশুর দায়িত্ব পালনে আসেন শিক্ষক। শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল তো
সেখানেও অবহেলা।পূজো পাঠ নিয়ে ব্যস্ত আবার স্কুলে ফাঁকিও দিচ্ছে। স্কুলে ছুটির হিসাব কড়ায় গণ্ডায় অসুল করে নিচ্ছে। শরীর সুস্থ মেডিক্যাল লিভ পাওনা আছে, ছাড়ব কেন? নিয়ে চলে আসছে মিথ্যা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট।চেয়ারে বসে ছেলে পড়ানোর বাহানায় ভাতঘুম সেরে বাড়ী ফিরছেন।
সচেতনতা ও দায়িত্বের পরিচয় দিয়ে নিজের ও সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের আরো অনেক বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত।
থার্টি সেভেন কোভিড লেন
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
খামের ওপর ঠিকানাটা দেখেই চমকে উঠলাম। কিড লেন, থিয়েটার রোড,বিধান সরণি এগুলো সবই চেনা রাস্তা। চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে গোটা কলকাতা টাই হাতের তালুর মতো চেনা। কিন্তু কোভিড লেন? কিছুতেই মনে করতে পারছি না। চাকরির ইন্টারভিউ এর চিঠি আসলে বাড়িতে একটা খুশির আবহাওয়া লক্ষ্য করতাম। চোখে কতো স্বপ্ন! আগের দিন কোলকাতা গিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটি র পাশে, কখনও সায়েন্স কলেজ বা আলীপুর চিড়িয়াখানার পাশে গিয়ে পরীক্ষার সেন্টার দেখে আসতাম, যাতে করে পর দিন সকাল দশটা'র মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌছুতে পারি।
যদি জানতাম পরীক্ষার আগেই সব পদ নেতা-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজন দের দিয়ে ভর্তি হয়ে যাবে, তাহলে এ ভাবে চাকরির পরীক্ষায় বসতাম না। পরে পোস্টম্যান রা দয়াপরবশ হয়ে আমাকে পোস্টম্যানের চাকরি দিয়েছেলো বলেই বেঁচে আছি।
সে যাই হোক, আমি কোভিড লেনের ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে একটা চা-এর দোকানে গেলাম। যিনি দোকানী এবং যারা চা খেতে এসেছে, তাদের সবারই চুল দাড়ি সাদা কেউই কলপ করেন না সবার ই গলায় মোটা সোনার চেন। চেন-এর লকেট গুলো ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ওটা পেন ড্রাইভ কাম অক্সিমিটার কাম সিটিজেনশিপ ডিভাইস। কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হ'ল কোন লকেটে ইংরেজি বর্ণমালার C এবং কোনটাতে D লেখা রয়েছে।
একজন উৎসাহি যুবক এগিয়ে এসে বলল " ওই নিউটাউনের কোভিড সংঘের পাশের গলিটাই কোভিড লেন। চলুন আপনাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিই।"
কোভিড সংঘের সাথে যুবকটির যোগাযোগ অাছে বোঝাতে আমাকে প্রায় জোর করেই ক্লাবঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। ক্লাবের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি ওয়াটস এপ ইউনিভার্সিটির সংশাপত্র টাঙানো রয়েছে। সই এর জায়গায় MJ... এবং তারিখ এর জায়গায় ৬/৭/২০২৬। নিজের চোখ কে নিজে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
আমার চিঠি র ঠিকানার পাশে মোটা অক্ষরে A লেখা দেখে যুবকটি উত্তেজিত হয়ে বল্ল, "নাহ! আপনার সময় নষ্ট করা যাবে না। আপনার চিঠি টা একজন ভি, আই পি' র।"
জানলাম এখানে চার প্রকারের নাগরিক। ABCD, যারা A তারা ভি আই পি। তাঁদের কোন কাজ করতে হয় না। তাদের জীবনযাত্রা খুব সুখের। মনে মনে বেশ লোভ হ'লো।
যারা বদমায়েশ এবং দালাল গোছের তারা B, ক্যাটাগরিতে পড়েন সবাই তাদের ভয় পায় এবং সমীহ করে চলে।
C ক্যাটাগরিতে তারাই যারা Conventional প্রকৃতির। এরা সংস্কার মেনে চলেন এবং পরোপকারী। তাদের খেটে খেতে হয়।
D মানে Digital. জিজিটাল ক্যাটাগরি। যারা D শ্রেণীর নাগরিক, তারা ডিজিটাল মানুষ। তারা ভয়ংকর রকমের ব্যাস্ত। নিজের টা বাদ দিয়ে আর কোন বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। সদাই 6G Tab এর মধ্যে মুখ গুঁজে কি সব করছে। কখনো আপন মনে হেসে উঠছে, কখনো শেয়ার বাজারের পতন হ'লে হাঊ হাউ করে কেঁদে উঠছে। কেউ বালিগঞ্জের বাসের নম্বর জানতে চাইলে, বেহালার বাসের নম্বর বলে দিচ্ছে।
মিডিয়া বলে কোন বস্তু নেই। খাদ্য সামগ্রী নেই বললেই হয়।সবাই ট্যাবলেট খেয়েই বেঁচে আছে। ডাক্তার বলে কোনো কিছু নেই। সোনার বিনিময়ে পানীয় জল পাওয়া যায়। ওই ট্যাবলেট গলাধকরন করতে যে টুকু প্রয়োজন।
জলের প্রসঙ্গে পিপাসায় আমার ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হওয়ায় আমার বন্ধু টি ড্রপারে করে কয়েক ফোটা জল আমার জিভে দেওয়াতে ধিরে ধিরে আমার জ্ঞান ফিরতে শুরু করল। ক্ষীন দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম আমি প্রসুতি সদনের বেডে শুয়ে আছি। একজন মাথায় কলপ করা নকল ডাক্তার আমার নাড়ি টিপে প্রেশার মাপছে, আর রক্তচাপ নিয়ে না না রকম ভুল তথ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ঘাড় ঘোরাতেই উকিল পাড়ার তিস্তা গ্যাস সার্ভিসের সাউনবোর্ড দেখতে পেলাম, যেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
ইন্সটিটিউশনের দরজাটার সামনে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল লাবণ্য। বাইরে থেকেই ছেলেমেয়ে গুলোর কথা, হাসি, টুকরো টুকরো গানের সুর, ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে মিনিকে নামালো যত্ন করে। শাড়ি পরে, ফুলের সাজে সেজে ছটফটে মিনি আজ একেবারে শান্ত হয়ে আছে.. সারা গাড়িতে একবার শুধু প্রশ্ন করেছে, 'আমার লিপস্টিক উঠে যায়নি তো? '.... এখনও ঠোঁট টিপে আছে চুপটি করে.. ওকে দেখে আবারও হাসি পেলো লাবণ্যর। এই সাত সকালে উঠে মায়ের সবকিছু গুছিয়ে ঠিক করে রেখে, গীতাদিকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে, অপূর্বর সবকিছু হাতের কাছে রেখে, মিনিকে সাজিয়ে, নিজে সেজে রওনা দেওয়া..
অবশ্য এভাবেই দিনগুলো কাটে লাবণ্যর। হাউজ ওয়াইফ হলেও সংসারের সাথে সাথে বাইরের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজকর্ম গুলোও লাবণ্যকেই সামলাতে হয় প্রায় একা হাতেই। বাড়ির কাজে সাহায্য করবার লোক আছে যেটুকু নিতান্তই প্রয়োজন.. তাছাড়া গত একবছর ধরে গীতাদি আছেন মাকে দেখাশোনা ও একটু সঙ্গ দেওয়ার জন্য.. অপূর্বর সকাল আটটায় বেরিয়ে রাত ন'টা সাড়ে ন'টায় ফেরা। মিনির তো সেই সকাল থেকেই স্কুল দিয়ে দিন শুরু হয়ে সপ্তাহের নানান দিনে নানান কিছু লেগেই রয়েছে। ওকে নিয়ে ছুটোছুটি করেই দিনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় লাবণ্যর। এসবের মাঝেই দুবছর আগে ওর এই ইন্সটিটিউশন.. 'সোনার তরী'.. লাবণ্যর ইচ্ছে, ভালোবাসা আর অপূর্বর সহযোগিতা.. এর সবটা মিলেই 'সোনার তরী'। এখানে আবৃত্তি শেখায় লাবণ্য। গত দু'বছরে বেশ অনেক কচিকাঁচার ভিড় হয়েছে এখানে। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে আবৃত্তি ছাড়াও নাচ, গান, নাটক সবকিছুই করায় ও। তবে সেগুলোর সবটাই থাকে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। পাঁচ বছরের ছোট্টো মিনিও আজ মায়ের এখানে নাচতে এসেছে, মায়ের হাত ধরে.....
'মা'.... লাবণ্যর বুকটা মুচড়ে ওঠে.. চাপা একটা কান্না গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায়.. ও নিজেওতো এভাবেই মায়ের হাত ধরে কতো জায়গায় গেছে অনুষ্ঠান করতে। মায়ের হাত ধরেই তো ওর এই প্রাণের পুরুষের সাথে পরিচয়.... মিনির হাত ধরে 'সোনার তরী'র ভেতরে পা বাড়ায়...
ছবির রবীন্দ্রনাথ চন্দনে, ফুলের মালায় সেজে উঠেছেন.. ছোটোরা, তাদের চাইতে একটু বড়োরা একে একে একক, সমবেত আবৃত্তি, গানে, নাচে শ্রদ্ধা জানালো রবি ঠাকুরের জন্মদিনের দিনটিকে.. শুরুতেই লাবণ্য ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওনার সম্পর্কে ছোটো ছোটো গল্প শোনালো সকলকে।লাবণ্যর ভরাট গলার মনকাড়া আবৃত্তির শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা.....
এই দিনগুলোতে লাবণ্য পিছিয়ে যায় আরও অনেকগুলো বছর.. ছবির মতো সবকিছু ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। ছোটো বেলার একেকটা দিন ওর কাছে হাজির হয় অনেক গল্প নিয়ে.. মায়ের পিঠময় ছড়িয়ে থাকা থাক থাক চুলগুলো, মায়াবী মুখ আর কাজল কালো চোখের সেই চেয়ে থাকা ওর মনে ছায়া ফেলে বারবার। মায়ের কাছে 'জন্মকথা' শিখবার পর, ও যখন তখন ছুটে এসে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে উঠতো,
'এলেম আমি কোথা থেকে
কোনখেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে? '..
একগাল হেসে মা বলতো 'ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। '
এভাবেই তো কবিতা পড়া, কবিতা শেখা, কবিতাকে ভালোবাসতে শেখা। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতে শেখা। সেবার যখন ওদের বাড়ির কোণের কাঁঠালচাঁপা গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গিয়ে গন্ধে মাতোয়ারা করে তুলেছিল, টুনটুনি পাখিগুলো ভিড় জমিয়েছিল ওখানে, লাবণ্য দুষ্টুমি করে মাকে বলেছিল,
'আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি
ভোরের বেলা মাগো ডালের পরে কচিপাতায় করি লুটোপুটি..... 'মা কেমন আকুল হয়ে ওকে আগলে নিয়ে বলেছিল, 'আমায় ছেড়ে কোথাও যাসনা সোনা.. কোথাও না.. '
খুব ছোটো বয়স থেকেই লাবণ্য বুঝেছিল ওদের এই সংসারে মায়ের খুব কষ্ট। কেউ এখানে মায়ের সুন্দর মনটাকে একটুও বুঝতে চায়না। মাকে আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখতো ও। ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই অনেক লোক আসতো। অনেক খাবার দাবারের গন্ধ ছড়াতো। সেদিন গুলোয় মা খুব সুন্দর করে সাজতো, কিন্তু মায়ের মুখ কেমন থমথম করতো.. লাবণ্য তখন ভয় পেত মায়ের কাছে যেতে। বাবা খুব মিষ্টি করে কথা বলতো তখন মায়ের সাথে.. অন্য দিনগুলোতে বাবা খুব কমই কথা বলতো.. বাড়িতেও থাকতো কম। চোখে কাজল, ঠোঁটে রঙ মেখে খাবার দাবার গুলোর ট্রে হাতে করে বিন্তি মাসির বদলে মা- ই সেই দিনগুলোতে বাবার ঘরে ঐ লোকগুলোর কাছে যেত.. খুব হাসাহাসির আওয়াজ আসতো ঐ ঘর থেকে। সেদিন রাতে মা আর ওকে খাইয়ে দিতনা। বিন্তি মাসির কাছে খেয়ে ও ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতো বিছানায়। অনেক্ষণ ধরে লোকগুলোর জড়ানো জড়ানো গলা কানে ভাসতো। অনেক পরে মা এসে ওর পাশটিতে শুতো। ডুকরে ডুকরে কাঁদতো মা। কিন্তু কেনো যেন মাকে ছুঁতে তখন খুব ভয় করতো ওর.. তার পর পর ক'দিন মা কারোর সাথে কথা বলতোনা। মনমরা হয়ে থাকতো কেমন। লাবণ্য তখন শুধু দূর থেকে মাকে দেখে দেখে চলে যেতো। হঠাৎ হঠাৎ করে হাজির হওয়া ঐ পাজি লোকগুলোকে ওর মনে হোতো 'বীরপুরুষ' কবিতার সেই 'হা রে রে রে রে' করে ডাক ছেড়ে তেড়ে আসা ডাকাতগুলো। ও ভাবতো ওর কাছেও যদি একটা তলোয়ার থাকতো, ঐ দুষ্টু লোকগুলোকে ও টুকরো টুকরো করে ফেলতো। আবার যখন মায়ের মন ভালো হয়ে যেতো, তখন ওরা একসাথে কবিতা বলতো, গান করতো, গল্প করতো, খেলা করতো।
একটু বড়ো হতেই লাবণ্যকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাবা। মায়ের প্রতিবাদ, আপত্তি, চোখের জল সবকিছুই বাবার জেদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। আর লাবণ্য? মাকে নিয়েই তো ওর গোটা পৃথিবী। যাবার আগে মা 'সঞ্চয়িতা', গীতবিতান', 'গীতাঞ্জলি'.... সাথে রবিঠাকুরের ছোটো গল্পের একটি বই দিয়েছিলেন লাবণ্যকে। বলেছিলেন, 'রবিঠাকুর তোর সাথে থাকবেন এখন থেকে.. দেখবি, জীবনে কখনো একা হবি না'.... সত্যিই তাই, রবীন্দ্রনাথ সেই তবে থেকেই তো ওর আপনার জন.. ওর আনন্দ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনার সঙ্গী। ছোটো থেকে বড়ো হয়ে উঠবার ধাপগুলোতে ওনার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান কেমন অর্থ বদলে বদলে ওর জীবনে ধরা দিয়েছে। মায়ের সাথে একসাথে কবিতা বলার দিনগুলো বড়ো বেশি করে মনে পড়ে লাবণ্যর। হোস্টেল থেকে বাড়িতে এসে গরমের বা পুজোর সময় টানা একমাস থাকতো যখন, মা ওকে আঁকড়ে থাকতো সবসময়। অলস দুপুর গুলো ওদের কেটে যেতো একসাথে কতো কতো কবিতা বলে....
আমাদের ঐ গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেতে তখন ফোটে শন।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ- ধারা,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে.....
মোটামুটি উঁচু দিকের ক্লাস গুলোতে পড়াকালীন লাবণ্য বাড়িতে এসে বুঝতো তাদের বাড়ির পরিবেশ এতোটুকুও পাল্টায়নি। মা তখন আগের চাইতে বেশ কিছুটা কঠোর, প্রতিবাদী। তাই বাবার অত্যাচারও মাত্রা ছাড়িয়েছিল আরও.. ব্যবসা আরও বেড়েছে ততোদিনে.. উচ্চাকাঙ্ক্ষাও.. মক্কেলদের খুশি করবার জন্য মাকে প্রতিদিন মরতে হোতো আত্ম মর্যাদা বোধের কাছে, বিবেকের কাছে।
লাবণ্য কলেজে পড়াকালীন হঠাৎ করেই মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল.. খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল মা। পরিচিত লোকজনকে চিনতে পারছিল না ঠিকঠাক। আবার হঠাৎ কোনো সময় অনেক পুরোনো কোনো কথা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠছিল। ধীরে ধীরে সকলকে চেনার ক্ষমতাই মা হারিয়ে ফেলছিল। হোস্টেল থেকে বাড়িতে এসে সেই অপরিচিত মাকে দেখে ভয়ানক এক কষ্টে বিবশ হয়ে পড়েছিল লাবণ্য। সকলের আড়ালে মাকে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সৃষ্টি পড়ে পড়ে শুনিয়েছিল ও.. কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি মায়ের। চোখের জলে মাকে বিদায় জানিয়ে বাবার ঠিক করা রিহ্যাবে পাঠাতে হয়েছিল। সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই অতল সৃষ্টিতে ডুবে থেকে মনকে শক্ত করতে পেরেছিল লাবণ্য.. কিছুটা হলেও.. বিশ্বকবির একের পর এক প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা গভীর ভাবে ওকেও স্পর্শ করেছিল, মাকে সাময়িক না পাওয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছিল।
তারপর কেটে গেছে বেশ কতোগুলো বছর। অপূর্ব ওর জীবনে এসেছে স্বর্গের দূত হয়ে.. সে এক অন্য গল্প। বাবা চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। মায়ের সাথে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল লাবণ্যর। মা কোনোসময় ওকে চিনতো, কোনোসময় আবার সম্পূর্ণ অপরিচিতের মতো ব্যবহার করতো ওর সাথে। গত বছর রিহ্যাব থেকে ছাড়া পেল মা। তখন থেকে মা লাবণ্যর কাছেই.. এখনও খুব চুপচাপ থাকে, কাউকেই বিশেষ চিনতে পারেনা। তবে সেসময় যেমন উত্তেজিত হয়ে পড়তো, সেটা আর নেই। সেই হারিয়ে যাওয়া মাকে খোঁজে লাবণ্য সবসময়...
কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে, গীতাদি লাবণ্যকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করবার ইঙ্গিত করলো। মিনিকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো লাবণ্য। সেন্টার টেবিলে রবীন্দ্রনাথ চন্দনে, ফুলের মালায় সেজে উঠেছেন। সামনে সুগন্ধি ধূপকাঠি সুবাস ছড়াচ্ছে। মা নতজানু হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে এক মনে বলে চলেছেন.....
'রাত্রি হলো ভোর।
আজি মোর
জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,
প্রভাতের রৌদ্রে লেখা লিপিখানি
হাতে করে আনি
দ্বারে আসি দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ......
বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না লাবণ্যর। দু'কান ভরে শুনে যাচ্ছিল সুন্দর উচ্চারণ গুলোকে। ওর সেই চেনা মাকে দু'চোখ ভরে দেখছিল ও। আর প্রাণভরে দেখছিল ওর প্রাণপুরুষকে.. যার জন্মদিনের সুন্দর সকাল ওর হারিয়ে যাওয়া মাকে ফিরিয়ে দিল আবার নতুন করে..
মায়ের গাল বেয়ে জলের ধারা.. সব বিস্মৃতির অতলেও রবীন্দ্রনাথ থেকে গেছেন মনের কোন অতলে। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সাথে কান্না ভেজা গলায় একসাথে বলে চলল....
'আর সে একান্তে আসে
মোর পাশে
পীত উত্তরীয় তলে নিয়ে মোর
প্রাণদেবতার
স্বহস্তে সজ্জিত উপহার _
নীলকান্ত আকাশের থালা,
তারি'পরে ভুবনের উচ্ছলিত সুধার
পিয়ালা......
উত্তরাধিকার
সৈকত সাহা
"এই শুনছ, আজ একটু দেখবে না।"
"আজ একটু দেখায় যায়, অসুবিধা কি, ও তো নিজে থেকে কিছু চাইছে না" অসীম মনে মনে ভাবল।
" অনেকেই তো মিষ্টি খেতে দিতে চাই, ও এতদিন নিত না, আজ তো নেওয়াই যায়।"
অভয় মাস্টার কোনদিন রেকর্ড বার করতে পারতো না, যদি পিয়ন অসীম এত সাহায্য না করতো।
ফরম ফিলাপ থেকে জমা দেওয়া পর্যন্ত, এবং বাবু দের দিয়ে সই সাবুদ, সব ও দায়িত্ব নিয়ে করেছে।
রজত বাবু, দীনেশ বাবু ওকে ঠিক পছন্দ করে না, কারণ ও যে কেস গুলো নিয়ে আসে, তাতে একটা টাকাও পাওয়া যায় না। কিন্তু ও গেলে নাও করতে পারে না। কারণ অংকে মাস্টার্স করা অসীম এর শিক্ষাগত যোগ্যতাই শুধু নয়, ওর বাবার প্রবাদ প্রতিম সততাও ওদের ভয়ের কারণ। লোকে বলে অমিয় বাবুর মতো সৎ লোক আজ পর্যন্ত কোনো ভূমি দফতরে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু আর না, সততা দিয়ে, ছ হাজার টাকার টেম্পোরারি চাকরি দিয়ে কষ্টে পেট হয়তো ভরে, কিন্তু.....
বাবাই বা কি করেছে , এত সততা দিয়ে।
বাবার সাথে যারা কাজ করতেন, তাদের তিন চার তলা বিশাল বাড়ি, গাড়ি, সবাই তো বেশ সুখে আছে।
আর ওর বাবা, অবসরের দু বছরের মাথায়, ক্যান্সার হয়ে মারা গেলেন। এমন স্টেজ এ ধরা পড়লো চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দিলেন না।
ভাবতে ভাবতে চোখ টা ভিজে গেল অসীমের।
না আর না, আর কোনো দ্বিধা না, বিনিতার সকালের কথাটা ভাবতেই হবে। ওই মেয়েটাই বা কি পেয়েছে ওকে বিয়ে করে। না সুখ, না গয়না, বাবার সময় নিজের মেয়েদের থেকেও বেশি করেছে। ওর কী দোষ? অসীম শিক্ষিত হয়েও কিছু করতে পারেনি, বাবার দয়াতে একটা টেম্পোরারি চাকরি করছে।
একটাই শখ বিনুর, ছেলেটা যেন ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তাও অসীম পারছে না।
ধূর আজ ও দেখবেই, আজ ও টাকা নেবেই। নিজে চাইবে না, যা মিষ্টি খেতো দেয়, তাই নেবে।
নিজের মনে যুদ্ধে জিতে, অসীম অফিসে আসে।
সামনেই অভয় মাস্টার দাঁড়িয়ে আছে, ওই ডেকেছিল সকাল সকাল।
অভয় মাস্টারের হাতে রেকর্ডের কাগজটা তুলে দিয়ে, অসীম চেয়ার টেবিল পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়লো, আর আড় চোখে মাস্টারের কাজ কারবার দেখতে লাগলো।
মাস্টারের চোখে জল।
"জানো বাবা, এই রেকর্ডের জন্য এতদিন জমি বেচতে পারিনি, এই অফিস, ওই অফিস, কতদিন। ধার দেনা করে মেয়েটাকে বিদেশ পাঠালাম। টাকার জন্য কী ওর পড়া আটকে থাকতে পারে?"
"আমাকে ওরা বলেছিল, এ কাজ শুধু আমিয়দার ছেলেই করতে পারবে, যেমন বাবা সেরকম ছেলে।"
"না না একি বলছেন স্যার, কোথায় বাবা আর কোথায় আমি"
অভয় মাস্টার পকেট থেকে দুটো 500 টাকার নোট বার করে অসীমের হাতে দিয়ে বললো, "বাবা, এটা দিয়ে নাতিটার জন্য কিছু নিয়ে যেও, আমার নিজেই যাওয়া উচিত ছিল।"
"স্যার, কি বলছেন, আমি আমার বাবার ছেলে স্যার, আপনাদের আশীর্বাদে নাতির কোনোকিছুর অভাব নেই। এটা নিতে বলবেন না।"
সকাল থেকে নিজের মনের সাথে এত যুদ্ধ, সব শেষ।
পরাজিত সৈনিক অসীম মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
জানলা দিয়ে অসীম কে আসতে দেখে বিনিতার বুক থেকে পাথরটা নেমে গেছে। অসীমের মুখ দেখেই ও বুঝে গেছে, আজও ও পারে নি।
দরজা খুলতেই অসীম বললো, "পারলাম না গো"।
" ভালো হয়েছে, পারোনি। আমাদের কিছু না থাক, ওই গর্বটা তো আছে। আমার, আমার ছেলের কিছু লাগবে না। আমায় তুমি ক্ষমা করো। "
সকাল থেকে এই প্রথম অসীমের মুখে হাসি ফুটলো, বিনিতাকে জড়িয়ে ধরলো। আর ঠিক তক্ষুনি একটা ঠান্ডা হাওয়া ওদের মাথায় যেন আশীর্বাদের মতো হাত বুলিয়ে গেল।
অন্য নববর্ষ
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
পয়লা বৈশাখ ,বাংলা সনের প্রথম দিন,তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দিপনার সাথে পালিত হয়।সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।
এই পুণ্য তিথিতে একসাথে আনন্দে মেতে ওঠাটাই সুছন্দা আর রিয়াজের বহু বছরের অভ্যাস। কিন্তু এই বছরের পয়লা বৈশাখ যেন অন্যই এক বার্তা বয়ে এনেছিল ওদের জীবনে।
সেই এগারো ক্লাসের কোচিং এর দিন থেকে আরম্ভ করে একসাথে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠা আর তারপর একই অফিসে চাকরিতে জয়েন করা যেন মনে হচ্ছিল, এই যেন কয়েক দিনের আগের ঘটনা।
সুছন্দা ওদের প্রিয় সেই কফি সপে ঢুকেই এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিল।আজ পয়লা বৈশাখ হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা ভীড় ছিলনা। শহরের এই কফি সপে কোনোদিনই খুব একটা ভীড় হয়না, আর আজ তো পয়লা বৈশাখ, একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। সবাই হৈহুল্লোড় করতে শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁ তে, প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, নন্দনে ইত্যাদি জায়গায় ভীড় করে থাকে।
সুছন্দা অবশ্য চাইছিল একটা নিরিবিলি জায়গা যেখানে ও নিবিড় ভাবে ওর সবচাইতে প্রিয় বন্ধু রিয়াজের সাথে সময় কাটাতে পারবে। ও ঢুকেই দেখল রিয়াজ ওদের পছন্দের টেবিলে বসে কফি সপের বাইরের সুন্দর লেকটার দিকে একপানে চেয়ে বসে আছে। কী জানি কী এত ভাবছে।
প্রত্যেক বারের মত সুছন্দা পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে রিয়াজের চোখটা চেপে ধরল, কিন্তু আগের মত রিয়াজ আজ অন্যদের নাম না নিয়ে সরাসরি সুছন্দার নাম নিতেই, সুছন্দা একটূ অবাক হল। ও বলেই ফেলল, "তুই এরকম করলি কেন? তুই কী ঠিকই করে নিয়েছিস, পুরনো সব অভ্যাস ত্যাগ করবি?" রিয়াজ ঠিক আগের মতই কিছু বলল না, শুধুই মুচকি হাসল। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, "কি রে, সু কি খাবি বল?" দুজনেই হো-হো করে হেসে উঠল। এরপর দুজনে মিলে সুমধুর স্মৃতি গুলোকে রোমন্থন করতে লাগলো। কত না আনন্দ করতো, কত স্বপ্ন বুনতো।
এবার স্বপ্ন ভঙ্গের পালা। রিয়াজ ওর গালে আর কপালে মিষ্টি করে চুমু খাওয়ার পর বলল,"পাগলী, আজকের পর আমাদের আর কোনোদিন দেখা হবেনা। আমরা নিরুপায়, তাই না। তোকে তোর মরণাপন্ন মায়ের শেষ ইচ্ছে রক্ষার্থে সিদ্ধার্থ কে বিয়ে করতে হবে। তুই এই সিদ্ধান্তে সুখি হবি, এটাই আমি চাই।"
এই কথাগুলো শোনামাত্রই সুছন্দার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল, চোখের কোনায় জল চিকচিক করে উঠল। দুজনেই জানত ধ্রুবসত্যটা, কিন্তু রিয়াজের এভাবে আবার মনে করিয়ে দেওয়াটা ওর কষ্টটা যেন দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল। ওর চোখের জল বাঁধ মানলনা। ও রিয়াজের হাতটা চেপে ধরল আর ওর চোখ দিয়ে অবিরল জল বয়ে চলল।
এই নববর্ষে শুধু যে বছরের দিনগুলো পাল্টাচ্ছে তা নয়, সুছন্দা আর রিয়াজের জীবনেও আমুল পরিবর্তন আসতে চলেছে। এক মাসের মধ্যেই সুছন্দার বিয়ে হয়ে যাবে সিদ্ধার্থর সাথে আর রিয়াজ পারি দেবে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে এক নতুন চাকরিতে, সুছন্দার থেকে অনেক অনেক দূরে।
শেষবারের মত একে অপরকে আলিঙ্গন করে, পয়লা বৈশাখে একে অপরের সাথে দেখা করার চিরাচরিত প্রথাকে আর না এগানোর প্রতিজ্ঞা করে কফি সপ থেকে বেড়িয়ে পড়ল। সজল নয়নে সুছন্দা, রিয়াজের দিকে ফিরে চাইল একবার, তারপর হনহন করে বাড়ির পথে রওনা দিল। দুরে কোথাও গান বাজছিল, "দাও রাঙ্গিয়ে দাও গো এবার যাওয়ার বেলায়।"
কবিতা
প্রতিশোধ
উত্তম রাজবংশী
এরপরেও বেঁচে আছি কি করে , ভাবছিস ?
হ্যাঁ , বাঁচিয়েছেন মৃত্যুর দেবতা অ্যানোভিস ।
পাঁজর খুলে , কলিজা চিবিয়ে
নিম্নাঙ্গ জ্বেলেছিলি অনেকক্ষণ ,
প্রতিবিধিৎসিতে ভেঙে এসেছি দেখ্
প্লেস অফ পিউরিফিকেসন ।
রণংদেহী ক্ষিপ্রতায় , পুড়ে মফেটিস এই বেশ
ঘটাবেই বিস্ফোরণ , হবে ক্ষমতার অবশেষ ।
বটের ঝুরি
সুবীর
অসংখ্য বটের ঝুরি পাকিয়ে পাকিয়ে নামে গহেরি মনের ভিতর। ঠিক যেন তপোক্লান্ত ঋষির মস্তকবাহিত পিঙ্গল জটারাশি। বহু জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে খুঁজে অচেতন বনমাঝে স্থবিরতা বা নিরাসক্তি লাভ করেছে। অথবা অনুভুতিহীন সময় থেকে সময়ান্তর পাড় হয়ে যাওয়া। না হয়তো সব স্থির বিশ্বাস অবিশ্বাস ধুলো বালিকণা রোদবাতাসে জড়িয়ে মড়িয়ে একাকার হয়ে একটি স্থানুবৎ সত্ত্বায় মিশে যাওয়া।
পাকানো ঝুরি কখনো যেন ধুনকর-বাতাসের বাড়ি খেয়ে মাঝপথে থেমে গিয়ে উল্টো ঘূর্ণিতে পাক খুলতে খুলতে চিন্তাসূত্র ধরে ছড়িয়ে প'ড়ে বিচিত্রিতা ভাবনার আকার পায়, ঠিক নিউরোণের শরীরি গঠনতন্ত্রের মতো অজস্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্ররূপ খোলা আকাশের ক্যানভাসে প্রতিরূপ পায়। অথবা তাঁতযন্ত্রের টানাপোরেনে কী অদ্ভূত দৃশ্যাবলির মুগ্ধ অভিনয়। অসম্ভব জোরালো ইম্প্রেশান জমে জমে আরণ্যক বট হয়ে যায়। অরণ্যছোঁয়া বাতাসে বয়ে আসে ভাবনার আশ্বাস। অথবা নিরবয়ব কাহিনিকুল মৃত্যুনদী পাড় হয়ে জন্ম হয়ে ফিরে ফিরে যায় ইথার তররঙ্গ বেয়ে যাপনের সুর তাল ছন্দ রক্তচলাচল ওঠাপড়ার মধ্যে...
বটের ঝুরি জট পাকায় দিনের নিঃসঙ্গতায় মধ্যরাতের তৃতীয় যামে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে পর্বত সানুদেশে অচেনা নদীর শীত শীত সোতায় স্তব্ধ রক্তবাহের ধারে ... সব অন্ধকারের অতলান্তে বটের ঝুরি নামে ....
আমাদের কোনো আকাশ ছিল না
সম্পা পাল
তুমি বড়ো বিপন্ন
এই যে আমি কথা বলছি তার কোনো শব্দ পাচ্ছোনা
অথচ উঁচুতে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছো দৈনিক
কখনো শব্দের ধাক্কা, কখনো জীবন হারাবার সংশয়
বেঁচে থাকার কী দারুণ মানে ....
তবে ভয় নেই এই সিঁড়িতেই আছে পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া নরকের গেট
অসুস্থ ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে বহুদিন হাত রাখিনি
জানিনা তোমার বাড়িটাও গভীর অসুখ থেকে সেরে উঠেছে কিনা
সৌজন্যবোধটা হয়নি বহুদিন
আসলে আমাদের কোনো আকাশ ছিল না
কিন্তু সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাওয়ার অনেকটা রাস্তা ছিল
শিকড়
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
এক ঝটকায় উপড়ে ফেলেছি শিকড়
মুড়িয়ে দিয়েছি ডালপালা,
ভুলে যেতে বসেছি সবকিছু যা ছিল-
বৃষ্টির জন্য আকুল
মাটির গন্ধে ব্যাকুল।
বানিয়েছি পাতার ঘর। পাতা দিয়ে মোড়া।
লিখেছি আত্মবিস্মরণের কাহিনী
পড়া গেলে পাঠ্য, না গেলে জঞ্জাল,
ধুলো ঝেড়ে ফুলদানি সাজাই না-
বরং নতজানু হই প্রিয় ঘুমের কাছে।
পাখিরা যখন ডানা মেলে দিগন্তে
তখন জোৎস্না খুঁজি আঁধার রাতে।
মনখারাপের গল্প
নবনীতা
কিছু গল্প এমনই হয়
ঠিক এমনই..
সে গল্প জুড়ে বয়ে চলে বিরহের লোনা এক নদী
তার আশপাশে পড়ে থাকে ধূ ধূ বালি
কোথাও আর কিছু নেই
না কিচ্ছু না ...
সে নদীর দিকে তাকালে
বিষাদের গভীর ছায়ায় ডুবে যায় গল্প পাঠকের মন
মনের আনাচ কানাচে ভেসে ওঠে
অবসাদের কালো মেঘ ...
সে গল্পে কখনও লেখা হয় না
ভালো থাকার কথা ,
লেখা হয় না ভালোবাসার কথা ,
কাগজ কলম ছুঁয়ে
শুধু গুমরে গুমরে বেরিয়ে আসে
একবুক অভিমান আর দীর্ঘশ্বাস ৷
কিছু গল্প এমনই হয়
ঠিক এমনই...
এই সময় দীপ্তিমান মোদক
এই সময়, কারো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দানা।
কারোর ঘরে উপবাস.....
রক্তাক্ত মাটি থেকে আঘাত কুড়িয়ে আনা,
সাথে ফেরে বিষাক্ত নিশ্বাস।
অসহ্যকর সাইরেন বাজিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাত
কত প্রিয়জন নিদ্রাহীন।
কত 'মা' সন্তানের কপালে ছোঁয়াতে পারেনি হাত,
শ্মশানে কাটে বসন্তের দিন।
এখনো তো অনেক পথ বাকি, সহজ নয়
আগামীর পথ,এই লড়াই।
থেকে যায় প্রতিদিন দুঃস্বপ্নের ভয়
শোকের থেকে বুঝি নিস্তার নাই ?
এক নতুন ভোরের অপেক্ষায় সবাই চেয়ে
যেখানে থাকবে না ক্ষুধিত দিন।
পৃথিবী হাসবে আলোর ছোঁয়া পেয়ে,
মিটে যাবে যাবতীয় ঋণ।
একতারীনা মজুমদার
আমরা সবাই শীর্ণ গাছের নিচে
দাঁড়িয়ে আছি--
কখনো খড়কুটো জমা করি,
হয়তো বা আছে চাল, নেই চুলো
মৃত্যুর উপর দাঁড়িয়ে মৃত্যু কে দেখছি
হিংসার দাবানলে পুড়ছি বারবার
শরীরের ভিতর শীত জমে আছে,
আমরা সবাই লড়াই করতে ভুলে গেছি
হাতে হাত মেলাতে আমাদের
বড় বাধে, কোথায় যেন একটু লাগে ?
কিন্তু আমরা সন্তানকে বলতে ভুলি না-
"মানুষ হও, বড় মনের হও"
লোভের আঁধারে ডুবে বড় মন'কে খুঁজছি ।
আমরা মরে যায়নি, শীর্ণ হয়েও
বেঁচে আছি-- আশা নিয়ে
কত বিষ লুকিয়ে, তবুও আমরা
হাসি মুখে বলি, "শুভ নববর্ষ"
আমরা শুভ'র মানে বুঝতে চাই না
এই শুভ সত্যের ভিতরে কত রক্তের ইতিহাস গাঁথা হয়ে আছে ;
শুভ কে ধরে রাখতে শিখিনি
শুধু গলা মেলাই, শুভ হোক শুভ হোক
কে করবে সব শুভ ?
ছায়া দীর্ঘতর হয় শেষ বেলায়
কিছু আলো এখনো দরজায়
কড়া নাড়ছে- শুনেও শুনছি না
দেখো, যেন ফিরে না যায় !
আমরাই পারি ভালো কে আনতে
শুধু চাই একতা...।
বৃষ্টিগান
মহাজিস মণ্ডল
অবিরাম দেখছি।সপ্তপর্ণা পাতাদের আঁকিবুকি
দু'চোখের পাতায়।অবিশ্রান্ত যাপনের কথামালায়
কখনও জমেছে মেঘ কখনও বা জোছনা।
রাত্রির গভীরে যে শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিধারে গোপনে
আমি তার উদ্ধত ফণা জাপটে ধরে
উজাড় করে ফেলি সমস্ত করাল অন্ধকারের থাবা।
আর রক্তক্ষরণ নয়, অবারিত আকাশের দিগন্তে
এবার ঝরুক মানবতার বৃষ্টিগান...
বড্ড অসহায়
শিল্পাশ্রী রায়দে
ভালোবাসি খুব
তাই ভয় হয় -
আজ কত বছর পর কাছে এলে
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুম পাড়াবে বলে
চোখ বুজে আসে আদরে
তুমি চুমু খেলে কপাল ছুঁয়ে।
মায়ের আদরে আফিমের চেয়ে বেশি নেশা থাকে,
বুঝলাম, প্রথমবার-
আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি-
যদিও আমি ঘুমোতে চাই না ।
আমি ঘুমোলে তুমি চলে যাবে জানি--
তোমায় ভালোবাসি খুব, তাই ভয় হয়-আবার যদি হারিয়ে ফেলি-
যেওনা মা,মা ছাড়া, ধরিত্রী মাও যে বড্ড অসহায়--
যদিমধুমালা বিশ্বাস (নুপুর)
জীবনটা যদি সিলেবাসের মতো
জানা বিষয়েই আবদ্ধ থাকতো
হতো কোনো মিষ্ট স্বপ্ন ঘেরা ঘুম
বা কবির কবিতা,
কিন্তু নির্মম পরিহাসে জীবন হয়ে গেল
দেশ বিভাজনের কাঁটাতার।
সমুদ্রের শান্ত নীল আভার মতো জীবন
শান্তি খুঁজে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে...
শিল্পী- সম্পূর্ণা নন্দী
সাম্প্রতিক
ছোট্ট রবির সুখ দুঃখ
কবিতা বণিক
রবি ঠাকুরের বাড়ির দর্জি নেয়ামৎ খলিফা।
পকেট ছাড়া জামা বানালে রবিকে দুঃখ দিত তা।
ছোট্ট রবির দুঃখের কথা কেউ বুঝত না।
শ্যাম চাকরের গণ্ডী ছিল বড় কঠিন।
গণ্ডী পেরোলেই বিপদ, রবি ছিলেন সদা সাবধান।
মনে পড়ত সীতার গণ্ডী। পেরোনোর পর।
এসেছিল বিপদ হয়ে রাক্ষস রাবণ!
পণ্ডিত মশায়কে ঠাণ্ডা রাখতে, তার প্রিয় আমসত্ত্ব আর কেয়া খয়ের চুরি করা হতো, ভাগ্নে সত্যর সাহায্য নিয়ে।
দীনবন্ধু মিত্রের " জামাই বারিক প্রহসন"
ছোট্ট রবির সে বই পড়া বারণ।
বই থাকত বাক্সে তালাবন্ধ অবস্হায়।
অগত্যা বই চুরির ফন্দি, প্রথম অসফল।
পরে পান , দোক্তা সামনে রেখে চুরির কৌশল।
আঁচল থেকে চাবির গোছা হল চুরি, বই পড়া শেষে চাবির গোছা ফেরত।
চুরির কাণ্ড শুনে হাসাহাসিই ছিল অধিক।
সন্ধ্যেবেলার পড়া ছিল মকলকস কোর্স অফ রীডিং।
কালো মোটা বইএর শক্ত ভাষার নির্দয় ফিডিং।
না আছে ছবি বইটায়, না কোন ভাললাগার কারণ।
ছিল মাষ্টারের ধিক্কার আর কঠিন বানানের উচ্চারণ।
ভাল না লাগার জেরেই হত ঢুলু ঢুলু চোখে ঘুমে অচেতন।
আলোচনা
কাব্যগ্রন্থ- ধ্রুপদী শূন্যতাকবি- পার্থ সারথি চক্রবর্তী
আলোচক- ফিরোজ হক্
প্রকাশনা- বিরক্তিকর
প্রচ্ছদ- শ্রীহরি দত্ত
মূল্য- ৩৫ টাকা
সম্প্রতি হাতে পেয়েছি কবি পার্থ সারথি চক্রবর্তীর 'ধ্রুপদী শূন্যতা' কাব্যগ্রন্থটি। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের নামকরণেই রয়েছে বেশ গভীর ও ব্যঞ্জনাময় অর্থ। আসলে বর্তমান সময়, সমাজ ও বেকারত্ব নামক অভিশাপের কবলে পড়ে অধিকাংশ মানুষের জীবনকেই গ্রাস করে একরাশ তিক্ততা ও শূন্যতা। এমন ভাবনাকে আশ্রিত করেই হয়তো কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে।
প্রথমেই কাব্যগ্রন্থের বহিরঙ্গের দিকটি আলোচনা করা যাক। শ্রীহরি দত্তের প্রচ্ছদটি কাব্যগ্রন্থটিকে আলাদা মাত্রা দান করেছে তা বলাই যায়।
যে কোনো বই, পত্রিকা, কাব্যগ্রন্থ বা গল্পগ্রন্থই হোক না কেন পাতার মান সেই বইটিকে আলাদা মাত্রায় উন্নীত করে। আলোচ্য বইটির পাতার মান যথেষ্ট ভালো ও মুদ্রণ বেশ ঝকঝকে যেখানে কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সময় পাঠককে হোঁচট খেতে হবে না এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি।
এবার ধীরে ধীরে বইটির অন্দরমহলে প্রবেশ করা যাক। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির স্বর্গীয় পিতা সত্যরঞ্জন চক্রবর্তীকে। যেখানে কবি লিখেছেন- তিনি সবসময় কবির পাশেই রয়েছেন। সাথে রয়েছেন। হ্যাঁ, একজন পিতা হোক বা মাতা তাদের হাত সবসময় সন্তানদের মাথায় আশীর্বাদের বৃষ্টি হয়েই ঝড়ে পড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে কবির ভাবনায় বিন্দুমাত্রও খুঁদ রয়েছে একথা বলা যাবেনা।
এবার ফিরে আসি বইটির মূল স্রোতে। যেই স্রোতে রয়েছে কাব্যগ্রন্থটির গতিময়তা, গতিশীলতা ও কবির চিন্তা, ভাবনা ও সমাজ সম্পর্কে কবির কিছু প্রশ্ন ও বার্তা। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা 'মুখোশ'। যেখানে কবির পক্ষে প্রকৃত মুখ ও মুখোশ চিনে ওঠা সম্ভব হয়নি।
কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় কবিতা 'ঈশ্বরী'। যেখানে কবি প্রকৃত ঈশ্বরীকেই আরাধনা করতে চেয়েছেন অথচ সেই ঈশ্বরীকেই সমাজ অন্য চোখে দেখে। যিনি সমাজে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। অর্থাৎ এই কবিতায় নারীর বর্তমান অবস্থা ও চিরকালীন প্রশ্ন সমাজের জন্য ছুঁড়ে দিয়েছেন। কবি এই উপেক্ষিত সমাজে থেকে বুঝতে পেরেছেন, নারীদের সফলতার পথ দেখাতে পারে একমাত্র নারীরাই। অথচ সমাজ নারীকে এতরকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে যে, অধিকাংশ নারীই লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু কবি বুঝেছেন, সমাজ থেকে 'নিম্ন মানসিকতার কলঙ্ক' মুছে ফেলতে হলে এগিয়ে আসতে হবে নারী অর্থাৎ ঈশ্বরীকেই। তাই কবি বলেছেন-
"জানি, তোমারও সীমাবদ্ধতা আছে,
তাই বলে ঈশ্বরী হবার চেষ্টা ছাড়বে না;
নাকি জনমদুখী নারী হয়েই থাকবে!"
কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় কবিতা 'আহুতি' -তে কবি বলেছেন, সময় দৈত্যের মতো আগুন নিয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে অথচ আমরা ঘৃণা ও দ্বেষকে অবলম্বন করে নিজেদেরকে চিতায় জ্বালিয়ে তুলছি। কবি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে 'ঘৃণা ও দ্বেষ' -কে 'পবিত্র আগুনে আহুতি' দেওয়ার কথা বলেছেন।
কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতায় কবি 'পরকীয়া' নামক অবৈধ প্রেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কলম তুলেছেন। একসময় আমরা ভালোবাসায় জড়ানো বিশ্বাসের বাহু ছেড়ে দিয়ে ভুল তারার ইশারায় নাচি এবং যখন বুঝতে পারি তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। কবির কথায়-
"এককালের ভালোবাসা জড়ানো বিশ্বাসের বাহু,
ভুল তারার ইশারায় বন্ধনের কানাগলি হয়ে গেলে,
প্রাপ্তির জানালায় উঁকি দেয় অবৈধ পরকীয়া রোদ।"
কাব্যগ্রন্থের পঞ্চম কবিতায় কবি এক মায়াবি অতীত চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। একটি গাছতলার নিচেও যে হাজারো সংসার পাতানো থাকে, পাশাপাশি সেই গাছতলা না থাকলে কতকিছু যে হারিয়ে যায় তা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন 'গাছতলার মায়া' কবিতায়।
'রক্তক্ষরণ' কবিতায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যা সর্বসম্মক্ষে গোপন করা সম্ভব হলেও নিজের কাছ থেকে গোপন করা অসম্ভব। তাই কবি লিখেছেন-
"হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে থাকে
মুখের কপট হাসির অন্তরালে"
'দ্বিধাবিভক্ত' কবিতায় কবি খুব সুন্দরভাবে সমকালীন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন যেখানে একটা 'লেভেল ক্রসিং' ভাগ করে দিয়েছে দুটি গ্রামকে। পাশাপাশি কবি ব্যঞ্জনা মিশ্রিত শব্দে বলেছেন-
"এভাবে মানুষের হৃদয়ও কেন ভাগ হয়ে যায়!" এই কেন চিরকালীন প্রশ্ন যার উত্তর কেউ দিতে পারেনা।
'আবর্তন' কবিতায় জীবনজুড়ে যন্ত্রণার ছবি তুলে ধরেছেন কবি। 'কবিতার বনবাস' কবিতায় কবিতার সঙ্গে মান-অভিমানের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কবি। কবিতাকে ঠিক কতটা ভালোবাসেন কবি, তা এই কবিতা থেকেই বোঝা যায়। সবশেষে সকল কবির মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বিস্মিতভাবে কবি বলে ওঠেন-
"দুঃখকেই ভালো না বাসলে কি-
কবিতা হয়!"
কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতায় হয়তো কবির মেজাজের আবহাওয়া ধরা পড়েছে। আলোচ্য কবিতায় প্রশ্নের মিলিয়ে যাওয়া, পরিকল্পনা মাফিক জীবন, আবেগ ভেঙে বিশৃঙ্খলা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বলিদান দেওয়াকে তুলে ধরেছেন কবি। সবশেষে কবি বলেছেন-
"হাওয়া অফিসের রোজকার বুলেটিনে-
কোন আভাস থাকেনা কোনদিনই।" কবির লেখা এই দুটি পঙক্তির সঙ্গে জীবন মিলে যায়। হ্যা, আবহাওয়া দপ্তরের রোজকার বুলেটিনের যেমন কোনো আভাস থাকেনা তেমনি মানুষের রোজকার মেজাজেরও কোনো ঠিক থাকেনা।
কিন্তু এতকিছুর পরও কাব্যগ্রন্থটি বেশ কিছু দিক থেকে আরও উন্নত করা যেত বলে আমার মনে হয়। কবিকে আরো সংযমী হতে হতো। এছাড়াও বেশ কিছু কবিতার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা কবিতাগুলিকে একটু অপরিণত করেছে অর্থাৎ আবেগে বেশি বলে ফেলেছেন বলে আমার মত। পাশাপাশি কবির অধিকাংশ কবিতায় আশার বন্ধন দেখা যায়নি। কিছুটা হলেও আশা ও মুক্তির পথ দেখাতেই পারতেন কবি।
তবে, বর্তমানের অরাজকর সময়ে দাঁড়িয়ে কবির পক্ষেও হয়তো আশার বৃথা গান গাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ হিসাবে কবিতাগুলি যথার্থ।
কবিতা/ছড়া
শিক্ষা চন্দ্রানী চৌধুরী
তোমার মতো উদার হবার
স্বপ্ন জীবনভর
আগলে রেখো হে আকাশ
দিও আমায় বর ।
তোমার মতো হিমালয়
হব উচ্চশির
আশা জাগে মনের কোণে
হতে হবে বীর ।
গাছ মায়ের মতোই হব
সরল মন-প্রাণ
অন্তরেতে উথলে ওঠে
জমাট বাঁধা গান ।
চাঁদের মিঠে আলো হব
কলঙ্ক না ছুঁয়ে
জীবন গড়ার শিক্ষা দিও
ভালোবাসা নিয়ে ।
হাসি
সৌমেন দেবনাথ
প্রাণটা খুলে দুঃখ ভুলে
হাসতে হবে হাসি,
প্রাণের আরাম মনের আরাম
দুটোই বাড়বে বেশি।
হাসলে কভু হয় না খরচ
ঝরুক হাসির বৃষ্টি,
হাসিটা হোক নির্মল হাসি
হাসিতে সুখ সৃষ্টি।
হাসিতে হোক বিশ্বটা জয়
নয় কটাক্ষ হাসি,
হাসি হোক বন্ধুত্বের চিহ্ন
হাসি হয় না বাসি।
হাসিতে দূর কর্ম ক্লান্তি
গৃহে আসবে সুখ ভোগ,
হাসির মূল্য যে অমূল্য
দূর করে রোগ বা শোক।
সোনা রাঙা বৈশাখ
মজনু মিয়া
বৃষ্টি বাদল হলে মাটি ভিজে নরম উর্বর হয়
নানান রকম ফসলের বীজ বুনে কৃষক তখন
শুদ্ধ বীজে সঠিক ফসল কৃষক জানে নিশ্চয়
বৈশাখের লাগিয়া পুষ্টুবীজ পোষে রতন।
ইরি ধানের সোনালি রূপ বাতাস করে খেলা
আঙিনাতে উঠতে ব্যাস্ত কৃষক মুখে সুখছবি
কাজে কর্মে উপযুক্ত সময় ফুরিয়ে যায় বেলা
আবার গৃহ কর্মে ফিরে পূবে যখন উঠে রবি।
সুখে দুখে মিলেমিশে নয়া বছর বৈশাখ সাজায়
হাজার আনন্দ উল্লাস দিয়ে মনে ধরা বাঁচায়।
বৈশাখ নামা
শাহীন রায়হান
প্যাঁপো প্যাঁপো বেজে যায় বাঁশি
চারদিকে উৎসব আলো রাশিরাশি
হাতপাখা সেজেগুজে হেসে যায় খুব
নাগরদোলা নেই একটুও চুপ।
লাল নীল বেলুনের কিযে মাতামাতি
হেঁটে যায় হনহন পথিকের ছাতি
মুখোশের তোড়জোড় চোখে নেই ঘুম
ইলিশ পানতায় আজ পরে গেছে ধুম।
দমকা হাওয়ার নেই একটুও লাজ
উড়ায় খুকুর চুল আলপনা সাজ
আকাশের দুই ঠোঁটে গুড়গুড় ডাক
তাক ডুম তাক ডুম এলো বৈশাখ।
রাজা বাবু
বাসেদ সরকার
আমাদের রাজা, দেয় যে থাবা
ভাতের থালে ।
দেখেনা কভু, আছে বিড়ালবাবু
টেবিলের তলে ।।
বেস্ত খেতে, রোজার পরে
তাকানোর জো নেই ।
বিড়াল তবু যে, দেখে রাজাবাবুকে
ভাতের আশাতেই ।।
মাটি মহান
নয়ন রায়
মাটি রে ,
তুই এত কষ্ট সহ্য করিস কী করে ?
ব্যথা করে না তোর দেহ ?
মোরা ,ওষুধ তো দেইনা কেউ !
দৈনিক কোটি -কোটি বৃদ্ধি ভার
সহস্র -সহস্র ইঞ্জিনের অত্যাচার
তবু যে সহ্য করিস বারংবার ;
ব্যথা করে না তোর দেহ ?
আর মানুষ ,
একটি পিঁপড়েও যদি কাটে
তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রাণহানে !
একটিবারও ভাবেনা সেও বাঁচে প্রাণে !
মাটি তুই বড় মহান।
বাস করিতে জায়গা দিস
খিদে মিটাতে ফসল ;
গর্ভ হইতে জল খাইয়ে
বাঁচিয়ে রাখিস জীবন ।
এত দানের প্রতিদানে, মানুষ পাপী
কষ্ট দেয় প্রতিক্ষণে ; করুণাময়ী তোর প্রাণে !
কৃষকের ফসল ঘাটে
তিরুষ্কারে আঘাত হানে ,
হতভাগি মাটির প্রাণে !
মাটি করুণাময়ী তুই ,শান্তি পাবি তুই ।
যত তোর দান দেখছে ভগবান ,
মাটি তুই বড় মহান !
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮
No comments:
Post a Comment