উত্তরের সুদৃশ্য ব্যালকনিতে বসে অবিনাশ চায়ের কাপে চুমুক দেন। সকাল আটটা এখন। ব্যালকনির সামনে পাল পাড়া। নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। কেউ রিকশা চালায়, কেউ অফিসের গার্ড, কেউ বা ছোটখাটো কারখানার চাকুরে। অবিনাশ তার সকালটা কাটান এইখানে ঘন্টা তিনেক বসে। খবরের কাগজ পড়েন, দু'বার চা খান। জলখাবারও এইখানে বসে খান।
সাড়ে আটটা নাগাদ আসে সুইপার। বাড়ি বাড়ি হুইসেল বাজিয়ে নোংরা সংগ্রহ করে। তারপর আসে সব্জিওলা, মাছওলা। একের পর এক মানুষের আনাগোনায় পালপাড়া জমজমাট হয়ে ওঠে। পালপাড়ার প্রতিটি পরিবারকে অবিনাশ চেনেন। ওই যে ফর্সা, লম্বা মহিলাটি টাইম কলে জল ভরছে, সে এ পাড়ার কুকুরদের মা। পাড়ার সাত-আটটা কুকুরের দুপুরের ভাত ওই মহিলার বাড়িতে বাঁধা। অসুখ হলে ওষুধ, ঘা হলে মলম, সস্তার টোটকা সবকিছুর দায়িত্ব ওই মহিলার। ওই যে লোকটি, বেশ সুপুরুষ, ন'টা বাজলে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ে, কোন অফিসে যায় অবিনাশ জানেন না। তবে বেশ টিপটপ হয়ে ছোট একটি মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। সামনের বাড়িতে থাকে শেফালি। চার বাড়ি কাজ করে। মাঝে মাঝেই একটি ভিখিরি মতন ছেলেকে দেখতে পান তিনি বাড়ির সামনে বসে ভাত খাচ্ছে। শেফালি ছেলেটি ভিক্ষে করতে এলেই খাইয়ে দেয়। অনেকদিন পর অবিনাশ জানতে পেরেছিলেন ছেলেটি বোবা। শেফালির স্বামী বেশ ষন্ডামার্কা। অবিনাশ বুঝতে পারেন না সে কী কাজ করে। মাঝে মাঝে রাতে সে খুব নেশা করে আসে। তখন শেফালির চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে যায়। শেফালির ছেলে-মেয়ে নেই। রাতে শেফালি যখন চেঁচায় তখন একটা কথা অবিনাশ প্রায়ই শুনতে পান, "চুপ বাঁজা মেয়েমানুষ।" কথাটা শেফালির বর বললেই শেফালি চুপ হয়ে যায়। অবিনাশের অস্বস্তি হয়। বিছানায় তিনি ছটফট করে ওঠেন। বিয়ের দশ বছর পরও যখন তার আর বৃন্দার কোন ছেলে- মেয়ে হলো না, তিনি হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। অফিসের পর বাড়ি ফিরতে তার ভালো লাগত না। এদিক- সেদিক চলে যেতেন। বন্ধু বরুণ একদিন নিয়ে গেলেন রয়াল ব্লু বার-এ। তিনি প্রথম বার মদ স্পর্শ করলেন। তারপর প্রায়ই। নেশার মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। বৃন্দা প্রথমে চুপ করে থাকত। যেদিন ট্যাক্সি থেকে নেমে টলতে টলতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন, সেদিন বৃন্দা আর চুপ থাকতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল,"তুমি এটা কী শুরু করেছ?" অবিনাশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন," চুপ বাঁজা মেয়েমানুষ।" বৃন্দা উত্তর দেয়নি। পরদিন সকালে বৃন্দা একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আশি লাখের সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে বসে থাকা অবিনাশ সেন আসলে পাল পাড়ারই একজন।
সন্ধ্যাবেলায় দাদুর কাছে
আবার জানতে চাইলো যখন,তখন ওর দাদু বলে, তোর পক্ষে বোঝা মুশকিল রে। তুতুস বলে, কি?
তখন ওর দাদুর মন চলে গেছে সেই ছোটবেলায়, যখন সত্যিই স্বাধীনতার মানে ছিলো আজকের
থেকে অন্যরকম। ওনার বাবা একেবারে সক্রিয় স্বদেশী করতেন। সেটার একটা কারণ হলো ওনার
মামারাও স্বদেশী করতেন। মামার বাড়ির পাশেই ছিলো শিবমন্দির সংলগ্ন বিশাল ময়দান।
সেখানে অন্য সময় যাত্রাপালা কথকতা হতো।আর প্রায়ই
হতো রাজনৈতিক পার্টির মিটিং।একবার এমন সমাবেশে পুলিশ এলো ধরপাকড় করতে। ছোট মামা
বাড়ির পেছনে একটা নোংরা জায়গায় বাঁশঝাড়ের ভেতরে লুকিয়ে ছিলো। সেই রাত্তিরে
ছোটমামাকে চান করে ঘরে ঢুকতে হয়ে ছিলো। বিকেলে আবার পুলিশ এলো বাড়ি সার্চ করতে।
ওদের কাছে খবর আছেএ বাড়িতেই লুকোনো আছে আগ্নেয়াশ্ত্র। সব দেখেশুনে বলে গেলো, ওরা
আবার আসবে,আর আপত্তিকর কিছু পেলে অবধারিত শাস্তি।
দাদুর বাবা তার দিদাকে
জিজ্ঞেস করেছিলো, এর মানে কি? দিদা বলেছিলো, ওই যে ওদের রাজত্বে আছি কিনা, তাই
ওদের সব কথামত চলতে হবে।মানে? দাদুর একথার উত্তরে দিদা বলেছিলো, ওরা হাত তুলতে
বললে হাত তুলবে। মাথা নাড়তে বললে মাথা নাড়বে, মানে দম দেওয়া পুতুল আর কি। যদি না
করে?তাহলে যেকোন ভাবে জেলে ভরা, তারপরে চলে শাস্তি। দাদুর বাবা ওই টুকু বুঝেই চুপ
করে গিয়েছিলো। আবার শাস্তি শুনে ভয়ও পেয়েছিলো। স্কুলে দেখেছে শাস্তি পেতে অন্য
ছেলেদের তাই আর কি।
একদিন ছোটমামা ওকে একটা
চিরকুট দিয়ে বললো, এইটা উমাকে দিয়ে আসতে পারবি, কেউ যেন জানতে না পারে, একেবারে
লুকিয়ে। চারটে বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। উমা মাসীকে পেছনের বাগানে ফুল তোলার সময়ে একা
পেয়ে হাতে দিয়ে বলেছিলো, মামা এর উত্তর দিতে বলেছে। সন্ধ্যে বেলায় আসতে পারবি একবার? সন্ধ্যে বেলায় মাঠ থেকে খেলা শেষে বাড়ি ফেরার
পথে উত্তর নিয়ে টুক করে ছোটমামার হাতে দিয়ে বলেছিলো, আর পারবে না। ছোটমামার মুখটা
কেমন বিসন্নহয়ে গিয়েছিলো। এর কদিন পরে এক রাতে খেয়েদেয়ে শুতে যাচ্ছে, তখন
শুনেছিলো,দিদা বলছে, আগে নিজের পায়ে দাঁড়া তবে ওসব ভাববি। এই জন্যে লেখাপড়া
শেখাচ্ছি? এরপরে বেশ কিছুদিন আর কিছু চালাচালি হয়নি। ছোটমামাও কিসব গুপ্ত মিটিং এ
ব্যস্ত। এদিকে শুনতে পাচ্ছে উমা মাসীর বাড়ি নাকি কিছুটা নিমরাজি হয়ে মত দিয়েছে।
তারমানে বাড়িতে একটা বিয়ে লাগতে যাচ্ছে। ছোটরা বেশ উত্সাহী হয়ে কত কি ভেবে ফেলেছিলো।
ব্যাপারটা সবে গুটি পেকেছে,সবাই
ফলের আশায় আছে। ছোটমামাকেও বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে।
এমন সময়ে হঠাত্ বাড়িতে পুলিশ রেড হলো।
ছোটমামার ঘর সার্চ করে অনেক আপত্তিকর
কাগজপত্র পাওয়াতে পুলিশ একেবারে হাতকড়া পরিয়ে সোজা জেলে।
দেশ স্বাধীন হবার পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মামা
বাড়িতে এলো ততদিনে দাদু গত হয়েছেন। দিদা অসুস্থ।উমা মাসি বিয়ের পরে বোম্বেতে। ছোটমামা
একটা স্কুলে কাজ পেয়ে বেঁচে গেলেন। অশরীরী
হয়ে থেকে গেলো তাদের না বলা কথা,স্বাধীনতার আলো না পেয়ে।
তুতুস আবার জিজ্ঞেস করলে,স্বাধীনতার
মানে তাহলে কি আসলে? ঘুম ভাঙ্গা গলায় দাদু বলে, তুই তোর মতো চলতে পারছিস্,তোর
অনুভূতির কথা বলতে পারছিস,কোথাও কোন বাধা নেই, এইতো
স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মানেওনেক বড়, আকাশের মতো মুক্ত, এইটে যতো বড় হবি বুঝতে
পারবি।
এই সময়ের কবিতা
চাঁদে
মাথুর দাস
চাঁদের মাটি হয়তো খাঁটি,
নয়া বসতি করতে
মুখিয়ে আছে লাখো মানুষ
মরণ-বাঁচন শর্তে ।
বাসযোগ্য হলেই চাঁদ
মিটবে সে মনের সাধ,
কীসের জন্যে থাকবে প'ড়ে
লোক-গিজগিজ মর্ত্যে !
আদর্শ শিক্ষক
রীতা মোদক
সবার অধিক সন্মান জানি
ইস্কুলের মাষ্টারমশাই,
সাদা ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া
ছিলনা অন্য পোশাকের বালাই।
চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করলে ---
মাথায় উঠতো আশীর্বাদের হাত,
পড়ানোর সময় ----গভীর মনোযোগ
অন্যমনস্ক হলেই, পড়ত বেত্রাঘাত।
শিক্ষা দিতেন উজাড় করে
বোঝাতেন সহজ গল্পের মতো,
সঠিক পথে চলার মন্ত্র শিখে
ছাত্র ছাত্রীরা ----মানুষ হতো।
অজ্ঞানেরে তুলে এনে
ছড়িয়ে দিতেন জ্ঞানের আলো ,
সদাচার জানতেন তারা
মানুষেরে বাসতেন ভালো।
কোথায় এখন মাষ্টারমশাই?
কোথায় গেলো হাতের লাঠি?
হারিয়ে গেলো শাসন ভার
তৈরী হলো--- উশৃঙ্খলতার ঘাঁটি।
প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে যাই....
কুলুপআটা এই সমাজের কাছে,
অধম সন্তানদের মানুষ করতে
আদর্শ শিক্ষকের কি দরকার আছে?
কু-শিক্ষাতে ভরলো সমাজ
দেশ জুড়ে শুধু দূর্নীতি আর হাহাকার
আসবেন কি ফিরে সেই শিক্ষক শিক্ষিকা ?
নেবেন কি তারা মানুষ করার ভার?
এগারোই আগস্ট
বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়
আগস্ট এগারো'র এক মঙ্গলবার, পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়।
দেশপ্রেমে পণ, তোলে আড়োলন, বাসুকি মস্তক নাড়ায়।
অসিত জলদ বুকে তার খেদ নেমে ছুঁয়েছিল ধরা ।
শোকার্ত মেদিনী, নয়ন মেলেনি, দেয়নাই কোনো সাড়া।
জনম লগনে, বাধা অলক্ষুনে, মায়ের আকুল প্রাণ ।
তিন মুঠো 'খুদে' বিনিময়ে শোধে, নাম তাই ক্ষুদিরাম।
তুমি বিশ্বমাতা ধন্য জন্মদাতা গর্ভে অমূল্য রতন।
পুত্র অষ্টাদশ, কি অসীম সাহস, হেলায় অসাধ্য সাধন।
ছোট সাদা ধুতি, সাধারণ অতি, মুখায়ব অমলিন।
বিপ্লবে প্রচন্ড, ঋজু মেরুদণ্ড, ভয়ডর শঙ্কাহীন।
অভিশপ্ত দিনে ভিড় অকারণ নীরব দর্শক সেজে।
ভীত নরাধম, জীবনে প্রথম, শহীদের অর্থ খোঁজে।
ভারত জননী, ক্ষোভে অভিমানী, অকালে পুত্রশোকে।
মেরুদন্ডহীন, সহস্র সন্তান, নির্বাক হয়ে দেখে।
ইংরেজি পেয়াদা, তার হাত বাঁধে, দর্শকের সমাগম।
দর্পে মাথা তুলে, গলা ছেড়ে বলে, "বন্দেমাতরম"।
“ফাঁসির রশিতে মোম কেন ঘষা”, শুধায় বিস্ময়ে যুবক।
উপস্থিত জনে, কাঁপে অকারণে, চেয়ে থাকে অপলক।
“মোমের ঘষায়, শহীদের গলায়, হবেকি মৃত্যু মসৃন?
জন্ম জন্মান্তরে, যাবো শোধ করে, দেশের মাটির ঋণ।“
ইংরেজ শাসন, ভয়ে কম্পমান, দেখে স্মিত মুখায়ব।
কালো আচ্ছাদনে ঢাকে হাসি মুখ,
শিহরিত মায়ের কেঁপে ওঠে বুক,
--- --- নিস্তব্ধ হয় রব।
"পরাধীনতার ভাঙবো শৃঙ্খল",শেষ হুঙ্কারে দৃঢ়বদ্ধ।
তার অন্তিম ধ্বনি “বন্দেমাতরম” !
একটা মুহূর্তে শিহরিত 'যম' !
--- --- কালচক্র হয় স্তব্ধ।
এ বাংলার মাটি, ভালোবেসে খাঁটি, করেছ অকাট্য প্রমান।
এই স্বাধীনতা, শুধু মহানতা, শহীদের অবদান।
শুদ্ধ দেশপ্রেমে, সার্থক জনমে, বঙ্গ হৃদয়ে শাশ্বত।
শহীদ ক্ষুদিরাম, অনন্ত সেলাম, চিরশ্রদ্ধায় শির নত।
সোনার ছেলে
চন্দ্রানী চৌধুরী
সোনার ছেলে বর্শা হাতে স্বপ্ন ফেরি করে
সোনার ছেলে বর্শা দিয়ে আলো আনে ঘরে
সোনার ছেলে অসম বীর দেশবিদেশে ছোটে
সোনার ছেলে অসম সাহস ভয় পায় না মোটে
সোনার ছেলে জড়িয়ে রাখে আকাশ কুসুম স্বপ্ন
সোনার ছেলে জড়িয়ে মনে হতেই হবে রত্ন
সোনার ছেলের বুকে থাকে ভারত দেশমাতা
সোনার ছেলে বুকে রাখে জাতীয় পতাকা
সোনার ছেলের মুকুট জুড়ে সোনার পালক
সোনার ছেলের মুকুটে আজ বিস্ময় বালক
সোনার ছেলের স্বপ্নগুলো আগুন দিয়ে গড়া
সোনার ছেলের স্বপ্ন উড়ান সোনা দিয়ে মোড়া
সোনার ছেলে এনে দিল সম্মান এবং সোনা ।
তাই সোনার ছেলে পেলো আজ সবার বন্দনা ।
বিপন্ন শৈশব ও পঞ্চায়েত ভোট
আশীষ কুমার বিশ্বাস
ওরা ছোটরা !
ওরা আম বাগানে খেলছিল ।
বোমাকে বল ভেবে ওঁরা ভুল করেছিল ।
বড়রা বা তাঁর পূর্বসূরি বোমা বেঁধে ছিল
ভোট যুদ্ধে বোমা নিয়ে খেলা-
এখন এটাই বড় উৎসব !
তার -ই কয়েক টা রাখাছিলো আম বাগানে ।
বিপন্ন শৈশব , বল ভেবে লাথি মারে বোমে ,
বোমা ফেঁটে রক্তাক্ত দেহ ।
কিছু গুণীজন , কিছু প্রতিবাদি মন আর তার
পরিবার , সোচ্চার বোমা খেলা নিয়ে !
শৈশব নিরাপদ নয় ।
কিছু দিনের মধ্যেই ভুলে যায় গুণীজন ,
প্রতিবাদি মন ।
ভুলেও ভোলে না তার শোকার্ত পরিবার ।
নিরাপদ নয় আমজনতা !
বোমার বল ঝোপে-ঝাড়ে আছে
সুযোগ বুঝলে বেরিয়ে পরে লোকালয়ে ।
তখন শৈশব নয় , বড়োরাও মারা পড়ে ,
অঘোরে প্রাণ যায় তাঁর ।
গণভোটে নাম জড়ায় জনগনের !
গণ ভোটে বোমা ফাটে বাজির রূপে
উল্লাস বাড়ে মাসলম্যান দের ,
এরাই হিরো ।
ভয় পায় আমজনতা ।
বড় গল্প
কালো ও কালে কালে বহমান জরা
সৌমেন দেবনাথ
তাকে সে ভীষণ পছন্দ করে কারণ তার ভেতর হাজারটা গুণ না থাকলেও এমন কিছু গুণ আছে যা তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু মানুষজন মানতে পারেন না তাদের ভেতর এত মিল হয় কি করে! কেউ না কেউ তোমাকে পছন্দ করবেই কারণ কিছু গুণ তোমার ভেতরও আছে যা অন্যের চোখে পড়বে না, তোমার চোখেই পড়বে। প্রথম প্রথম বিভা এড়িয়ে চলতো, কিন্তু যখন সে বুঝতে পারলো মানুষটার হৃদয় অনেক বড়ো, তখন সে কাছে এসেছে, অনেক কাছে। কাউকে পেতে হলে, একান্ত করে কাছে পেতে হলে তাকে আগে বুঝতে হয়। এজন্য কেউ দ্রুত সন্নিকটে না এলে মন খারাপ করতে নেই, তাকে বুঝতে সময় দিতে হয়, তাকে বুঝতে নিজেরও সময় নিতে হয়।
অফিস থেকেই ফোন করে মৃদুল জানালো, চুলে বেণি করো, দুটি বেণি।
বিভা মৃদুলের কথাতে হ্যাঁ সম্মতি জানালো। অথচ আজ দুপুরে স্নানের সময় সে চুলে স্যাম্পু করেছে। খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ে উড়ে তাকে বিশেষ বিরক্ত করছে তখনও৷ স্বামীর খুশির জন্য সে এলোকেশে বেণি করতে বসে গেলো। নিজের পছন্দকে বিসর্জন দিলো স্বামীর খুশির জন্য। মানুষটি তাকে বিরক্ত করে, কিন্তু কখনো বিরক্ত হয় না। এই কারণে নিজের ভেতর বিরক্তিবোধ জাগলেও প্রকাশ করে না। সারাটা জীবন ভেবে ভেবে বড়ো হয়েছে, বিরক্ত কারবো, কিন্তু বিরক্ত হবে না এমন একজন মানুষ জীবনে চাই।
তেমন মানুষটি সে পেয়েছেও। একটু পরে ফোন করে জানালো, আসার সময় বাদাম আনবে।
মৃদুল বাসার কাছে চলে এলেও বুঝতে দিলো না, সে আবার স্থানীয় বাজারে গেলো। বাদাম কিনলো। বাদাম পেলেই যে সন্তুষ্ট হয় তাকে অসন্তুষ্ট করার জন্য ন্যূনতম অজুহাতও ব্যক্ত করা ঠিক না।
দিনশেষে মৃদুল বাড়ি এলে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে বিভা। মৃদুল বলে, বিভার আভায় হারাবো আমি। নিকষে বিভা কী খোঁজে?
উত্তরে বিভা বলে, চরিত্রের সাথে সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সৌন্দর্য কখনো চরিত্রের চেয়ে দামি হতে পারে না। আর সৌন্দর্য আচরণে, ব্যবহারে; অঙ্গে না।
ঠোঁটে একটু হেসে মৃদুল বলে, কিন্তু নিষ্পলকে চেয়ে আছো কেন? মনে হয় প্রথম দেখছো! প্রথম দেখার মতো কি আশ্চর্য লাগছে আমাকে? আর আমাকে দেখে কি আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে?
বিভা বলে, চোখ থাকলেই হয় না, দৃষ্টিশক্তি থাকতে হয়। সুদৃষ্টিশক্তি। সোনা চেনা সহজ কাজ নয়। চোখ থাকার পরও চোখে দৃষ্টিশক্তির অভাবে মানুষ সোনাকে কাচ ভেবে ফেলে দেন। মানুষটা তুমি খাঁটি। অপেক্ষা করা সুন্দর হয় যখন যার জন্য অপেক্ষা করা হয় সে খাঁটি হয়। একজন খাঁটি মানুষ জীবনে আছে। খাঁটি মানুষের জন্য আশ্চর্যতা ফুরায় না।
মৃদুল বলে, চোখের দিকে অনন্তকাল তাকালেও কি মানুষ চেনা যায়?
বিভা বলে, মনের কথা বুঝতে মন লাগে। না বলা কথাগুলো অনুভব দিয়ে বুঝে নিতে জানলে আপন মানুষ চেনা যায়। কারণে-অকারণে যে খোঁজ নেয়, আমি জানি সে আমাকেই চায়।
মৃদুল হাসে। প্রাপ্তির হাসি, মিষ্টি হাসি। হেসে নিয়ে বলে, সুযোগ দাও, ফ্রেশ হই। ঘামের গন্ধে আমি নিজেই থাকতে পারছি না।
বিভা নিষ্পলকে চেয়ে বলে, তোমার ঘামগন্ধ আমার মুখস্ত। আমি তোমার ঘামগন্ধে কোনো দুর্গন্ধ পাই না। আমাদের জন্য তোমার ঘাম ঝরে, তোমার ঘামের দাম আমার কাছে অনেক। অমূল্য স্বর্ণ দিয়ে আমি কী করবো? আমার কাছে অমূল্য তুমি।
মৃদুল এবার বিভার চোখ বরাবর নিষ্পলকে না চেয়ে থেকে পারলো না। হৃদয়ের ভেতর থেকে একটি কথা বের হয়ে এলো, এত ভালোবাসো কেন?
উত্তরে বিভা বলে, শত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও যে মানুষটা আমাকে আগলে রাখে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়!
মৃদুল বলে, আমি যে মাঝে-মধ্যে তোমার উপর রেগে যাই!
বিভা বলে, অতিরিক্ত রাগি মানুষের ভালোবাসাটাও অতিরিক্ত হয়। যে অল্পে রাগে সে অল্পে হাসেও। যে অল্পে রাগে সে অল্পে ব্যথা-বেদনাও ভুলে যায়।
মৃদুল অবাক হয়ে বলে, যখন রেগে যাই তখন দুঃখ লাগে না?
বিভা না-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার সময়ে দুঃখকে প্রশ্রয়ই দিই না।
মৃদুল বলে, তবে কেন চোখে জল আসে?
বিভা বলে, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে চোখ দিয়ে জল ঝরবেই।
মৃদুল বিস্ময় ভরা চোখে বিভাকে দেখে আর বলে, আমি কালো, তোমার কোনো আক্ষেপ নেই?
বিভা দৃঢ়চিত্তে বলে, চেহারা কদিনই থাকে! মনের লাবণ্যই স্থায়ী। যার কাছে আমার মূল্য অনেক সেই তো আমার কাছে অমূল্য। যে আমাকে গুরুত্ব দেয়, আমি তার কাছে সুখ পাবোই। তুমি কালো সবার চোখে, কিন্তু আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।
একটু হেসে মৃদুল বিভার বাধা ডিঙালো। তারপর ফ্রেশ হতে স্নানাগারে গেলো। টেবিলে খাদ্য-খাবার তরে তরে সাজালো বিভা। খেতে বসে মৃদুল বললো, ইলিশ মাছ তোমার পছন্দ বলে গতকাল ইলিশ মাছ নিয়ে আসতে বললে। অথচ ইলিশ মাছ রান্না করোনি কেন?
বিভা বললো, ইলিশ মাছে তোমার এলার্জি আছে আমাকে তো বলোনি, মা বলেছেন। তুমি খাবে না সেই খাবার আমি খাবো কী করে!
মৃদুল আশ্চর্য হয়ে বলে, বলো কী! আমার কারণে একটা প্রিয় খাবার ত্যাগ করবে?
বিভা বলে, প্রিয় মানুষের জন্য অনেক প্রিয় বিষয় ত্যাগ করতে হয়। তোমার পথের পথিক আমি। তোমার শখের ভেতরই আমার শখ নিহিত।
মৃদুল দ্রুত উঠে গেলো খাওয়ার টেবিল থেকে। ফ্রিজ থেকে মাছ নিয়ে নিজেই ভাজতে গেলো। বিভা পেছন পেছন এলো আর বললো, এভাবে আমার পছন্দ যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সে কেন আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হবে না? পুরো পৃথিবী লাগে না, সাথে এমন সঙ্গী থাকলে গণ্ডিও যথেষ্ট।
মৃদুল মাছ ভাজতে ভাজতে বলে, বাইরে আগে অনেক কিছু খেতাম, এখন কিছু খেতে গেলেই তোমার কথা মনে পড়ে। তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তোমাকে নিয়ে তাই অনেক ভাবনাজাল আঁকি।
বিভা বলে, আমাকে যে ভাবনা জুড়ে এতটা রাখতে পারে, সে কেন আমার ভাবনা জুড়ে থাকবে না? সেই তো আমার সকল সুখের কারণ। তুমিই তো আমার সকল সুখের কারণ। তাই তোমাকে খুশি করার কারণ খুঁজি। নিজেকে খুশি রাখার কারণ খুঁজি না। তোমার খুশিতে আমার মনে খুশির জোয়ার সৃষ্টি হয়।
এই বলে বিভা মৃদুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মৃদুল বলে, এত আদরকাড়া কেন তুমি? এত আদর জানা কেন তুমি? আমি তো আদর দিতে জানি না!
বিভা বলে, এতটা যে যত্নে রাখে আলাদা করে তাকে আর আদর করা জানতে শিখতে হয় না। আমার প্রতি যার এতটা টান একদিন সে আদর দেওয়ার শিক্ষক হয়ে যাবে। প্রকৃত জীবনসঙ্গী প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর সব সুখ খোঁজে।
মাছ ভাজা শেষ হলে ওরা আবার খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলো। তারপর মৃদুল নিজেও এক টুকরো ইলিশ মাছ নিলো। তা দেখে বিভা বললো, ইলিশ খাবে? দেখো এই খাদ্যই ওষুধ, এই খাদ্যই বিষ।
মৃদুল বলে, পছন্দের মানুষের পছন্দ অপছন্দের হলেও পছন্দের করে নিতে জানতে হয়। শুধু নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করতে থাকলে পছন্দের মানুষের কাছে অপছন্দ হয়ে যেতে হয়।
বিভা বাধা দিয়ে বলে, যা খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে তা না খাওয়ায় শ্রেয়। তুমি তোমার তাই তুমি তোমাকেই আগে ভালোবাসবে। সম্পর্কে মধুরতা আনতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে নেওয়া ঠিক না। আমার খুশির কারণ হতে গিয়ে তুমি তো তোমার দুখের কারণ ডাকতে পারো না।
মৃদুল বলে, যার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তার জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই সামান্য। আর অসুস্থ হলে শুশ্রূষা দেওয়ার মানুষ তো আছে আমার। তোমার সেবায় হবো আমি বলীয়ান।
বিভা দ্বিমত পোষণ করে বলে, সেবা দেওয়ার মানুষ থাকলেই রোগ ডেকে আনতে হবে? কোনো রোগকেই আমন্ত্রণ জানানো ঠিক না।
মৃদুল খেতে খেতে বলে, মন ভালো থাকলে রোগ হয় না। পৃথিবীর সব মানুষ কল্পনাতেই বেশি সুখী। আমি বাস্তবে সুখী।
বিভা গদগদকণ্ঠে বললো, তোমার মন ভালো রাখার সেই শক্তি কি আমার আছে? আমি শুধু তোমার ভালো চাই, কিন্তু নিজের ভালো তো নিজেকেই রাখতে হয়। সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে মুখে যে হাসি তুমি রাখো তা মূলত মিথ্যা হাসি।
খাওয়া বন্ধ করে মৃদুল বললো, ভালোবাসার প্রত্যেকটি মানুষই জীবনের জন্য জরুরি। সবার ভালো থাকার উপর নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। হাজার কষ্টে থেকেও কাছের মানুষের সুখে রাখার চেষ্টাটাই আসল ভালোবাসা। একা ভালো থাকা যায় না, একা ভালো থাকার চেষ্টা করলে একাই হয়ে পড়তে হয়। অনেকের অনেক ত্রুটিই চোখে পড়ে, সব দেখেও না দেখার ভান করা হয় শুধু সম্পর্ক রক্ষার জন্য। কারণ সম্পর্কটা জীবনের জন্য জরুরি। অনাদরে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
বিভা বললো, আমার ভেতর ত্রুটি পেলে জানাবে, নিজের ভুল নিজে ধরা যায় না। আমার আচরণ তোমার মনের বিরুদ্ধে গেলে জানাবে। আমি ভুল করেই যাবো, তুমি ক্ষমা করেই যাবে এটা ঠিক না। তোমার আমার সম্পর্কে কেন অসুস্থতা থাকবে?
মৃদুল বলে, তোমার নিজস্বতা আছে। আমার প্রভাবে কেন তুমি তোমাকে পরিবর্তন করবে? কোনো একটি বিষয়ে তোমার ধারণা আমার সাথে নাও মিলতে পারে, আমার অযাচিত চাওয়া থাকবেই বা কেন? আর আমার অযাচিত চাওয়ার কাছে কেন নিজেকে ভাঙবে?
বিভা জানায়, আমার জীবনে তুমি বিশ্বস্ত মানুষ। তুমি আমার খারাপ কখনোই চাইবে না। তাই তোমার উপর আমার এত বেশি নির্ভরতা। জানি আমি তোমার প্রয়োজন ও প্রিয়জন।
পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে একটি শাড়ি কিনে এনেছে মৃদুল। অন্যান্য নারীরা শাড়ি দেখলে যেমন পুলকিত হয় বিভা তেমনটি পুলকিত হলো না। বললো, বলেছি তো আমাকে শাড়ি দিলে তুমি শার্ট নেবে। তুমি শার্ট না নিলে আমি শাড়ি নেবো না। আমি সাজবো তুমি দেখবে আমি তা বুঝি না।
শুনে মৃদুল বলে, তোমাদের জন্যই আমি পরিশ্রম করি। তোমায় ভালো রাখা, ভালো থাকতে সহয়তা করা আমার দায়িত্ব। তোমার চোখের কাজল কেনার দায়িত্বও আমার, তোমার চোখে জল যেন না আসে সে দায়িত্বও আমার।
বিভা না-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, তোমার ঘাড়ে ভারবোঝা হয়ে থাকা কি আমার দায়িত্ব? দুটি মানুষ পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটলে অনেক পথ যেতে পারে। আমায় কাঁধে নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবে? আমি তো তোমার কাঁধের বোঝা নই, আমি তোমার সহযাত্রিনী। আমাকে মূল্যবান উপহার দিতে হবে না, কেবল সময়টুকু দিও। তোমার দেওয়া প্রত্যেকটি ক্ষণ আমার জন্য মহামূল্যবান।
অন্যমনস্ক হয়ে মৃদুল বললো, শাড়িটা তবে ফেরত দিয়ে আসবো? খুব পছন্দ হয়েছিলো বলেই এনেছিলাম। তুমি কত খুশি হবে ভাবতে ভাবতে এসেছি, হলে অখুশি।
শাড়িটা বিভা বুকে চেপে নিলো আর বললো, না ফেরত দিতে হবে না। তবে নতুন শার্ট না কিনলে এ শাড়ি আমি পরবো না। ক্রমাগত ত্যাগ করে যাবে তুমি আর আমি ক্রমাগত সুবিধা নিয়ে যাবো ভালোবাসার দলিলে তা লেখা নেই।
এমন সময় মৃদুলের মা মৃদুলকে ডেকে নিলেন। পারিবারিক ব্যাপারে কথা চললে বিভা সেখানে যুক্ত হয়ে নিজের মত পেশ করে না। আজ বিভাকে জোর করে ডেকে নিলো মৃদুল। কিন্তু বিভা চুপ থাকলো। কোনো কথা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে সে নিশ্চুপই থাকে। নিজের ঘরে ফিরে মৃদুল বললো, পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তুমি কথা বলো না। তুমি কি পরিবারের সদস্য না?
উত্তরে বিভা বলে, তোমাদের কত ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে এই সংসার দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ এই বাড়ি এসে আমার কথা বলা আমার কাছে অনধিকার চর্চার মতো মনে হয়।
মৃদুল বলে, লক্ষ্মীর মতো কথা বলো। লক্ষ্মীরাই লক্ষ্মী থাকে। রগচটা, বদমেজাজিরা কখনো লক্ষ্মী হয়ে উঠতে পারে না। শুধু ভাগ্যের কারণেই তোমাকে জীবনে পেয়েছি।
বিভা মৃদুলের চোখ বরাবর চেয়ে বলে, হৃদয় মাঝে ডুব দিতে জানো, ডুব দিতে জানো বলেই ঝিনুক পাও, ঝিনুক না পেলে কি কেউ মুক্তো পায়?
মৃদুল বলে, চারিদিকে মুক্তোর ছড়াছড়ি থেকে একটি মুক্তো কি করে বাছাই করবো ভাবতাম। কিন্তু মুক্তো বাছাই করতে হয় না, মুক্তো জীবনে চলে আসে। হৃদয় থেকে যারা চায় তারা মুক্তোই পায়। মন থেকে চাইলে মন মনের মতো মানুষ পাবেই পাবে।
বিভা মৃদৃলের বুকে মুখ লুকায়। বড়ো নির্ভরতার আশ্রয় এই বুকের সন্ধিস্থল। বলে, তোমাকে কত যে ভালো লাগে তুমি জানো না, আমি জানাতেও পারবো না। কেন এত ভালো লাগে জানি না। ভালো লাগার কারণ থাকে না। এখন একা থাকলে ভয় করে, একা বাইরে গেলে ভয় লাগে। একটু সময় কথা না বললেই খারাপ লাগে। অন্যদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবলই তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কাজের মধ্যেও মনের চোখে শুধু তোমার চোখ ভাসে। যে যাকে ভাবে তার মনশ্চক্ষে সে সব সময় থাকে। তুমি আমার তৃষ্ণা জুড়ে।
মৃদুল বলে, এভাবে মায়া জাগানো কথা আর বলো না। এত মায়া দিলে বাইরে যেতে পারবো না, বাইরে গেলেও থাকতে পারবো না। এত মায়া জাগাতে জানো তুমি ভাবতেই পারি না। যে মানুষটা এভাবে মায়া জাগাতে পারে সে মানুষটা খুব ভালো মনের হয়।
বিভা ঠোঁটে হেসে বলে, তুমি কত ভালো মানুষ তুমি জানো না। তোমাকে আমি চিনে নিয়েছি, তুমি মিষ্টি হৃদয়ের একজন মানুষ। তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাতর হয়ে থাকি। তুমি এখন আমার প্রয়োজন না, তুমি আমার ভালোবাসা; প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়, ভালোবাসা শেষ হয় না। তুমি আমার নিজের মানুষ। একান্তই নিজের মানুষ। নিজের মানুষ সেই যার কারণে নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম হয়।
মৃদুল বলে, কাচ খুঁজতে খুঁজতে মানুষ হিরা পেলে মানুষ আর কাচ খোঁজে না। তুমি আমার হিরা, অমূল্যের চেয়ে অমূল্য। কাচ না পেয়ে পেয়েছি হিরা, আমার ভাগ্য বড়ো সৌভাগ্যের। কতক্ষণ এভাবে বুকটা দখল করে রাখবে? একটু তো চাও আমার দিকে?
বিভা বলে, তোমার বুকে যে প্রশান্তি পাই কোথায় গেলে পাবো আমি? তোমার বুকের মধ্যখানে থাকলে আমি স্বর্গসুখ পাই।
মৃদুল বলে, আমার ঘরে আসার আগে কখনো কি মনে হয়নি মানুষটা ভালো হবে তো? কখনো কি মনে হয়নি যার ঘরে যাচ্ছি তার মন মানসিকতা কেমন হবে?
বিভা উত্তরে বলে, না তেমন মনে হয়নি। আমি ভেবেছি যে মানুষটা আমাকে গ্রহণ করছে আমাকে জেনে-বুঝেই গ্রহণ করছে। কেউ অসুখী হওয়ার জন্য সংসার গড়তে যায় না। মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আমার মানুষটা আমাকে অনেক ভালোবাসবে। তাছাড়া স্বামী কখনো স্ত্রীকে ঠকায়? কখনো কেউ কাউকে ঠকিয়ে নিজে জিততে পারে না। তুমি আমার হাত ধরেছো শুধুমাত্র তো মুহূর্তটুকু উপভোগ করার জন্য না। কোনো পুরুষই তার সঙ্গিনীকে কষ্টে রাখে না, এটাই সত্য।
মৃদুল বিভার কথা শোনে আর আশ্চর্য হয়। মনের অনুভূতিগুলো কত সুন্দর করে প্রকাশ করতে জানে সে। অথচ সে নিজে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না বলে গুমড়ে মরে। বিভাকে বললো, এত ভালোবাসো কেন? মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসতে নেই। অতিরিক্ত যত্ন করতে নেই। বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। ভালোবাসা বেশি প্রকাশও করতে নেই। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে বদলে যায়। মানুষ বদলে গেলে মানুষ ভুলে যেতে চায়। বদলে গেলে দীর্ঘদিনের সম্পর্কও ঠুনকো হয়ে যায়। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে গুরুত্ব দিতে ভুলে যায়। বেশি ভালোবাসা পেলে ভালোবাসার মর্যাদা রাখে না।
শুনে বিভা বলে, যে সত্যিকারে ভালোবাসে সে বদলে যায় না। যে সত্যিকার ভালোবাসে সে গুরুত্ব দিতে কার্পণ্য করে না। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ কখনো ছেড়ে যায় না। ভুলে থাকে না। ভুল বোঝে না।হাজারও কষ্টের মাঝে আগলে রাখে। জীবনে যাকে পেয়েছি আমি জানি আমিই তার কাছে পুরো পৃথিবী। হাজারও ব্যস্ততার মাঝে আমি তাই তোমাকেই স্মরণে রাখি, রাখি মনের কোঠরে।
মৃদুল বলে, কত ভালো তুমি। এমন একজন জীবনসঙ্গীই আমি মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম যে আমাকে পাওয়ার পর আমার ভেতরেই পৃথিবীর সব সুখ খুঁজে পাবে। সৌন্দর্যের মাঝে ভালোবাসা না খুঁজে তুমি ভালোবাসার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজেছো, আর তাই আমার মতো একজন কালো ছেলেকেও কত অনায়াসে গ্রহণ করেছো। কালে বলে সারাটাক্ষণ ভাবতাম হয়তো আমার একজন ভালোবাসার মানুষ জুটবে না। রূপের সৌন্দর্যের অহংকারের কাছে গুণের সৌন্দর্যের পতন।
বিভা বলে, মনের মানুষটা মনের মতো হতে হয়। সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসা ভুল সিদ্ধান্ত। ভালোবাসার মধ্যেই সৌন্দর্য খুঁজলে জীবনটা রঙিন হয়। পরস্পর পরস্পরের বিশ্বাসে থাকলে আর কিছু লাগে না। প্রত্যেকই জীবনে একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি চায়। ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তি মানুষটা ভালো হলে আর কিছু লাগে না। আর আমি কখনো আমার রূপ নিয়ে ভাবিনি। পুরুষ মানুষকে রূপ দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আটকানো যায়। এজন্য গুণ দিয়ে আটকাতে হয়, মায়া দিয়ে জড়াতে হয়।
দুইদিন পরে বিভার বাবা বিভাকে নিয়ে বাড়ি গেলেন। বাসায় পৌঁছেই মৃদুলকে ফোন করে কান্না করলো বিভা। মৃদুল বললো, এক পাক্ষিক সময়কালের সংসার জীবন আমাদের মাত্র অতিক্রান্ত হলো। এত মায়া আমার জন্য? এত কান্না আমার জন্য।
বিভা বললো, তোমার জন্য মনের মধ্যে খুব মায়া জন্মেছেগো। এক পাক্ষিক অনেক সময়, একদিন হলেও বন্ধন যদি বন্ধনের মতোই হয় তবুও মায়া জন্মে। এ মায়া ঈশ্বর প্রদত্ত।
মুদুল বলে, হয়তো আমার চাওয়াটা পবিত্র ছিলো, তাই তোমাকে পাওয়া। চাওয়াটা পবিত্র হলে পাওয়াটা অনিবার্য। জীবনে সব কিছু ভুলে থাকা গেলেও তোমার মায়া ভরা মুখের কথা ভুলে থাকা যাবে না। থেকো তুমি আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে লেগে।
একটু পরেই পাশের বাসা থেকে জেঠিমা এলেন। এসেই বিভার সামনে বিভার মাকে বললেন, জগতে কি আর ছেলে ছিলো না? ওমন একজন কালো ছেলের সাথে তোমার এমন লক্ষ্মীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে কেন বিয়ে দিলে? জুড়ে দিলেই জোড়া লাগে?
জেঠিমাকে সমর্থন করে পাশের বাড়ির শ্যামলের বৌ বললো, পয়সার লোভ করেছে বিভার বাবা-মা। ছেলে চাকরি করে, আর কোনো কিছু না ভেবে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে। পয়সা তো মেথররেও আছে।
বিভার মা বললেন, নায়কোচিত চেহারার কত ছেলে আছে রিক্সা চালাচ্ছে। মেয়েকে সুন্দর চেহারার রিক্সা চালকের কাছে বিয়ে দেবো? ছেলেটির কর্মগুণ আছে বলেই তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। শ্যামলের বৌ বাড়ি যাও, রাত-দিন শ্যামলের সাথে ঝঞ্জাট করো, তুমি এসেছো জ্ঞান দিতে। জগৎ চলে মেধায়, রূপে না। মানুষ কর্মের কারণে মহামানুষও হয়, অমানুষও হয়। সফল মানুষরাই সত্য আর সুন্দর। তোমরা চেহারা দেখো বলে ঠকো, চরিত্র দেখলে জিততে। চেহারা দেখো, আচরণ দেখো না।
শ্যামলের বৌ চলে গেলেও জেঠিমা গেলেন না। বললেন, বুঝলাম ছেলেটির রোজগার ভালো। কিন্তু ওদের কি মানাচ্ছে? কালো, কিন্তু কত কালো! ফরসা আর কালোই কি কখনো মানিক-জোড় হয়? মানিক-জোড় শব্দযুগল কিন্তু অকারণে আসেনি! জুড়ি বা জুটি মানানোর ব্যাপারও আছে। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্মও যদি ওমন কালো হয় কেমন হবে? আগাম না ভেবে কেউ সিদ্ধান্ত নেয়?
বিভার মা জবাবে বললেন, মৃদুল শিক্ষিত, তার সন্তান শিক্ষিত হবেই। আপনার কোন সন্তানটা শিক্ষিত হয়েছে? কালো সন্তানও ভালো, মূর্খ আর বখাটে সন্তানের চেয়ে।
জবাব শুনে মনোক্ষুণ্ণ হয়ে জেঠিমা চলে গেলেন। বিভার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মন এমনই, চারিপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়, আর ভারাক্রান্ত হয়। যার কাছে যাকে ভালো লাগে তার কাছে সেই সুন্দর, নিজেকে শান্ত করে ঘরে গেলো সে।
বিভা এসেছে জেনে বিভার তিনটি বান্ধবী চলে এলো। রজনী উৎসাহের সাথে বললো, এই দেখ্ তোদের বিয়ের ছবি। তোর বরকে চেনায় যাচ্ছে না, রাতের আঁধারের সাথে যেন মিশে গিয়েছে। আর তোর ছবি দেখ্, মনে হচ্ছে আঁধারের মাঝে পূর্ণিমার আলোর বিচ্ছুরণ। এই মানুষটার সাথে থাকলে তোর আত্মসম্মান থাকবে? আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো সাথে থাকার চেয়ে একা থাকাও সম্মানের।
রজনীর কথার সাথে কথা মিলিয়ে দিনা বললো, ঈশ্বর তার সাথে তারই মিলিয়ে দেন যার সাথে যার মিলবে, কথাটি তোর ক্ষেত্রে মিললো না। দাদাবাবুর সাথে থাকতে থাকতে হয়তো ভালো লেগে যাবে, কারণ প্রতিটি হৃদয়েই ভালোবাসা প্রগাঢ় থাকে। কিন্তু তিনি এই যে এত কালো ব্যাপারটা মানা যায় না। ভালোতে ভালোত্ব নাও থাকতে পারে, কিন্তু কালোতে কালোত্ব কমই থাকে। তবুও তোদের জুটিটা মানানসই হলো না।
স্মারণি বললো, তুই সুন্দর ও লম্বা। তোকে অপছন্দ
করবে এমন পাগল সমাজে নেই। কোথা থেকে এক কৃষ্ণকালো এলো চিল হয়ে, আর তোকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো, মানা যায় না। তোর কপালটা খারাপ। আসলে সুন্দরীদের কপাল সুপ্রসন্ন হয় না। সৌদামিনীর বিয়েও হলো এক কালো ছেলের সাথে। কালো ছেলেগুলোর সুন্দরী মেয়েদের প্রতি এত লোভ কেন?
বান্ধবীরা চলে গেলে বিভা মন খারাপ করে বসে থাকলো। মৃদুল ফোন দিলে বিভা রাগতস্বরে বললো, মন ভালো নেই পরে কথা বলবো।
মৃদুল বললো, আমার সাথে কথা বলে যদি মন ভালো না হয় আর কারো সাথে কথা বলে কভু তোমার মন ভালো হবে না।
বিভা কর্কশকণ্ঠে উত্তর দিলো, তুমি কি মন ভালো করার মেশিন? তুমি আর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবে না।
হঠাৎ এমন কথা শুনে মৃদুল হতবাক হয়। সর্পিণীদের খোলস আছে, তাই বদলায়। বিভাকে তাই মনে হচ্ছে। তাই সে বলে, তোমার কথার ভেতর আমার জন্য কেমন যেন বিতৃষ্ণা। একদিন চোখের আড়ালে না যেতেই ভুলে গেলে সব ভালোবাসা? একদিন না যেতেই বদলে ফেললে নিজেকে? পাল্টে ফেললে বোল? হালকা হাওয়াতেও বদলে ফেলো নিজেকে? ভুলে যাও সব কথা দেওয়া?
বিভা বললো, তুমি তো একজন যোগ্য মানুষ। আমাকে নিজের সাথে জড়াতে কেন এসেছিলে? চেহারা কি যোগ্যতার মাপকাঠি? তুমি নিজেকে কেন একজন যোগ্য নারী থেকে বঞ্চিত করেছো? রূপ ছাড়া তো আমার মাঝে কিছু নেই, অথচ মানুষ তোমাকে ছোটো করছেন। আমার ভাগ্যকে মানুষ দুর্ভাগ্য বলছেন। তুমি নাকি আমার উপযুক্ত নও।
শেষের কথাগুলো শুনে মৃদুল চমকে গেলো। একটু আগেও চেনা মানুষটার আচরণ অচেনা লাগছিলো, কিন্তু এখন চেনা মানুষটার আচরণ চেনার চেয়ে আরও চেনা লাগছে। সে বললো, আমি কখনোই কারো কাছে স্পেশাল ছিলাম না। একমাত্র তুমিই তোমার জীবনে আমাকে স্পেশাল করে নিয়েছো। তোমার কাছে আমি বিশেষ কিছু না হলে তুমি আমার কাছে থাকতে না। তুমি কষ্ট দিলে সহ্য করতে পারবো না।
বিভা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, ওরা সব রূপ দেখে; তোমার গুণ দেখে না, মন বোঝে না। ওরা তোমার বাইরটা দেখে, তোমার ভেতরটা জানে না। আবরণে সুন্দর মানুষ দিয়ে আমি কি করবো যদি মানুষটার ভেতরটা সুন্দর না হয়? নায়কোচিত চেহারা দিয়ে আমি কি করবো, যদি সে নায়কই না হয়! তুমি তো আমার জীবনের নায়ক।
মৃদুল বললো, এজন্য তোমাকে চোখের আড়াল করতে চাই না। নানা মানুষ কুমন্ত্রণা দেন কানে। কবে না জানি এই কুমন্ত্রণায় তুমি ভুলে যাও। সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আসেন যত্ন করে মন ভেঙে দিতে। অন্যের সুখ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায় তখনই এমন করেন তাঁরা। একজনের সুখ অন্যজনের অসুখ, সহ্যাতীত। অন্যের সুখ দেখলেই আসল অসুখ জাগে।
এভাবে একটি দিন আসে সে দিনটাও চলে যায়। প্রতিবেশিনীরা আসেন আর মন ভাঙা কথা বলেন। মন্দ কথা বলতে কেউ কৃপণতা করেন না। ভালো নেই যারা তাঁরাই এমন মন্দ কথা বলতে জানেন। ভালো থাকবেন না তারা যারা এমন অন্যের সম্পর্কে বিষ ঢালেন।
তিন দিনের মাথায় মৃদুল বিভাকে নিতে এলো। প্রতিশিনীরা জাদুঘরের আশ্চর্য জীব দেখার মতো উৎসুকের সাথে বিভাদের বাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে আসছেন মৃদুলকে দেখতে। যেমন করে নতুন বৌকে দেখতে আসেন গ্রাম্য গৃহিণীরা। মৃদুলকে দেখেন আর মিটিমিটি হাসেন আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে একে অন্যের কানে কানে কী কী বলেন! বোঝায় যায় কালো ব্যাপারটি নিয়ে সবাই গুঞ্জণরত।
কেশবের মা যুগলের মায়ের উপর রেগে গিয়ে বললেন, পৃথিবীতে কালো রং আছে বলেই সাদা রং এত শোভা পায়। কালো তাতে কী! মনে কালি না থাকলেই হলো। পুরুষের রূপ কি সম্পদ! পুরুষের গুণ হচ্ছে সম্পদ। শরীরের রং দিয়ে কখনো সৌন্দর্য বর্ণনা করা ঠিক না। চেহারা যেমনই হোক মন যেন সুন্দর হয়।
যুগলের মা বললেন, কালো বলেই তো দেরি করেনি, দেখতে এসেই বিয়ে করেছে। কোনো প্রকার মত পরিবর্তনের সুযোগ দেয়নি। বিভার বরের বুদ্ধি আছে। যাহোক, যেটা হয়ে গিয়েছে এখন সেটা মানতে হবে৷ বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সন্তানকে মনোদুর্ভোগ নিয়ে বাঁচতে হবে।
মানুষের এমন সমালোচনা, কানাঘুষা মৃদুল দেখে। ব্যাপারটা দিনভর এবং প্রতিদিন হচ্ছে। তার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। যে কালোত্বের কারণে তার প্রতি পরীক্ষার লেখাতে পর্যাপ্ত নম্বর উঠলেও ভাইভায় নম্বর কম উঠেছে, যে কালোত্বের কারণে জব না হতে হতেও একটা জব হয়েছে, যে কালোত্বের কারণে কর্মক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনের কাজে যুক্ত হতে পারে না, যে কালোত্বের কারণে অনেক মেয়েপক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একটা বিয়ে করতে পেরেছে, সেই কালোত্বের কারণেই সে শ্বশুরবাড়ি অপমানের পর অপমান হচ্ছে। সে আর সহ্য করতে পারলো না। কাউকে কিছু না বলে সন্ধ্যাবেলাতেই শ্বশুরালয় থেকে বের হয়ে পড়লো।
মৃদুলকে না দেখতে পেয়ে বিভা ফোন করলো। ফোন বন্ধ। বাড়ির সবাই জেনে গেলেন মৃদুল কোথাও চলে গিয়েছে। বিভার মা রেগে গেলেন, বিভাকে বললেন, মানুষ দেখতে সুন্দর হলেই সুন্দর আর ভালো হয় না, মানুষের বড়ো পরিচয় তার কর্মে, আচরণে। কারো কথা শুনে মৃদুলকে যদি আঘাত করে থাকিস ভুল করেছিস। পৃথিবীতে আমাদের পর যদি কেউ তোর ভালো চায়, তবে সে মৃদুল। তোর কষ্টে আমাদের পর যদি কেউ কষ্ট পায়, তবে সে মৃদুল। আমাদের পর যদি কেউ তোকে নিরাপত্তা দেয়, তবে সে মৃদুল। মৃদুল ভালো ছেলে। সংসার করতে একজন ভালো মানুষের খুব প্রয়োজন।
বড়দি এসে বললো, মৃদুলের চেহারা নিয়ে কখনো আক্ষেপ করবি না। যার মন যত সুন্দর সে তত বেশি সুন্দর। মৃদুলকে আমরা চিনেছি। সুন্দর মনের মানুষ চিনতে আঁতশ কাচ লাগে না।
বড়দা বললো, ফরসা চেহারার চেয়ে সুন্দর মন অনেক দামি। মনের সৌন্দর্য সুপ্ত থাকে না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। মৃদুল নম্র আর ভদ্র। তার কথাবার্তা পরিচ্ছন্ন। যার যত সুন্দর ভাবনা সে তত সুন্দর মানুষ, চেহারা তো আবরণ মাত্র। মানুষের সৌন্দর্য চেহারায় থাকে না, থাকে মনে। চেহারার ফোয়ারার চেয়ে ব্যক্তিত্বের মায়া দামি।
বড়দি আবার বললো, মানুষের বড়ো সৌন্দর্য হলো তার চরিত্র। চেহারার অহংকারে মাটিতে পা না পড়লে এক সময় পায়ের নিচে মাটি থাকে না। চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, ব্যাক্তিত্ব থেকে যায়; মৃদুল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। ব্যক্তিত্ব দেখে ভালোবাসতে হয়।
যাকে তাকে ভালোবাসার কথা বলা যায় না। বিভা মাকে, দাদা-বৌদিকে বোঝাতেই পারলো না মৃদুলকে সে কত ভালোবাসে। মৃদুলের হৃদয়টা কত বেশি পরিষ্কার আর সুন্দর সে ছাড়া তো আর কেউ বেশি জানে না। কাউকে ভালোবাসলে রূপ দেখে ভালোবাসতে হয় না, মন বুঝে ভালোবাসতে হয়, সে জানে। যারা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে তারা মূলত সৌন্দর্যের পাগল হয়, মানুষটার মনকে বোঝে না। রূপ, টাকা আর ক্ষমতার বাহারকে গুরুত্ব না দিয়ে ভালো মনের জীবনসঙ্গীকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চেহারা যেমনই হোক, ভালোবাসাটায় আসল। মানুষ মন মানসিকতায় উন্নত আর আচরণে সুন্দর এমন খোঁজে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনে মনে চেহারায় সুন্দরকেই লালন করে। মনের বা গুণের সৌন্দর্যের খোঁজ কেউ রাখতে চায় না। বেশিরভাগ মানুষ বোকা তাই বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই খোঁজে। কিন্তু বিভা তেমন নয়, সে জানে সৌন্দর্য মুখের আবরণে না, মনে। সুন্দর ব্যবহারই আভরণ। আর তাই পারিপার্শ্বিকতার কারণে যে দিনের আলোতেই বাইরে যেত না, সে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতেই বের হয়ে পড়লো মৃদুলের উদ্দেশ্যে। বিভার অন্তরের টান দেখে বোঝা যায়, পুরুষ মানুষের সৌন্দর্যে নারী আটকে যায় না, আটকে যায় পুরুষের দায়িত্বে।
বাড়ি এসে দেখে শুকনো মুখে বসে আছে মৃদুল। বিভাকে দেখতেই দৌঁড়ে এসে বুকে চেপে ধরে বললো, এত রাতে বের হয়েছিলে কেন বাসা থেকে?
বিভা বললো, তুমি যেখানে সম্মান পাও না, সেখানে আমি থাকি কী করে? আর সেখানে যাবো না আমি।
মৃদুল প্রতিউত্তরে বলতে থাকে, বিভা, সবাই আমাকে কালো বলে এতে আমার কষ্ট নেই। সত্যকে মেনে নিতে শিখেছি অনেক আগেই। তুমি সুন্দর বলে তোমাকে বিয়ে করেছি, এটা সত্য। আমি চাইনি আমার সন্তানও কালো হোক, আর সারাটা জীবন আমার মতো নির্যাতিত হোক পরিবেশ দ্বারা। তোমাকে হঠাৎ এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে সময়ক্ষেপণ না করে বিয়ে করেছি, এটাও সত্য। যাতে নানা মতের প্রভাবে তোমাদের মত পরিবর্তন না হয়। কী করবো বলো? আমার আচরণ সবার কাছে ভালো লাগে, আবার সবাই-ই বলে কালো হলে কী হবে কথাবার্তা ভালো। আমার দ্বারা আমার মহল্লার অনেকেই উপকৃত হয়, সেই তারাই আবার বলে, কালো হলে কী হবে উপকার করার ইচ্ছা আছে। আমার রেজাল্ট ভালো, সেই দিকে কারো নজর নেই, আমি কালো সেই দিকে সবার ভ্রূক্ষেপ। ভালো চাকরি করি, ভালো রোজগার করি তবুও সেদিকে মানুষের নজর নেই, বলে ইনকাম ভালো তাতে কী কালো তো। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বড়ো হয়েছি বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। সন্তান মানুষ না হলেও আক্ষেপ করবো না, তবুও আমার সন্তান যেন পরিষ্কার হয়। অবিবেচক সমাজে যোগ্যতার চেয়ে রূপের মূল্য অনেক। রূপদম্ভের কাছে কর্মগুণের পতন এই সমাজ বাস্তবতায়। আমার খুব খারাপ লাগে যেখানে আমি আমার অধস্তনদের আত্মবিশ্বাস জোগাবো, সেখানে আমার নিজেরই আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায়, শুধু কালো বলে। মানুষ সৌন্দর্য দেখে, চরিত্র দেখে না। সুন্দর মানসিকতা কেউ দেখে না, সবাই সৌন্দর্যের পাগল। মানুষের মন সদা ছুটে চলে ফরসাপানে। ব্যক্তিত্বের মাধুর্য দিয়েও যে মানুষকে কাছে টানা যায় অধিকাংশই তা বুঝতে চান না। শুধু চেহারায় ভালো বলে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাবা-মা, তবুও আমার কাছে বিয়ে দেননি। কালো টাকা রোজগার করে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তবুও আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেননি। কালো যেন রং না, কালো যেন অভিশাপ। কালো বাজারিকে মানুষ পছন্দ করেন, কিন্তু নির্ভেজাল কালো মানুষকে মানুষ অবজ্ঞা করেন।
বিভা কোনো কথা না বলে মৃদুলের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। সে মৃদুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পায় না। মৃদুলও এখন কোনো সান্ত্বনায় ভোলে না। প্রকৃতপক্ষে একজন কালো মানুষ জানে পৃথিবীর নিয়ম আর বাস্তবতা কত কঠিন।
একটু দেখা
সুব্রত দত্ত
শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে "কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেস" এসে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্ট সংরক্ষিত আসন খুঁজে নিয়ে বসে পড়ে দিব্যেন্দু। ট্রেন ছাড়তে কিছুটা সময় নেবে, ইঞ্জিনটাকে ঘুরিয়ে নিতে হবে বলে। সকালবেলায় গাড়ি ধরা তার ক্ষেত্রে ভীষণ ঝকমারি। বেশি রাতে ঘুমোয়। তাই লেট রাইজার। "চায়ে" - "চায়ে" হাঁক শুনে দিব্যেন্দু নিচে নেমে চা-বিস্কুট খায়। তাড়াহুড়োয় বাড়িতে কিছুই খাওয়া হয় নি। ট্রেন হুইসল দিতেই সে নিজের আসনে বসে। এবার সে সহযাত্রীদের দেখে নেয় এক ঝলক। মহিলাদের দিকে সে সরাসরি তাকাতে অনভ্যস্ত। ভদ্রলোকই মনে হলো সবাইকে। আসলে এভাবে অচেনা লোকের সাথে সখ্যতায় সে তার লেখার অনেক রসদ খুঁজে পায়। পাশেই একটা বাচ্চা ছেলে বসেছে বাবা মায়ের সঙ্গে। ছেলেটি জানালা দিয়ে গোগ্রাসে দু'দিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। লোভ সামলাতে না পেরে দিব্যেন্দু কথা শুরু করে,
-তোমার নাম কি?
-শুভ, শুভদীপ ব্যানার্জী।
-বাড়ি কোথায়?
-শিলিগুড়ির আশ্রমপাড়ায়।
-কোন ক্লাস?
-নাইন।
-বাঃ, ভালো। কোথায় চললে?
-নিউ মাল জংশনে নেমে ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে
ত্রিবেনীতে যাবো ঘুরতে।
-এত ঘুরে যাচ্ছো কেন?
এবার শুভদীপের মা উত্তর দিলেন,
-এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অন্য ট্রেনের ভিড় এড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে জার্নি করতে এই ট্রেনে আসা।
শুভ বলে, তাছাড়া সেবকে যদি স্টপেজ দেয়, তাহলে নেমে যাবো। গাড়ির ড্রাইভারকে করোনেশন ব্রিজে আসতে বলবো। সেই সময়টুকু সেবকেশ্বরী কালি মন্দিরটা ঘুরে নেবো।
-বাঃ, সুন্দর প্ল্যান বানিয়ে নিয়েছো। অবসর সময়ে কী করো?
-গল্পের বই পড়ি।
-তাই? বাঃ!
গুলমা স্টেশন পেরিয়ে গভীর সবুজ অরণ্যের বুক চিরে বিশালকায় এক কেন্নোর মতো গাড়ি ছুটে চলে। বাঁদরগুলো মনে হয় দিব্যেন্দুকেই ভেংচি কাটছে। কয়েকটা ময়ূরের দেখা মিললো। মাঝে মাঝে হাতিরাও রেলপথে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ হয়তো এখনো তাদের ঘুম ভাঙে নি! দিব্যেন্দু বলে,
-কোন ধরনের লেখা ভালো লাগে?
-গোয়েন্দা আর এডভেঞ্চার। ফেলুদা আমার প্রিয়।
-হুঁ। মৃগাঙ্ক গুপ্তের বই পড়েছো?
-হ্যাঁ, গোয়েন্দা দেবেশ আর তার সহকারী পার্থ!
-দেবেশ আর কার নাম বলতে পারবে?
-হ্যাঁ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
-তুমিও এসব বই পড়ো?
ইতিমধ্যে গাড়ি সেবক স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুভ "আসি" বলে বাবা মায়ের সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়। দিব্যেন্দুও আর উত্তর দেওয়ার সময় পেলো না। সেবকে তো এলাহি কারবার চলছে। বাঁ দিকের পাহাড়ে টানেল খুঁড়ে সিকিমে যাওয়ার রেলপথের কাজ চলছে। তিস্তা সেতু পেরিয়ে পরপর দু'টো অন্ধকার টানেল। সেখান থেকে বেরোতেই আলোর ঝলকানিতে সামনের আসনে বসা ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়ে যায়। হাল্কা সবুজ রঙের ঢাকাই জামদানী শাড়ি পরনে। প্রসাধনীর আধিক্য নেই। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মার্জিত লিপস্টিকের আভা। স্বচ্ছন্দ আভিজাত্যের প্রকাশ। দিব্যেন্দু বেশ কিছুক্ষণ থেকে তার সহজাত রিফ্লেক্সে বুঝতে পারছিল কেউ তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এবার সেই ভদ্রমহিলা বলে ওঠেন,
-আপনি কি দিব্যেন্দু সেন?
-হ্যাঁ, কিন্তু ...
চন্দ্রানী অতি উৎসাহী হয়ে বলে,
-আমি চন্দ্রানী।
-খুব চেনা চেনা লাগছে। চন্দ্রা...
-সেই যে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ - ভুলে গে...
-ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আসলে এতদিন পর তো! তা এদিকে কোথায়?
-হাসিমারায় যাবো। স্বামী এয়ারফোর্সের অফিসার। কলকাতায় বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি ছুঁয়ে এলাম রুটিন মাফিক। আর তু...!
-কি হলো, থামলে কেন?
-তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-আলিপুরদুয়ারে একটা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে।
-লেখালেখি করো বুঝি?
-ওই একটু আধটু।
চন্দ্রানী একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে দেখে দিব্যেন্দু মুচকি হেসে বলে,
-ওভাবে কি দেখছো?
-নাঃ, কিছু নয়।
-উঁহু, কিছু তো বটেই!
-দেখছি, তোমার হাসিটা। একই রকম রয়ে গেছে। ওটা দিয়েই আমাকে জখম করেছিলে। মনের ভেতরে এখনো সে দাগ রয়ে গেছে।
-কেমন আছো?
-কেউই বোধহয় কোথাও ভালো নেই! তুমি?
-ওই, চলে যাচ্ছে আর কি। তোমার তো খারাপ থাকার কথা নয়!
-হুঁ, মনের বাইরের পাওয়ায় কোনো অভাব নেই।কিন্তু ছোট্ট এক টুকরো খুব মিষ্টি অতীতের আলোটাকে আজও মনে মনে খুঁজে বেড়াই। আজ পেলাম, কিন্তু অন্য রূপে। আসলে, আমি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। তাই এমন অবহেলাই হয়তো আমার প্রাপ্য ছিল!
দু'দিকের সবুজ নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে বাগরাকোট, ওদলাবাড়ি, ডামডিম স্টেশন এবং উচ্ছল লিস, ঘিস, চেল প্রভৃতি পাহাড়ি নদী পেরিয়ে ট্রেন থেমেছে নিউ মাল জংশনে। কামরা অনেকটা খালি হলো। কথা ঘোরাতে দিব্যেন্দু বলে,
-সিঙ্গারা খাবে?
- না, তুমি খেতে পারো।
-না, ঠিক আছে।
-প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে?
-নাঃ, এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে।
-রবি ঠাকুরের "হঠাৎ দেখা"-য় তবু একটা উত্তর ছিল। "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।" কিন্তু আমি তোমার মনে না রাখা এক অনামি তারা। "মেঘে ঢাকা তারা।" উত্তর দেওয়ার কেউ নেই!
-উঁহু, ঠিক বললে না। মনে থাকবে না কেন? তবে হ্যাঁ,
আমাদেরও এই লৌহপথগামিনী শকটে হঠাৎ দেখা হলো!
-লৌহপথগা... বাব্বাঃ, এত কঠিন বাংলা! এর মানে...
-রেলগাড়ি।
চন্দ্রানী খিলখিল করে হেসে ওঠে। আজ এই প্রথম তাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখা গেলো। সেই হাসির যাদুতে দিব্যেন্দুর বুকে চেপে বসা জগদ্দল পাথরটা যেন এক লহমায় সরে গেলো। অনেকটা হালকা বোধ হচ্ছে এখন। দিব্যেন্দু জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবে, সেই চনমনে চঞ্চল মেয়েটি আজ যেন বড়ই শান্ত। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে চন্দ্রানী মাথা নেড়ে বলে,
-তুমি এরকম লাজুক না হলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো।
-এভাবে বলছো কেন? মাত্র তিন দিন আমাদের দেখা আর কথা হয়েছিল।
-(বিদ্রুপের হাসি মেখে) দেখা! হ্যাঁ, তুমি শুধুই চোখের দেখা দেখেছিলে। আর আমি দেখেছিলামদেখার চোখ দিয়ে। তবু অবহেলায় না ফোটা কুঁড়ির মত ঝরে পড়েছি ধুলোয়।
-তুমি অবশ্য আগেও সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে।
-তাই? তোমার মনে আছে সেসব?
চন্দ্রানী জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। গাছ, গরু, ছাগল মানুষেরা সব একে একে দূরে সরে যাচ্ছে। সেই পুরোন দিনের কথা, দিব্যেন্দুর জন্য প্রতীক্ষার দিন গুনে যাওয়া - তার মনটাকে তোলপাড় করে তোলে। আর দিব্যেন্দু সেই পুরোন দিনের স্মৃতির জাল হাতড়ে বেড়ায়। সত্যিই সেদিন সেভাবে ভাবেনি সে। তখন সদ্য আশুতোষ কলেজে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে। শিলিগুড়ির বাড়িতে এসেছে গরমের ছুটি কাটাতে। কলকাতায় ফেরার আগের দিন তার দাদার বন্ধু রঞ্জনদা তার স্ত্রী আর শ্যালিকা চন্দ্রানীকে নিয়ে হাজির। আকাশি রঙের স্কার্ট পরেছে। দু'টো বিনুনিতে তার গোছা চুল বিভক্ত। অসাধারণ ভাবে সাধারণ সাজ। তবে বেশ ছটফটে মনে হলো। আকর্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। রঞ্জনদার শ্বশুরমশাই প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টেড ছিলেন শিলিগুড়িতে। একসাথে লাঞ্চ সারা হলো। অনেক গল্প শেষে বিকেলে চা-পর্বের পর রঞ্জনদা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি। হঠাৎ চন্দ্রানীর পীড়াপীড়িতে তার বাবার কোয়ার্টারে দিব্যেন্দুকে যেতেই হলো। প্রচুর মিষ্টি আর স্ন্যাক্স প্লেটে সাজানো দিব্যেন্দুর সামনে। মিষ্টিতে তার অভক্তি। চন্দ্রানী তার সঙ্গে এঁটুলীর মতো লেগে রইলো। কলকল করে কত কথা বলে গেলো মহানন্দার স্রোতের মত। স্বল্পভাষী দিব্যেন্দু "হুঁ","হ্যাঁ" বলে কাটিয়ে দেয়। পরের দিন দিব্যেন্দু দার্জিলিং মেইলে ফিরবে শুনে চন্দ্রানীর চোখে আনন্দের বিদ্যুৎ রেখা খেলে যায়। কারণ, একই ট্রেনে তাদেরও কলকাতার টিকিট কাটা! ফেরার সময় চন্দ্রানী তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল,
-তুমি গান জানো?
-নাঃ!
-তুমি সত্যিটা বলছো না। তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় যে তুমি একজন ভালো গায়ক।
দিব্যেন্দুর কথা চন্দ্রানী সেদিন বিশ্বাস করে নি। পরের দিন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে মিলিত হয় তারা। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চন্দ্রানী দিব্যেন্দুর নন-এসি কামড়ার জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বারবার বলেছিল, শেয়ালদায় নেমে দেখা না করে যেন সে না বেরোয়। সকালে পৌঁছে দিব্যেন্দু প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলো। দেখা হতেই কথার যেন শেষ নেই চন্দ্রানীর। যেন তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। দিদি জামাইবাবু তাড়া দিতে থাকে। সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দিব্যেন্দুর কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয় যে, তার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের হস্টেলে সে দেখা করতে যাবে। কিন্তু দিব্যেন্দু ভীষণ লাজুক ছিল বলে মেয়েদের হস্টেলে গিয়ে দেখা করতে যাওয়ার ক্ষমতা হয় নি। তবে মনের খাঁচায় একটা অপরাধবোধ যেন ঘিরে রেখেছিলো বেশ কিছুদিন। তারপর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই সামলাতে গিয়ে ধীরে ধীরে চন্দ্রানী আবছা হতে হতে নদীর স্রোতের মতো দূর থেকে আরো দূরে বিলীন হয়ে যায়।
-কি ভাবছো?
হঠাৎ প্রশ্নে দিব্যেন্দু সম্বিৎ ফিরে পায়। বলে,
-না, তেমন কিছু নয়।
-এত করে অনুরোধ করার পরেও কেন আমার সাথে দেখা করতে যেতে পারলে না?
-আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি যে...
-বুঝতে পারো নি যে, প্রথম দেখায় কারোর মনে এমন গভীর ভালোবাসা জন্মাতে পারে। তাই না? কি করবো বলো? ভীষণ ভালো লেগেছিল তোমায়। বিশ্বাস করেছিলাম খুব। তখন যদিএখনকার মত মোবাইল ফোন থাকতো, তাহলে কিন্তু তোমাকে পালিয়ে যেতে দিতাম না।
-আসলে বিষয়টা এত গভীর ভাবে ভাবার অবকাশ ছিল না। ভবিষ্যৎ তৈরি করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য।
-কেন, ভালোবাসলে কি ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায় না? আমি যে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করে নিয়েছিলাম! সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু সেই ভাঙ্গা স্বপ্ন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি নি। যাকগে, থাক এসব কথা। আজ তোমার দেখা পাওয়াটাই আমার কাছে এক বড় পুরস্কার। আমার এতদিনের উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের মুক্তি হলো আজ। আর হয়তো দেখা হবে না কোনদিন! এই দেখো, কথা বলতে বলতে বানারহাট, জলঢাকা ব্রীজ, দলগাঁও স্টেশনও পেরিয়ে এলাম। এরপর মুজনাই স্টেশন, তারপর তোর্ষা নদীর পরেই হাসিমারায় আমার নামার পালা। ভালো থেকো।
-দাঁড়াও, তোমাকে একটা উপহার দেবো। নেবে তো?
-উপহার?
-হ্যাঁ। আশা করি খারাপ লাগবে না।
-তুমি কিছু দিলে আমি নেবো না, তা কি হয়?
দিব্যেন্দু তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে লিখে দেয়, "চন্দ্রানীকে - সৌজন্যে মৃগাঙ্ক গুপ্ত
(দিব্যেন্দু সেন)। তারপর বইটা এগিয়ে দেয়। চন্দ্রানী সেটা হাতে নিয়ে বইয়ের নাম দেখে,
মিতালী
মৃগাঙ্ক গুপ্ত
তারপর মলাট উল্টে টাইটেল পেজে দিব্যেন্দুর কলম দিয়ে লেখাটা পড়ে তার চোখে বিস্ময়ের স্ফুরণ! সে বলে ওঠে,
-তুমিই মৃগাঙ্ক...!
-হুঁ, আমার ছদ্মনাম।
-তুমি এত ভালো লেখো! আমার বাড়িতে তোমার বেশ কিছু বই আছে। আমি পড়ি তো! এটা অবশ্য নেই। সাম্প্রতিক প্রকাশিত, তাই না? ছদ্মনামের মত নিজেকে আমার কাছ থেকেও লুকিয়ে রেখেছিলে!
-ছদ্মনামটা বিশেষ কারণে...
-থাক, আর কারণ দর্শাতে হবে না। একটা অনুরোধ করবো? এবার রাখবে তো?
-ঠিক আছে বলো, অবশ্যই রাখবো। তোমার
হাসিমারা স্টেশন চলে এলো। তাড়াতাড়ি বলো।
-হুঁ। বলছি, আমাদের নিয়ে একটা গল্প লিখবে?
-উঁ?
-মানে, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে গল্প? সত্যি
ঘটনাই লিখবে! কি, লিখবে তো?
-আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার নিশ্চয়ই কথা
রাখবো। আর তুমিও ভালো থেকো। সাবধানে
নেমো।
-অনেক বাজে কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করো
না।
-না না, মনে করার কি আছে। সময়টা খুব সুন্দর
কাটালাম!
-তাই? জানি তুমি আমার কেউ না, তবুও কোনো একটা অবয়বে আমার মনের ঘরে তোমার চলাচল অনুভব করি। তুমি অবশ্য এসব বুঝবে না। ঠিক আছে, আসি।
চন্দ্রানীর দু'চোখের কোণে মনে হলো স্ফটিকের বিন্দু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে দরজার দিকে এগোয়। দিব্যেন্দু তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ট্রেন থামে। চন্দ্রানী নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়। ট্রেন ছাড়লে সে হাত আর মাথা নেড়ে বিদায় জানায়। হ্যাঁ, বিদায়! এবার সেটা নতুন করে, জেনে শুনে আর দায়শূন্য ভাবে। দিব্যেন্দু অবশ্য নতুন একটা গল্প লেখার রসদ পেয়ে গেলো। চন্দ্রানী হয়তো মুক্তি পেলো, কিন্তু সে দিব্যেন্দুকে যেন স্মৃতির খাঁচায় নতুন করে বন্দি করে রেখে গেলো। নাঃ, গল্পটা লিখতেই হবে, চন্দ্রানীর জন্য। পাঠকের কেমন অনুভূতি হবে তা সে জানে না। তবে তার নিজের মনটা আজ বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। এর থেকে কবে মুক্তি পাবে, কে জানে! রেলগাড়ি ছুটে চলে তার গন্তব্যে, নিয়ম মেনে।
No comments:
Post a Comment