সম্পাদকের কথা
আবার বসন্ত। আবার বছর শেষের আহ্বান। শীতের রুক্ষতা আর জীর্ণতা দূরে সরিয়ে নব কিশলয়। নতুন করে সেজে ওঠা প্রকৃতির। তবু কিছু না-পাওয়া আর অপূর্ণতায় ছন্দ নষ্ট হয় আজও। প্রশ্ন জাগে নারীর অসম্মান নিয়ে। বিস্মিত হতে হয় অতি সক্রিয়তা আর নিষ্ক্রিয়তার যূথবদ্ধতায়। বসন্ত এসব যেন দেখেও দেখে না। আসলে আমাদের জীবনে বসন্ত বোধহয় আসে না। তাই ভগবানের আসন থেকে সহসা নেমে আসেন কেউ। মিশে যান দু`কান কাটাদের ভিড়ে। কেউ আবার ডিগবাজির চূড়ান্ত দেখিয়ে এই দল থেকে লাফিয়ে আর এক ডালে দিব্যি দোল খান। তাই বসন্তে প্রকৃতি সেজে উঠলেও মানবজীবন রয়ে যায় সেই একই জায়গায়। নিরাসক্ত এক বিষণ্ণতায়।
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪৩০
এই পর্বে আছেন যাঁরা
শ্রাবনী সেনগুপ্ত, অভিজিৎ সরকার, বিনয় বর্মন,
স্বপন কুমার দত্ত, দেবদত্তা বিশ্বাস, কবিতা বণিক,
সুব্রত দত্ত, প্রদীপ কুমার দে, রীতা মোদক,
বটু কৃষ্ণ হালদার, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, মিষ্টু সরকার
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪৩০ (গদ্য পর্ব)
বসন্ত প্রবন্ধ
বসন্ত উৎসব
শ্রাবনী সেনগুপ্ত
বসন্ত ভালোবাসার কাল ।শীতের রুক্ষতাকে পেছনে ফেলে প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজানোর বার্তাবাহক বসন্ত। পয়লা ফাল্গুনের ঋতুরাজের আনুষ্ঠানিক আবির্ভাব।প্রকৃতি নবনবরূপে নিজেকে সাজিয়ে তোলে তাকে বরণ করতে। প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনেও লাগে দোলা। বাংলা এবং ভারতের অন্যত্র বসন্তকে বরণ করে নেওয়া হয় বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্যে দিয়ে।
বসন্ত উৎসবের প্রাচীনতম রূপ হলো দোলযাত্রা। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন রাধা কৃষ্ণ। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে এই উৎসবের জন্ম। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা ।হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয় ,চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের রচিত জগত বিখ্যাত কামসূত্র তে দেখা যায় দোলায় বসে নরনারীর আমোদ প্রমোদের বর্ণনা।সপ্তম শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনকালে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল হোলির বর্ণনা দেওয়া একটি প্রেমের নাটিকা। সপ্তম শতকে শ্রীকৃষ্ণের 'রত্নাবলী 'এবং অষ্টম শতকের 'মালতি মাধব' এই দুই নাটকেও এই উৎসবের দেখা মিলেছে। জিমূতবাহনের' কাল বিবেক' ও ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তর ভারতে হোলি উৎসব পালিত হয় বাংলার দোলযাত্রার একদিন পর। এই উৎসব পালনের পেছনের কাহিনী অন্যরকম। এই কাহিনীর মূলে রয়েছে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু ও তার বোন হোলিকা। তিনি অপরাজেয় বর পাওয়ায় কোনো দেবতাকেই সম্মান দিতেন না।তিনি বলতেন যে দেবতা নয়,তারই পূজো করতে হবে। তার পুত্র প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্মালেও ছিল পরম ধার্মিক বিষ্ণুর ভক্ত। সে কোনোমতেই বাবার এই আদেশ মানতে রাজি ছিল না। তাই হিরণ্যকোশিপু নানাভাবে চেষ্টা করত তার পুত্রকে শাস্তি দেওয়ার ,কিন্তু প্রতিবারই অসমর্থ হয়ে শেষে প্রহ্লাদকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করল হোলিকা ।এক্ষেত্রে সে নিজেকে অগ্নি নিরোধক শালে মুড়ে নিল ।কিন্তু কথায় বলে 'রাখে হরি মারে কে' তাই বিষ্ণুর কৃপায় আগুনের তেজ বাড়তেই হোলিকার গায়ের শাল উড়ে এসে ঢেকে দিল প্রহ্লাদকে। আর তাকে মারতে চাওয়া হোলিকা নিজেই আগুনে পুড়ে প্রাণ বিসর্জন দিল ।এই সময় বিষ্ণু এসে হিরণ্যকোশিপুকে বধ করেন। এরপর থেকেই লোকবিশ্বাসে সেই চিতার আগুন অশুভের বিরুদ্ধে সুখের জয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। আর যেহেতু সেই আগুনে দগ্ধ হয়েছিল হোলিকা তাই পরদিন পালিত হয় হোলি উৎসব। বাংলায় দোলের আগের দিনই খড় কাঠ জ্বালিয়ে বিশেষ এক উৎসবের আয়োজন করা হয় যেটি পরিচিত 'ন্যাড়া পোড়া' নামে। পুরীতে ফাল্গুন মাসে যে দোল উৎসব হতো তার অনুকরণে বাংলাতেও এই উৎসব পালনের রেওয়াজ চালু হয়।
তবে বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য বরাবরই ছিল। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্য বিখ্যাত নবদ্বীপে রাসমেলার উৎপত্তি। বসন্তকালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এবং বাংলাদেশের খুলনা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাস মেলা হয়ে থাকে। সেখানে কীর্তন গান ও নাচের আসর বসে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বিরা ফাল্গুনী পূর্ণিমা উদযাপনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিতেন। ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরী সন এর প্রবর্তন করেন। একই সাথে প্রবর্তিত হয় প্রতিবছর ১৪ টি উৎসব পালনের রীতি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব। সেই সময় বাংলার সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষই বিভিন্ন উৎসব মেলার মাধ্যমে এই বসন্তকে বরণ করে নিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসবে সূচনা করেন শান্তিনিকেতনে, যাতে অংশ নেয় বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে আসা হাজারো মানুষ। ১৯৬০ সালে বিশ্বকবির ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসব ।শান্তিনিকেতনে প্রাণ কুটিরের সামনে শুরু হয়েছিল এই উৎসব। এখন অবশ্য সেই প্রাণ কুটির রবীন্দ্র পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। এই ঋতুরঙ্গ উৎসব কালের বিবর্তনে আরো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এখন এই উৎসবের আগের রাতে বৈতালিক হয় ।সকালবেলা 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল' গানের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সন্ধ্যার সময় গৌড় প্রাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রতিবছর এই উৎসব উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে প্রচুর জনসমাগম হয়।
১৯৫২ সালের ৮ই ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারির পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙ্গা আবেগের জোয়ার মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সেদিনের সেই তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করেছিলেন সালাম বরকত সাফিক জব্বারের মত ভাষা শহীদের। সেই ষাটের দশক থেকেই বাঙ্গালী মেয়েদের মাঝে পয়লা ফাল্গুনে হলুদ শাড়ি পরার চল নতুনভাবে শুরু হয়। সেই সময় বাজারে এইরকম শাড়ির চল না থাকলেও তাঁরা ফাল্গুনের আগের রাত জেগে শাড়িতে ফুল দিয়ে রাঙিয়ে নিতেন। তার সঙ্গে পড়তেন গলায় গাঁদা ফুলের মালা, কানে চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ। আজ যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে বসন্তের প্রথম দিন বা পয়লা ফাল্গুন অন্যতম বৃহৎ সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে তার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৯১ সালে কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াও বসন্ত উৎসব পালন শুরু করেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একদল শিক্ষার্থী ।সেই বারে পয়লা ফাল্গুনের আগের দিন তারা শাড়ি কিনে মৈত্রী হলে রাতের বেলা ব্লক প্রিন্ট করেন। পরদিন ওই শাড়ি পরেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হন ।বরাবরের মতোই তখন বাংলা একাডেমিতে চলছিল অমর একুশে বইমেলা যা তাদের মাঝে যোগ করে অতিরিক্ত উৎসবের উন্মাদনা ।এর কিছুদিন আগেই স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের পতন ঘটেছিল ,স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের বিজয় উদযাপন করতে তাই আগে থেকেই রঙিন কাগজ দিয়ে ফুল প্রজাপতি আর পাখি বানিয়ে রাখা হয়েছিল। ছেলেরা সেগুলি হাতে নিয়ে রঙিন শাড়ি পরিহিত মেয়েদের সাথে এক বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন ।শোভাযাত্রাটি যখন ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করছিল অংশগ্রহণকারীরা তখন শিশুতোষ ছাড়া আবৃত্তি করছিলেন, সব মিলিয়ে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অভূতপূর্ব উৎসবমুখর পরিবেশের সূচনা হয়। এর পরের বছর ,১৯৯২ সালে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে একে অন্যের মুখে আবির মাখিয়ে ছোট একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে বসন্ত উৎসবের পালন করেছিলেন। ১৯৯৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত উৎসব উদযাপন শুরু হয় ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে জাতীয় উৎসব হিসেবে উদযাপন কমিটির তখন থেকেই নিয়মিত চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের বসন্ত বড়দের জন্য উৎসবের আয়োজন করেছে। এছাড়া এখন বসন্ত বরণ উৎসব পালন করা হয় কলাভবনের সামনের বটতলা আর পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এ। লক্ষ্মী বাজারেও এই উৎসব পালিত হয় রবীন্দ্রনাথ নজরুল ,জীবনানন্দ ও অতুলপ্রসাদ জসীমউদ্দিন, শাহ আব্দুল করিমের অমূল্য সৃষ্টি ভান্ডার এর মধ্যে দিয়ে ।অনেকের কাছেই বসন্ত হলো প্রেমের ঋতু। পশ্চিমা সংস্কৃতির দেখা দেখি আমাদের দেশে ও ভ্যালেন্টাইন ডের প্রচলন ঘটেছে বেশ কয়েক যুগ ধরেই তবে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের বসন্ত বরণ কোন অংশে কম নয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে মননে প্রকৃত প্রেমের দিন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনও দুলতে থাকে। বসন্ত আমাদের হৃদয়ে অপরাধ অকারণ খুশির দোলা দিয়ে যায়, শহরের ইঁট কাঠ জঙ্গলের মাঝেও শোনা যায় কোকিলের কুহু ডাক।
আর্যপূর্ব ,আর্য এবং আর্যেতরো অনেকগুলো উৎসব অনুষ্ঠান, আচার প্রথার সংমিশ্রণে দোল বা হোলি উৎসব বর্তমান আকার ধারণ করেছে ।সারা ভারতে প্রচলিত এই বসন্ত উৎসবটির মধ্যে স্থানীয় নানান উপাদানের সমাবেশ ঘটেছে। দোলের তিন চার দিন আগে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে একজনকে 'সূর্য রাজা 'সাজিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে মজা ও তামাশা করতে দেখা যায়। রাজা যাকে পান তারই কাছ থেকে অর্থ খাজনা আদায় করেন এবং সেই অর্থে আমার আমোদ আহ্লাদ খাওয়া-দাওয়া করা হয়। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলাও কোনো কোনো অঞ্চলের রেওয়াজ। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, তাঁর জ্যোতিষ গণনার দ্বারা দেখিয়েছেন যে, প্রায় 6000 বছর আগে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে সূর্যের উত্তরায়ন গতি আরম্ভ হয়েছিল। বর্তমান দোল উৎসবকে বলা যায় তারই স্মৃতি। ফাল্গুনী চতুর্দশীতে চাঁচর অনুষ্ঠানে যে গৃহ ভস্বীভূত বা মেষ দগ্ধ করা হয় তাঁর মতে তা ভাদ্রপদা নক্ষত্রের প্রতিরূপক। ঋকবেদের কালে এই ভাদ্রপদার নাম ছিল অজ একপাদ (এক পদ বিশিষ্ট ছাগ)। বহনুৎসবে যে মেষ দগ্ধ করা হয় সে এই অদ্ভুত দর্শন ছাগেরই প্রতিরূপ। এখানে ওই ছাগকে অসুর রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই অসুর সূর্যকে উত্তরায়ণ স্থানে আসতে বাধা দিচ্ছে। তাকে ভস্মিভূত বা বিনষ্ট করলে সূর্যের উত্তরায়ন গতিতে বাধা থাকবে না ,সূর্যের তাপ বাড়বে, দিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ভেড়ার কুশপুত্তলিকা দাহের মধ্যে তার প্রতিরূপ লক্ষিত হয়। দোল উৎসবে লাল বা সাদা ফাগ দিয়ে শালগ্রাম রূপে সবিতার বা বিগ্রহরূপী শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গ ভূষিত করা হয়। ঋকবেদে সবিতার হিরণ্য দ্যুতির উল্লেখ পাই। শীতকালে বালরবি লোহিতবর্ণ দেখায়। ওই ফাগ দিয়ে তা বোঝানো হয়। কেউ কেউ মনে করেন ,এই বসন্ত উৎসব আদিতে ছিল কৃষি পূজা। সুশস্য উৎপাদন কামনা বা ফলন বৃদ্ধির জন্য জমিতে বহনুৎসবের ভস্ম ছড়ানো হতো। বৈদিক কালে স্বেচ্ছাচারিতার জন্য, কুমারীর স্বামী সন্ধানে, দেহপোজীবীনী জীবিকা নির্বাহ করার আকাঙ্ক্ষায়,তিরন্দাজ ও অশ্বারোহি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুরস্কারের লোভে শীতকালে অনুষ্ঠিত 'সমন' উৎসবে যোগ দিত। এখনো হোলির সময় উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরে কোন কোন আখড়ায় পল্লী কবিদেরমধ্যে কবিতা রচনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। রাজস্থানে দুই দল অশ্বারোহির মধ্যে প্রহসন হয়, তারা পরস্পরের দিকে আবিরের গোলা নিক্ষেপ করে। কলিযুগে এই উৎসবকে সকল উৎসবের প্রধান বলা হয়েছে ।পদ্মপুরাণের পাতাল খন্ডে ফাল্গুন মাসের একাদশী থেকে আরম্ভ করে তিন বা পাঁচ দিনের এই উৎসবে চতুর্দশীর অষ্টম মাসে বা প্রতিপদ সন্ধিক্ষণে যথাবিধি ভক্তিপূর্বক সিত, রক্ত ,গৌর ও পীত এই চতুরবিধ ফাল্গু চূর্ণ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার বিধান দেওয়া আছে। মুকুন্দরামের চন্ডী মঙ্গলে ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ ষোড়শ শতকের বঙ্গদেশে দোল খেলার এক আনন্দঘন চিত্র দেখা যায় -
ফাল্গুনে ফুটিবে ফুল মোর উপবনে,
তথি দোলমঞ্চ নাম করিবে নির্মাণে।
হরিদ্রা কুমকুমে নাথ দিবে পিচকারী।
মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও আমির ওমরাহদের মধ্যেও এই বসন্ত উৎসব খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।সিরাজদৌললা আমির ওমরাহোদের নিয়ে হোলি খেলায় মেতে উঠতেন। খ্রিস্টীয় তৃতীয় চতুর্থ শতক থেকে আরম্ভ করে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ভারতের সব জায়গায় মদন উৎসব কিংবা কাম মহোৎসব নামে এক উৎসবের প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে ষোড়শ শতকের পর কোন এক সময় এই মদন বা কাম উৎসব হোলি উৎসবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তারপর সেকালের মুসলমান শাসক, ওমরাহ ও হারেমের মহিলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হোলি উৎসব ওই সমস্ত উৎসবকে গ্রাস করে নিজের একচ্ছত্র আসনটি অধিকার করে বসে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আমাদের দোল উৎসবের অনুরূপ উৎসব প্রচলিত আছে ।শ্যাম দেশের ব্যাংককে চার ব্যক্তিকে বিশেষ পোশাকে সজ্জিত করে দোলায় আরোহন করান এবং তাদের ঘিরে নানা রকম আচার অনুষ্ঠান করা হয়। এই উৎসবকে সেই দেশের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে বসন্ত উৎসব বলা হয়েছে। হোলির সমসাময়িক কালে অনুষ্ঠিত রোমানদের মেহনালিয়া ফেসটা উৎসবটি প্রজনন সংক্রান্ত ও বসন্ত আবির্ভাব এর উৎসব রূপে উদযাপন করা হয়। ১৫ই মার্চে অনুষ্ঠিত গ্রাম্য লোকের খেলাধুলা ,মদ্যপান,নৃত্য গান এবং ইতর জঘন্য রসিকতা Anna Purnna উৎসবের প্রধান অঙ্গ। ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ,জার্মানি প্রভৃতি দেশে মানুষের কুশপুত্তলিকা ('কার্লিতাল ফুল 'নামে পরিচিত) আগুনে পোড়ানো হয়। এইভাবে আমাদের হোলি বা দোল উৎসবের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক উৎসবে রঙ্গবিশেষ জড়িয়ে আছে। কোনো একটি মাত্র উৎসবের একক উপাদান আমাদের এই উৎসবটি গড়ে তোলেনি, বিভিন্ন উৎসবের বিভিন্ন প্রাচীন জাতি উপজাতির আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও ধর্ম বিশ্বাসের কথা সবকিছু নিয়ে এই উৎসবটি বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বসন্তের শিমুল ও আমাদের শৈশব
অভিজিৎ সরকার
আমরা যারা গ্রাম বাংলার ছেলে তারা শিমুল গাছ ও শিমুল ফুল দুটোর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রাম বাংলার এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই যারা শিমুল ফুলকে চেনে না, শিমুল ফুলের সাথে তাদের পরিচয় ঘটেনি। আমার বাড়ির পেছনেই ছিল এক বিরাট শিমুল বাগান যা দেখে আমি ছোটো থেকে বড় হয়েছি, তাই শিমুল আমার কাছে এক আবেগের নাম, বসন্তের সবচেয়ে প্রিয় ফুল। যখন সদ্য স্কুলের গন্ডিতে পা রেখেছি কোন কোন মাস নিয়ে বসন্ত ঋতু তা আমার ধারণার বাইরে ছিল তাই বলে বসন্তের আগমনকে আমি মোটেও চিনতে ভুল করতাম না তখন আমার বসন্তকে চেনার একমাত্র মাধ্যম ছিল উঁচু উঁচু গাছের লাল পাপড়ি যুক্ত সেই রক্তিম ফুলগুলি। যে রক্তিম ফুলগুলি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতো বসন্তের সঙ্গে। ফুল দেখতে কার না ভালো লাগে আমিও তার ব্যতিক্রম নই তবে বসন্তের এই লাল ফুল গুলো যেন বয়ে নিয়ে আসতো অপরূপ সৌন্দর্য এবং গ্রামের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে তুলতো। সকাল হলেই শিমুলের ডালে বসে শুরু হত পাখিদের কিচির মিচির শব্দ , ছোট ছোট পাখিরা এসে বসে থাকতো শিমুলের ডালে যেন শিমুলের সঙ্গে মেতে উঠতো গোপন আলাপচারিতায়। যেন মনে হতো তারও উপভোগ করছে বসন্তের এই নতুন সকাল। কখনো ছোট ছোট চড়ুই , কখনো আবার কোকিল বসে থাকতো শিমুলের ডালে যেন উপভোগ করত বসন্তের আমেজ। আমাদের ছিল টিনের চাল মাঝেমধ্যে যখন হাওয়া বয়ে যেত তখন আমাদের টিনের চালে ঝরে পড়তো শিমুল ফুল আমরা শব্দ পেতাম , যেন মনে হতো ঘরের উপর নেমে আসছে পুষ্প বৃষ্টি। বিকেল হলেই ছুটে যেতাম বাড়ির পেছনের শিমুল বাগানটিতে, স্কুল শেষে সব বন্ধুরা মিলে খেলার তখন একমাত্র জায়গা ছিল সেই শিমুল বাগান। মাঝে মাঝে খেলতে খেলতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যেত আর তখন মা হাতে লাঠি নিয়ে ছুটে আসতো শিমুল বাগানে আর আমি তৎক্ষণাৎ খেলা ছেড়ে এক দৌড়ে বাড়ি ছুটে আসতাম। ভয়ে ভয়ে তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে গাঁ হাত পা ধুয়ে সাথে সাথে বিছানায় বই খুলে বসতাম। মায়ের লাঠির হাত থেকে তখন বাঁচার এই একমাত্র হাতিয়ার ছিল বই খুলে বসা। মা এসে যখন দেখতো বই নিয়ে বসে পড়েছি তখন মার রাগও নিমেষেই গলে জল হয়ে যেত। আমার তখনও কোন পড়ার টেবিল হয়নি আমি ও আমার ছোট ভাই রোজ সন্ধ্যে ও খুব সকালে বই নিয়ে বসতাম এক বিছানায়। মাঝেমধ্যেই ঝগড়া লাগতো জায়গা নিয়ে কে বেশি জায়গা দখল করে আছে বিছানায়। মার কানে পৌঁছে যেতে ঝগড়ার আওয়াজ আর মার কানে ঝগড়ার আওয়াজ পৌঁছনো মাত্রই সব সমস্যার সমাধান ঘটে যেতে। মা রোজ ভোরে ডাক দিয়ে তুলে দিতো ,আমরা খুব ভোরে উঠেই সকাল সকাল বই নিয়ে বসতাম। সে অভ্যাস আমার এখনো রয়ে গেছে তাই আমি বেলা অব্দি আজও শুয়ে থাকতে পারি না সকাল হলেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। এখন বড় হয়েছি ঠিকই তবে সেই অভ্যাস এখন আমার পাল্টে যায়নি। মায়ের তৈরি করে দেওয়া সেই অভ্যাস এখনো চলছে নিয়ম অনুসারে। এখন আসি শিমুল ফুলের ব্যাপারে, আমাদের গ্রামের লোকজনকে দেখেছি শিমুল ফুলকে এক অন্য মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করতে আমার মাকেও দেখতাম ছোটবেলায় এ কাজ করতে। শিমুল গাছ থেকে যখন শিমুলের ফুলগুলি ঝরে ঝরে পড়তো প্রতিদিন মা এই ফুলগুলি গাছের নিচে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এক জায়গায় জমা করে রাখতো। নিয়মিত গাছ থেকে ঝরে পড়া শিমুল ফুলগুলিকে জড়ো করে রাখত কোন এক স্থানে। তারপর অনেকগুলো ফুল এক জায়গায় জমা করে সেই ফুলগুলি রোদে শুকিয়ে ফেলা হতো। ফুলগুলি শুকানোর পর সেগুলি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পরিনত করা হতো ছাইয়ে। আর সেই ছাই দিয়ে তৈরি করা হতো বাসন মাজার উপাদান। গ্রাম বাংলার অনেক মহিলাকেই দেখেছি এই কাজ করতে। সত্যি কথা বলতে যখন ছোট ছিলাম এইসব জিনিস দেখেই বড় হয়েছি আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় গ্রাম বাংলার বহু মানুষই এই এই বুদ্ধি অবলম্বন করে থাকতো। সেই ফুল কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখার দায়িত্ব করেছি স্বয়ং নিজেও। মা কাজের চাপে যখন গাছের নিচ থেকে ফুল নিয়ে আসার সময় পেত না তখন আমাকে পাঠিয়ে দিত ফুল কুড়িয়ে আনার জন্য। তবে সেসব এখন আর সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না কালের নিয়মে আজ এসব হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এসব জানেন না এবং ব্যবহার করেন না । সত্যি কথা বলতে সেসব ব্যবহার করার এখন আর সেভাবে প্রয়োজনই পড়ে না। তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে তখন অনেকটাই বড় হয়েছি হঠাৎ একদিন দেখলাম বাড়ির পিছনের সেই শিমুল বাগানটি কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। রীতিমতো সেই বাগান ধ্বংস করে সেখানে তৈরি করা হয়েছে আবাদি জমি।আমি ছোটোবেলা থেকেই গাছগুলো দেখে বড় হয়েছি তাই যখন ওই জমিটার দিকে তাকাই তখন মনে বড় কষ্ট হয়, ছোটোবেলার কথা স্মৃতিতে ভেসে আসে, মনে পড়ে যায় সুমধুর স্মৃতি, যেন খুঁজে পাই আমার হারানো শৈশব কে। আমি যখন খুব ছোট তখনই মা বাড়িতেও বেশ কয়েকটি অন্যান্য গাছের সঙ্গে শিমুলের চারাও লাগিয়েছিল এখন গাছগুলি বেশ বড় হয়েছে, ছোট্ট শিশু থেকে এখন পা দিয়েছে যৌবনে। সেই গাছে এখন ফুল হয়, গাছের নিচে পড়ে থাকে সারি সারি ফুল। আমি মাঝে মাঝেই ছুটে যাই শিমুলের খোঁজ নিতে জানিনা কি শান্তি পাই তবুও ছুটে যাই শিমুল গাছের নিচে। সেই ফুলগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে থাকি কোথাও যেন খুঁজে পাই আমার হারানো শৈশব, মনে পড়ে যায় পুরানো সেই দিন, আমার বসন্তের কথা, আমার শৈশবের কথা, আমার সেই প্রিয় শিমুল বাগানের কথা।
বসন্ত রম্য রচনা
বসন্ত বিলাপ অথবা বসন্ত দিনের বস্-অন্ত ভাবনা
বিনয় বর্মন
উপনিবেশিক ঘোর ( colonial hangover) কাটুক বা না কাটুক আমরা এখনো বস্-অন্ত প্রাণ রয়ে গেছি l সে বর্ষা হোক বা বসন্ত - আমাদের প্রাণ বস্-অন্ত l অফিস হোক বা বাড়ি বসের কথায় নড়ি বসের কথায় চরি !
ইচ্ছাপূরণের মতো বাসনা থেকেই hero worship এর উদ্রেক ! বাস্তব জীবনে আমি যা করতে পারছি না ,তা যদি সিনেমার পর্দায় , ক্রিকেটের মাঠে , ধর্মীয় আখ্যানএ কেউ করছে , সুপারম্যান এর মত অসম্ভবকে সম্ভব করছে - এতে আমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে l মানসিকভাবে সুপ্ত বাসনা পোষণ করছি : একদিন হয়তো আমার জীবনেও আমার সমস্যাগুলোর সমাধান করে দেবে কোন এক সুপারম্যান , কোন হিরো l তাই আমরা একজন কাউকে বস্ মানতে ভালোবাসি l
উনবিংশ শতাব্দীর স্কটিশ প্রাবন্ধিক দার্শনিক ও ঐতিহাসিক Thomas Carlyle এর বর্ণিত hero worship হোক বা রবীন্দ্রনাথের কথায় , " ... দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা ... " বীর পূজা আমাদের মজ্জাগত l অতএব একজন কারও নেতৃত্ব ছাড়া আমাদের চলে না l
কর্মস্থল বা রাজনীতির পাশাপাশি দাম্পত্যেও একই অবস্থান l একজন কারও কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া l স্বামী হোক বা স্ত্রী একজনের লেজ নামানো থাকবেই l বাইরে প্রবল দাপুটে পুরুষ বাড়িতে স্ত্রীর সামনে কেঁচো l আবার উল্টোটাও দেখেছি l ডাকসাইটে সুন্দরী , শিক্ষিতা , এমনকি উঁচু পদে চাকরি করে, বাড়িতে বরের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে l এমনও দেখেছি শুধু তৃণমূল স্তরের মহিলা জনপ্রতিনিধিই নন , স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পর্যন্ত সরকারি মিটিংয়ে স্বামীকে নিয়ে হাজির হন। বা পেশাগত সমস্যায় স্বামীকে জড়ান l অবশ্যই সবাই নন l কিন্তু এই প্রবণতা যথেষ্ট বিদ্যমান এখনও l আসলে একজন বস্ এর অধীনতা মেনে চলা আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে l
বসের আজ্ঞাবহ হওয়াই নয় l বসের সঙ্গে থাকতে থাকতে আবার অনেকের ইচ্ছেও হয় "রোল-প্লে"রl কিছু কিছু শিক্ষায়তনে দেখেছি প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকা না থাকলে কয়েকজন স্বঘোষিত "প্রধান" হয়ে যান l এই "কতিপয় প্রধানের" কাজ শুধু নির্দেশ দেওয়া l এই অমুক তুমি এটা করো , এই তমুক তুমি ওটা করো l Boss-ism . কিন্তু অন্যরা মানে কেন ? এটা বোঝার জন্য গ্রামসির বর্ণিত hegemony - শোষিতের সম্মতি- পড়ার দরকার নেই l প্রাপ্তি যোগের আশা : যদি কিঞ্চিত সুবিধা পাওয়া যায় ! দেরি করে আসা , আগে চলে যাওয়া , 'অন ডিউটি' ইত্যাদি l এই মানসিকতারই বর্ধিত রূপ নানান জায়গায় মনোনয়নের ব্যবস্থা l অমুক সংস্থার মনোনীত প্রতিনিধি l কোনরকম নির্বাচনের ঝামেলা না সামলেই বা যোগ্যতামান উত্তীর্ণের পরীক্ষা না দিয়েই 'নমিনি' হয়ে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ l রাজনৈতিক "গডফাদার" বা বসের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে রাজনৈতিক প্রিভিলেজ l অতএব বসের আজ্ঞাবহ অথবা বসের ভূমিকায় l আমার প্রাণ সদাই বস্-অন্ত l
নর নারীর সম্পর্কেও এই প্রভুত্ববাদ বিদ্যমান l E L James এর Fifty Shades of Grey তে দেখিয়েছেন , প্রেমও আসলে অধিকার ও দখলদারির ন্যারেটিভ l নায়ক ক্রিশ্চিয়ান তার নায়িকা এনাকে পেতে চায় বসের মত l তার যৌনতা আসলে BDSM : Bondage , Domination , Submission , Masochism .
যুথোবদ্ধ জীবনের স্মৃতি লালন করে চলেছি আমরা l যুথপতি হবার কিংবা হারেম পালনের সুপ্ত বাসনা - এই বস্-অন্ত ভাবনার বিবর্তিত ও বিবর্ধিত রূপ l সঙ্গিনীর দখল নিতে না পেরে বিবাগী হলো ডুয়ার্সের যে গন্ডার , কিংবা প্রেমিকার মনের দখল না পেয়ে আত্মঘাতী হলো যে কিশোর , এরা আসলে বহন করে চলেছে সেই বিবর্তিত একই জিন ( gene )এর দূরাগত বাসনা : অগম্যতে গমনের , অপ্রাপ্যকে প্রাপ্তির, অধরা কে ধরার !
বসন্তের এই দিনে যখন ' বাতাসে বহিছে প্রেম ' তখনও কি আমাদের হৃদয়ের গান আসলে হয়ে আছে বস্-অন্ত প্রাণ !
দুয়ারে ফাগুন
স্বপন কুমার দত্ত
শীতটা কেন যেন এবছরে যাইযাই করেও যাচ্ছেনা। কখনো উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের শৈত্যপ্রবাহের দাপটে কখনো আবার সিকিমে তুষার হাতের কারণে ঠান্ডায় জবুথবু। কম্বল সম্বল না করলেই খুক্ খুক্,খ্যাক্ খ্যাক্ ইত্যাদি ইত্যাদি। এর উপর তো রয়েছে, নানা ভাইরাসের দাপাদাপি।
অবশ্যই এই মরসুমেই শীত উপভোগ করবার জন্য বাঙালির কাঙালীপনা দর্শনীয়। বরফপাতের দৃশ্যাবলোকনের সুযোগ না ঘটলেও শুধু কম্বল জড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার মানসে কী ভিড় কী ভিড়। ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই বাসে, ট্রেনে বা বিমানে। ট্রেনে বাথরুমের সামনে খবরের কাগজ বিছিয়েও ভ্রমণে উৎসাহী পর্যটক এখানেই মিলবে। সাধে বলে," বাঙালির মতো আদেখলা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি"! সে যে যা খুশি তাই করুক। পয়সা থাকলে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধেও বাধা দেবার আমি কে?
প্রশ্ন জাগে অন্য জায়গায়। চাকরি নাই বাকরি নাই। চাকরি পেলেও থাকবে কিনা স্থিরতা নাই। বিবাহযোগ্যা কণ্যার পিতারা এখন মেয়েকে পাত্রস্হ করার আগে সাতবার ভাবছেন, ভাবী জামাই এর চাকরিটা অনলাইনে না অফলাইনে না বেলাইনে, থাকবে না যাবে? নাকি আবার গরাদের পেছনে কাটবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তা এসব ঝামেলার মধ্যেও ভূলোকে এতো পুলক কিসের? হোটেলের বারান্দায় একই ভাড়া দিয়ে রাত কাটাবার মতো ভ্রমণ পিয়াসীর নাম যে এখনও কেন " ওয়ার্ল্ড বুক অফ রেকর্ডস"-এ উঠছে না, সেটাই ভাবি।
কিন্তু মাস হিসেবে তো ফাগুন দুয়ারে হাজির। ভোর শুরু হতে না হতেই পুরুষ কোকিল তার সঙ্গিনীর খোঁজে রীতিমতো আরম্ভ করে দিয়েছে হাঁকডাক। তাই নাক ঠেকে ঘুমোনোর জো নেই। যদিও আমগাছে এখনো মেলেনি বউল। অলিরা তার সন্ধানে জেরবার।
এরমধ্যেই প্রেমের হালখাতা উৎসব সরস্বতী পূজা হয়ে গেছে শেষ। " খুল্লম খুল্লা, বাঁধনহারা, মাতোয়ারা হবার দিনটি পাওয়া গিয়েছিল পুরো একটি বছর পর। অবশ্য সেই দিনটি জানান দেয় যে, " দুয়ারে ফাগুন হাজির।"
তবে দুয়ারে ফাগুন এসে বাজারের আগুন কিছুটা হলেও নিভিয়েছে। মুক্তোঝরা হাসিতে আল্হাদে ষোলখানা হয়ে যাওয়া ফুলকপি এখন দশ টাকায় দুখানা। লজ্জায় দাঁড়িপাল্লায় উঠতে একেবারেই নারাজ। আর বাঁধাকপিও তথৈবচ। ব্যাগখানা এগিয়ে দিলেন কয়েকখানার সাথে একটা ফ্রিও দিয়ে দিতে পারে। তবে সঙ্গে গ্যাস বা বদহজমের ট্যাবলেটটা দিলেই বোধহয় ভালো হত। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে সেনের দিকে না এগোনোই ভালো। আপাতত নিরীহ জেনে যে লাঠি হয়ে তেড়ে আসবে, সেটা কে কবে জানতো? ইচ্ছে থাকলেও উচ্ছে কিনতে গিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করা ছাড়া উপায় কী? উচ্ছের তিক্ত অভিজ্ঞতা হবেই যে কোন বাজার সরকারের। দোলের দিনে গত বছর কচিপাঁঠা কিনতে গিয়ে নিজেই বোকাপাঁঠা। অগত্যা গাছ পাঁঠা এচোড়ের খচরামিতে হতে হয় তুষ্ট।
দুয়ারে ফাগুন আসার অর্থই হল এবার সূর্যদেবের চোখরাঙানির শুরু। গরমে আইঢাই, কোথা তাই কোথা যাই, জলপানে সুখ নাই, খেয়ে মজা নাই, ঘুমিয়ে হাইফাই, এককথায় জীবন বেগড়বাই। অথচ উপায় নেই। শুধু ভালো দিকটাই নেবে, তাহলে কালোটা নেবে কে?
তবে হ্যাঁ, দুয়ারে ফাগুনে একটা বাড়তি লাভ ফাগুয়া। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্ সবের মতো দোলের দিনটিও কিশোর কিশোরী,যুবক যুবতীদের কাছে আরও একটি খুল্লম খুল্লা দিন। ঘর থেকে না বেরোলে হতে পারে রঙের অনাকাঙ্ক্ষিত অণুপ্রবেশ। তাইতো শুনি," খেলো হোলি রঙ দেবো না তাই কখনো হয়, এসো এসো বাইরে এসো ভয় পেয়ে না ভাই।" তবে এখন রঙের প্রথাগত সংঙ্ঘা হারিয়ে সবাই নিজের মনের মতো অপরকে রাঙাতে হয় ব্যস্ত। তাই দোলের পর হাজারো চেষ্টায় গালের চামড়া উঠে গেলেও আদরে বাঁদুরে রঙের চিন্হ থাকে বর্তমান। গাইতে ইচ্ছে করে," রঙ শুধু দিয়েই গেলে,আড়াল থেকে অগোচরে,দেখেও তুমি দেখলে নাতো, সে রঙ কখন লাগলো এসে মনে, গেলো জীবন মরণ ধন্য করে, শুধু রঙ দিয়েই গেলে।"
এখন দোলের সময় হাজির," দুয়ারে রঙবাজি"! বার্ণিশ, ছাপাখানার কালি, পরিশেষে নর্দমার সুগন্ধি জলের ককটেল মকটেলে ফেস পাউডার,রুজ,ক্রীমমাখা মুখ হতে পারে একেবারে ছয়লাপ একই রঙে নিজেকে রাঙাতে না পারলে কখন যে আপনার রঙটি কেড়ে নেবে, টেরটিও পাবেন না।
বসন্ত ভাবনা
খোলা চিঠি প্রিয়তমকে.....
দেবদত্তা বিশ্বাস
আমার আসমানী রঙে তোমার সবুজ মিশে যায় আজ প্রিয়তম। যেমন ডুডুয়ার ডাকে তার উপনদীর নীল জল মিলেমিশে জন্ম দেয় আমাদের গোপন রূপকথার। বসন্তের উদাস হাওয়ায় আমার পাগল পাগল মনে পলাশ রঙা ভালোলাগারা কুহু কুহু ডাকের আবেশে প্রণয়ীর উষ্ণতা চায়।তোমার ছড়ানো এক মুঠো আবির গায়ে মেখে আমার চিরকালীন ভালোবাসা উদযাপন।
মহুয়ার নেশার মতো ঝিম ধরায় তোমার আকর্ষণের তীব্রতা।তাইতো ঝরা পাতার খসখস উপেক্ষা করেও তোমার প্রেমে আমি চিরহরিৎ। বাতাসের গায়ে খানিক রং মাখিয়ে আমি পাঠিয়েছিলাম আমাদের প্রেমের ঠিকানায়। প্রিয়তম আজ যে বসন্ত!
তোমার ভালবাসার দরবারে আমার বাগেশ্রী আমাদের মিলনের সাক্ষী হয়ে থেকে যাক আজ।দীপক রাগ ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালুক মধ্যরাতেও। আর ভৈরবীর সাথেই উদীয়মান সূর্য সাত রঙে বিভাজিত হোক আমাদের ভালোবাসার প্রতীক স্বরূপ। রাঙিয়ে দিয়ে যাও আমায় তোমার ভালোবাসায়।এই বসন্ত সমাগমে।
বসন্ত বিলাপ
কবিতা বণিক
সেদিন যদিও গোলাপ দিবস, ভালবাসার মাস। সকালে কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য তার সোনা রঙ ছড়িয়ে দিলে, দেখলাম দূরের ঐ রাস্তার বাঁকে পলাশ গাছে ধিকিধিকি আগুন ! বাঃ পলাশের কুঙ্কুম, সকালের মলয় বাতাস , নীল আকাশ আমার দুচোখে এক স্বপ্ন মায়া এঁকে দিল। এ যে ‘নব বসন্তের দানের ডালি।’ বসন্ত যে ভালবাসতে জানে। মনে মনে ছুটে গেলাম ঐ পলাশ গাছের নীচে , এস এস বসন্ত! উড়িয়ে তোমার উতলা উত্তরীয়! শীতের রুক্ষতা দুর করে আজ সকালের এই বসন্তের বার্তা যেন সৌরভের শিখা জাগিয়ে দিল। বসন্ত তার ‘গানের মুকুল আপনি ধরে কী আদরে।’ দূরের ঐ গাছ থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহুতান। বসন্তের এই ললিত রাগ দক্ষিণা বায়ে ভর করে পৌঁছে যায় প্রতি কর্ণ কুহরে। মনকে করে উচাটন ,আজ আনন্দ বসন্ত সমাগমে। আজ সকালের এই আনন্দ , এই মুগ্ধতা জমা থাক আমার দিনচর্যার ডায়েরির পাতায়। তাইতো মনের ভেতর ‘ উঠল জেগে আমার গানের কল্লোলিনী কলরোলা’ হরিণীর মত চঞ্চল পায়ে ছুটছি।যেন ‘ কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।’ হঠাৎই মাটিতে ছাতার পাখিদের কিচির মিচির শুনছি শুকনো পাতার ওপর , যেন ঝরা পাতার নুপুরের নিক্কন! এই ভালবাসার মাসে সবই সোহাগ মাখা ভালবাসায় মোড়া। সোনালি রোদেলা দিনে গাছে গাছে সবুজ কচিপাতার ঝিকিমিকি সব মিলে বসন্তের এই রঙিন মুহূর্ত গুলি কচি থেকে পাকা সব মনেই দোলা দেয়। ফুলে ফুলে রঙীন হয়ে ওঠে পৃথিবীর সব কোণ। ফুলের সুগন্ধে আমোদিত প্রাণ গুলি কেমন আনন্দে মাতোয়ারা। টিয়াপাখির ঝাঁক পলাশ গাছে খাবার খুঁজছে। লেজ ছড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে বুলবুলির নাচন যেন অশ্রুত সেই তালে বাজে। দিকে দিকে উৎসবরাজ বসন্তের আগমন বার্তা — এভাবেই ঘোষিত হোক জনে জনে।
বসন্ত গল্প
বসন্ত-রাগ
সুব্রত দত্ত
কলেজ জীবন বছর পেরিয়ে গেল পাপড়ির। তবুও আবীরকে দেখলে কেমন যেন হয়ে যায়। দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তাকাতে লজ্জ্বা করে। একসঙ্গে ছেলেমেয়েদের আড্ডা হয়। কিন্তু সেখানে আবীর থাকলে পাপড়ি সিঁটিয়ে থাকে। আবীর চলে গেলে পাপড়ির মুখে বুলি ফোটে। এই নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। মধুশ্রী একদিন বলে,
--- "আবীরকে তুই অ্যাভয়েড করিস কেন? খারাপ কিছু করেছে?"
পাপড়ি জিভ কেটে বলে,
--- "না না, তা কেন? কিছু করে নি তো?"
দেবিকা হেসে বলে,
--- "ও কলেজের কত মেয়ের ক্রাশ জানিস? জিনিয়াস ছেলে একটা। আমি হ্যাংলার মত লেগে রয়েছি, তবুও পাত্তা দেয় না।"
পাপড়ি দায়সারা ভাবে "হুঁ, চলি রে" বলে উঠে যায়।
রোজ আবীরকে দেখলেই পাপড়ির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, আর চোখ নামিয়ে নেয়। এভাবেই কেটে যায় কিছু দিন।
পরের দিন দোলের জন্য কলেজ ছুটি। তাই আগের দিনেই হোলি উৎসব শুরু হয়ে যায় কলেজে। পাপড়ি কলেজের গেটের ভেতরে যেতেই সামনে এসে দাঁড়ায় আবীর। পাপড়ি কি করবে তা ভেবে উঠতে পারে না। শুধু বলে,
--- "কি হলো?"
আবীর বলে,
--- "দেবো?"
পাপড়ির অজানা আতঙ্কে তাকিয়ে বলে,
--- "কি"?
-- "শুধু কপালে একটা টিপ দিতে পারি?"
চমকে ডাগর দু'টি চোখ নামিয়ে নেয় পাপড়ি। পড়ন্ত শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে। সে যেন অথৈ জলে পড়েছে! থার্মোমিটারে মাপলে নির্ঘাত জ্বর উঠবে 105 ডিগ্রি!
--- "কি হল, উত্তর নেই যে?"
আবিরের প্রশ্নে পাপড়ি মাথা নীচু করেই থাকে। তার ঠোঁট দু'টো কেঁপে ওঠে শুধু।
--- "ও, ইচ্ছে নেই তাহলে! ঠিক আছে, যাও। আমি জোর করবো না।" মনক্ষুণ্ণ হয়ে আবীর বলে।
--- "না!" পাপড়ি আঁতকে উঠে বলে, "তা নয়! ঠি-ঠিক আছে। দা - দিন।"
আবীর জোরে হেসে বলে,
--- "দিন আবার কি? দাও বলতে পারো না?
--- "না, মানে - হ্যাঁ" মাথা নেড়ে বলে পাপড়ি।
আবীর তার নতুন প্যাকেট খুলে লাল আবীরের টিপ পরিয়ে দেয় পাপড়ির কপালে। পাপড়ি চোখ বন্ধ করে এক অচেনা শিহরণ অনুভব করে। আচমকা বহুকাঙ্খিত এক মনের মানুষের স্পর্শ! আবেশ জড়ানো কন্ঠে বলে, "হয়েছে?"
--- "না, হয় নি।"
পাপড়ি বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে,
--- "তার মানে? আবার কি?"
আবীর তার মুখটা পাপড়ির মুখের সামনে নামিয়ে এনে বলে,
--- "তুমি দেবে না আমায়?"
--- "আ-আমি যে আনি নি!"
--- "কি আনো নি?"
--- "আবীর!" বলেই পাপড়ি জিভ কাটে। এবার মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কানে শোঁ শোঁ শব্দ শুধু শোনে সে।
--- "এই যে, আবীর!"
পাপড়ি দেখে, তার দিকে এগিয়ে দেয়া আবীরের হাতে সদ্য খোলা আবীরের প্যাকেট। পাপড়ি মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই প্যাকেটের দিকে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়। কিছুটা আবীর নিয়ে মাখিয়ে দেয় আলতো করে আবীরের কপালে, গালে। পাপড়ি রীতিমত কাঁপছে। এই প্রথম কোনও পুরুষকে স্পর্শের অনুভূতি পেলো সে। পুলকে যেন এক পরম সুখের শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। আর আবীর পাপড়ির নরম হাতের ছোঁয়ায় বিবশ হয়ে বলে,
--- "এবার তো চোখ খোলো।"
আবীরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে পাপড়ি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সরাসরি আবীরের চোখে। কিছু একটা বলতে যেতেই, হাততালি আর কলরবে হতচকিত হয়ে ওরা দেখে, সব বন্ধু বান্ধবীরা ওদের ঘিরে রয়েছে। সারাটা দিন বেশ আনন্দেই কাটে। বসন্তোৎসবের প্রাক মুহূর্তে প্রথম স্পর্শে ওদের দু'জনের জীবনের প্রথম বসন্তের রঙে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে।
বসন্ত প্রেম
প্রদীপ কুমার দে
বসন্ত কাল। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। প্রকাশ আজ বড়ই প্রেম রোগে আক্রান্ত। বন্ধু তমালকে ধরলো।
বন্ধু তমাল সুযোগ করে দিল। রিমির সঙ্গে প্রকাশের মুলাকাত হয়ে গেল।
প্রেমের প্রথম পাঠে লাজুকতা,পরে মাদকতায় পরিণত হতে চলল।
রিমি যেন লাজহীনা।চোখ বড় বড় করে বললো - " ও রকম করে দেখা তোমাদের ছেলেদের স্বভাব। সোজা করে বলতে সাহস হয় না? "
প্রকাশ খানিকটা অপ্রস্তুত, সে বললো -" আমি দেখছিলাম? আপনি দেখেছিলেন তাই না বুঝলেন?
" আমি? " টলটলে বড় বড় চোখ দুটো যেন গিলে খেতে এল।
প্রকাশ ভয় পেয়ে গেল। হারাবার ভয়।
যদি রেগে চলে যায়।
হাসার ভান করে বললো -" যাক ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম।"
প্রকাশ জানতো না ম্যাডাম যখন ধরেছেন তখন পৃথিবীর কোন দেবতার ক্ষমতা নেই তাকে ছাড়াবার।
বহুদিন লুকোচুরি। তারপর তমালের মাধ্যমে কথা আদান প্রদান চলতে থাকল ওদের মধ্যে।
প্রকাশ শান্ত। রিমি উগ্র।
প্রকাশ রিমির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে।
যখনই ডাকে তখনই দৌড়ায়।
প্রকাশ বলে -" তমাল বললো তুমি ডেকেছো।"
রিমি -" কচি খোকা! নিজে থেকে আসতে পারো না?"
প্রকাশ কাঁচুমাচু মুখে -" প্রথমে কলেজ, তারপর বাড়ির কাজ।"
রিমি রেগে বলে" প্রেম ট্রেম তোমার দ্বারা হবে না।তাহলে আমাকে ফাঁসালে কেন?"
সত্যি প্রকাশ যে রিমিকে মনের মধ্যে ধরে রেখেছে, এখন বাজে কথা বলে কি হবে?
প্রকাশ রিমিকে ফাঁসিয়েছে নাকি রিমি প্রকাশকে ফাঁসিয়েছে ? এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলতেই পারে, কিন্তু প্রেম চললো তারই নিয়মে, তারই পরিণতিতে।
প্রকাশ এখন ঘন ঘন প্রোগ্রাম করে। মাঠে ঘাঠে আনাচে কানাচে। সাঁত্রাগাছিতে ঝিলের ধারে। রিমির একটা তেজ আছে যা প্রকাশ কে উষ্ণ করে। রিমির তেজে প্রকাশ শক্তিমান হয়ে উঠতে চায়।
বসন্ত এসে গেছে। প্রেম তার মধুরতা মাখিয়ে এই দুইজনাকে একেবারে সত্যিই কাবু করে দিল।
হ্যাপি হোলি
রীতা মোদক
সারারাত দুচোখের পাতা
এক করতে পারলো না অমিতা।শুধু মনে পড়ছে দু - বছর আগের দুঃস্বপ্নের কথা।সালটা ২০১৫ ।
দোল পূর্ণিমার দিন সকাল সকাল স্নান সেরে একটা আবীর রঙা শাড়ী পরে অমিতা ঠাকুর ঘরে ঢুকে
যায়। তার স্বামী অমিতকে বলতে গিয়েও থেমে যায়, অমিতের এসবের প্রতি এখন আর কোনো উৎসাহ
নেই। তাই তাড়াতাড়ি পুজো দিয়ে ঠাকুরকে আবীর দিয়ে শ্বাশুড়ীকে ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে
মদনমোহন মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করে। মদনমোহন এর চরণে আবীর ছুয়ে একটু
আবীর নিয়ে আসে অমিতের জন্য। আসার সময় শিবরাত্রি মেলায় ঢুকে ছেলের জন্য একটা
খেলনা বন্দুক ও একটু বেশি করে জিলিপি নিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে দেখে অমিত খাওয়া সেরে বিছানায়
শুয়ে টিভি দেখছে।এক চিমটে আবীর কপালে ছোঁয়াতে
গেলে অমিত চিৎকার করে বলে -- "রাখো তো এসব।আমি চান - টান কিছু করিনি , কালকে দিও
আবীর।"
মুহূর্তে আমিতার মনটা খারাপ হয়ে
গেলেও প্রকাশ করে না। আবীরের ব্যাগটা ঘরের একটা কোনে রেখে দেয়।রাতে ঘুমানোর সময় যখন ঠিক বারোটা বাজলো অমিতের কানের কাছে ফিস ফিস
করে বলে -- "হ্যাপি হোলি।কাল কিন্তু আমরা বাইকে করে ঘুরে ঘুরে রঙ খেলবো।"
অমিত নিরুত্তর।
--কি ব্যাপার কিছু বলছো না যে?
-- কাল তোমরা রঙ খেলো, আমি খেলা
দেখবো।
অমিতা অবাক হয়, শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে-- মানুষটার মনে কি কোনো রসকস নেই?
অথচ এই মানুষটাকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল?
মনে পরে বিয়ের আগের কথা -- বিয়ের আগে এক সন্ধ্যায় অমিত অমিতার সিঁথিতে এক চিমটে
আবীর দিয়ে বলেছিল -- "হ্যাপি হোলি।
" অমিতা লজ্জায় দৌড়ে পালিয়ে ছিল।কিন্তু আয়নার দিকে তাকাতে সে আবীর কপাল জুড়ে
সিঁদুরের মত জ্বলজ্বল করছিল। সে আবীরের ছোঁয়া যেন অমিতার মনে ঢেউ তুলে দিয়ে ছিল।আজ সেই প্রেমিক
অমিত কোথায় হারিয়ে গেলো?
যাই হোক অমিতা ভাবে কাল সে রঙ মখাবেই।তার মুখমণ্ডলে ও সারা শরীরে গারো নীল
আবীর দিয়ে সাজাতে হবে। কপালে দিতে হবে গোলাপী আবীরের টিকা।কাল অমিতকে সে কৃষ্ণ সাজাবে
আর নিজে রাধা। সকালে সবাই হাত মুখ ধুয়ে আসলে অমিতা সবার জন্য কফি নিয়ে আসে।
শ্বাশুড়ি জিজ্ঞেস করে -- "বৌমা প্রতিদিন ত লাল চা খাওয়াও , আজ কফি কেন? " অমিতা উত্তর দেয় -- "আরে
এটা আজকের স্পেশাল।"
সবাইকে কফি দিয়ে অমিতা নিজের কাপটা এগিয়ে নেয় মুখের দিকে, তখন অমিতের বৌদি পলি আসে পাশের বাড়ি থেকে –
--- কিগো তোমরা কি করছো?
অমিতের মা বলে -- "বৌমা, পলিকে এক কাপ কফি দাও ,আর কালকের জিলিপি আছে না ?পলির হাতে দুটো দাওতো।
"
অমিতা অগত্যা নিজের কাপটা পলি বৌদির
হাতে দিয়ে জিলিপি আনতে ঘরে যায়,ঠিক সে মুহর্তে অমিত ঠাকুর ঘরে গিয়ে আবীর ও একটু
খৈনি রঙ জলে গুলে পিছন দিক থেকে পলি বৌদির মুখে দিয়ে দেয়। পলি বৌদি চিৎকার করতে থাকে "আরে ছাড়ো, ছাড়ো... কি করছো "
এ দৃশ্য দেখে অমিতা খুব কষ্ট পায়। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার
চেষ্টা করে। খানিক বাদেই পলি বৌদি রঙ এনে অমিতের গালে লাগাতেই অমিতা আর থাকতে পারলো না। তার প্রিয়তম মানুষটিকে
কৃষ্ণ সাজানোর স্বপ্ন ,নিজে অমিতের হাত থেকে প্রথম রঙ নিয়ে রাধা সাজার স্বপ্ন ভেঙ্গে মুহূর্তে খান খান হয়ে গেলো! অমিতা কতক্ষণ থ হয়ে থেকে ভাবলো
এ জীবন রেখে আর কি লাভ? সে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে পরে গেলো মেঝেতে।সবাই কি হলো,
কি হলো বলে দৌড়ে এলো। চোখে জলের ঝাপটা দিতেই
আমিতার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরতেই অমিতার কানে আসে , শ্বাশুড়ি বলছে -- "একটুখানি রঙ দিছে বলে
কি দোষ হইয়া গেছে নাকি? একেবারে মাথা ফাটাইতে লাগব? এই বউ নিয়া আমি সংসার করতে পারবো
না।আমাদের তো জেলের ভাত খাইতে হইব। এই অমিত এই বউ
বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দিবি, না কি করবি
তুই কর।এই বউ এই বাড়িতে থাকলে আমি থাকবো না। হয় বউ থাকবে , না হয় আমি থাকবো।"
অমিত তখন রাগে গজ গজ করতে করতে বাইক নিয়ে বের হয়ে গেলো। অমিতা র দিকে ফিরেও তাকাল না।এদিকে আমিতার মাথা
কপাল চোখ ফুলে উঠেছে। ব্যথায় ছটফট করছে বিছানায়। হসপিটালে নেওয়ার নাম নেই কারো।
অমিতা প্রতি বছর তার বরকে নিয়ে
্যায় বাবা – মাকে আবীর ছুঁয়ে প্রনাম করতে ।এবছর
দেরি হচ্ছে বলে আমিতার মা বার বার ফোন করে ও কোনো উত্তর পায় না।পরে বাধ্য হয়ে নিজেই
চলে আসে অমিতার বাড়ি। এসে অমিতার এই অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তার মা।মাকে পেয়ে
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে অমিতা মনে মনে মৃত্যুকে ডাকে। যেখানে ভালোবাসা
নেই, দয়া মায়া নেই, সেখানে বেঁচে থেকে কি লাভ? এ কোন অমিত ,তাকে কি সে ভালোবেসেছিল?
আমিতার মনে পরে -- বিয়ের দুবছর আগে অমিতার পায়ে একবার একটা বিড়াল খামছে দিয়েছিল
, সে খবর শোনা মাত্রই অমিত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।বিড়াল
এর দিকে সেদিন অমিতের কি রাগ , মনে হয় বিড়ালটিকে মেরেই ফেলবে। কোথায় হারিয়ে গেলো তার সেই অমিত ?
অমিতার মা পরম সোহাগে মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে চলে হসপিটালে।এসব
দেখে অমিতের ভাসুর সুদীপ যায় পিছু পিছু। ডাক্তার অমিতাকে দেখে পিছিয়ে যায়
--" দেখে মনে হচ্ছে এটা মারামারি কেস ,
কি করে এসব হল ? পুলিশ ডাকতে হবে । "
অমিতার মা কিছু বলতে যাবে , এমন সময় অমিতা অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বলছে --" ডাক্তার বাবু কারো কোনো দোষ নেই , আমি
তাড়াহুড়ো করে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের মুখটা আমার মাথায় লেগে গেলো । " তখন ডাক্তার অমিতাকে ভালো করে দেখে সিটি স্ক্যান করতে বলেন ও কিছু অসুধ লিখে দিলেন । পরদিন সকালে অমিতার মা সুদিপকে সাথে নিয়ে কুচবিহার
যায় সিটি স্ক্যান করতে। অমিতা মনে মনে খুব কষ্ট পায় অমিতের জন্যে।
যার সঙ্গে ১০ বছর প্রেম করছিল তার এমন পরিবর্তন যে সহ্য করা যায় না। কুচবিহার এ সিটি
স্কেণ করে আমিতার মা অমিতা কে নিয়ে বাড়ি
চলে যায়।ডাক্তার বলেছে কদিন একদম রেস্টে থাকতে
হবে। নিজের বাড়ি এসে মায়ের আদর যত্নে অমিতা সেরে উঠতে থাকে।কিন্তু গভীর রাত এলে অমিতা
র চোখ জলে ভরে যায়। এত কিছু ঘটার পরেও অমিতকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পাষাণ
অমিত একটা ফোন ও করে খবর না।তাই অমিতা সিদ্ধান্ত
নেয় সে আর শ্বশুর বাড়ি যাবে না।কিছু দিন পরে অমিতা অফিস জয়েন করে।একদিন সকালে অমিতা
আফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে,এ সময় অমিত এসে হাজির।বলছে --- বাড়ি চলো। অমিতা চুপচাপ।
না শুনার ভান করে তৈরি হচ্ছে।আবার অমিত রেগে
গিয়ে -- তুমি এখুনি বাড়ি চলো, নইলে ছেলেকে দাও।অমিতা ভাবে , অমিত কি আজ তার জন্য
এসেছে নাকি শুধুমাত্র ছেলের টানে? অমিত অমিতা ও ছেলেকে জোর করে নিয়ে চলে গেলো।সেখানে
গিয়ে অমিত অমিতা র কাছে ক্ষমা চায়। ভালোবাসা দেখায় আগের মত।অমিতা নাছোড়বান্দা,ক্ষমা
করবে না কিছুতেই। কিন্তু গভীর রাতে যখন অমিতা র পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চায়,তখন
অমিতা অমিতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।অমিতের আদরে ভুলতে চেষ্টা করে সব ব্যাথা।তার
শ্বাশুড়ি ও এখন ভালো ব্যবহার করে।
এভাবেই কেটে যায় আরো চার বছর
। প্রতিবার হোলি আসলে দুজন দুজনকে আবীর দেয়। কিন্তু সে আবীরে আগের মত আর ভালোবাসার
উচ্ছ্বাস আসে না। আবার দোল পূর্ণিমা চলে এলো।মদন মোহন বাড়ি থেকে শুরু করে সারা মাথাভাঙ্গা
শহর জুড়ে দোল উৎসব পালিত হবে। মেয়ে বউরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে দোল উৎসবের আনন্দে
মেতে উঠবে। এবার অমিতা কে দোল উৎসবে যোগ দেবার জন্য মদন মোহন বাড়ি কমিটি থেকে অনুরোধ
করেছে। অমিতা এখনো তার আগের অমিতকে খুঁজে চলে।সে বার বার অনুভব করে কিশোরী বয়সে প্রথম আবীরের ছোয়া। তখন থেকেই সে তার
অমিতকে মনে মনে স্বামী বলে ধরে নিয়েছিল। আজ তাদের বিবাহিত জীবনের অনেক বছর পেরিয়ে
গেছে।কিন্তু পুরনো ব্যথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে কখন সে ভোর হয়ে গেছে
অমিতা বুঝতেই পারেনি। হুশ ফিরলো অমিতের ছোঁয়া পেয়ে। অমিত এক চিমটে আবীর অমিতার কপালে,
গালে মাখিয়ে দেয়।অমিতা অবাক হয়ে বলে --
“আরে কি করছো? এখনো ঠাকুরকে আবীর দেইনি”।
অমিত অমিতার চোখের জল মুছে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ,-- “আমি
যে আমার রাধাকে আবীর দিচ্ছি।তুমি তোমার কৃষ্ণকে সাজিয়ে দেবে না? “ অমিতার মনে
জেগে উঠে বসন্তের প্রেম। সে ও তার প্রিয়তমকে সাজায় সাত রঙা আবীরে।অমিত অমিতা কে জড়িয়ে
ধরে বলে -- "হ্যাপি হোলি।"
বসন্তের বিশেষ প্রবন্ধ
অমর একুশে ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালীর বাংলা ভাষা দুর্জয় দিন
বটু কৃষ্ণ হালদার
২১ শে ফেব্রুয়ারি এলেই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সেই মর্মস্পর্শী গানের কথা মনে পড়ে যায়:_
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি"।শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।
‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এদেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান।
সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস জানে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটি দেশের জন্ম হয়েছিল তার নাম বাংলাদেশ। আর ভাষাটির নাম হল সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা।আর সেই বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানি হায়নাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাটার নাম ছিল উর্দু।জাত ধর্ম নির্বিশেষে আপামর বাঙালি জনসাধারণ পাকিস্তানীদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উর্দুভাষা মেনে নেয়নি। যার ফলে ভাষা আন্দোলন তৎকালীন সময় অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ব্যাপক রূপ ধারণ করে।দাবালনের আগুনের ফুলকির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আন্দোলন রুখতে তৎপর হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। কিন্তু বাঙালির প্রাণের বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে পারেনি তাদের মুখ ও মন থেকে।
কি ছিল সেই ইতিহাস তা একটু জেনে নেওয়া দরকার।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার, সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক,সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহআরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর।২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলা ভাষা আন্দোলন,মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।
এবার আসা যাক আসামের শিলচরে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে।এখানের ইতিহাস বলছে বহু যুগ ধরে বসবাস কারী বাংলা ভাষা সংস্কৃতি বুকের মাঝে বাঁচিয়ে রেখে ছিল বরাক উপত্যকার বসবাসকারী বাঙালিরা।কিন্তু আসাম সরকার তাদের উপর জোর করে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দিচ্ছিলেন।কিন্তু আপামর বাঙালিরা অসমিয়া ভাষা মেনে নেয় নি।কারণ রক্তে মিশে আছে বাংলা ভাষা,সংস্কৃতির মূলমন্ত্র।শুরু হয় আন্দোলন।১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। আসাম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল।১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন'জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের ফেলে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও জনগণের তৎপরতার সাথে সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারি বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়।অনেক লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন'জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু'জন পরদিন শহিদ হন। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহিদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল মানভূমের ভাষা আন্দোলন।
ইতিমধ্যে বিশ্বের সবথেকে সুন্দর ও সুমধুর ভাষার তকমা জুটেছে বাংলাভাষার কপালে। ইউনেস্কোতে নিজের জায়গা পাকা করেছে বাঙালির হৃদয়ের ভাষা।কিন্তু বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গভীর ভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যায় এই ভাষা বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে বেশি অসহায় আর বিপন্ন।তার কারণ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষার ক্ষেত্রে অসহায় ও বিপন্ন হয়ে আন্দোলন হয়েছে কি? মুখের ভাষা মনের ভাষা সাহিত্যের ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে কোন রক্তপাত ঘটেছে?
বর্তমান সময়ে এসেও এই বাংলায় জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি ভাষা।কিন্তু ভারত কোন নির্দিষ্ট ভাষার দেশ নয়।এই দেশ তো ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ধর্মের মহা মিলন ক্ষেত্র তা ভুলে গেলে চলবে না।হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের পর এই বাংলায় উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চলছে।সস্তা মিডিয়ার যুগে একটা ভিডিও সবার মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে তা হোল কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে দেখা যাচ্ছে তাতে তিনি প্রকাশ্যে বলছে ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে এই বাংলার অর্ধেক মানুষ উর্দু বলবে।মেয়র সাংবিধানিক পদ এবং অবশ্যই নিরপেক্ষ,সেই পদে বসে এভাবে বিতর্কিত বক্তৃতা দেওয়া যায় কি? তবে এই প্রথম নয় এর আগেও তিনি কলকাতাকে মিনি পাকিস্তান বানানোর সম্পূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন। একথা বোধহয় আজ কারো অজানা নয়।
এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধীনস্থ হয়ে নেতাজি সুভাষ,চিত্ত রঞ্জন দাস মহাশয় রা এই ধরণের বিভাজন কখনো করেছে বলে শোনা যায় নি।আসলে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেলে এ ভাবেই ক্ষমতার অপব্যবহার বর্তমানে নতুন কিছু নয়।বর্তমান রাজনীতিতে এটা প্রচলিত আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই বাংলায় ভাষার সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ কিন্তু ঘর শত্রু বিভীষণরা। পশ্চিমবাংলার ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে যুগ যুগ ধরে বসবাস করার ফলেও নিজেরা সেই সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে বহিরাগত অপসংস্কৃতির ঢেউ যেমন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, অপরদিকে বহিরাগত অপসংস্কৃতি মনস্কদের প্রশ্রয় দিয়ে বাংলায় লালন পালন করা হচ্ছে।
তবে মনে রাখতে হবে একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান স্বৈরাচারী শাসকদের ভাষা নীতির প্রতিবাদে বাংলা ভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠাতায় শহীদ হয়ে তরুণ ভাষা সৈনিকরা যে ইতিহাস রচনা করেছিল সেই গৌরব গাঁথা সাহস যুগিয়েছিল ৬১'র ভাষা আন্দোলনকে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেরণা শুধুমাত্র ওপার বাংলার বাংলা ভাষা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে তা নয় যখনই বাংলা ভাষা মুখের থেকে কেড়ে নেওয়ার প্রয়াস হয়েছে বাংলা ভাষা অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে তখনই একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে নয় অতীতে এবং আগামী ভবিষ্যতেও বাঙ্গালীদের ভাষা সংস্কৃতি উপর কারো দখলদারি বাঙালি সমাজ মেনে নেবে না। যদি দরকার হয় তার জন্য আরও একটা ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলবেই নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে। বাংলা উন্মুক্ত ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বর্তমানে আছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও থাকবে।এখানে হিন্দি উর্দুর প্রভাব কোনমতেই মেনে নেবে না।
বসন্ত পাঠ
মনের জানালা: অভিজিৎ তরফদার
আলোচনা - অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
কনকনে শীতের এক সন্ধেবেলায় বইমেলার মাঠে ছড়ানো ছিটোনো বইয়ের স্টলগুলিতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ও নানান ধরণের বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখতে দেখতে বিভা পাবলিকেশনের স্টলে হঠাৎই হাতে উঠে এসেছিল 'মনের জানালা' বইটি। পরবর্তী দুচারটে শীতের রাত যার হাত ধরে এক অপার ভালোলাগার উষ্ণতাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে পৌঁছে দিয়েছিল নিজের মনের জানলায়।এখন ফাল্গুন। ভালোবাসার সুরের মূর্ছনা আকাশে, বাতাসে, বৃক্ষরাজির শাখা প্রশাখায়, রঙিন মনগুলি জুড়ে এদিকে সেদিকে।এ হেন ভালোবাসার এই বসন্ত ঋতুতে বইটির নানান স্বাদের ভালোবাসার রঙে রাঙানো টুকরো টুকরো কিছু ছবি ও গল্পটির নায়িকার জীবনে হঠাৎ বসন্তের কানাকানি এই বইটি নিয়ে দুকথা বলবার হাতছানি দিয়ে গেল।বইটি সংগ্রহ করবার দিনটিতে মলাট উল্টে নিয়ে দেখা লেখার মূল বিষয়টি ও শেষ মলাটের লেখক পরিচিতি আগ্রহ তৈরি করেছিল বইটি পড়ে দেখবার। সুপরিচিত গল্পকার অভিজিৎ তরফদার তাঁর নানান রঙে আঁকা মোট আঠেরোটি ছোট ছোট পর্বের ছবিতে এক গৃহবধূর জীবনের ফিরে দেখা, তার উপলব্ধি, অনুভূতি,সংসার যাপন,বাৎসল্য ,তার চারপাশের ঘটমান জীবন, আকস্মিক কোনো অভিজ্ঞতা, ভালোবাসা সবটাই এঁকেছেন নিখুঁত মুন্সিয়ানায়। গল্পটির নায়িকা তুলিকা অকপটে এই বইটিতে নিজেই নিজের কথা বলে চলে লেখকের ঝরঝরে, প্রাণবন্ত কলমে।তুলিকা চরিত্রটির সুন্দর,স্বচ্ছ,সংস্কারমুক্ত মন, মুখোশবিহীন মুখ ও স্পষ্টবাদিতা তার বাড়ি, বন্ধু -বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের মতো পাঠকদের মনেও তাকে অচিরেই 'তুলি' এই ডাকনামে জায়গা করে দিতে বাধ্য।বইটির সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো এর উপস্থাপনের ভঙ্গিটি।ছোট ছোট সাধারণ ঘটনাগুলি লেখকের কলমে অত্যন্ত মজাদার করে, সরস ভাবে পরিবেশিত হয়েছে যা গুরুগম্ভীর পাঠকের মুখেও হাসির ঝলক দিয়ে যাবেই।অথচ এটি আদৌ কোনো হাসির গল্প নয়। বরং জীবন থেকে উঠে আসা আমাদের খুব চেনা, খুব জানা আজকের দিনের 'ঘর ঘর কি কাহানি' বা আজকের সামাজিক পরিকাঠামো, আজকের প্রজন্মের কিছু ঝলক,রাজনৈতিক দুর্নীতি, ফিরে দেখা অতীতের কিছু জলছবি বা কিছু চেনা চরিত্রের গল্পগাথা,গহীন এক ভালোবাসা যার মধ্যে গভীর এক মনকেমনও ছায়া ফেলে যায়।
তুলির প্রগাঢ় মিষ্টিপ্রিয়তা, ফোনে আশ্চর্য ভাবে হাসির রেশ রেখে কথা বলা তার বন্ধু অদিতি, নিজের কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে দেওয়া উপহার হাত ঘুরে ঘুরে আবার এক বান্ধবীর হাত ধরে তুলিকার ঘরেই ফিরে আসা,ওভার ওয়েট মেয়ে রিমের স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়ার বদলে উল্টোপাল্টা খাবার বেশি করে খাওয়ার প্রবণতাকে ঘিরে তুলির প্রতিক্রিয়া,ঘরে ঘরে টিভি সিরিয়াল দেখবার ঝোঁক,পাগলাটে কিন্তু তুখোড় এক ডাক্তারের চেম্বার, আজকের দিনের অনন্ত সেলফির হুজুগ,অন্ধ কুসংস্কারে জ্যোতিষীর পেছনে ছোটা এই বিষয়গুলি মুখোরোচক হাস্যরসের পরিবেশনে যেমন সুস্বাদু তেমনিই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আবার ছেলে ঝিমের প্রতি ভালোবাসা, রিমের স্বভাবের পরিবর্তন,স্থিতধী স্বামী,সংসারে আপনজনেদের ছোটোখাটো চাহিদাগুলিকে নজরে রেখে তাদের হাসিমুখ দেখে তুলির ছোট ছোট খুশি, কাজে সাহায্যকারী স্বপ্নার অল্পে তুষ্ট সুখী সংসারের ছবি, আদরের ইমলির তুলিমা হয়ে ওঠা, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাবের এক বান্ধবীর স্বভাব ও যাপনের বৈপরীত্যকে ছুঁয়ে তুলির ভাবনার জগতে তোলপাড়,ঋদ্ধির খোলামেলা সুন্দর আকর্ষণীয় চরিত্রটিকে ঘিরে তুলির মনের জানলায় অচেনা ফুলের গন্ধ বইটির গভীরতার দিকটিকে উন্মোচন করে। তুলির শান্ত স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব ও কথা বলার মাদকতা ছুঁয়ে থাকতে বাধ্য পাঠকের মনের জানালা জুড়ে।সুপটু ভাবে লেখক ঘটনাক্রমকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পাঠকের ভালো লাগার জায়গায়।
মনের জানালা অত্যন্ত রুচিশীল, বাস্তবনির্ভর, সমকালীন,প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক চিন্তাধারার একটি বই। লেখক এই গল্পে তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি চরিত্রকে কলমের আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছেন।এক নিঃশ্বাসে পড়ে যেতে হয় এমন এক ভালোলাগাকে। পড়বার মাঝে মাঝের বিরতিগুলি অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে মনের জানলার সার্সিতে বসে তুলিকার গল্প শোনার। তুলিকার জীবনের দর্শক, শ্রোতা তো পাঠকেরাই। ঋদ্ধি নামে এক ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে যেতে যেতে ফল্গুধারার মতো তিরতিরে অচেনা এক ভালোবাসার স্রোতকে উপলব্ধি করে, মনের গহীনে তার প্রতি ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েও এতদিনের সঙ্গী নিজের স্বামীর কাছে তুলিকার এই অনুভূতিকে উন্মুক্ত করবার দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত গল্পটিতে নতুন এক মাত্রা যোগ করে। একদিকে নিজের হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা নিজের সংসার, যার আনাচেকানাচে তার নিজের ছোঁয়া, নিজের স্বামী.. যাকে মনের সমস্ত বন্ধ কুঠুরি খুলে দিয়ে সে অর্থে হয়তো ভালোবাসতে পারেনি কিন্তু মায়া আছে একরাশ,প্রাণের চেয়ে প্রিয় দুই ছেলে মেয়ে আর একদিকে নিজের মনের অচেনা এক ভালোবাসার গহীন ঝিল জুড়ে খোলা হাওয়ায় ঋদ্ধি নামে এক পালতোলা নৌকোর ছবি। ঠিক এমন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজের স্বামীর কাছে নিজের অনুভূতির উন্মোচনের প্রস্তুতি নেওয়া তুলিকার মতো একটি বলিষ্ঠ চরিত্রের পক্ষেই সম্ভব।এই পদক্ষেপে পাঠকদের সহযোগিতা চেয়ে নিয়েছে গল্পের নায়িকা।সমকালীন হয়েও তাই এই লেখা মূল্যবোধকে হারায়নি। শেষ হয়েও রেশ রেখে গেছে অনেকখানি।
অভিজিৎ তরফদারের প্রথম উপন্যাস 'মহাজাগতিক' যেটি পরবর্তীতে ' স্পন্দন' নামে জনপ্রিয় এক টেলিভিশন ধারাবাহিক হিসেবে দেখানো হতো।অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই ধারাবাহিকটি।'মনের জানালা '- ও অগণিত পাঠকমনে জায়গা করে নিক নিজের।শতাধিক ছোট গল্প ও প্রায় কুড়িটি উপন্যাসের রচয়িতা এই লেখকের আশ্চর্য সুন্দর এক রচনা 'মনের জানালা' নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতাটুকু শুধুমাত্র পড়বার আনন্দে ও এই ভালোলাগা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে অন্যদেরও বইটির স্বাদ নিতে আগ্রহী করতে।যা কিছু ভালো তা সকলে মিলে উপলব্ধি করলে, পড়লে আনন্দ অনেকগুণ বেশি হয়,মনের সিন্দুকে সঞ্চয় হয় আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার অফুরান এক ভালোলাগা।
কৃষ্ণেন্দু মন্ডলের আঁকা সুন্দর রঙিন প্রচ্ছদে,উন্নত মানের পৃষ্ঠায়,নির্ভুল ছাপার অক্ষরে এবারের কলকাতা বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত এই বইটি নিঃসন্দেহে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
প্রকাশক বিভা পাবলিকেশনের এই বইটির মূল্য -১৯৯ টাকা।
বসন্ত স্মরণ
স্মরণ পঙ্কজ উদাস
মিষ্টু সরকার
যদি আরেকটু সময় পেতাম !
কথা রাখবার ,পাশে থাকবার,
কারণে-অকারণে নামধরে কাছে ডাকবার...
আরেকটু রঙে যে, হৃদয় - রাঙিয়ে যেতাম ।।
( ভালোবাসা)
এ আফসোস তো শিল্পী মনে থাকে বলেই তিনি শিল্পী ।
সেই আশা নিয়েই বাহাত্তরে পাড়ি দিলেন গজল সম্রাট পঙ্কজ উধাস জি। রয়ে গেল তার সুরের রেশ, তার চিঠির ভাষায়। এই একটি মাত্র চিঠিতে তিনি আপামর জনতার মনে নির্দিষ্ট জায়গা করে নিয়েছেন। সব ভেসে গেলেও এ চিঠি সুর হয়ে মানুষের মনের মনিকোঠায় এক নির্ভরযোগ্য আস্তানা গড়ে নিয়েছে।
সংগীত মানব জাতির সর্বজনীন ভাষা । Music is the universal language of soul & the best medicine of mind. মাত্র এগারো বছর বয়সে স্টেজে শিশু শিল্পী হিসেবে *এ্যয় মেরে ওয়াতন কে লোগো* গেয়ে সবার চোখে জল এনে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই তাঁর গানে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
আশির দশকের সঙ্গীত জীবনের প্রায় শুরুর দিকে, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬, `নাম` ছায়াছবির মুক্তির সাথে সাথে `চিটঠি আয়ি হ্যায়` --- এই গানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায় , নিশ্চয়ই সেই সাথে শিল্পীও সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যান। বিবিসি রেডিও বিশ্বব্যাপী সহস্রাবদের ১০০ টি গানের একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এই গানটি। এই গানটি `নাম` ছায়াছবির সমস্ত কলাকুশলীদের, প্রযোজক , পরিচালক সবার জীবনেরই একটি মাইলস্টোন।
এই গানটি নিয়ে একটি সুন্দর গল্পও আছে। গানটিতে তিনি শুধুমাত্র সংগীতশিল্পী হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন । তিনি নিজের জেদে অনড় ছিলেন । ভাবতেই ভালো লাগে যে তিনি নিজেকে এবং নিজের অর্জিত শিল্প স্বত্বা কে, স্বল্প খ্যাতির বিনিময়ে বিকিয়ে দেননি।
তাকে রাজি করাতে মহেশ ভাটের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পরে তার দাদা স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী শ্রী মনোহর উধাস জি- র কথায় কোনোভাবে তাকে রাজি করানো হয়েছিল। আর ছবিতে তিনি জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই ধরা দেন, ছবির গানটিও তার ওপরই চিত্রায়িত হয়েছিলো । এই ব্যাপারটিও অনেকটা কাকতালীয়। পঙ্কজ'জি নিজের কথায় গানটি আগে কয়েকবার গাইলেও music director Lakshmi Kant এর কোথাও কিছু একটা missing মনে হচ্ছিলো । তিনি পঙ্কজ'জি কে জিজ্ঞেস করেন তিনি কিভাবে গাইতে স্বাছন্দ বোধ করেন ! উত্তরে তিনি জানান তিনি বসে নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তার বিভিন্ন কনসার্টে গান গেয়ে থাকেন । তারপর সমস্ত ব্যবস্থা হয় এবং একটি টেকেই তিনি সাত মিনিটের গানটি সম্পূর্ন শেষ করেন। গান শেষে লক্ষ্মী কান্ত জি ও রাজেন্দ্র কুমারের চোখে মুখে খুশির ঝলক।
রাজেন্দ্র কুমার জি , রাজ কাপুর সাহেব কে তার গান শোনালে তিনি কেঁদে ফেলেন। বলেন এমন গান তিনি বহুবছরে একবার শুনছেন। আবার সিনেমাটি রিলিজের আগে রাজ কাপুরের সাথে পঙ্কজ জি'র দেখাও হয়ে যায় হঠাৎই। পঙ্কজ'জি তাকে প্রণাম করেন এবং তিনি কিছু বোঝার আগেই রাজ কাপুর বলেন- "পঙ্কজ উধাস আমর হো গ্যয়া" ।
পঙ্কজ উধাস জি তার ইন্টারভিউতে বলেছেন এই একটি গান নিয়ে তার জীবনে যত গল্প আছে তা দিয়ে একটা পুরো বই লেখা যাবে । আমরা যাকে বলি ঈশ্বরীয় সংযোগ। এই গানটি স্বয়ং ঈশ্বর বরপ্রদত্ত যেনো।
খুব পরিচিত এই গানটির সুবাদে ছোটবেলাতেই ভাবতে বেশ ভালো লাগতো - সিনেমাতেও কিসুন্দর গায়ক গায়িকা-রা এসে গান গেয়ে যান। এসব ছেলেমানুষ ভাবুক মনের এলোমেলো সব ভাবনা।
Music has the power to heal সেই কারণেই হয়তো এই গানের কথা ও সুরের মিশেলে যে মর্মস্পর্শী ভাবনা জাল বুনেছে তার অমোঘ টানেই এই সাধারণীকরণ।
কতো শত সুন্দর বন্দিশ তাঁর সুরেলা কন্ঠের আধারে পেয়েছে ভাষা। সে ভাষার ঋণে আমরা বঙ্গবাসী আপ্লুত। তাই তো তাঁকে নিয়ে দু-কথা লেখার বাসনা। তিনিও তাঁর মিঠে বোলে অজস্র বাংলা গানের ডালি ভরে দিয়েছেন বাঙালির জন্য। কখন যে এক প্রাণের সুরে সুরে বাঁধা পড়েছি তার হদিস পাইনি।
প্রতিটি মানুষের কাছেই কিছু আসে কারো না কারো সূত্রে। আমার গজল ভালোবাসার সূত্রপাত আমার ছোটমামার হাত ধরে । কিছু মনে রয়েছে কিছু নেই। যা রয়েছে বারবার শুনতে চাই কোনো ভালোলাগার নিজস্ব সময়ে-
তেরি নিগাহ সে এয়সি শরাব পি ম্যায়নে
কে ফির হোশ কা দাওবা কিয়া কভি ম্যায়নে ।
বো অউর হোঙ্গে জিন্ হে মত আ গ্যায়ি হোগি
নিগাহে ইয়ার সে পায়ি হ্যায় জিন্দেগি ম্যায়নে ।।
--------এ্যায় গম্ এ জিন্দেগি কুছতো দে মশ্ বরা
এক তরফ উসকা ঘর
এক তরফ ম্যায় খ্ড়া ।।
এখন এমন অপূর্ব শব্দ-বন্ধ খুব একটা চোখে পড়েনা । প্রেম তো আলো, তার তো ছড়িয়ে পড়া ছাড়া নিস্তার নেই। তার গভীরতা , গোপনীয়তা মাপার চেষ্টা সে যুগে ছিলো। অদ্য প্রেমে ফোটেনা গদ্য। যাকগে আজ অন্য কথা বলার দিন। ফিরে যাই সেই আশি-নব্বই এর দশকে যেখানে আছে --
১/ দিল কি বাত হ্যায়
২/ মোহে আয়ি না জগ সে লাজ
৩/ চান্দি য্যায়সা রংগ্ হ্যায় তেরা
৪/ না কাজরে কি ধার, না মোতিও কি হার
৫/ ছুপ্ কে ছুপ্ কে সখিয়ো সে বোও
৬/ অউর আহিস্তা কিজিয়ে বাতে
এই সুন্দর music video গুলো আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার দিন গুলোর সাথী । একটা গল্প ও গানের মেলবন্ধন থাকতো এখানে ।
`চান্দি য্যায়সা রঙ` এবং `না কাজরে কি ধার`- তাঁর গাওয়া বহু শ্রুত দুটি গান । তিনি মজা করে বলতেন দাম্পত্য কলহ মেটাতে এই গান দুটির জুড়ে মেলা ভার ।
`চান্দি য্যায়সা রং হ্যায় তেরা` গানটি বহুল প্রচলিত দর্শকদের অনুরোধের তালিকায় থাকতো সেটি। যতদূর মনে পড়ছে এই গানটি ব্যবহার Himtaj Oil এর বিজ্ঞাপনে ও ব্যবহার করা হয়েছিলো। যদিও আমার স্মৃতিতে রয়েছে তবুও এর কোনো তথ্য প্রমাণ পাইনি।
বাংলা ছবির গানে ডালি -
১/ যদি আরেকটু সময় পেতাম
২/ কতো স্বপ্ন দেখেছি
৩/ বলো এ কেমন কথা
৪/ সে কেনো আমায় বুঝলো না ( বাপ্পী লাহিড়ী র সুরে, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় , *আমার তুমি* ছবির গানটিও সেই সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
এমন অনেক গানই আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা।
দুধ সাদা পাঞ্জাবিতে, আড়াআড়ি করে নেওয়া শালে, হারমোনিয়ামের অপূর্ব কারুকার্যে, সদা হাস্যময় মানুষটি বাঙালিয়ানার মূর্ত প্রতীক । শ্রদ্ধেয় শিল্পী আমরা আপনাকে ভুলবোনা কখনো।
হৃদয়ের মাঝে নীরব রবে জানি,
তোমার গানের সুরের চিঠিখানি ।
গাইলে গান সেই তো পরম লগ্ন !
একটি জীবন , ধন্য একটি জন্ম ।
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪৩০ (গদ্য পর্ব)
No comments:
Post a Comment