পাঠ প্রতিক্রিয়া
কাব্যগ্রন্থ: মনীষা, তোমাকে
কবি: সুদীপ দত্ত
প্রকাশনা: গাঙচিল
মূল্য: ১২৫টাকা
আলোচক: শৌভিক রায়
পঞ্চাশটি কবিতা নিয়ে গাঙচিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুদীপ দত্তের 'মনীষা, তোমাকে'। সীমা মন্ডলের প্রচ্ছদে, গাঙচিল প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মতোই, দামি কাগজের ওপর ঝকঝকে মুদ্রণের কাব্যগ্রন্থটি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
উত্তরের সাহিত্য জগতে সুদীপ দত্ত মূলত গদ্যকার হিসেবে পরিচিত। ছোটগল্প লিখেও পাঠকমহলে সমাদৃত তিনি। কিন্তু কবিতা জগতেও তাঁর গতিবিধি স্বচ্ছন্দ। তাই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে অনায়াসে লিখেছেন 'এখন আমার কোনও অসুখ নেই/ ক্ষোভময় এই বেঁচে থাকার সঙ্গে/ প্রথাগত সহবাস করি উলঙ্গ শরীরে' বা 'বারবার মৃত্যুকে শুনিয়েছি জীবনের পদাবলী/ আমিই সে/ সাদা কালো মুছে রঙিন এঁকেছি সমস্ত সুড়ঙ্গ-গলি' ইত্যাদির মতো চমকে দেওয়ার মতো বেশ কিছু লাইন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে অনেকটা সরে এসে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে কবি বারবার নিজেকে ভেঙেছেন। একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। কিছু কবিতায় এক বা দুই লাইনে ভাবনার অসামান্য প্রকাশ করেছেন কবি। যেমন- 'মুকুট মানে নদী। অনুকূল স্রোত। নৌকো।` অথবা 'মুখোশের দু চোখে কী রেখেছ তুমি? ভালবাসা না বেদনা?` সমসাময়িক বেশ কিছু শব্দবন্ধ যেমন '৬৪ জি বি মেমরি কার্ড', 'হোয়াটসআপ মেসেজ`, 'ফোর জি নেটওয়ার্ক`, 'অলীক ডিপির ফেসবুক মেয়ে` ইত্যাদি কবিতাগুলিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আবার 'হে চিরপ্রণম্য অগ্নি`, 'শ্রাবস্তীর কারুকাজ` ইত্যাদি কিছু শব্দবন্ধে চিরন্তনতার সুর বেজে উঠেছে।
আসলে আবহমানতার যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমনই পরিবর্তন হয় না মানুষের আবেগ ও অনুভূতির। সর্বদেশে সর্বকালে তা একই থাকে। কবিতা শুধু আলাদা হয় শব্দ চয়নে ও ব্যবহারে। অত্যন্ত পারদর্শীতার সঙ্গে কবি সেই কাজটি সম্পন্ন করেছেন এবং সমসাময়িক কবিদের থেকে সরে কবিতার নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করেছেন। এখানেই কাব্যগ্রন্থটির সার্থকতা। আলাদা ভাল লেগেছে 'স্বপ্ন`, 'ভাত খেতে ভয় পাই`, 'ছায়াপথ`, 'বিভাজিকা`, 'দুপার` ইত্যাদি কবিতাগুলি।
এই কাব্যগ্রন্থের 'মনীষা` সিরিজের বারোটি কবিতায় কবি আগের কাব্যগ্রন্থের মতোই কবির অনবদ্য সৃষ্টি। তীব্র আবেগ মেশানো কবিতাগুলিতে কবিকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। এই সৃষ্টিগুলিতে টানটান শহুরে ভাষা ব্যবহৃত হলেও, সুরে ও মননে কবি চিরদিনের সেই প্রেমিকাকে খুঁজে চলেছেন। আর সেই অন্বেষণে মণিমুক্তোর মতো তুলে এনেছেন 'শপিংমলের টানটান মেয়ে তাচ্ছিল্যে তাকায় আমার দিকে, যেন আমি কাঙালেরও অধম`, 'পৌষালি দুপুরে কমলালেবুর কোয়া দেখে ইচ্ছে করে মনীষাকে চুমু খাই বেহিসাবি', 'মনীষার জন্য আমার কাছে আস্ত একটা পালতোলা নৌকা আছে` ইত্যাদি লাইনগুলি।
মুদ্রণের ক্ষেত্রে প্রকাশক সেন্টার অ্যালাইন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেটি দৃষ্টিনন্দন হয় নি। সাবেক লেফট অ্যালাইন বোধহয় সঠিক ছিল। কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে প্রবাদপ্রতিম অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যকে। সেদিক থেকেও কাব্যগ্রন্থটি অন্য মর্যাদা পাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment