।। পাঠ প্রতিক্রিয়া ।।
কাব্যগ্রন্থ- নানের ডায়েরি ইনসমনিয়ার
বাকফসল: দেবব্রত ভট্টাচার্য্য
প্রকাশক- অক্ষরবিন্যাস
`প্রথম খেলাচ্ছলে বশ্যতা মেনেছিলাম, সে দিনফিরিয়ে নিচ্ছি
প্রথম খিদের জন্য হত্যা করেছিলাম, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি'
`বাবার নামের আগে লিখি চন্দ্রবিন্দু, রোগশয্যায় একটু একটু করে বিসর্গে মা
বর্ণমালার পর বর্ণমালা ডিঙিয়ে যায় ছেলে, আমি থমকে যাচ্ছি যতিচিহ্নে।`
`একটা বয়সের পার খই-এর খয়রাতি, অবাধ্য স্মৃতি
একটা বয়সের পর ভালোবাসার কোনো জিজ্ঞাসা থাকে না শুধু ময় ঝোপে কুয়াশার সংকেত
অসহ্য খোঁজ, অপেক্ষা`
চমকে উঠতে হচ্ছে তো? হবেই। কেননা এই উচ্চারণগুলি একজন প্রকৃত কবির। তাঁর জীবন জুড়ে কবিতা সাধনা।
`আমি কবি` যখন আজ উচ্চকিত চারদিকে, প্রচারের নিনাদে যখন গগন ফাটছে, উত্তরীয় গলায় যখন জোড়হস্ত নতমস্তক তাঁবেদার চতুর্দিকে, ঠিক তখনই নিজস্বে যাপনে এই মানুষটি জীবনকে দেখছেন, অনুভব করছেন পরতে পরতে আর তারই ফল এরকম অজস্র পংক্তি যা পড়বার পর স্তব্ধ হতে হয়, আর কিছু লিখব কিনা ভাবতে হয় বারবার। কেননা যা লিখতে চেয়েও পারি না তার সবটাই বলে ফেলেছেন এই মানুষটি। এ তো শুধু তাঁর নিজস্ব যাপন নয়। তিনি যেন আবহমানকাল ধরে না বলা অথচ ধ্রুব সত্য কথাগুলোকে আমার আপনার সকলের হয়ে বলে দিচ্ছেন। এক অসম্ভব মুখপাত্রের কাজ করছেন তাঁর দৈনন্দিনতায়।
কবি দেবব্রত ভট্টাচার্য্যের `নানের ডায়েরি ইনসমনিয়ার বাকফসল` পড়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই কথাগুলিই মনে এলো। দেবব্রত ভট্টাচার্যকে ব্যক্তিগতভাবে যারা চেনে, তারা জানেন তিনি একাধারে কবি ও নাট্যকার। সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি সুবিদিত। এই মুহূর্তে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে তাঁর নিজস্ব অভিমুখ সাহিত্যচর্চায়।
আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটি কবি দেবব্রত ভট্টাচার্য্যের একটি বিশেষ সময়ের সৃষ্টি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে লেখা এই কবিতাগুলি বোধের যে স্তর থেকে উঠে এসেছে সেটা তাঁর জীবন সম্পর্কে খানিকটা ওয়াকিবহাল বলেই জানতে পেরেছি। কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা মুজনাইতেও প্রকাশিত। সেদিক থেকে শ্লাঘা বোধ করছি কবি ও মুজনাই দুজনের জন্যই।
কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার বারবার মনে হয়েছে আসলে কবিতা একটি বৃত্তপথ মাত্র। যা বলা হয়ে গেছে আমরা সেটাই বলছি আবার। শুধু পরিভাষা আলাদা। ফলে অতীতে সেই পরিভাষা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে যদি শুরু করা যায় তবেই গড়ে ওঠে নিজস্বতা। `নানের ডায়েরি` পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে কবি দেবব্রত ভট্টাচার্য্য সেই পরিভাষা বহু আগেই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিভিন্ন দিনে তাঁর ভাবনা ও মনন মিলেমিশে যা সৃষ্টি করেছে তা কবিতার জগতে নিঃসন্দেহে এক অনন্য মাইলস্টোন। দুই একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
না, এই চাঁদ তোমারও না আমারও না। ভারী বুক ভারী নিতম্ব নিয়ে ট্রেনের জানালার কাচে, ছায়াগাছের মগডালে যেহেতু কোজাগরী নোয়ানজুলিতে জ্যোৎস্নার ডুবজলে যতই খেলুড়ে হোক ছলাকলা পটিয়সী কোজাগরী সুন্দরী, আহামরি যতো হোক কাকচক্ষু আমি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় দোলা ঘুমের তুমি এই চাঁদ কারো না।` (৬ অক্টোবর, ২০১৭)
`জেদ মানুষকে রোদ বা ছায়াতল দিয়ে ধ্বংস বা নির্মাণে পৌঁছে দিতে পারে। প্রেম উদ্বাস্তু সমস্যায়ও হতে পারে লালগোলাপ সমর্পণ মুহূর্তে ভিখিরি করে দিতে পারে` (৩ নভেম্বর ২০১৯)
`কোথায় মেরুদণ্ড, কোথায় হাড্ডি, এতো মখমল। ছায়ায় শুকোতে দেওয়া গোলকম্বল।সময় ও দুঃসময়ের সমকামী সংসার।হত্যা, আত্মহত্যা অথবা রাষ্ট্রবিপ্লব ছাড়া আর কোনো অপশন থাকে না।` (২৯ ডিসেম্বর, ২০২০)
যন্ত্রণাবিদ্ধ এই যে জীবন, যার অভিঘাত অনেকক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক, যা বিদীর্ণ করে ব্যক্তি স্বত্বাকে, যার জন্য অনেক সময় আমরা থৈ পাই না, তার সবটাই ফুটে উঠেছে কবির দর্শনে। কিন্তু কিছু সময় চরম রোমান্টিক হয়ে বলতে পারেন `আসলে তো হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশের গাথা/ কথাবলা কলম হারিয়ে প্রথম ইচ্ছে হয়েছিল আত্মহত্যা।` এই দর্শন আসলে এক প্রাজ্ঞ ঋষির যিনি ব্যক্তি জীবনেও যুঝে চলেছেন অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে। সেজন্যই আরও স্পষ্ট করে বলে ফেলেন, আমার চেয়ে ছোটো থেকেই মোর যেতে চাই/ আনন্দলোকে পুলিশ ঢোকে, বলে ক্যানো?/ কি করে বোঝাই ওদের আমি তো আকাশযান নই/ নিতান্ত ন্যানো।`
কিন্তু কবির জীবন তো রহস্যময়। গতানুগতিকতার উর্ধে। সেজন্যই বোধহয় কবি দেবব্রত ভট্টাচার্য্য বলতে পারেন-
`চশমায় যেমন দেখিস আমি তা নই।
সকল ক্ষতচিহ্ন জুড়ে অবৈধ শিলালিপি
ঘাড় ঘুরিয়ে থাকা তোকে কি করে বোঝাই
বাঁচার জন্য ঘেরাটোপ, তাই রাসচক্র।
পরজন্মে দেখা হলে খোলস ছাড়িয়ে তোকে বলবো
গতজন্মে ওরকমই বরাদ্দ ছিল, এজন্যে তোর চারপাশে
লাভ নাই, ক্ষতি নাই, মিটিমিটি জ্বলবো।'
এই মিটিমিটি জ্বলাই কবির ভবিতব্য। এই মিটিমিটি আলোই শেষ অবধি পথ দেখায় ক্লান্ত মানুষকে এক অন্য উত্তরণের দিকে। সেখানে কবি হয়ে ওঠেন অদেখা প্রদর্শক। কবি দেবব্রত ভট্টাচার্য্যের `নানের ডায়েরি ইনসমনিয়ার বাকফসল` সেই পথকেই নির্দিষ্ট করছে।
কবি সুবীর সরকারের মুখবন্ধ ভাল লাগে। গ্রন্থের মুদ্রণ ও বাঁধাই সুন্দর। সুপ্রসন্ন কুণ্ডুর প্রচ্ছদ আকর্ষক।
শুধু `কি` এবং `কী`-এর ব্যবহারে একটু সচেতন হলে ভাল লাগত আরও।
আলোচক- শৌভিক রায়
No comments:
Post a Comment