সম্পাদকের কথা
কবি লিখেছেন 'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?`
কখনও এমনটি মনে হয় ঠিকই।
আসলে সবসময় বহন করি যাঁকে, যিনি আমাদের অন্তরে তিনি কি সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন মাত্র দুটি দিনে?
তাই আর কোনও কথা নয়।
তাঁকে ভাবা শুধু, শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়....
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
২২ শ্রাবণ
যাজ্ঞসেনী
শুয়ে আছেন কবি মুদিত নয়ন
মৃত্যুতেও যেন আবার জীবন চয়ন
স্তব্ধ বাতাস, লিখিছে শোক গাথা
শূন্য পৃষ্ঠা সকল, শূন্য খাতা
ভিজিছে চরাচর আজি, বরিষণ ধারা
হৃদয় সমগ্রে শোক, স্বজন হারা
দহনে অগ্নি আর আঁখিতে প্লাবন
শূন্য এ বুকে, ২২ শ্রাবণ
মুজনাইতে এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে সেই বাইশে শ্রাবণ (৮ই আগস্ট) আমি দুই বছর বাদে দাঁড়িয়ে আছি রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত মংপুতে এক নষ্টালজিক অনুভূতি নিয়ে। মনে পড়ছে ২০১৬ সাল। এসেছিলাম কালিম্পঙে কালচারাল টুরিজমকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের উপরে যে গবেষণামূলক কাজ করছি তার তথ্য অনুসন্ধান করতে। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউসে ক্ষেত্র সমীক্ষা করে কালিম্পং ফেরত আমরা পরিকল্পনা নিলাম মংপুতে যাব। পাহাড়ের বন্ধ আর আন্দোলনের জেরে মংপুতে তখন টুরিস্ট আসত না বললেই চলে। অনেক দিন ধরেই ওই ভবনের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ ছিল পর্যটকদের। ফলে সবাই বাইরে থেকেই ভবনটি দেখে ফিরে আসতেন। অপেশাদার জার্ণালিস্ট এবং লেখক হিসাবে বিশেষ অনুরোধে ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলাম। তবে ছবি তোলা বারণ ছিল। বাইরে থেকে ছবি নিয়েছিলাম। তখন ভবনটির অবস্থা ছিল করুণ। ছাদের কোণ দিয়ে জল পড়ছিল। মোটামুটি ভেঙে পড়ার দশা। আসবাবপত্র ও আলোকচিত্রগুলোর অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। কাগজে দেখেছিলাম মংপুর সংগ্রহশালা থেকে চুরি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা আসল ছবি, ছবি আঁকার রং-তুলি-কালি, পাণ্ডুলিপি, তাঁর শখের হোমিওপ্যাথির সরঞ্জাম, দুর্লভ আলোকচিত্রসহ নানা কিছু। অকুস্থলে এসে দেখেছিলাম মংপুর এই ভবনটি থেকে চুরি হওয়া মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারই তো চুরি হয়েছে। খুব রাগ হয়েছিল। বঙ্গদেশে যে স্থানগুলোতে এমন সংগ্রহ রয়েছে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঢিলেঢালা হবে কেন। আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদরাশির অধিকাংশই আমরা হারিয়েছি। তাই এই সব সম্পদের যেটুকু আমাদের দেশে রয়েছে তার নিরাপত্তায় কেন আমরা আরও যত্নবান হব না? ফিল্ড রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে ছবিসহ পাঠিয়েছিলাম হেরিটেজ কমিশন, রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, তৎকালীন পর্য্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে এবং মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে।
২০১৭ সাল। সংবাদপত্রে জেনেছিলাম মংপুর রবীন্দ্রভবন সংস্কারের কাজ শুরু করেছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল। জেনেছিলাম ৪৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মংপুতে রবীন্দ্রভবন সংস্কার করছে হেরিটেজ কমিশন এবং গৌরীপুর ভবনকেও সংস্কার করে পিপিপি মডেলে একদিকে রবীন্দ্র হেরিটেজ ভবন, সংগ্রহশালা এবং অপরদিকে বাণিজ্যিক ভবন করা যায় কিনা সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তখন রবীন্দ্র অনুরাগী হিসাবে একটু আশান্বিত হয়েছিলাম এবার হয়তো হাল ফিরবে মংপুর রবীন্দ্র ভবন এবং কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউসের। তাই সেই কারণেই অন্তরের টানে ছুটে এসেছিলাম রবীন্দ্র তর্পণে মংপু এবং কালিম্পং। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি বিজড়িত মংপুর রবীন্দ্রভবন তখন সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার কাজ চলছিল। এই কাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল বলে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কাজ চলছিল। ঠিক ছিল পরের বছর পঁচিশে বৈশাখ সেই ঐতিহাসিক ভবন আবার নতুন করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। দেখেছিলাম মূল ঐতিহাসিক কাঠামো ঠিক রেখে ওই ভবনের মেঝে সুন্দর করে তোলা হচ্ছিল। ভিতরে বাইরে রং করা হচ্ছিল। আগে বৃষ্টির সময় ভিতরে জল পড়ত। যাতে তা না হয়, তার ব্যবস্থা হচ্ছিল। হচ্ছিল আরো অনেক কাজ। পুরো ভবনটি নতুন করে রং করার পাশাপাশি ভিতরের মেঝের কাঠের পাটাতন নতুন করে তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ বৈশাখ নতুন রূপে রবীন্দ্রভবনের দরজা পর্যটকদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয়। এর কৃতিত্ব অবশ্যি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তৎকালীন পর্য্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবের।
আমাদের গাড়িটা রবীন্দ্রভবনের গেট পেড়িয়ে গিয়ে থামতেই এগিয়ে এসেছিলেন শিশির রাহুত। মংপু রবীন্দ্রভবনের কেয়ারটেকার তথা গাইড, তথা সব কিছু। সেই প্রথম পরিচয়। কুইনাইন ফ্যাক্টরির প্রবেশদ্বারের ঠিক উল্টোদিকে রবীন্দ্রভবনে ঢুকবার রাস্তা। ঢুকেই বাগান। বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। বারান্দায় সাদা চাদরে ঢাকা চেয়ার, চেয়ারে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির পেছনে মৈত্রেয়ী দেবী-কৃত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাম্রলিপি যাতে বাংলা, হিন্দি আর নেপালি ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন পালকিতে সওয়ারি হয়ে সাড়ে ছ-মাইল থেকে মংপু যেতেন তখন কবিগুরুকে পালকিতে করে নিয়ে আসতেন ভীমলাল রাহুত। রম্ভি থেকে মংপু পর্যন্ত পথ উঠে গেছে একেবারে মংপুর পাহাড়ের শীর্ষে। তখনকার পালকির সর্দার ছিলেন ভীমলাল রাহুত। তাঁরই নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জনে মিলে পালা করে মংপু পাহাড়ে নিয়ে আসা হতো কবিগুরুকে। বর্তমান রবীন্দ্র ভবনের কেয়ারটেকার শিশির রাহুতের ঠাকুরদাদা ছিলেন ভীমলাল রাহুত। শিশির রাহুত তাঁরই সুযোগ্য নাতি। দাদুর সুবাদে শিশিরবাবুর বাবাও কবিগুরুকে দেখেছেন। শিশিরবাবুর রক্তে তাই মিশে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। শিশির রাহুতের কাছ থেকে জেনেছিলাম ১৯৫৪ সালে মৈত্রেয়ী দেবীর উদ্যোগে এই বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমকল্যাণ দপ্তর দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। তারা ছিলেন ২০০০ সাল পর্যন্ত। এখানে তখন দপ্তরের পরিচালনায় স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাচের স্কুল, সেলাই স্কুল ইত্যাদি চলত। তাদের জন্যে ব্যবস্থা ছিল ক্যারাম বা টিটি খেলারও। ২০০০ সালে তখনকার নগর উন্নয়ন দপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়িটিকে মিউজিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইভাবে সংস্কার প্রক্রিয়া চলে। স্থানীয় মানুষ, সরকারি কুইনাইন ফ্যাকট্রি এদের নিয়ে গড়া হয় কমিটি। তখন থেকেই শিশির রাউত মিউজিয়ামের দায়িত্বে।
শিশিরবাবুর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম ওই সময় থেকেই রবীন্দ্রভবনের রক্ষণাবেক্ষণের আর্থিক দায়িত্বে নিয়মিতভাবে আর কেউ থাকে নি। মুখে এক স্থায়ী বিষন্নতা নিয়ে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রভবনের নির্মাণটিকে ঠিকঠাক রাখা বড় অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন দিন। না জিটিএ, না রাজ্য সরকার কারুরই দায়িত্বে নেই এমন মূল্যবান ঐতিহাসিক আবাস। কাজেই কোনও অসুবিধেয় পড়লে সরকারি অফিসে ছুটোছুটি আর ধরাধরির একশেষ হতে হয়েছে। ২০০৬ সালে স্থানীয় সাংসদের এমপি ফান্ডের টাকায় কিছু সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল ঝড়ে দুটো গাছ ভেঙে পড়েছিল। ফলত, বাড়ির ডানদিকের বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অনেকবার পাহাড় সফর করেছেন। তিনি মংপুতে এসেছিলেন তিনবার এবং শিশির-দীপেনদের বক্তব্য অনুযায়ী রবীন্দ্রভবন নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী নাকি কথাও দিয়েছিলেন। শিশিরবাবুর যুক্তি ছিল, কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-জড়ানো বাড়ি গৌরীপুর ভবনের অবস্থা এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। আইনের বাধা না থাকলে গৌরীপুর বা মংপুর রবীন্দ্র-মিউজিয়ামের দায়িত্ব নিতে পারে জিটিএ। যেহেতু মংপুর রবীন্দ্র ভবনের আরেক অংশের পরিচালনায় তারা আগে থেকেই নিয়োজিত আছে। শুধু দরকার এ ব্যাপারে তাদের একটু উদ্বুদ্ধ করা।
রবীন্দ্র অনুরাগী অসংখ্য পর্যটক মংপু রবীন্দ্র ভবনে ভিড় জমান। শিশিরবাবুই পর্যটকদের গাইডের কাজ করে দেন। বাংলা, নেপালি, হিন্দি এবং কিছুটা ইংরেজিতেও কথা বলতে পারেন। কত আর আয় হয় তাঁর! সকাল সকাল এসে রবীন্দ্রভবন পরিষ্কার করেন। পর্যটকেরা এলে চাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন দরজা খুলে দিতে। কোনো পর্যটক না থাকলে রবীন্দ্রভবনের দরজা বন্ধ করে গাছতলায় কিছুক্ষণের জন্য বসেন, গাছের ছায়ায় বসে মাথা কাত করে গান গেয়ে যান শিশিরবাবু। শিশিরবাবুর কথা বলা এবং গান গাওয়ার একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে। এই নিয়ে চলছে তাঁর জীবন সংগ্রাম। জেনেছিলাম ১৮৬৪ সালে তৈরি হওয়া যে গভর্নমেন্ট কুইনাইন ফ্যাকট্রি রবীন্দ্রভবনের ঠিক মুখোমুখি রয়েছে তার পরিচালকেরা একজন মালিকে বহাল করেছেন বাড়ি-বাগান সাফসুতরো রাখার কাজে আর রবীন্দ্র মিউজিয়াম দেখাশোনা করেন শিশির রাউত। তাঁকে কারখানা কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন মাসে খুব সামান্য মাসোহারা যা দিয়ে শিশিরবাবুর সাংসারিক দায় কোনমতেই মেটে না। রবীন্দ্রভবনেই একটা গ্রন্থাগার রয়েছে এরিয়া লাইব্রেরির নামে। তার লাইব্রেরিয়ান দীপেন তামাং জিটিএ-র বেতনভোগী কর্মচারি। তিনিও একমত ছিলেন মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ আর তার ইন-চার্জের পরিশ্রমের বিনিময় মূল্য এই দুটোর ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার।
শিশিরবাবুর কাছ থেকেই জেনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ মংপুতে শেষ এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ২১ শে এপ্রিল। ২৫ শে বৈশাখের অনুষ্ঠান পালন করে চলে যান কালিম্পঙে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রথমে কালিম্পঙে এলেও মংপুতে আর আসতে পারেন নি। কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন আসবার জন্য। তাই হয়তো আসবার আগে পাঠিয়েছিলেন নিজের ওষুধের কৌটো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি নিরুপায় হয়ে কলকাতায় ফিরে যান। রবীন্দ্রস্মৃতি ধন্য মংপুর ভবনে আজও রক্ষিত সেই কৌটোগুলি। শুধু ওষুধের কৌটোই নয়, ষোলোটি ঘরের এই বিরাট ভবনটিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত খাট, তোশক, বিছানা। তাঁর নিজের নকশায় তৈরী চেয়ারটিও যত্নে রাখা। চেয়ারের ওপর রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত কুশনটিও। রক্ষিত কবি ব্যবহৃত রঙের বাক্স। প্রতিটি ঘরেই রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য নিদর্শন, ব্যবহৃত সামগ্রী। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য আনা এক আনা দামের ন্যাশনাল হেরাল্ডের একটি কপিও। বেশ কিছু দামি ফোটোগ্রাফও রয়েছে, তবে অযত্নে সেগুলির দশা অত্যন্ত সঙ্গীন। আজ এই বাড়িটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। দেখে নেওয়া যায় স্মৃতিভবনের সবকিছুই, এমনকি ইট ও বালি দিয়ে বানানো বাথটবটিও। রবীন্দ্রস্মৃতি ভবনের বর্তমান কেয়ারটেকার শিশির রাউত উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে গাইড করেন পর্যটকদের। নেপালি মানুষটার কন্ঠস্থ কত-কত কবিতা, নিখুঁত সুরে গাইতে পারেন কত যে রবীন্দ্রসংগীত কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তা ভাবাই যায় না। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষা করেন শিশিরদা, অথচ সম্মানজনক পারিশ্রমিক প্রদান করে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে কি রক্ষা করতে পারে না রাজ্য সরকার বা জিটিএ?
তুমি রবীন্দ্রনাথ
চিত্রা পাল
ছোট্ট শিশু অবাক আঁখি অবুঝ স্বপ্নভরা
অবোধমন অবাধছোটা নেই তো কোন বাধা।
নৌকো ভাসা বর্ষা,শীত বসন্তের খেলা
সব ভরে দেয় ওদের মনে তোমার কথামালা।
দৃপ্ত কিশোর তপ্ত অতি জব্দ করার লোভে
তোমার তূণের তীরটি গাঁথে ঠিক নিশানাতে।
যৌবনেরই উচ্ছলতা আবেগ আদর মান
তোমার সঙ্গ সবাই যাচে নেইকো অভিমান।
জীবন পারাবারের খেয়ায় ক্লান্ত দুটি চোখ
তোমায় ধরে সাঁতরে চলে এই মর্ত্যলোক।।
কোপাই
সুপর্না চৌধুরী
সকাল নটা বাজে। বাড়ির কাজ সারছিলেন রমাদেবী। বহুদিন কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে গৃহবন্দী তাঁরা। ছেলে সুবীর কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করে। তার 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চলছে। তাই করোনাকালে এসময়টা আর অফিসের ভাত দেবার কোন তাড়া নেই।
বাড়ির দরজায় সব্জী, ফল, মাছ নানা পণ্য নিয়ে বিক্রেতারা চেনা সুরে হেঁকে যাচ্ছে। আজ আর কিছু দরকার নেই তাঁর। তাই আজ বাড়ির কাজেই লেগে আছেন। একটা অনামী মন- খারাপ ভারী হয়ে ঝুলে আছে তাঁর বুকের মাঝে। ভারী বুকের গভীরে একটা সুর যেন থেকে থেকে চলকে উঠছে —
" বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি ।/ শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে/ ঊর্ধমুখে নরনারী ।।"
আচ্ছা! তিনি কি সত্যিই জানতেন একদিন পৃথিবীর এমন গভীর অসুখ হবে, আর মানুষ তাঁর গানের ডালি থেকে এমন একটি ফুল নিয়ে ঈশ্বরের কাছে তাঁদের কাতর প্রার্থনা জানাবেন? কাজ করতে করতে এই রবীন্দ্রগানের সুরটা আপন মনে ভাঁজতে থাকেন রমাদেবী।
হঠাৎ একটা মিষ্টি কচি কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে এল তাঁর। জানলায় এসে দেখলেন তের-চোদ্দ বছরের একটি ছেলে তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে গাইছে,
"বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও, ফিরাইও না জননী... "
রমাদেবী মুগ্ধ হয়ে দরজায় এলেন। ছেলেটি গান থামিয়ে বলল,
— "আন্টি, কিছু দেবেন প্লিজ!"
ছেলেটির বয়স ও কথার ধরণে অবাক হয়ে গেলেন রমাদেবী। জিজ্ঞাসা করলেন,
—"তোমার নাম কি, বাবু?"
—"কোপাই রায়।"
—"ওহ্। কোপাই? সে তো বীরভূমের একটি নদীর নাম! বাহ্! ভারী মিষ্টি নাম তো!" রমাদেবীর গলায় স্নেহ ঝরে পড়ে।
— " হ্যাঁ আন্টি। আমাদের বাড়ি বীরভূমের মল্লারপুরের একটি গ্রামে। তাই দাদু আমার এই নাম রেখেছিলেন।" উত্তরে ছেলেটি জানায়।
তারপর একটু ঢোঁক গিলে নিয়ে কুন্ঠিত মুখে ছেলেটি বলে চলে,
—" আন্টি, আমার বাবা-মা স্টেজ-থিয়েটারের কর্মী। তাই কলকাতায় থাকি আমরা। কিন্তু কোডিড পরিস্থিতিতে কাজ নেই তাঁদের। বাবা এখন ফল নিয়ে বেরিয়েছেন। মা আজ থেকে রান্নার কাজে ঢুকেছেন। আর আমি গুরুদেবের এই গান নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।"
এক নাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে চুপ করে যায় কোপাই।
—" আর তোমার পড়াশোনা?"
— 'ক্লাস এইটে পড়ি আমি। আমার পড়া চালানও কষ্টকর হয়ে আসছে। কিন্তু আমি পড়তে চাই, আন্টি! তাই রবীন্দ্রননাথের হাত ধরলাম। দাদু শিখিয়েছেন ছোট থেকে রবীন্দ্র- সঙ্গীত। বাবাও শেখান।
রমাদেবীর মনে পড়ল কবিগুরুর "কোপাই" কবিতাটি,
—"...তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন;/ এ দুইয়েই তার শোভা--"
কবির ছন্দ-বাণীকে সাথী করে জীবনের পথে বেরিয়েছে এই ছোট্ট কোপাই।
—"একটু দাঁড়াও, বাবু।"
বলে ভেতরে গিয়ে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে রুটি-তরকারি আর হাতে করে একশ টাকা এনে কোপাইকে দিয়ে রমাদেবী বললেন,
—" আমি বুড়ো মানুষ। একা থাকি। তুমি রোজ বিকেলে এসে আমাকে গান শুনিয়ে যেও তো। ভারী মিষ্টি গলা তোমার! সকালে বেরোবে না, বুঝলে? পড়াশোনা করবে।"
কোপাই বিষ্ময় বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রমাদেবীর মুখের দিকে।
তিনি
সুশান্ত পাল
তিনি আমাদের স্বপ্নের
তিনি আমাদের নি:শ্বাস
তিনি অপরূপ সংগতি এক
চিরআয়ুষ্মান বিশ্বাস,, "
মাত্র আঠারো বছর বয়সে "করুনা "প্রথম উপন্যাস,যদিও পরে ছোট গল্পের আকারে তা প্রকাশ পায়,,সেখান থেকেই তার দক্ষতার নমুনা সত্যি মন কারে,, সবার একটা ব্যাক্তিগত রবীন্দ্রনাথ থাকে তেমনি আমারও একটা আছে,, আমার কল্পচিত্রে তিনি কিন্তু একজন পরিশ্রমী সাধারণ মানুষ,, তার আভিজাত্য নিয়ে এত কথা উঠলেও আমার কিন্তু বার বার মনে হয় সেই লাইন "একটা সাদাজামার উপর আর একটা সাদাজামাই ছিল বিলাসিতা",, বারবার ভেবে কষ্ট পাই তার পারিবারিক বিশৃঙ্খলার রূপ দেখে,, নিজের কন্যার মৃত্যু বুকে চেপে তিনি যখন বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত একটা আলোচনা সভায় উপস্থিত হন তার মনের অবস্থা বঙ্গভঙ্গর কষ্টের থেকেও কতোটা জোরালো ছিল সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই,, তার অগণিত লেখনী আমাদের আনন্দ দিলেও তার জীবন এতটাই হয়তো বিষাদগ্রস্ত ছিল যেটা ভেবে আজও খুব কষ্ট হয়,, রাগ যে হয় না তা কিন্তু নয়, কী দরকার ছিল এত পরিশ্রম তবুওতো তিনি বিশ্বকবিই থাকতেন,, খুব জানতে ইচ্ছে করে!
তবে কাদম্বরী দেবী নিয়ে নিন্দুকেরা যাই বলুক আমার তাতে বিন্দু মাত্র সমস্যা নেই,,,
শ্রাবণের অঞ্জলি
সুনন্দ মন্ডল
শ্রাবণের পিঠে লেখা রবির নাম
বিরহগাথার সংকীর্তন।
মৃত্যুবার্ষিকীতে কীই বা করি বলো
মানুষের ভিড়ে এ জীবন।
ধূপ ধুনো কিংবা ফুল-মালা
চড়ানো হবে তোমার ছবিতে।
দু'একটা গান চলবে হয়তো
ব্যর্থ মনস্কাম শহরের যানজটে।
সকালের রোদ মাপবে পৃথিবী
ভার নেবে সয়ে বিশ্বকবির।
ধার-দেনা যা কিছু বাকি থাক
তোমার জন্য অঞ্জলিটুকুই স্থির।
রবি ঠাকুর
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আকাশ জুড়ে শ্রাবণ মেঘের এ কোন ঘনঘটা,
ঝিলিক মারে কোথাও যেন সোনালী রোদ ছটা।
আমি যখন শব্দ সাজাই ইঁটের উপর ইঁট,
বাতাস তখন পাকায় দড়ি কোথাও বাঁধায় গিঁট।
রামধনুতে মেঘ সেজেছে আকাশ গেছে রেঙে,
কাক - শালিকের বচসাতে স্বর গিয়েছে ভেঙে।
বাঁশে বনেরই কচিপাতায় ডগায় নাচে জল,
ভারী থোকায় ঝুলছে গাছে কামরাঙারই ফল।
তিস্তা পারে বান ডেকেছে , জল থৈ - থৈ কুল,
ডাঙায় এসে হাঁতড়ে বেড়ায় কলমীশাকের ফুল।
রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশী, বাউল সুরটি নিয়ে,
মাছরাঙা তার পেট ভরেছে, বোরোলী মাছ দিয়ে।
ঝর্ণা বুঝি জল ছড়িয়ে, কলকলিয়ে চলে,
বৃষ্টি ভেজা গাছের পাতা, ছন্দে কথা বলে।
কেউ দেখেনি সবার চোখে, সে দিয়েছে ফাঁকি,
ছায়াশরীর রবি ঠাকুর, দাঁড়িয়ে আছেন একি।
এই শ্রাবণেই আবার বুঝি , এলেন তিনি ফিরে,
সকল চিন্তা ভাবনা মেশে, তাঁর চারপাশ ঘিরে।
'হে রবি..'
দীপ মুখার্জি
এসো হে রবি
এসো হে এসো
এসো আজ আমাদেরই মাঝে
বইয়ে দাও নবীন আনন্দের ফল্গুধারা
দাও নবচেতনা..নুতুনের আশ্বাস
দাও সৃষ্টিসুখের স্নিগ্ধ পরশ
আমাদেরই দেহখানি জুড়ে...
এসো হে রবি
এসো হে এসো।।
খুলে রাখি দিবো
আমাদের হৃদয়ের দ্বার
আপন করি নিবো তোমায়..
তোমার পূজার মঙ্গলঘট
পাতিবো আজ আমাদেরই মনে..
যেতে নাহি দিবো তোমায়।।
হে রবি....
তোমার পরশের পরশমণি দিয়ে..
আজি পূর্ন হবে আমার মন
তোমার স্নিগ্ধ আলোকছটায়
ধুয়ে যাবে বিশ্ব চরাচর..
আজকের পূণ্য প্রভাতে।
এসো হে রবি..
এসো হে এসো
রবি
কাকলি বিশ্বাস সরকার
তুমিই রবি, তুমিই বিশ্ব কবি,
তোমার নামের অন্তর্নিহিত শব্দার্থ,
ভারতের আকাশে তুমিই ঊজ্বল নক্ষত্র।
নামের দীপ্তি ছড়িয়ে,
কর্মের আলো প্রজ্বলিত করে।
আজও বসে আছো, নিজ আসনে।
ভারত মায়ের শীষখানি রেখেছো ,
উচ্চশিখড়ে।
কবিগুরু তোমায় স্মরনে গর্বিত ভারতবাসী।
শ্রাবণের ধারার মতো,
হৃদয় অঙ্গনে তূমি বয়ে চলেছো ,
অনন্তকাল ধরে।
তোমায় ,শত -সহস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শ্রাবণ জল
বিজয় বর্মন
জীবন যেন,
বোধিবৃক্ষ তলে,
শ্রাবণ জলে মাখামাখি,
খোলা,মনের জানালায়।
ভরা যৌবনা শ্রাবণ,
ভাসিয়ে সোনার তরী,
একলা চলার গান,
বিতানের মধুমায়া।
সময় বুঝে,
শোকের ছোঁয়া,
জল ভরা আকাশ বাতাস,
নরম মনে শুধুই আর্দ্রতা।
মেশানো অশ্রু,
বৃষ্টি ফোঁটায়,
পাপড়ির মতো ঝরে,
জীবনের দাগ,
সব মুছে দিয়ে।
উজার করা নশ্বর সব,
ভেঙে যাওয়া, ঘরের চাবি,
থাক বোধিসত্ত্ব টুকু,
তোমার স্মরণে।
শিল্পী- বাবুল মল্লিক
শিল্পী- প্রীতম কর
No comments:
Post a Comment