মুজনাই আজ বিশ্বের সব সহোদর ভাই ও বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। কামনা করে, পবিত্র এই সম্পর্ক সময়ের বয়ে চলার সঙ্গে আরও দৃঢ় হোক....
সেই সে শীতের রাতে
মৌসুমী চৌধুরী
— "অ্যাই দিদি, এই...কী ঘুম রে বাবা! ওঠ না।
শোন না কে যেন ডাকছে।"
চোখ কচলাতে কচলাতে ধড়মড় করে উঠে বসি বিছানায়। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতের রাত। বাইরে ঘন কুয়াশা। আমি ক্লাস টেনে পড়ি আর আমার বোন এইটে। সামনেই বোনের অ্যানু- য়াল পরীক্ষা আর আমার টেস্ট পরীক্ষা বলে আমরা দু'জনেই পড়াশোনা শেষ করে একটু রাত করেই শুতে গেছি। কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যেতে আমি বিরক্ত বোধ করি। এত রাতে এ আবার কী বিপত্তি রে বাবা! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৩ টা বাজে। বোন আবার আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
— "ওই যে শোন, কে যেন বাবার নাম ধরে ডাকছেন।"
মা-বাবা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। পাশের ঘরে ঠাকুরদা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। বারান্দা লাগোয়া ছোট ঘরে সারাদিনে পরিশ্রম শেষে শুয়েছে আমাদের মীনাদি। যিনি আমাদের দেখাশোনা, রান্নাবান্না ইত্যাদি কাজকর্ম করতেন।
এবার শুনলাম এক করুণ নারীকন্ঠ বলছে,
— " দরজাটা খোল না। আমার লিপির খুব জ্বর। এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। মেয়েটা আমার বাঁচবে না গো বোধহয়।"
জানালা সামান্য ফাঁক করে আমরা দেখি পাড়ার পুতুলমাসি কাঁদতে কাঁদতে কাতর অনুরোধ জানাচ্ছেন।
ছোট থেকেই দেখতাম পুতুলমাসি বিধবা৷ পরে শুনেছিলাম তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। তাঁর বড় মেয়ে অলিদি ছিল বদ্ধ উন্মাদ। তিনি ও তার মেয়েরা পাড়ায় কারও সঙ্গে মিশতেন না। তাঁদের একটা কাঠের বাংলো প্যাটার্নের জঙ্গল ঘেরা বাড়ি ছিল। বাড়িটি দেখে দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম করত আমাদের! এত রাতে সেই পুতুলমাসি এসেছেন বাবাকে ডাকতে! আমি বোনকে বললাম,
—" এত রাতে এখন বেরোস না। বলে দে বাবা
নেই। সকালে এস ।"
আমার বোন ছিল খুব ডানপিটে আর অসম সাহসী। ছোট থেকেই অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে জেন্ট'স সাইকেল চালাতে জানত। পুতুলমাসির কাতর অনুরোধ শুনে বোন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। ঠাকুদার সাইকেলটা বের করে পুতুলমাসির মেয়ে লিপিদিকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে গামছা দিয়ে নিজের কোমড়ের সঙ্গে বেঁধে নেয়। তারপর তীব্র শীতের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে কুয়াশাজড়ানো রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে তাকে নিয়ে পৌঁছায়। আমাদের পাড়া থেকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি ছিল দু' কিলোমিটার দূরে। অনেক ডাকাডাকির পর ডাক্তারবাবু গেট খোলেন। ডাক্তারবাবু পারিবারিক সূত্রে আমাদের পরিচিত ছিলেন। তিনি তো অত রাতে বোনকে দেখে অবাক,
—" তুই এই পেসেন্টকে নিয়ে এত রাতে একা এসেছিস? একে তো এক্ষুনি হসপিটালে ভর্তি
করতে হবে। ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ার লক্ষ্মণ
মনে হচ্ছে...। "
সে যাত্রায় ডাক্তারবাবুর সহৃদয়তায় লিপিদিকে সেই মূহুর্তে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রাণে বেঁচে যায় সে।
সব কর্মকান্ড সেরে বোন বাড়িতে ফিরে এসেছিল সকালবেলায়। পুতুলমাসি হাত ধরে
তাকে বলেছিলেন,
—" এত ছোট বয়স থেকেই তোর মনে এমন মায়া-দয়া! তুই যা করলি কোনদিন ভুলব না। ভগবান তোর ভালো করবেন, দেখিস।"
ভগবান তার কতটা ভালো করেছিল জানি না। তবে মা-বাবার কানে কথাটা উঠলে বাবা তেমন কিছু না বললেও মায়ের কাছে বেশ বকুনি খেতে হয়েছিল তাকে। আতঙ্কিত হয়ে মা বলেছিলেন,
— "শীতের অমন অন্ধকার রাতে কত কি বিপদ হতে পারত! কাউকে ডাকা উচিত ছিল তোর।"
আমার বোনের সরল উত্তর,
— " ডাকতে ডাকতে রোগীর ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেত, তাই ডাকাডাকি করে সময়
নষ্ট করিনি।"
অটুট বন্ধনশ্রাবণী সেনগুপ্ত
ভাই বোনের সম্পর্কের মতন সম্পর্ক এ জগতে আর একটিও নেই।এ হল গভীর থেকে গভীরতর শেকড়ের টান,যা বহু টানাপোড়েনেও থাকে অমলিন।আমার ভাই আমার থেকে বেশ অনেকটাই ছোট।তবে একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হবার সুবাদে আমার বেশ কয়েকজন দাদা ছিলেন।মনে পরে ,আমি সে বছর পাঠভবনে ভর্তি হয়েছি-তৃতীয় শ্রেণী।আমাদের শ্রেণী শিক্ষিকা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাদের কার কার ভাই বা বোন আছে?তাতে আমি সব তুতো ভাই বোনদের মিলিয়ে যে সংখ্যাটি বলেছিলাম, তাতে আগেকার মানুষেরা অবাক না হলেও তখনকার দিনে বেশ বিস্ময়ের।উনি আমাকে বলেছিলেন যে তোমার নিজের কয়জন ভাই বা বোন আছে সেটি বলো।তখনও নিজের,পরের বোধ হয়নি।যাইহোক,নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলেছিলাম যে আমার কোনো ভাই বোন নেই।সেই বছর ই গরমে ভাই হল।আমি স্কুলে গরমের ছুটি র পরে এসে প্রথমেই মিস কে সেইটি ঘোষণা করে নিজের ভুল সংশোধন করেছিলাম।
ভাই হবার সময় আমি মামার বাড়িতে ছিলাম। মাসিমনি হাসপাতাল থেকে এসে বললেন ভাই হবার কথা,আমার তো খুব আনন্দ,কিন্তু দেখলাম বাড়ির বড়দের মুখ গম্ভীর।আমি ছোট বলে আমাকে কেউ কিছু বললেন না।শুধু দিদিমা বলেছিলেন যে, তুমি এখন ঠাকুরকে জল দিতে পারবে না,তোমার এখন শুভ অশৌচ।আমি তখন দিদিমার সঙ্গে ঠাকুরকে জল বাতাসা দিতামতো, তাই।আমিতো তখন বাড়ি যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি।শুনলাম ভাইকে আর মাকে আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।পরে জেনেছিলাম ভাই সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছিল,তাই বেশ কিছুদিন ওকে ইনকিউবেটর এ রাখা হয়েছিল,এবং জন্মে নাকি কাঁদেনি।যাইহোক বেশ কয়েকদিন পরে ভাই বাড়ি এল।আমিও মামাবাড়ি থেকে ফিরলাম।খুব ছোট্ট ছিল ভাই,হাতের আঙুলগুলো খোলার ভিতরের মোচার মতন।খুব কমজোরি আর ফ্যাকাশে।আমরা তো অতো বুঝিনা তখন,আমি,আমার জ্যাঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা মিলে খুব লাফিয়েছিলাম বিছানার উপর,মনে আছে খুব বকুনি খেয়েছিলাম সেইজন্য।মা ভাইকে বুকের মধ্যে করে নিয়ে শুতেন ,ওই উত্তাপে ও ভাল থাকত।সেই প্রথম আমার মাকে কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।আমার একাধিপত্যে ছেদ পরাতে অখুশি হইনি, বরং সেই ছোট থেকেই সেইটিকে আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি।এতদিন ছিলাম একা, তাই খালি আদর পেতাম,এখন আদর করার একজন পেলাম।সেই আমি দায়িত্ববান বড় দিদি হয়ে গেলাম।সেই ধারা আজও বহমান।এইভাবেই দিন কাটতে লাগল,আমরা বড় হতে লাগলাম।আমার বাবার ছিল রেলের চাকরি,তাই বেড়াতে যাবার জন্য পাশ পেতাম। তখন রেলে ফার্স্টক্লাস কূপ থাকত,তাতে আমরা চারজন আর অন্য একজন থাকতে পারতেন।দরজা বন্ধ করে দিলেই পুরো ঘর।আমি নিচের সিটে, বাবা আমার কোনাকুনি উপরের সিটে আর মা ভাইকে আমার পাশের সিটে।মনে পড়ে ভাই একটু দেরিতে কথা বলতে শিখেছিল।তাজমহল দেখতে গিয়ে বলেছিল-"তাজমলল।"আগ্রাতে আমরা যেখানে উঠেছিলাম মা সেখানে প্রেসার কুকারে করে আমাদের ভাত করে দিতেন।যেহেতু বাবা একদম নিরামিশ খেতেন ,তাই আমরা বেশিরভাগ সময়েই হলিডে হোমে উঠতাম আর ওখানেই রান্না করে খাওয়া হত।ভাইয়ের জন্য মা স্পিরিট স্টোভ নিয়ে যেতেন।আমার উঁচু ক্লাসে র পড়াশুনার জন্য খুব বেড়ানো হয়নি।মনে পরে ভাই যখন ক্লাস ফোর এ পড়ে, তখন স্কুলে এক সহপাঠির ধাক্কায় ওর হাত ভেঙে যায়, সেই অবস্থাতেই আমরা গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিলাম।
ভাই ছোটবেলায় আমাকে কোথাও একা যেতে দিতে চাইত না।যখন কলেজে পড়ি, তখনও বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাবার উপায় ছিলনা,আমি একা বেরোব জানতে পারলেই আমার শাড়ি পেঁচিয়ে বসে থাকত।আমার বন্ধুরা এলেও সবসময় কাছে বসে থাকত, আর বলত-"তোর বন্ধু আমারও বন্ধু।"আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের বাড়িতে ওর ছিল অবাধ যাতায়াত।আমি যদি কোথাও কিছু কিনতাম বা খেতাম সবসময় ওর জন্য নিয়ে যেতাম,সে সামান্য বাদাম হলেও।একা কিছু আনন্দও উপভোগ করতে পারতাম না।নাটক দেখা,সিনেমা দেখা সবসময় আমার সঙ্গী।ভাইয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় যে স্কুলে সিট পড়েছিল,সেই স্কুলের সামনে আমি পরীক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।আর উচ্চ মাধ্যমিকের সময়তো বাবা খুব অসুস্থ,তখন আমিই টিফিন নিয়ে যেতাম,আর মুখে মুখে পড়াও বলে দিতাম।ওই স্কুলের দারোয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল আপনি কে হন? ভাইয়ের উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোবার সময় বাবা হাসপাতালে।তারপরতো বাবা চলেই গেলেন।আমার বিয়ের দিন সকাল থেকেই ওর চোখে জল।তাও সব কর্তব্য করেছিল।আর প্রথম জামাইষষ্ঠীর দিন সমস্ত বাজার নিজে করেছিল।মা খুব দুঃখ করছিলেন যে, আমার দাদু তাঁর বড়জামাই অর্থাৎ আমার বাবার জন্য নিজে যত্ন করে বাজার করতেন,আর নিজের একমাত্র জামাইয়ের সময়েই তোর বাবা রইলেন না।তবে খুব খুশি হয়েছিলেন যে, ভাই সবকিছু গুছিয়ে বাজার করে এনেছে বলে।
একসময় মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন আমার শাশুড়িও খুব অসুস্থ।আমি এই বাড়ি, ঐ বাড়ি স্কুল,উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখা সব নিয়ে নাজেহাল।আমি,আমার কর্তা আর ভাই প্রাণপাত করে এক অসম লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলাম।তখন যেমন কিছু জনকে পাশে পেয়েছি,সেইরকম বাড়ির মধ্যে থেকেও অসম্ভব নিষ্ঠুর ব্যবহার পেয়েছি,যা মানসিকভাবে অনেক বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।হাসপাতালে আমার ভাইকে আর ওর জামাইবাবুকে সবাই ভেবেছিল দুই ভাই।মা চলে গেলেন।ভাই একা হয়ে গেল।আমি কিছুদিন ঐ বাড়িতে কাটিয়ে এই বাড়িতে ফিরে এলাম।খেয়ে ঘুমিয়ে কিছুতেই শান্তি পেতাম না।ভাইয়ের রান্না করার জন্য যে ছিল সে প্রায়ই কামাই করত।তখন কয়েকবার ওকে পাইস হোটেলেও খেতে হয়েছে।আমরা এখানে ভালমন্দ কিছু খেতে পারতাম না।সবসময় ওর কথা মনে হত।আমার শাশুড়ি মা কিছু রান্না করলেই ওকে ডেকে পাঠাতেন।কালের নিয়মে আমাদের আদি বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হল।সেই সময় ভাড়া বাড়িতে সব কিছু নিয়ে যাওয়া, ভাইয়ের একা থাকা সে এক লড়াই।যাইহোক তারপর ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া হল।আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম।কিন্তু সেই যে দিদি হয়ে ভাইয়ের প্রতি অপত্য স্নেহ অনুভব করেছিলাম,তা আজ একসন্তানের পিতার প্রতি সমান মাত্রায় বহমান।সুখে দুখে আজও আমরা পরস্পরের পাশে।এ অটুট বন্ধন অপার্থিব সৃষ্টি।
গল্পের ছেলেবেলা
অলকানন্দা দে
শৈশবকে উপলব্ধি করা যায় তাকে ছেড়ে দূরত্বে এসে দাঁড়ালে। তখন মনে হয় এমন সুশ্রী দিন এত আচমকা কেন ফুরিয়ে যায়!
আরও খানিকটা বিস্তারিত হতে পারতো! কিন্তু তেমন তো হবার নয়! যে বেলার যতখানি মুহূর্ত প্রাপ্য ততটাই মেনে নিতে হয় বিনা প্রশ্নে। তাই পিছন ফিরে তাকালে, শৈশবের স্মরণে ডুব দিলে রূপকাহিনীর মতো লাগে আজ! তার থেকে যত দূরেই গড়িয়ে যাই না কেন ফিরে তাকাবার সময়ের অমিল কিন্তু হয় না! দুই দাদার সাথে কাটানো মুহূর্তরা খেলা শেষে প্যাভিলিয়নে ফিরেছে সেই কবেই! কিন্তু হাততালির রেশ থামেনি যেন এখনো!শিলিগুড়ি শহরে কার্শিয়াঙ পাহাড়ের মুখোমুখি আবাসের উঠোনে ছড়িয়ে আছে সেই ছেলেবেলা! গল্পগুচ্ছ পুরনো হলেও তাকে পুনশ্চ বলার মধ্যে মধু নিঃসরণ অব্যাহত।
একটি বিরাট মাঠের মালিকানা ছিল আমাদের। রকমারি খেলা ও খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। সকালের পড়াশোনা, দুপুরের ইস্কুল শেষে খাওয়ার জন্য সময় দেওয়াটাও সময়ের অপব্যবহার বলে মনে হ’ত। কারণ খেলার সময়ে কোন কাটছাঁট চলবে না। সবে মিলে জড়ো হওয়া মাঠের বুকে, ঘড়ির কাঁটা ৪ টের ঘরেও পৌঁছয় না।থাকুক না গ্রীষ্ম দাহ, পরোয়া নেই।
খেলা হ’ত ক্রিকেট, যেখানে একটি নিম্ন সাধারণ বল জুটলেও ব্যাট বলতে ছিল একটি ভাঙা টেবিলের পায়া। তাতে কি। এতে সুনীল কপিলের থেকে কিছু কম দক্ষতা প্রকাশ পেত না কিন্তু। কারণ তখন এনারাই ছিলেন তুঙ্গে। আর ছিল ব্যাডমিন্টন পিট্টু ডাংগুলি কাবাডি ঘুড়ির প্যাঁচ আরও কত কি। একটি বিশেষ খেলা ছিল আমাদের যার নাম স্লিপচোর। মাঠের পরেই ছিল খেলার পার্ক। পার্কের সম্বল ছিল চারটি দোলনা, দুটি বড় স্লিপ দুটি ছোট স্লিপ, আর চারটে ঢেঁকি। এই স্লিপের ওপর ওঠানামা করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলাটাই ছিল স্লিপচোর। বাড়ির নির্দেশ থাকতো বড় স্লিপে উঠে কিন্তু স্লিপচোর খেলা নয়। কিন্তু কে শোনে সেই সৎ উপদেশ। কথা না শোনাটাই যথাযথ ছেলেবেলা একথা পরিণত বয়স বলে। এরকমই একদিন স্লিপচোর খেলা চলছে আমি দাদা ও আরও সকলে। আমাদেরই বন্ধু মানিক পার্কের একটি খুলে যাওয়া মাঝারি মাপের গেট যা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ছিল সেটি কে হাতে ধরে দোলাচ্ছে। সকলে বারণ করছে কিন্তু ঐ যে, ছেলেবেলা বেপরোয়া,শোনে না কারও কথা। ওর দুষ্টুবুদ্ধি সংলাপ বলে যায়, “ফেলে দেব কিন্তু ফেলে দেব কিন্তু”। মুখের কথাও ফুরোয় না, মানিক আর টাল সামলাতে না পেরে দিল ফেলে সেটি আমারই পায়ে। দাদারা ও তাদের বন্ধুরা এবং আমার বন্ধুবর্গ সবে মিলে বোধহয় পঞ্চাশের অধিক হবে ছুটে এলো এবং মানিককে চেপে ধরলো। আমার অবস্থা তো কহতব্য নয়। কাটাছেঁড়া তো দেখা যাচ্ছে কিন্তু ভাঙাচোরা তো বোঝার উপায় নেই। সবাই মিলে ধরে তো আমাকে ঘরে নিয়ে এলো। সাথে বিরতিবিহীন কান্না অব্যাহত। একে তো ব্যাথা পাওয়া তায় সকলের সহানুভূতির পরিমণ্ডলে মন বলে আরও একটু কাঁদি। ওদিকে মানিক বেচারা মুখ চুন করে হতবুদ্ধি হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে ঝড়ের মতো তিরস্কার শুনছে দাদার বন্ধুদের থেকে। তারা সবাই আমাকে ‘বোন’ বলে সম্বোধন করতো। মাত্রাতিরিক্ত আহ্লাদ আগলে রাখত সুখের মধ্যে সুখ ঢেলে! যাইহোক, এবারে শুশ্রূষা পর্ব। প্রথমেই কথা উঠলো ইঞ্জেকশনের যা শোনার পর সমস্ত জখম একদিকে ও কান্না একদিকে। সান্ত্বনার তো অগাধতা বাড়ছে ক্রমশ। এ বলে ‘কিচ্ছু হবে না বোন’, তো ও বলে ‘পিঁপড়ে কামড়ের চেয়েও কম লাগে দেখবি’। কিন্তু সে কথায় আমি বিশ্বাসী হব কেন। আমার বিশ্বাস ইঞ্জেকশন দিয়ে আর কেউ বাড়ি ফেরে না। যথারীতি ওজর আপত্তির অবধি রইলো না। কিন্তু তারা জায়গা করতে পারল না সমস্যার তীরে।যেতেই হ’ল জন্মাবধি সেই ভয়ের মুখোমুখি হ’তে! বাবার কোলে আমি আর সাহসে যাতে কোনো ঘাটতি না পড়ে সেই প্রত্যয় যোগাতে দাদারা ও তাদের বন্ধু-সংসার! দাঁতে দাঁত চেপে নিষ্ঠুর চিকিৎসার ছুঁচ ফোটাতে হ’ল এবং এইটিই যে জীবনে চেঁচিয়ে ওঠবার শ্রেষ্ঠ সময় তা প্রমান করে দিলাম। অবশেষে যুদ্ধবিরতির পর মুখে নিয়ে মলিন হাসি ফিরে এলাম সদলবলে যখন বিখ্যাত দিবসের সূর্য নামে পাটে।
মানসিক পাড়ায় এই ছেলেবেলা দীর্ঘায়ু! বিস্মৃতির ধুলো মাখে না সে কখনো! পরিণত বয়সে হৃৎপিণ্ডে যখন বাস্তব ছেনি-হাতুড়ি চালায় তখন প্রলেপের জন্যে আবেগ উড়ে যায় তারই কাছে এবং পেয়েও যায় আশানুরূপ বিশল্যকরণী! মিলন-ভাবনায় মোড়া অমোঘ অন্দর-মহলের নামই শৈশব যা আলো জ্বালে দীর্ণ পরাজয়ে! এ কথা অভিজ্ঞতা বলে!
ভাইয়ের সাথে কাটানো দিনগুলো
বুলবুল দে
" এমা, ভাইটা লাল রঙের কেন?"
"একদম ছোট্ট তো তাই, তুই ও যখন এতটুকু ছিলি এরকমই লাল ছিলি "
জেঠাতো দিদিদের সাথে ভাইকে প্রথম হাসপাতালে দেখতে গিয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে দিদিরা একথা বলেছিল। আমার আরও নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দিদিরা হেসে কুটিপাটি, মনে আছে এখনও। তার পর ভাইকে নিয়ে মা বাড়িতে আসলে মায়ের গায়ের গন্ধ টা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিল। মা আর ভাইয়ের গায়ে একই গন্ধ। মা বলেছিল হাসপাতাল থেকে এসেছি ওষুধ পত্র খাই তাই এই গন্ধ। এক দুদিন পরেই চলে যাবে । সত্যিই তাই হয়েছিল। আস্তে আস্তে আমার জড়তা
কেটে গেল। ভাইকে আদর করতে শিখলাম। হামাগুড়ি দিতে শুরু করল যখন তখন তো ওকে সামলানোই যেত না এত দুষ্টু হয়েছিল। স্নান করতে যাবার সময় মা ওকে খাটের পায়ায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত তখন এমন চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিত আমি অনেক ভুলিয়েও থামাতে পারতাম না। ভীষণ কষ্ট লাগত আমার। একদিন তো কান্না সহ্য করতে না পেরে আমি দড়ির বাঁধন খুলে দিলাম ব্যাস আর যায় কোথায়, একেবারে তান্ডব লীলা শুরু করেদিল।ঘরের সমস্ত জিনিস তছনছ করে, ঠাকুর গুলোকে ছুড়ে ফেলে একেবারে সাংঘাতিক কান্ড! এসব করতে গিয়ে নিজেও বারবার ব্যাথা পেয়ে কেঁদে উঠছে পরক্ষণেই থেমে গিয়ে আবার হুলুস্থুলু বাধাচ্ছে। আমি নিজেই তখন এত ছোট যে ভাইকে ধরে রাখার ক্ষমতাই নেই। আমিও চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। ভাই হওয়ার পর তখন আমরা আবার জলপাইগুড়ির ভাড়া বাড়িতে চলে এসছি। ঘরে কেউ নেই। চিৎকার শুনে মা তো আঁধা স্নানেই বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে শেষমেশ সব সামাল দেয়।বাপরে তার পর থেকে হাজার কাঁদলেও, কষ্টে বুক ফেটে গেলেও আর একদিনও বাঁধন খুলিনি। শুধু ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি আমার সীমিত সাধ্যে। এরপর আমরা পাকাপাকি ভাবে কোচবিহারে চলে আসি। হাসি খেলা খুনসুটি করতে করতে দুজনেই বড় হতে থাকি। ভারি মজা
হত মাঝেমাঝে যখন ভাইকে লিপস্টিক,কাজল, টিপ, মেয়েদের জামা পরিয়ে মায়ের ফলস্ চুলদিয়ে বিনুনী ঝুলিয়ে মেয়ে সাজিয়ে সব জেঠুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম সবাই দেখে না বোঝার ভান করে বলত," ওমা এটা আবার কার মেয়েরে? " তখন নিজেই মনে মনে নিজের নিখুঁত সাজানোর তারিফ করে গর্বিত হয়ে উঠতাম।ভাই ও বোধ হয় মজা পেত তাই সাজানোর সময় চুপটিকরে থাকত। তবে
আর একটু বড় হলে আর সাজতে চাইত না।বোধ হয় পৌরুষে বাঁধত। একবার সুনীতিতে পড়তে, ক্লাসে বসে আছি হঠাৎ দেখি সব মেয়েরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে আর গেটের কাছে দারোয়ানের ঘরের দিকে যেন কি দেখাচ্ছে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। তার পর একটা মেয়ে যখন ভাইকে দারোয়ানের ঘরথেকে নিয়ে আসল আমি তো হতবাক! আসলে ও তখন সামনেই বাংলা স্কুলে ক্লাস টু তে পড়ত। বাড়িতে খুব দুষ্টুমি করত বলে চার বছরে ওকে ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি করানো হয়েছিল।পরে ক্লাস থ্রি তে জেনকিন্স এ ভর্তি হয়। স্কুলের ছুটি হতেই আমার স্কুলে চলে
এসছে কারণ বাবা নাকি আমার সাথে বাড়ি যেতে বলেছে। এদিকে আমার তখনও দুটো ক্লাস বাকি।
টিচার ক্লাসে আসলে ভাই কে কোনও রকমে লুকিয়ে আমার পাশে বসালাম। কিন্ত টিচার তাও দেখেফেলেছিল। ভেবেছিলাম খুব বকা খাব। কিন্ত টিচার বকলেন না, ভাইয়ের নাম, কোন ক্লাস ইত্যাদি
জিজ্ঞেস করার পর বললেন এইভাবে অন্য স্কুলে
ঢুকতে হয়না।আমি মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকলাম।
রাখীর সময় ভাই ফোঁটার সময় ওর আগ্রহটাই
বেশি ছিল। নিজেই রাখি কিনে আনত। নয় বছর বয়সেই টুকটুক করে বাজারে চলে যেত। ও ই প্রথম বাড়িতে ইন্দ্রজাল কমিকস্ আনতে শুরু করে। আমি গো গ্রাসে সেগুলো পড়তাম।প্রথম ক্যাডবেরি চকলেট প্রথম ম্যাগি ভাই ই ওই ন দশ বছরে দাশ ব্রাদার্স থেকে এনেছিল। একবার ফেলুদার সিনেমা দেখে কোত্থেকে একটা বুমেরাং নিয়ে এল কিন্ত সেটাতো কিছুতেই আর ঢেল মারলে ফিরে আসেনা! আর একবার আনল সিলভার স্টার স্ট্যালনের হাতে যে হাতিয়ার থাকে নাম টা ভুলে গেছি , সেটাও কোত্থেকে জানি এনে কসরত করে শেখার চেষ্টা করল। আমার জমিয়ে লুকিয়ে রাখা পয়সাগুলো কখন যে চপ তেলেভাজা খেয়ে শেষ করে ফেলত টেরই পেতাম না। যখন পেতাম তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বেঁধে যেত। আবার যখন নতুন নতুন খাবার জিনিস, গল্পের বই আনত তখন খুব আনন্দ হত।এভাবেই আমাদের দুই ভাই বোনের বড় হয়ে ওঠা ।
কত কত ঘটনার ঘনঘটায় আনন্দ মুখর সেসব স্মৃতি সে তো আর বলে শেষ করা যায়না। খুব ছোট বেলার এক দুটোতেই ইতি টানলাম।
আমার বোন
রীতা মোদক
আমার একটা নয় , দুটো নয় , তিন- তিনটে পিঠাপিঠি বোন । হাসিখুশি ,খুনসুটি লেগেই থাকতো সবসময়।আবার কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারতাম না।কাকে নিয়ে লিখবো আর কাকে ফেলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
আমার প্রথম বোন অজন্তা। পড়াশোনায় একটু কাঁচা হলেও খেলাধুলায় তার সাথে কেউ পেরে উঠত না।প্রতিবারই বাড়িতে প্রাইজ আসতো। দৌড়, জং জাম্প, হাই জাম্প, ডিসকাস থ্রো, লৌহ বল নিক্ষেপ, সাইকেল রেস সবকিছুতেই ফাস্ট অথবা সেকেন্ড প্রাইজ।আমি স্কুলে পড়াশোনায় প্রথম হলেও খেলাধুলায় প্রাইজ আনা বড় কথা বেশিরভাগই পেছন দিক থেকে প্রথম হতাম । আমাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল ।সেখানে ছোট - বড় সবাই স্নান করত।পুকুর পাড়ে কয়েকটা মাঝারি সাইজের শিশু গাছ ছিল। পাড়ার কিছু দুরন্ত ছেলে শিশু গাছের ডালে চড়ে সেখান থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত।আমার বোন ও ওদের থেকে কম কিছু নয়।সেও তরতরিয়ে গাছে উঠে যেত এবং উচু ডাল থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত।আমি তো ভয়ে সাত হাত দূরে।সাঁতার ও শিখেছে আমার থেকে অনেক আগে।ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, পদ্মাসন করে সাতরে স্পিডে পুকুর পাড় হয়ে যেত।আমার তো ভেতরে ভেতরে ভীষন লজ্জা-- বড় হয়েও সাঁতার জানিনা। কিন্তু সেটা সবাই জেনে গেলে আরো মুস্কিল হয়ে পরবে।আমিও হারবার পাত্র নই।তাই বুদ্ধি করে একটা বড় পাথর নিয়ে জলের নিজ দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রায়ই উপরে উঠে আসতাম ।সবাই ভাবে আমিও ভালো ডুব সাঁতার জানি।একদিন কি হলো আমি পাথর ধরে জলের নিচে চুপ করে বসে আছি,এমন সময় আমার বোন উপরের গাছ থেকে এমন জোরে ঝাঁপ দিল এক্কেবারে পরলো এসে আমার মাথায়। আমিতো জল খেতে খেতে কুপোকাত।আর একটু হলেই হয়তো আমার ডুব সাঁতারের কেরামতি জন্মের মত বেরিয়ে যেত।ছোটবেলায় বোনের জামাকাপড়ের উপর কোনো ভালোমন্দ অথবা কোনো প্রকার হিংসে ছিল না। ওর জামা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না পরি ততক্ষণ সে বুঝতেই পারতো না তার জামাটা ভালো কি মন্দ ।ওর জামা আমি পড়তাম,আমার জামা সে পড়ত।কোনটা আমার জামা,কোনটা বোনের জামা কেউ বুঝতেই পারতো না।
আমার দ্বিতীয় বোন সবিতা।ছোটবেলা থেকেই সে বেশ সৌখীন। কুকরানো চুল এবং দেখতে আমাদের থেকে অনেক সুন্দর ।খাওয়া দাওয়া এবং জামাকাপড়ের প্রতি পরিপাটি থাকতেই সে পছন্দ করত।ওর জামা কাউকে পড়তে দিত না এবং সবচেয়ে দামী জামার প্রতি ওর আকর্ষণ ছিল একটু বেশি । মা সবাইকে সেরকম ভাবে দিতে পারতো না । তাই সে বাজারের সবচেয়ে বেশি দামী জামার জন্য মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত। মা চিন্তা করে কোনো পথ না পেয়ে শেষমেশ একটা বুদ্ধি বের করলো। বোনকে না নিয়ে দোকান থেকে একাই জামা জামা কিনে এনে বোনকে ডবল দাম বলতো।তাতে বোন বেজায় খুশি। আমার বাবা গোকসারডাঙ্গা একটা মিষ্টির দোকানে থাকতেন। তখন রাস্তায় এতো গড়ি ছিলো না।বোনের তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রী হবে। হাপ প্যাটেল এ সিতাইমোড় থেকে বাড়ী পর্যন্ত বাবার সাইকেল নিয়ে চালানো শিখত।একদিন দুপুরের দিকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে ,অনেকক্ষণ হয়ে গেলো ফিরে আসার নাম নেই। তখন মায়ের খুব চিন্তা হলো।মায়ের সাথে সাথে আমরাও পাগলের মত বোনকে খোঁজা শুরু করলাম।আশেপাশে জিজ্ঞেস করেও কোনো খবর পাওয়া গেলো না।কেউ কেউ বলছে ফাঁকা রাস্তায় একা পেয়ে ওকে হয়তো কেউ তুলে নিয়ে গেছে ।মা তো পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে,আমরাও কান্নাকাটি করে অস্থির।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন সময় কাছে সাইকেলের দোকানের একটি ছেলে শ্যামল এসে মাকে বলল -- 'আপনার মেয়ে আমাদের দোকানের সামনে সাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে,সাইকেলটা আমার কাছে আছে।'
মা ভেবেছেন বোনের হয়তো কোনোকিছু হয়ে গেছে।তাই এ কথা শুনে আরো কান্নায় ভেঙে পড়ল।তখন শ্যামল মাকে জানায় -- আপনার মেয়ের সেরকম কিছু হয়নি, হাঁটুতে অল্প কেটে গেছে।আপনার ভয়ে বাড়ী আসেনি। ও কাকুর কাছে চলে গেছে ,আমি বাসে তুলে দিলাম।পরের দিন সকালে বাবা বোনকে নিয়ে বাড়ী আসে।
আমার তৃতীয় বোন অর্থাৎ সবার ছোটো আদরের বোন ঝুমুর।ডাক নাম ঝুমা। ছোটো বেলা থেকেই খুব আহ্লাদী এবং ন্যাকা ন্যাকা কথা বলত।তার বায়নার শেষ ছিলো না।অল্পতেই কেঁদে ফেলতো এবং মা এসে আমাদের খুব বকা দিত।অজন্তা আর আমি যদি কোথাও যেতাম সে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরত।নিয়ে গেলেও জ্বালা।হাত ধরতে বললে দুজনের হাত ধরে ঝুলে পড়ত,আবার হাত ছাড়তে বললে রাস্তা দিয়ে উল্টাপাল্টা দৌড়াতো।নদী দেখলে ভীষণ ভয় পেত।কোলে চড়ে ব্রীজ পাড় হতো।একবার পুজোতে লাছা নামে ঘাগরার মতো একধরনের পোশাক খুব বেরিয়েছিল।একদিন রাতে আমরা সবাই পড়াশুনা করছি তার মাঝে হঠাৎ করে ঝুমা বলে উঠল ---- বড়দি এবার পুজোতে আমাকে জালা কিনে দিবি।
আমিতো ওর কথা শুনেই কি চায় একবারে বুঝে গেছি।তবু না বোঝার ভান করে বারবার জিজ্ঞেস করছি -- জালা কি? কলসী নাকি বস্তা।মা , বোনরা সবাই হাসতে হাসতে প্রায় পেট ফাটার মত অবস্থা।আমরা যত হাসছি ঝুমা ততো জোরে কান্না করছে।শেষে হটাৎ করে আমার দিকে চটে গিয়ে সে কি লার্থি ঘুষি ।আর মুখে বলছে তুই জানিস। বোনের আবার অনেক গুণ ছিলো।মায়ের থেকে দেখে দেখে ছোটবেলাতেই সেলাই শিখে গিয়েছিল। সেলাই করে পুতুলের জামাকাপড় বানাতো।একবার আমার একটা নতুন হলুদ জামা দেখি পিঠের দিকে অনেকটা কাটা। ইদুরের কাটলে তো এমন চারকোনা করে কাটবে না।মা তো আমাকে বকছে জামার এই অবস্থা কেমন করে হলো।শেষে দেখা গেলো আমার জামার অংশ দিয়ে পুতুলের জামা বানানো হয়েছে । ঝুমা আর্টে ও খুব ভালো ছিলো।একা একা খুব সুন্দর ছবি আকত।একদিন আমি উঠোন সাইকেল বসে বলেছিলাম -- তোর ফোন থাকলে এরকম ভাবে আমার একটা ছবি এঁকে দেখতে পারবি?
বোন তখন আমার সাথে কোনো তর্ক না করে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।দুদিন পরে দেখি সাইকেল বসা অবস্থায় হুবহু আমাকে এঁকে ফেলেছে ।
এখন আর আমার বোনদের মধ্যে খুনসুটি, মারামারি হয় না। ।কারণ আমরা সবাই এক সাথে নেই। প্রত্যেকের বিয়ে হয়ে একেক জায়গায় থাকে ।আমি খুব মিস করি সেই দিনগুলি।জামাই ষষ্ঠীর সময় অথবা কোনো পূজা - পার্বণে সবাই একসাথে হই।অনন্দ হৈচৈ করতে করতে কখন সময় শেষ হয়ে যায়।বড্ড মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলি।
No comments:
Post a Comment